আবু তৈয়ব
কোন কাজ না হলে সে কাজটি না হওয়ার কোনো কারণ দেখানো,যেটি আসল কারণ নয়। তাই হল অজুহাত। এ—ই জন্য বলা হয় ‘কাজটি না করার চেয়ে সেটি পরে করার অজুহাত দেখানো বেশি ভয়ানক (—পার্কিসন)। আরও বলা হয় ‘সময় সীমিত, তাই অজুহাত দেখিয়োনা। কারণ এটি তোমাকে তিলে তিলে শেষ করে দেয় (সেক্সপিয়র)। তাই বলা হয় ‘ আপনি যতটুকু অজুহাত দেখান আপনি ততটুকু দরিদ্র।’ সফল ও ব্যর্থ ব্যক্তির মধ্যে তাই পার্থক্য হল কাজে লেগে যাওয়া আর না যাওয়ার মধ্যে। তাই জীবনের বড় ঘাতক হলো ক্যান্সারের মত ‘অজুহাত’। সফল মানুষের ব্যস্তময় জীবন দেখে যদি জিজ্ঞেস করেন ‘ আপনি এতকিছু ম্যানেজ করে চলেন কিভাবে?’ ব্যস্ত মানুষটির সহজ উত্তর ‘আমি কেবল অজুহাত দেখাই না ‘ (—রিচার্ড ট্যাঞ্জি)।
অন্যভাবে বললে ‘যে কাজটা তুমি আজই করতে পারো, তা কখনো আগামীকালের জন্য ফেলে রেখোনা (—থমাস জেফারসন) কাজ, বিষয় ও ব্যর্থতায় কাঙি্ক্ষত বা অনাকাঙি্ক্ষত ব্যাখ্যা প্রদান করাকে অজুহাত বলে। কোনো কিছু করতে না পারলে আমরা ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছি, তা না করে কোন পথে কাজটি হবে তা সকল পরিবেশ ও পরিস্থিতে বের করতে পারাই হচ্ছে সফল ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য। পরীক্ষায় ফেল করলে কারণ বিশ্লেষণ করছি। মন্দ কাজে যুক্ত হলে খেঁাড়া যুক্তি খুঁজছি। কারো অনিষ্ট করতে বিতর্ক সৃষ্টি করছি। কখনও সফলতা না—পেলে সান্ত্বনার বাণী ছড়াচ্ছি। এ—সকল ব্যাখা, কারণ, বিশ্লেষণ, যুক্তি, বিতর্ক, দুর্বলতা, সান্ত্বনার বাণী শুনছি আসলে সকল কিছুই এক—একটা অজুহাত। অজুহাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমন বিষয় ব্য প্রসঙ্গ খুব কমই রয়েছে। নিজেদের অদক্ষতা, দুর্বলতা, ব্যর্থতা, স্বার্থপরতা, ইত্যাদি ঢাকার জন্য অজুহাতের প্রশ্রয় নিচ্ছি। অজুহাত অনেকের জন্য একধরনের ব্যাধিস্বরূপ।
অজুহাতের নেতিবাচকতা আমাদের জীবনের অনেক শক্তিশালী দিকসমূহকে দুর্বল করে দেয়। অসংখ্য সম্ভাবনা এবং সুযোগের সুপথকে নষ্ট করে অনুকূলতাকে প্রতিকূল করে। কথায় বলে, মানুষের রয়েছে তিন হাত—একটি ডান হাত: আর একটি বামহাত;অসফল মানুষের অপরটি হলো অজুহাত।
অজুহাত কখন প্রকাশ করা হয়—
বিভিন্ন কারণে, নানাবিধ পরিবেশ—পরিস্থিতির কারণে মানুষ অজুহাত দিয়ে থাকে, যার কতিপয় কারণ এখানে তুলে ধরা হলো।
যেসব কারণে অজুহাত দেখানো হয়—
ক) ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। খ) কোনো কিছুর দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ নিতে অনীহা থাকলে। গ) মন্দ কাজ করা, কারো অনিষ্ট করার বা নেতিবাচক মন—মানসিকতা প্রকাশ করতে। ঘ) নিজেকে কোনো বিষয় হতে গুটিয়ে রাখলে বা জড়াতে না—চাইলে বা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলে। ঙ) দুর্নীতির ইচ্ছা থাকলে। চ) স্বার্থপর হলে। ছ) কাউকে ঘায়েল করতে চাইলে। জ) দক্ষতার অভাব থাকলে। ঝ) অনভিজ্ঞ হলে। ঞ) ভয় ও দুর্বলতা বেশি থাকলে। চ) ব্যবস্থাপনায় অদক্ষ হলে। ছ) উদ্যোগ ও ঝুঁকি নিতে না—চাইলে। জ) ক্রাইসিস মোকাবেলা না—করতে পারলে। ঝ)আত্মরক্ষার প্রয়োজন পড়লে। ঞ) কম সাহস, মানসিকভাবে দূর্বল ও অ—আত্মপ্রত্যয়ী হলে। ট) লাজুক ও অদূরদর্শী হলে। ঠ) অভ্যাস এবং চরিত্রগত কারণে। ড) পরিবর্তন এবং উদ্ভাবনে অবিশ্বাসী ও অপছন্দনীয় হলে।
‘অজুহাত মানব জীবনের অন্যতম একটি ব্যাধি; যা আমাদের কাঙি্ক্ষত অগ্রযাত্রার পথে বহুবিধ অন্তরায় সৃষ্টি করে: মুক্ত মনোজগৎ সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে। নিজেদের সঠিক বিকাশ ও প্রকাশের পথ রুদ্ধ করে।’
অজুহাতের ফলে যা হয়—
ক)অর্থনেতিক দৈন্য সৃষ্টি করে। খ) মানবীয় চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশের পথ দুর্বল রাখে। গ) নিজেদেরকে অন্য মানুষের নিকট ব্যর্থ—হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটায়। ঘ) সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতার পথ রুদ্ধ করে। ঙ)মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে। চ) উদ্যোগ ও ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহিত করে।
ছ) ক্রাইসিস মোকাবেলা ও সমস্যার সমাধান জটিল করে। ঙ) সফলতার পথ অমসৃণ করে।চ)নেতিবাচক চিন্তা—চেতনা বৃদ্ধি করে। ছ) মানুষকে ভীত ও লাজুক রাখে।
অজুহাত দূর করা বা কম করার উপায়:
ক) নিজেকে দক্ষ করা। খ) সাহসী ও দূরদর্শী হওয়া। গ) মুক্ত মনের হওয়া। ঘ) অপচিন্তা, অপকর্ম, অপসংঘ পরিহার করা। ঙ) দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ নিতে শেখা। চ) নেতিবাচক চিন্তা—চেতনা ও কর্ম পরিহার করা। ছ)জ্ঞান, তথ্য ও অভিজ্ঞতার পরিধি স¤প্রসারিত করা। জ) সৃষ্টিশীল চিন্তা—চেতনা ও উদ্ভাবনী দক্ষতা বৃদ্ধি করা। ঝ) ব্যর্থতা ও সমালোচনাকে জয় করতে শেখা। ঞ)সফলতা—ব্যর্থতার পরিসংখ্যান না—করে কাঙি্ক্ষত প্রয়োজনে উদ্যোগ ও ঝুঁকি নেওয়া। ট) বহুমুখী অভিজ্ঞতা ও তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করা। ঠ) ভালো ও দক্ষ ব্যবস্থাপক হওয়া। ড) নানাবিধ সৃষ্টিশীল কাজে অংশগ্রহণ করা। ঢ)অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সুযোগ—সুবিধা সৃষ্টিতে আগ্রহী হওয়া। ণ) পরিবর্তন—প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশ্বাসী এবং মটিভেটেড থাকা।
অভ্যাস ও অজুহাত। আমাদের অনেকেই স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রাতের খাবার প্রতিদিনই দেরি করে খাচ্ছেন। আবার আমাদের কেউ—কেউ রাতে একটু দেরিতে ঘুমাচ্ছেন। কেউ—কেউ সকালে একটু দেরিতে ঘুম হতে উঠছেন। আবার কেউ—কেউ একটু দেরি করে অফিসে যাচ্ছেন। কেউ—কেউ অফিস হতে একটু তাড়াতাড়ি ফিরছেন। কেউ—কেউ দিনের কাজ একটু দেরি করে শেষ করছেন; কেউ—কেউ আবার জীবনটাকে বদলানোর কথা মাথা হতে ঝেড়ে ফেলেছেন: কেউ—কেউ অন্যের কথা বা পরামর্শ বিরক্তি ভরে শুনছেন। কেউ—কেউ দৈনন্দিন কাজে, দক্ষতায়, ব্যর্থতায় নানান ব্যাখ্যা—অপব্যাখ্যা, যুক্তি, খেঁাড়াযুক্তি দিয়ে আসল বিষয়সমূহ প্রলেপ দিয়ে রাখছেন। আসলে সকল বিষয়ের পিছনে, ব্যর্থতার কারণে কিছু যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে: অনেকগুলো সঠিক হলেও অধিকাংশই আসলে অযৌক্তিক আর অপব্যাখ্যা। আর এসকল অযৌক্তিক আর অপব্যাখ্যার অংশসমূহকে বলা হয়ে থাকে অজুহাত। আর অজুহাত হতে সৃষ্টি হয় অলসতা; যা পরবর্তীকালে বদভ্যাসে পরিণত হয়।
কেউ সময়ের কাজ সময়ে করে না। কম সময়ে বেশি কাজ করতে চায় না। জীবনের পরিবর্তন, সফলতা, সমৃদ্ধি দেখতে চায় না। জীবনকে আপডেট করতে না । কানকথা দিয়ে মন—প্রাণ ভরে রাখতে চায়।তা হলে ব্রেইন হতে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ও নেতিবাচক তথ্যসিগন্যাল সৃষ্টি হয়। যা মানুষের সক্ষমতাকে ঢেকে রাখে, প্রকাশিত হতে দেয় না। তাই কাজটি কেন হচ্ছে না তার যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হওয়ার পথটি খুঁজে বের করতে পারাই হল বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ। তাই সফল ব্যক্তিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বুদ্ধিমান হওয়া। আর বুদ্ধি হল মানসিক ক্ষমতা, যে ক্ষমতা বলে কাজটি হতে পারার বা সমস্যাটি সমধানের উপায় বা পথটি বের করতে পারে। ব্যক্তি সফলতার দিকে এগিয়ে যায়, প্রচেষ্টা ও কর্মের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে বিবেক গড়ে উঠে,আর বিবেকের কাছে সিদ্ধান্তসমূহ যুক্তিযুক্ত করাই হলো যুক্তি—যুক্ততা
যেখানে যেখানে অজুহাত দেখানো যায়—
ক) আইন না—মানায় খ) কাজ করতে না—পারায় গ) নেতিবাচকতায় ঘ)সময় না—মানায় পিছনে ঙ) অবৈধ অর্থ—অর্জনে চ) ধনী হতে না পারায় ছ) দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না—করায় জ)নিজেকে আপডেট না—করায় ঝ) না—দেখা বা ভুল দেখায় ঞ) ভাগ্যে চ) ব্যর্থতায় ছ)অসচেতনতায় জ) অজ্ঞতায় ঞ) কাজের ব্যর্থতায় ট) অপকর্মে ঠ) ঠ) মিথ্যা বলার পিছনে ড) উদ্যোগে ব্যর্থতায় ঢ)অর্থ উপার্জন করতে না—পারায় ণ) কর্মে দেরিতে অনুপস্থিতিতে ণ) কোনো তথ্য না—জানায় ত)ভুল শোনায় থ) ভুল বলায় দ) প্রযুক্তি না—ব্যবহারে ধ) অলসতায়
ন) অদক্ষতায় —অকারণে, অসচেতনতায়, অব্যবস্থাপনায়, ব্যর্থতায়, অদক্ষতায়, অলসতায়, ভুল লাইফস্টাইল, নেতিবাচক চিন্তা—চেতনায়, জানা বা অজানায়, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবে, খেঁাড়া যুক্তি আর কুসংস্কারের মোড়কে আবদ্ধ থেকে নানান সময়ে—অসময়ে আমরা অজুহাত দিয়েই যাচ্ছি।
গুরুত্বপূর্ণ কথা, কাজ, সেবা, প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিই না। যে সময়ে, স্থানে, বস্তুতে যতটুকু প্রভাব বিস্তার করা প্রয়োজন তা করি না। আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় অতি গুরুত্ব দিচ্ছি। ফলশ্রুতিতে আমাদের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে অভ্যাসগত—অনেক অজুহাত।
কিন্তু অভ্যাসগত পরিবেশ—পরিস্থিতি সঠিক সময়ে—সঠিকভাবে উপলব্ধি করা, বুঝতে শেখা, যথাযথভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টার মধ্যে হতে মিলতে পারে অজুহাত থেকে মুক্তি। তথ্যগত দক্ষতা, সময়গত ব্যবস্থাপনা, সার্বিক প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুধাবন করা, বাস্তবিকতা, প্রয়োজন, চাহিদা, প্রবৃদ্ধি, বিবেচনায় সময়ে—সময়ে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির চেষ্টা, প্রচেষ্টা গ্রহণ কমাতে পারে আমাদের অভ্যাসগত অজুহাত—ব্যাধি।
শিক্ষার্থীর সফলতার জন্য নানা অজুহাত দেখানোর অভ্যাস থেকে শিক্ষার্থীকে মুক্ত করতে হবে। অজুহাত নয় বুদ্ধিমত্তায় সে যেন যেকোন অবস্থায় কাজটি বা সমস্যাটি সমধান করতে পারে সে মানসিকতায় গড়ে উঠতে হবে।
আবু তৈয়ব, প্রাবন্ধিক ও গবেষক
অধ্যক্ষ, খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ, পটিয়া, চট্টগ্রাম