ভাবানুবাদ ও ভাষান্তর : ফারজানা নাজ শম্পা
[ কবিতার ভাষায় সামাজিক সংস্কার ও পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা থেকে প্রকৃতির অনুপম রূপের অনুরণন ঘটিয়েছেন কানাডার প্রখ্যাত কবি, শিক্ষাবিদ,গবেষক ও টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক ব্রুস মায়ার। তাঁর কাব্য ও গবেষণা সৃজনশীল সাহিত্য চর্চার জীবন বৈচিত্র্যময় ব্রুসের সাহিত্যকর্মে শুদ্ধ ধারার এক জীবনমুখী আধ্যাত্মিক বোধ, কানাডার আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য নৈসর্গিক প্রকৃতি, প্রাত্যহিক জীবন, মানবিক সম্পর্ক ও মানবতার সফল সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্য অনুরাগী পাঠক বারবার তাঁর সৃজনশীল কাব্য ও সাহিত্য কর্মের এক স্বতন্ত্র স্বাদ অনুভব করতে পারবেন। ব্রুসের শব্দের বিন্যাস সাবলীল সরল এবং সহজবোধ্য প্রাঞ্জল ও আলংকারিক উপমা রসে ঋদ্ধ। ব্রুসের কবিতার গতানুগতিক ছন্দরীতির ব্যবহার লক্ষণীয় নয় বরং কিছুটা গদ্যরীতি অব্যাহত রেখে তাঁর কবিতা পরিণত রূপ পেয়েছে। তাঁর চিন্তার অন্যতম দিক হলো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও জীবনপ্রবাহ মূল্যায়নে ইতিবাচক ও অনড় আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। মানব হৃদয়ের আত্মিক ও চিরন্তন সৌন্দর্য বোধের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায়। ষাটের অধিক তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে অধিকাংশই কবিতার বই। সম্প্রতি তাঁর ছেষট্টি তম (৬৬তম) কাব্যগ্রন্থ ‘গ্রেস অব ফলিং স্টারস ‘ প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচিত এই বইটি তাঁর জীবনচিত্রের, মনন ও জীবনদর্শনের অর্ধেক প্রতিফলন ঘটিয়েছে। কানাডার Brantford poet laureate Jhon B Lee কাব্যগ্রন্থ ব্রুসের কাব্যগ্রন্থ গ্রেস অব ফলিং স্টারস প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন
Each and every poem in Grace Of Falling Stars presents itself as something of a glimpse of grace made available in words partaking in the sustaining condition of praise and the healing quality of prayer কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি স্মৃতিচারণ, প্রকৃতিবিষয়ক গ্রন্থ, ফিকশনধর্মী গল্প, পাঠ্যবই, গবেষণা ও সংকলিত অসংখ্য সফল গ্রন্থের রচয়িতা। শিক্ষাজীবনে কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স ও টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। কানাডার কবিদের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে তাঁর একটি আলোচনা গ্রন্থ The Golden Thread the Potrait of Canadian Writer -এর মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য সাহিত্যের আনন্দময় উৎস তুলে ধরেছেন আর কানাডার সিবিসি রেডিও প্রচারমাধ্যম থেকে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
কানাডিয়ান শিক্ষা ও সাহিত্যে তাঁর বহুমাত্রিক সৃজনশীল চর্চার দীর্ঘ পথচলায় সম্মানিত ও অভিষিক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কারের পাশাপাশি নানা ক্ষেত্রে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন অসংখ্যবার। উত্তর আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবিতার গ্রন্থ হিসেবে মনোনীত ‘দ্য সিজনস: দ্য হান্ড্রেড সনেটস’ এর জন্য তিনি আইপি গোল্ড মেডেলে অভিষিক্ত হয়েছেন। ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন কানাডার অন্টারিও আর্ট কাউন্সিল লিটারারি গ্রান্ট। কানাডার সিবিসি রেডিওতে মাইকেল এনরাইটের সঙ্গে সম্প্রচারকৃত ‘দ্য গ্রেট বুকস ফর দিস মর্নিং’ শ্রেষ্ঠ ধারাবাহিক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
কবি ব্রুস জীবন চর্চার সব পরিস্থিতে নিয়মিত তাঁর লেখার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, লেখক হিসেবে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্বাস ধারণ করেন। তাঁর মতে, লেখার মাধ্যমে চিন্তার প্রকৃত মুক্তি লাভ সম্ভব। তাই অবিরল ধারায় লেখার চর্চায় নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও লেখকের মূল দর্শন হলো যথেষ্ট পাঠাভ্যাস রাখা এবং ধৈর্য সহকারে নিয়মিত স্বকীয় স্বতন্ত্র ধারায় লেখার চর্চা। এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য Never write like anyone else. Write like yourself. Pay the price and await the outcome. Copying other people is not art. It is manufacturing.
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, কবিতার সৃষ্টির জন্য তাঁকে প্রাণিত করেছে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের পরিচিত ছোট বড় বিভিন্ন ক্ষেত্র । তিনি গভীরভাবে একটি ঘটনা বা সম্পর্ককে পর্যবেক্ষণ করেন।
কবি ব্রুস কানাডার অন্টারিও প্রদেশের বেরি শহরে গ্রেগরিয়ান কলেজ ও টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজি সাহিত্য ও সৃজনশীল লিখন শৈলীর অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর স্ত্রী কেরি জনস্টোন (একজন সাংবাদিক) ও একমাত্র কন্যা কেটিকে নিয়ে তিনি কানাডার অন্টারিওর বেরি শহরে বাস করেন।]
বেলুন
আমি দুঃখিত তুমি তোমার খেলার
প্রথম বেলুন টি হারিয়ে ফেলেছো
সেই বেলুনটি যা তোমাকে বিস্মিত করেছিল ,
আর যা বাতাসের চেয়ে হালকা ছিল
বেলুনটিতে আঁকা ডিজনি রাজকন্যাদের ত্বক
রুপালি আভায় আবৃত ছিল
আমরা সেটা তোমার স্ট্রলারে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিলাম ।
কিন্ত তা হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল আর
তার সাথে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল
কোন হালকা বিস্ময় কে,
যা হারিয়েছিল দুপুরের মেঘের অন্তরালে ষ
খুব ছোটবেলায় কোন প্রাপ্তির পর
সেটি হারানোর ঘটনা আমাদেরকে
জীবনের অন্যায় আর দুঃখের দিক কে অনেকটাই
আত্মস্থ করতে শেখায় আর এক একটি বেলুন প্রায়
এমন একটি মুখোশের মতো
অবতীর্ণ হয়,
এবং যার অন্তরালের মিথ্যা গুলি এখন তেমন কোন
নিরাশা সৃষ্টি করে না
আর এর হতে উত্তরের প্রত্যাশায় কেউ প্রশ্ন তুলে না।
সম্ভবত এই হারানো বেলুনদের নিজস্ব কোন একটি ভুখন্ড আছে
যে স্থানে মৃতপ্রায় আর বন্ধনহীন এই বেলুনেরা
চলে যায় এবং তাঁদের কেউ পিছু ডাকে না।
দুঃখের ওজন সাধারণত সামান্য হয় ।
তাই যে কোন স্থানে তা অবতরণ করে ।
আমি দুঃখিত মেয়ে তোমাকে কিছু হারানোর কষ্টকর
অধ্যায়গুলি এইভাবেই জানতে হলো
তবে এর মাধ্যমে সৃষ্টবিস্ময়রা
সমৃদ্ধ এবং হালকা কোন বাতাস ফুঁড়েই বের হয়েছিল ।
পৃথিবীর যাত্রা শুরুর দিন
একদিন আমি প্রাতরাশ প্রস্তুত করছিলাম
সেই সময় আমার স্ত্রী জানিয়েছিল
আমাদের যাপিত জীবনের পরিচিত চেনা জানার
বিষয়গুলির সূচনা ঠিক এই ভাবেই ঘটে,
আমি তাঁকে অন্যান্য দিনগুলির বিষয় প্রশ্ন করেছিলাম,
যেদিনগুলি আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কাজে নিমগ্ন থাকতাম
ডাক হরকরা বিভিন্ন দরজায় তামার
চিঠির বক্সে বিভিন্ন জনের চিঠি আর বিল রেখে যেত,
অথবা ছুটির কোন এক বৃষ্টির দিনে
যখন আমরা নিজেরা একটি পিকনিক
আয়োজনের আশায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সূর্যালোকের
জন্য অপেক্ষা করছিলাম,
আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম
জীবনের প্রতিদিন তাঁর জন্য কি কোন বোধ বহন করে
সে জানিয়েছিল এই বিষয়টি
শুধুমাত্র প্রতিদিন তাঁকে
কিছুটা অনুশীলন শেখায়,
যার মাধ্যমে জীবনের সব কিছু
সঠিক ভাবে করার চেষ্টার
কৌশল রপ্ত করা যায়।
কোন মৃত্যু, বকেয়া কর, অসুস্থতা
আমাদের সেইসময় পেছনে ঠেলে দিতে পারেনি
আর আমরা কেউ বলতে পারি নি আজকের দিনটির
খুব খারাপ ভাবে সূচনা হয়েছিল।
সঠিক ভাবে কোন কাজ করার জন্য
বিশেষ কৌশল রপ্ত করার প্রয়োজন হয়,
বাতাস ও পানির প্রবাহের মতো সাধারণ ঘটে যাওয়া
নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়গুলি যা আমাদের
আপাতঃ বিচারে খুব সাধারণ সেই দিকগুলি এর অন্তর্গত হয়।
অনুবাদকের পরিচিতি:
ফারজানা নাজ শম্পা একজন নবীন লেখক, ভাবানুবাদক গবেষক এবং সাংবাদিক। তিনি প্রথম আলো অনলাইন, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার একজন লেখক ও কানাডার সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে সম্পৃক্ত আছেন। টরেন্টোভিত্তিক কানাডিয়ান বাংলা নিউসের একজন সংবাদ প্রতিনিধি। ফারজানার জন্মস্থান চট্টগ্রাম-এ ১০ ই ডিসেম্বর ১৯৭৬ ইং।
বর্তমানে কানাডার পশ্চিমের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের রাজধানী ভিক্টরিয়াতে স্বামী দুই সন্তান সপরিবারে বসবাসরত। ফারজানা লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত আছেন নব্বই দশকের শেষ থেকেই। ফারজানা নাজ শম্পা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে লোক প্রশাসন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স এবং নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোরাড ফেলোশিপ নিয়ে ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন’ বিষয়ে এম ফিল ডিগ্রী সমাপ্ত করেন। তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয় বাংলাদেশর ইংরেজি দৈনিক ‘দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’র সাপ্তহিক সাময়িকী তে একজন ফিচার লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে। পরবর্তীতে নরওয়ের নোরাড ফেলোশিপ বৃত্তি নিয়ে বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ জেন্ডার ও উন্নয়ন’বিষয়ে দুই বছরের এমফিল ডিগ্রি সমাপ্তির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিস ‘বিভাগে নেদারল্যান্ডসের সহায়তাপুস্ট একটি প্রজেক্টে কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি। প্রথম বইটি হলো বাংলায় লিখিত ‘জেন্ডার শব্দকোষ’ আর দ্বিতীয় বইটি ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রামীণ ব্যাংক ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে একটি রাজশাহীর মনিগ্রাম বাঘা তে মাঠ পর্যায়ের গবেষণামূলক গ্রন্থ। উল্লেখ্য এই গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ জার্মানির একটি জনপ্রিয় প্রকাশনা ‘ভি ডি এম ‘প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় ও কানাডার কবি ব্রুসের নির্বাচিত অনূদিত কবিতা তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাব্য গ্রন্থ। কানাডার দীর্ঘ পরবাসী জীবনেও ফারজানা নাজ বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের সমৃদ্ধশালী ধারাটি সমুন্নত রাখার প্রয়াসে কানাডার সাহিত্য ভৌগোলিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে নিয়মিত বাংলা ভাষায় লিখছেন। এছাড়া এই প্রয়াসের ধারাবাহিকতায় তিনি কানাডিয়ান বাংলাদেশি নিউজ সিবিএন ২৪ একজন সংবাদ প্রতিনিধি ও উপদেষ্টা রূপে নিয়মিত লিখেছেন। এছাড়া বেঙ্গলি টাইমস, ও বাংলাদশের দৈনিক প্রথম আলোর প্রবাসের পাতায় ও কানাডার পরবাসী ব্লগ, বার্তা ২৪ সহ ভারতবর্ষের খবর ইন্ডিয়া এই বাংলা সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত কানাডার বিভিন্ন বিষয়ে নিবন্ধ,কবিতা,প্রতিবেদন ফিচার লিখেছেন। কানাডার মূলধারার শিক্ষাবিদ ও কবি ব্রুসের সম্মতিক্রমে তাঁর নির্বাচিত কবিতা নিয়ে একটি তাঁর একটি অনূদিত কবিতা সংকলন বাংলাভাষা প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে কবি ব্রুস একটি বিশেষ মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা কানাডিয়ান কবির জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক কয়েকটি বংলায় অনূদিত কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।