এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:৩১- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:৩১- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

মাছ সংবাদ

শোয়ায়েব মুহামদ

 

এক

হেজা বৃত্তান্ত শ্রাবণ মাসের।

অমাবস্যা আর নি¤œচাপের সিগনালে সকাল থেকে টানা বৃষ্টি আর তার ভেতর হেজা যায় নয়টা লাউ নিয়ে হাটে। থানা ফেলে বাইপাসের উত্তর মাথায় তরিতরকারির হাট বসে, হাটে লাউয়ের খাঁচা নামাতে না নামাতেই বেচা বিক্রি শেষ। বৃষ্টি বলে সব লোকাল বেপারি, টাউনের বেপারিরা নেই। গত পরশু বুধবার ঢলে খেতকৃষ্টি সব ভেসে যাওয়ায় গৃহস্থ চাষারাও আসে নি। তা না হলে হেজার যে লাউখেত ছিল তাতে প্রতি হাটে কম করে একশ লাউ বেচা যেত। লাউ বেচে সে কেনে পুকুরের পাঙাশ মাছ আর ফুলুড়ি। ফুলুড়ি দেবে মাছের সঙ্গে।

সদাইপাতি কিনে তাড়াতাড়ি ফিরলে টুবানি বলে, ‘পাঙাশ নিরালা আর থোরা ইচা মাছ হৈলে লাউদি রাধন যাইত।’ টুবানির ফরমাইশ অথবা ইচ্ছায় জলদি হাট ফেরা হেজা ঝাইজাল নিয়ে বের হয় থোরা ইচামাছ মারা যায় কি না দেখতে। ঝাইজাল গুরামাছের আর ছটকি রুই-কাতালের। তার ছটকি জালও আছে কিন্তু মারবে লাউ রাধার গুরা চিংড়ি, তার জন্যে ছটকি জাল তেলাপোকার গাড়ি আর লাল বলদের হাল।

হেজা জাল নিয়ে নামে রাজার গোপাটে। রাজাপুর খালের দক্ষিণ পাশ রাজার গোপাট। হেজা গোপাট ধরে খালে জাল মারে। লক্ষ্মণের গোলা থেকে পাঁচবাড়ি-শরৎ ভুঁইয়া, জিন্নাত আলি, বাগিচার বাপগো, ডাবালা আর এবাদ সেরাংয়ের বাড়ি ঘেঁষে খাল পড়েছে সন্দ্বীপ নদীতে। কাড়ি, বড় বাঁধের ওপর স্ল্যুইস গেট। বারিয়াখালী আর রাজাপুর দুই খালের মাথা একত্র হয়েছে স্ল্যুইস গেটে। টানা বৃষ্টি হলে স্ল্যুইস গেট দুই খালে উপরের নামা পানির চাপ সামলাতে না পারলে ঢল নামে। সেই ঢলে পুকুর গড় খন্দক উপচে জল গড়ায় বিলে। কাড়ির স্ল্যুইস গেটের পর খালের জল নোনা। তাতে নদীর নৌকা আসে।

খালে জাল মারতে মারতে নজিরের বাপের টেকে এসে দাঁড়ায় হেজা। নজিরের বাপের টেকে রাজার গোপাট উত্তরে বেঁকে পশ্চিমে মোড় নিয়েছে। টেকে ছিল নজিরের বাপের খামার বাড়ি। হেজা তো হেজা, তার বাপেও সে খামার বাড়ি, নজির অথবা তার জন্মদাতাদের দেখে নাই।

টেকে দাঁড়িয়ে হেজা কোমরে বাঁধা ডুলায় দেখে লাউ রাধার চিংড়ির সঙ্গে টেংরা, পুঁটি, বাইলা সব মিলে প্রায় আধা কেজি। গতকালের ঢলে চারপাশ রুইমাছের গা রং, ঘোলা। গোপাট সমান জল বিলে। সেই জলে আউশ খোন্দের ধানের ডগাও নজরে আসে না। ডুলায় টুবানির মাছ হয়েছে দেখে হেজা খাল থেকে জাল তুলে বিলে ঢলের জলে মারবে ভাবে। গোপাটে দাঁড়িয়ে অনেকেই জাল মারছে বিলে।

হেজা খাল থেকে তোলা জাল গোপাটে রেখে তাতে আটকানো খড়কুটো, পচা পাতা, বাঁশের কঞ্চি পরিষ্কার করে। আর মারবে না, শেষ খোপ এ চিন্তায় জালের ঘের ভালো মতো মেলে চিতল পিঠার অবিকলে মারে। জাল মেরে জল দেখছে ঢলের, হেজা হাতে বাঁধা কাছিতে টান অনুভব করে। আনন্দ আর দুশ্চিন্তা ভাবায়। কচ্ছপ অথবা বড় মাছ পড়লে এ রকম টান লাগে। হেজা গোপাট থেকে বিলের জলে নেমে ফোরকা মাটি থেকে আলগা না হয় মতো আস্তে আস্তে জাল টানে। জাল যত কাছে আসে টান তত বাড়ে। হেজা বুঝে জাল ছেড়ে মাছ পালায় নাই। কাছাকাছি এলে হেজা টানা থামিয়ে জলে ডুব দেয়। ডুব দিয়ে জালসহ মাছ তুলে আনলে দেখে বড় কাতলা মাছ।

গোপাটে দাঁড়িয়ে, খালে, ঢলে ডুবা বিলে জাল মারছিল যারা সবাই মাছ দেখতে ছুটে আসে। গোপাটই রাস্তা, গোপাটই খালপাড়। মহিন সকালে হেজার সাথে ঝিঙা নিয়ে গেছিল হাটে। বলে, ‘কর পৈরর পুরান মাছ, ঢলে বার হৈ আইছে। কত ওজন হৈব আন্দাজ?’

তার প্রশ্নে কেউ একমত হতে পারে না। ভিড়ের কেউ বলে দশ, কেউ বলে পনেরো। করিম বলে একজন, সে বলে, ‘ধুর! কমসে কম পঁচিশ কেজি।’

ভিড়ের এই বিতর্ক আর মতভেদের ভেতর হেজা জালসহ মাছ কাঁধে রওনা দেয়। আগে দেখাবে টুবানিকে। টুবানি হেজার বউ।

 

দুই

হেজা বাড়ি ঢুকে দেখে টুবানি সকালে খেত থেকে তুলে আনা লাউ কুটছে।

গুরা চিংড়ি মারতে যাওয়া খসমের কাঁধে এত বড় মাছ দেখে তাজ্জব বনে যায় সে। খসমকে কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। হেজাও বউকে বলার মতো কথা খুঁজে পায় না। শুধু হেসে বলে, ‘কাড়ির গোরাত বিলে জাল মারি পাইছি। ঢলে কর পৈরতোন বার হৈ গেছে।’ বলে কাঁধ থেকে মাছ আর কোমর থেকে ডুলা উঠানে নামিয়ে মসজিদের পুকুরে গোসল করতে যায়। টুবানির সব কিছু কেমন জাদুর মতো লাগে। খসম গেল গুরা মাছ মারতে, নিয়ে এল কাতলা মাছ! সে ডুলা থেকে গুরা চিংড়ি বেছে লাউ চড়ায় চুলায় আর ভাবে হাটে নিলে কত হতে পারে এ মাছের দাম।

হেজা গোসল করে আসলে টুবানি বলে, ‘মাছ কি হাটে নেবা?’

হেজা বলে, ‘দইনের হাটে নুমু। বেনমাদান বেচছি লাউ, এ মাদান বেচমু বড় কাতাল।’

উঠানে ধারাতে মাছ রাখা। আশপাশের বাড়ির লোকজন, খবর শুনে আসা খানিক দূরের লোকজন ভিড় করে মাছ দেখছে। হেজাদের বড় বাড়ি, দুই সারিতে দশ ঘর। বাড়ির লোকজনও এসে এসে দেখে যাচ্ছে। এসব দেখাদেখির ভেতর দুপুরে পাঙাশ, ফুলুড়ি আর গুরা চিংড়ি দিয়ে রাঁধা লাউ খেয়ে মাছ নিয়ে দক্ষিণের হাটে যাবার প্রস্তুতি নেয় সে। মাছ বড় বস্তায় ঢুকিয়ে ভ্যানগাড়ি ডাকে।

হেজা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও উঠানে জটলা থাকে। টুবানি উঠানের জটলায় দাঁড়িয়ে হেজাকে নিয়ে, তার পাওয়া মাছ নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক বোঝা ওদা লাকড়ি তুলে নেয় এ রকম মেঘলা দিনে চুলার পাশে উষ্ণ আঁচে দেবার জন্যে।

টুবানির ভাবাভাবি আর মেঘ মেঘ আকাশের ভেতর হেজা পৌঁছে হাটে। হাটে মাছের তিনটা আড়ত। আড়তদাররা ডাক দিয়ে মাছ কিনে নিতে চায়। হেজা বলে, সে বসে বেচবে হাটে। মাছবাজারের পাকা মেঝেয় আস্ত মাছ শুইয়ে সে অপেক্ষা করে খদ্দেরের। লোকজন দর করে, কেউ পরামর্শ দেয় কেটে বেচার, কেউবা বলে মহকুমা শহরের বড় হাটে নেবার। আসর পর্যন্ত মাছ বেচার জুতসই খদ্দের না পেলে আড়তদাররা ফুসলায় তাদের কাছে আস্ত মাছ বেচে দিতে। কিন্তু প্রতি হাটে লাউ, ঝিঙা, ঢেঁড়স, শিম, বরবটি বেচা হেজার ইচ্ছা আজকের মাছহাটায় আসা সবচেয়ে বড় মাছ নিজে বসে বেচার। কিন্তু জোহরের কিছু পর থেকে আসর অক্ত পর্যন্ত জুতসই খদ্দের না পেলে সে ভাবনায় পড়ে সকালবেলা তার জালে আটকানো কাতলা মাছ সৌভাগ্যের বদলে বিড়ম্বনা নিয়ে এল কি না!

তার ভালোমন্দ ভাবনার ভেতর বাজারে ঢুকে গোলাম রসুল সওদাগর। গত হাটে দশ কেজি তিলক কস্তুরি চাল কিনেছিল হেজার থেকে। তিনটে বড় হিনো ট্রাক চলে ঢাকা-চিটাংয়ের রাস্তায়। পাথরেরও কারবার আছে। এই হাটসহ আশপাশের তিন হাটের সবচেয়ে বড় সওদাগর সে। ঘরে চার বেগম। হেজাকে দেখে এগিয়ে আসে সওদাগর।

‘কি হেজা সাব, কডে পাইছ এত বড় মাছ?’

হেজা বলে, ‘ঢলের বিলে জাল মারি পাইছি। আমনে লৈযান গৈ সাব।’

হেজার কথায় অথবা তাজা বড় মাছ দেখে সওদাগরের লোভ হয়। সে জিজ্ঞেস করে, ‘ওজন কদ্দুর হৈব হেজা?’

হেজা বলে সে এখনও মাপে নাই। সওদাগর নিয়ে আড়তদারের পাল্লায় ওজন করলে দেখা যায় বারো কেজি। মাসে দু মাসে হঠাৎ হঠাৎ এত বড় মাছ আসে হাটে। মাপঝোক শেষ করে দরদাম ভেঙে সওদাগর বলে মাছ তার ছোট বেগমের ঘরে পৌঁছে দিতে।

 

তিন

হেজা সওদাগরের টাকা বুঝে নিয়ে মাছ তোলে ভ্যানগাড়িতে। তুলে রওনা দেয় ছোট বেগমের মোকামের দিকে। শিবপুর, গোলাবাড়িয়া, বশরতনগর, কতোয়ালদিঘিÑএই চার গ্রাম পেরিয়ে হেজার ভ্যান আসে গোলাম রসুল সওদাগরের ছোট বেগমের মোকামে। চার বেগমের আলাদা করে চার কোঠাবাড়ি। বাড়ির চারদিকে উঁচু প্রাচীর আর সদর দরজায় দারোয়ান প্রহরায়। সওদাগর মাছ পাঠিয়েছে, হেজা দারোয়ানকে ছোট বেগমের কাছে এ খবর দিতে বলে। দারোয়ানের নাম শুকলাল বলী। আগে ছিল হাটসহ গোটা তীর্থের তত্ত্বাবধায়ক মহন্তের বডিগার্ড। পয়ষট্টিতে শিবপুরের সেনরা দেশছাড়ার আগে পুকুরসহ ভিটাবাড়ি বেচে দিলে সওদাগর কিনে চার বেগমের জন্যে চার কোঠাবাড়ি বানায় আর চারপাশে প্রাচীর তোলে ইট সুরকির। মহন্তের বডিগার্ড ছেড়ে শুকলাল আসে সওদাগরের দারোয়ানিতে। মওলা বক্স, কোরবান আলী, গুরা মিয়া মাস্টারের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বসা বলীখেলার মেডেল জিতে সে তখন নামি বলী। আর প্রায় সব বনেদি হিন্দু দেশ ছাড়ায় মহন্তেরও পড়তি অবস্থা।

খবর শুনে শুকলাল বলে, ‘মাছ তোঁয়ার না আর কার?’

এত বড় মাছ পাবার গর্বে হেজা জানায় মাছ তার।

শুকলাল বলে বিড়ি খাবার দশ টাকা না দিলে মাছের খবর ভেতরে দেয়া যাবে না। হেজা লুঙ্গির প্যাঁচ খুলে মুচড়ানো দশ টাকা বের করে দেয়। শুকলাল ভেতরে যায় বেগম সাহেবকে মাছ আনার খবর দিতে।

তখন প্রায় বিকেল। সদাইপাতি আছে যাদের ভাতপানি খেয়ে তারা যাচ্ছে হাটে। আসরের নামাজের আগে মুসল্লিদের কেউ চা খেতে এসেছে দোকানে। দোকানের সামনে কিছুক্ষণ পর জেলেরা নিয়ে আসবে মেশানো মাছÑযুইন্না ইচা, পুষ্টিগুরা, অলুয়া। তার অপেক্ষায়ও কেউ কেউ বসে আছে দোকানে। বিকেল ডোঙায় লেগে থাকা খেজুর মিঠার মতো আলস্যময়।

হেজা মাছের পাশে ভ্যানগাড়িতে বসে। তার সামনে বিলের ধানিজমির সবুজের পর শিবপুরের নুরুল ইসলাম চেয়ারম্যান খুন হওয়া রাস্তা।

শুকলাল বেরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘মাছ মর্দা না মেদ্দি?’

সওদাগরের চার বিবির বড়জন বর্মার আরাকানের। গোলাম রসুল সওদাগরের বাপ ইমামতি করত মংদু বাজার মসজিদে। মসজিদের সামনে ইমামের ছিল পান বিড়ি সেন্ডেলের দোকান। তাতে বসার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল ছেলেকে। সেখানেই শীতের রাতে পরিবানুর হঁঅলা শুনতে গিয়ে বড়বিবিকে দেখা, পরে প্রস্তাব পাঠিয়ে বিয়ে। বড়বিবির বয়স তখন তের-চৌদ্দ। রাতভর রাজ্য হারিয়ে বাদশা সুজার আরাকান যাত্রা, আরাকান রাজের পরিবানুর রূপ দেখে পাগল হওয়া, তা থেকে রক্ষা পেতে সুজা আর পরিবানুর সমুদ্রে আত্মহত্যার বয়ান আর গায়কের সাইগরে ডুপালি পরীরে গান শুনতে শুনতে কেঁদে চোখ লাল করা কিশোরী বড়বিবিকে দেখে তার ভালো লাগে। মেজজন চাচাত ভাই দারোগার বিধবা। ছোটবিবি পার্ট করত যাত্রার। সেনের হোটেলের পেছনে ধানিজমিতে শিবচতুর্দশী মেলায় টানা এক মাস আনারকলি ড্রামায় হিরোইনের পার্ট করলে সওদাগরের চোখে লাগে। তারপর থেকে জোৎ¯œ্যা হিরোইন ছোটবউ সওদাগরের।

দারোয়ান মাছ মর্দা না মেদ্দি জিজ্ঞেস করলে হেজা প্রথমে খানিক দোটানায় পড়ে যায়। ভালো করে পেট দেখে বলে, ‘মাছ মর্দা।’

শুকলাল জানায়, ছোট বেগম বলে দিয়েছে মাছ মর্দা হলে তার মোকামে না ঢোকাতে। ধর্মে মহিলাদের কঠিন পর্দার বিধান, আর সে পর্দা ভেদ করে মর্দা মাছও ঢুকতে পারবে না অন্তঃপুরে।

 

চার

মাছ মর্দা না মেদ্দি এ প্রশ্ন তুলবার গনা গনা নয়দিন পর হেজা হাজির হয় গোলাম রসুল সওদাগরের গদিতে। মাছ হাটে নিয়েছিল মঙ্গলবার, সে যায় পরের বুধবার। হাটবারের পরের দিন ব্যস্ততা থাকে কম, হেজা খোঁজখবর নিয়ে জোহর অক্তের পরপর আসে। সওদাগর ভাতের পর পান চিবোচ্ছিল। হেজাকে দেখে নড়ে চড়ে বসে। মাছ মর্দা হওয়ার প্রশ্ন তুলে ছোট বেগমের না নেয়ার সংবাদ সে রাতেই পেয়েছিল। কিন্তু এ কান্ড ছোটবউ জোৎস্ন্যার ঢং না ধার্মিকতা তার ভেদ সওদাগর এখনো করতে পারে নাই। দোকানে ঢুকলে হেজাকে পাশে টুল দেখায় বসতে।

টুলে বসে হেজা বলে, ‘কাইল রাইতে এক খোয়াব দেখি আমনের কাছে আইছি সদর সাব।’

গোলাম রসুলের পান খাওয়া আর চোয়াল নাড়া তখনো শেষ হয় নি। হেজা বলে, ‘দেখি আমনের ছোট বেগমের কোঠাবাড়ির সামনে সাড়ে তিন হাত প্রস্থ আর দশ হাত দৈর্ঘ্যরে একখান পরিখা খোড়া। পরিখায় দশমণ লাল রং গাভির দুধ, দুধের মধ্যে একদরে কেনা লবঙ্গ আর চারদিকে বৃত্তের মতো করে সাজানো রক্তজবা ফুল। বেগমের মোকামের সব জেনানা লাফ দিয়ে সেই পরিখা পার হচ্ছে।

মর্দা কি মেদ্দি এ প্রশ্ন তুলে ফেরত দেয়া কাতলা মাছ আড়তদাররা কিনে রাতে কেটে কেটে বেচেছিল হাটে। সওদাগর মাছের দাম আগেই দিয়েছিল কিন্তু ছোট বেগম ফেরত দিলে হাটের আড়তে বেচে পাওয়া টাকা দিতে এসে হেজা স্বপ্নের কথা তুললে সওদাগর এর কোনো দিশা খুঁজে পায় না। স্বপ্নে ছোট বেগমের মোকাম, পরিখা পার হওয়া জেনানা, ফেরত দেয়া কাতলা মাছ অথবা হেজাÑসবকিছুই তার জন্যে হতে পারে এক ইশারা।

হেজা বলে, ‘আঁই আইছিলাম আসলে আমনের টেঁয়া দিতে। যে মাছ আমনেরে বেচি ন তার টেঁয়া রাখন ত যায় না। সুযোগে খোয়াবের কথাও কৈলাম।’

সওদাগরের হেজার কথায় কান নেই। সে তখন স্বপ্নের পরিখা পার হতে শূন্যে লাফ দেয়া ছোট বেগমের কাপড়ের বাইরে বের হয়ে আসা রোদের মতো ফরসা পা দেখায় মশগুল।

পাঁচ

হেজা চলে যাবার পর তার বলা স্বপ্নের বৃত্তান্ত জানতে বাজারের মসজিদের ইমামকে খবর দিয়ে আনে সওদাগর। সব শুনে মৌলভী বলে, ‘বুধবার পয়া আর যেকোনো কিছুর জন্যে শুভ পূর্ণিমার দিন। সামনের শনিবার পূর্ণিমা, কোনো কাজ থাকলে সেদিন থেকে শুরু করতে পারেন।’

হেজার স্বপ্ন শুনে বাজারের মসজিদের মৌলভী এই তত্ত্ব দিলে গোলাম রসুল হাদিয়া দেয় দুটো বড় দেশি মুরগি। এই হাদিয়া হুজুরের আর বিপদ কাটে এই ধারণায় মোল্লা মিসকিন খানা করে শুক্রবার। হেজার স্বপ্নের পরিখায় ছোট বেগমের মোকামের জেনানা পার হওয়া কোন অমঙ্গলের ইশারা কি না আর এই অমঙ্গল থেকে মুক্তিতে মিসকিন খানা করলেও সওদাগরের মন তাতে শান্তি পায় না। সওদাগরের কেবল মনে পড়ে পাক কোরানে বলা ইউসুফের স্বপ্ন বৃত্তান্ত আর তাতে লুকানো ইশারার কথা।

ভাইদের চক্রান্ত আর জুলেখার ভালোবাসায় ভাগ্যবিড়ম্বিত ইউসুফের সঙ্গে একই সময় জেলে আসে বাদশাকে বিষ প্রয়োগের সন্দেহে আটক রাজ পাচক আর সুরা পরিবেশক। জেলে আসার পরদিন সুরা পরিবেশক আর রাজ পাচক তাদের রাতে দেখা স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানায় ইউসুফকে। সুরা পরিবেশক বলে, সে স্বপ্ন দেখেছে বাদশার জন্যে আঙুর পিষে মদ বানানোর আর পাচক জানায়, সে দেখেছে তার মাথার ঝুড়িতে রাখা রুটি খুটে খাচ্ছে পাখিরা।

বৃত্তান্ত শুনে ব্যাখ্যায় ইউসুফ বলে, যার স্বপ্ন ছিল বাদশার জন্য আঙুর পিষে সুরা বানানোর, সে শীঘ্রই মুক্তি পেয়ে বহাল হবে পূর্বের চাকরিতে। দ্বিতীয়জন, যে মাথায় করে রুটি নিয়ে যাচ্ছিল, তার শাস্তি হবে আর তার মগজ খুটে খাবে পাখিরা।

কয়দিন পর সত্যি সত্যি ইউসুফের বলা ব্যাখ্যা মতো নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে সুরা পরিবেশক ফিরে যায় নিজের চাকরিতে। আর রাজ পাচকের হয় প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসি। তার মগজ ঠুকরে খায় পাখিরা।

জেলের ভেতর ইউসুফকে বলা স্বপ্ন আর তার ভেতর লুকানো ইশারা ঘুরে ঘুরে সারাদিন মনে পড়ে সওদাগরের। সে সন্ধ্যায় গদি থেকে উঠে সওদাগর সোজা যায় ছোট বেগমের মোকামে।

সওদাগর মোকামে যাবার পরের শনিবার ভাদ্রের পূর্ণিমায় পরিখা খনন হয় ছোট বেগমের মোকামের সামনের চাতালে। আসরের পরপর মোকামের জেনানাদের জড়ো করা হয়। বাইরে বেরিয়েছে বলে সবার গায়ে বোরকা। তাতে চোখ মুখ শরীর ঢাকা। পরিখার পাশে ভাড়া করে আনা আনসার দাঁড়ানো। গোলাম রসুল সওদাগর মোকামের জড়ো হওয়া জেনানাদের সাড়ে তিন হাত প্রস্থের পরিখা লাফিয়ে পার হতে হুকুম করে। সওদাগর বলে, ‘এ পরিখা এক লাফে পার হওয়া এক প্রতিযোগিতা আর যেসব জেনানা এক লাফে পার হবে তাদের পুরস্কার সোনার আংটি।’

ছোট বেগমের মোকামের সমাবেত বোরকা পরা মহিলাদের পাঁচজন পরিখা পার হতে পারে। সওদাগর তাদের পাঁচজনকে ডাকে সোনার আংটি দেবার জন্যে। পুরস্কার নিতে আসা জেনানাদের নেকাব উল্টালে দেখা যায়, এদের কেউই জেনানা নয়, সবাই হেজার কাতাল মাছের মতো মর্দা।

 

শোয়েব মুহামদ, কথাসাহিত্যিক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে