মহীবুল আজিজ
বিকিনি বিচটাই সবচেয়ে ভালো। মনে হয় যেন পৃথিবীর বাইরে কোথাও বিরাট অসীম এক সৈকতে উদ্দাম ছুটছে সব অপৃথিবীর লোকজন। বেশিভাগই মেয়ে, কখনও কখনও সকলেই মেয়ে। আর সে যে কী মেয়ে একেকটা। দেহ যেন তাজা গোলাপ। রোদ তাদের গায়ে পড়ে পিছলে যায়। বুকের দুই সৃমদ্ধ স্তম্ভে রোদ একটু ধাক্কা খায় অবশ্য। তাতে করে বিকিনি বিচের মেয়েদের আরও রহস্যময় দেখায়। নিম্নাঙ্গে লেপ্টে থাকা পলকা কাপড়ের টুকরো আর দৃশ্যমান বক্ষবন্ধনীতে তারা একেকজন স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী। রাফসানের ইচ্ছে করে এক দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে ওদের ভিড়ে। ঢুকে ইচ্ছেমত ল্যাপ্টালেপ্টি করে নেয় খানিকটা। ওদের গোলাপি, লালচে, হলুদাভ চামড়ায় ঘষাঘষি করা শেষে একটাকে নিয়ে একটু ছায়া-ছায়া আলোর মধ্যে গিয়ে হারিয়ে যায় অমৃত সাগরে। আবার বিকিনি বিচের চাইতেও এক কাঠি সরেস হলো ন্যুড বিচটা। একটা নির্দিষ্ট সৈকতাঞ্চলের মধ্যে সবাই ঘুরে বেড়ায় জন্মদিনের পোশাকে। নানা মেয়ের নানা রকম স্তন। ডানে স্তন বামে স্তন, খালি স্তন আর স্তন। শুধু কি স্তন সঙ্গে আর যা-যা অনুষঙ্গ থাকে সব। পরিধেয়গুলো ওরা সীমানার ক্লোকরুমে রেখে আসে।
কিন্তু দেখো আইন বলে কথা। সীমানার ভেতরে তুমি নগ্নতায় চূড়ান্ত স্বাধীন কিন্তু সীমানাদেয়ালের ঠিক ওপারেই হাজার ডলার জরিমানা, যদি তুমি তোমার নগ্নতাকে নিয়ে যাও নির্দিষ্টতার সীমানা পেরিয়ে। ন্যুড বিচটা কিছুদিন দেখবার পর আর টানে না তাকে। এত খোলামেলায় কোনো রহস্য নেই। বরং খানিকটা আড়াল খানিকটা রাখঢাকের মধ্যে যেন আবিষ্কারের আনন্দ আছে। পরিপূর্ণ নগ্নতার মধ্যে নেই আবিষ্কারের আনন্দ। সবই যেখানে লভ্য, যেখানে কোনো কিছুই কল্পনাক্ষম নয় সেখানে নিজের সক্ষমতার কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। কিন্তু রাফসান চায় নিজের সত্তার শক্তিকে সম্পূর্ণ ঝালাই করে নিতে। বিকিনি বিচের উড্ডিণতা দেখে শক্তি পরখের তীব্র ইচ্ছেটা করোটিতে কামড়ের পর কামড় বসিয়ে যেতেই থাকে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় একটা নিতান্ত ধরাছোঁয়ার জগতের এক মেয়ের ঔদ্ধত্যের প্রতিক্রিয়া।
মেয়ে মানে তো মেয়েই। মেয়ে মানে পুরুষ নয়। বরং ভালো করে বললে পুরুষের অধীন একটা প্রাণি। যাকে সারাজীবন অধীনতার মধ্যেই কাটাতে হয় তার এত তেজ কিসের ভেবে পায় না রাফসান। দিয়েছিল সাদা কাগজে একটা চিঠি: তোমার নাম জানছি, তুমি নিরা। তোমাকে আমার ভালো লাগে। এইটুকুই। এতে কোন্ খারাপ জিনিসটা আছে সেটা কেউ এসে একবার বলুক তাকে। সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে মেয়েটা তার পায়ের স্যান্ডেলের নিচে পিষে ফেললো এবং তার দিকে লাল-লাল চোখ করে বললো, মাস্তানির আর জায়গা পাও না! বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ভালো হবে না। এখন চওড়া চ্যাপ্টা এলইডি স্ক্রিনে বিকিনি বিচের ভিড়ে মেয়েটাকে ঠেসে ঢুকিয়ে দেয় রাফসান। দিলে অদ্ভুতভাবে সে মিশে যায় সেই নগ্নারণ্যে। মেয়েটাও দারুণ ফর্সা ওদেরই মতোন। কী যেন নাম মেয়েটার! হ্যাঁ, মনে পড়ে গেল, নিরা। মেয়েটাকে একবার এই বিচে নিয়ে যেতে পারলে হয়। বেশি উল্টোপাল্টা করলে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরবে তাকে। পরনের সমস্ত পোশাক খুলে নিয়ে সমুদ্রের তীরের বালুর মধ্যে ফেলবে। ফেলেই ভিডিওটা দেবে চালু করে। ব্যস, এবার বেটি তুই চ্যাঁচাতে থাক, দ্যাখ বাড়াবাড়ি কাকে বলে! রাফসানকে তো তুই চিনস নাই এখনও! এবার চিনবি। যখন দেশের ঘরে-ঘরে পাড়ায়-পাড়ায় লোকে দেখবে আমি তোকে সুমদ্রের বালুর মধ্যে ফেলে জাপটে ধরে জীবনের সব খেলা একাই খেলে নিচ্ছি তখন ঠিক বুঝতে পারবি, কাউকে অপমান করলে তার ফল কী হয়!
বাবা-মা গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গেছে আকাপুলকোয়। সে যায় নি। না যাওয়ার কারণ একটাই। যে ছেলে মিশরের পিরামিড দেখতে যাবে তাই একটা সেমিস্টার বাদ দিয়েছে পরে দেবে বলে, যে-ছেলে হাল্কা শীতেই কুম্ভকর্ণ সে-ই দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখবে বলে আঁধার-আঁধার ভোরে জেগে বসে থাকে। এখন সে-ই যদি বলে, না তোমরা যাও এবার, আমার এই সেমিস্টারটা অনেক টাফ, তখন কী আর করার থাকে। থাকো তুমি হোম এ্যালোন! ডিপফ্রিজ-ভর্তি খাবার থাকছে। প্রায় সব রকমের খাবার। মাংস, মাছ, চপ-কাটলেট, কোপ্তা এইসব। শুধু মাইক্রোওভেনে গরম করে নিলেই হয়। ওরা থাকবে সপ্তাহখানেক কিন্তু দুই ফ্রিজ মিলে খাবার রয়েছে অন্তত মাসখানেকের। আর বিকল্প তো আছেই। ধরো আলসেমির বিলাসে পেয়েছে তোমাকে। কিছুই ভালো লাগছে না। এরকম হয় মাঝে-মাঝে। কেমন একটা শূন্যতার বোধ। সবকিছু হাতের নাগালে কিন্তু তবু একটা ফাঁকা অনুভূতি। সেটা ঠিক বলে বোঝাবার নয় কিন্তু সেটা শূন্যতাই। সেটা এমন নয় যে, একটা কিছু পাওয়া হয়ে গেলেই সেই ফাঁকা শূন্যস্থানটা পূর্ণ হয়ে যাবে। আসলে তখন ইচ্ছে করে কিছুই না-করার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে। সেরকম সময়ে একটুখানি কষ্ট করে অর্ডার করলেই সুস্বাদু টেকএ্যাওয়ে দোরগোড়ায় এসে হাজির। এরিমধ্যে পরপর তিনবেলা খাওয়া হয়েছে গরু-খাসি। ফুডপ্যান্ডা দিয়ে গেল পিৎজা, তা-ও আবার বিফ। মাহিরকে নিয়ে এক বসায় তিনটে করে হাইনিক্যান চালালো। এখন যখন স্বল্পবসনা প্রায় নগ্ন মেয়েরা ছুটেই চলেছে সমুদ্রের তীরে আর তাদের উচ্ছ্বাসের অনুবাদ মুহূর্তে মুহূর্তে ঘটে চলে ঢেউয়ের ফেণায় মনে হতে থাকে যেন উপচানো বিশাল একটা হাজার পাইন্টের গ্লাস থেকে উপচে পড়ে বিয়ারেরই ফেণা। হ্যাঁ, শূন্যতার অনুভূতির উৎসটাকে হয়তোবা চিহ্নিত করা যাচ্ছিল। সামুদ্রিক ফেণা যেমন উচ্ছিত হয় কোনো এক গভীর উৎস থেকে এসে তেমনই রাফসানের বুকের অনেক গহিন থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসতে থাকে সেরকম এক বোধ যা ঠিক ফেণার মত বা ঢেউয়ের মত দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু সেটা ঢেউয়ের মতোনই আছড়াতে থাকে আর ছড়িয়ে দিতে থাকে অদৃশ্য ফেণারাজি।
মাগিটাই সব নষ্টের গোড়া— পায়ের তলায় তার আহ্বানের পত্র পিষে ফেলা নিরার উদ্দেশ্যে যা মনে আসে সব মুখে সে উগরে চলে। তার সেই ওগরানোটা শ্রোতৃপক্ষের অভাবে প্রায় মনোলগে পরিণত হয় এবং পাহাড়ের লাগোয়া তাদের সীমানাঘেরা দোতালা বাড়ির এদিকে ওদিকে অবসর পেয়ে অপস্রিত হয়ে যায়। মাহিরটা থাকলে প্রয়োজনীয় সহযোগ পাওয়া যেতো। কিন্তু সে গেছে রেকি করতে। হলিডে কাটিয়ে বাবা-মা ফিরবে আরও ছ’দিন পরে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই তাকে জীবনের একটা কঠিন সংকটের মোকাবেলায় নামতে হবে। অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে হবে অপমানের। সে মানে রাফসান যে একটা পুরুষ আর সে মানে নিরা যে একটা মেয়েমানুষ সেটা তাকে টের পাইয়ে দিতে হবে হাড়ে হাড়ে। প্রেম করার তার দরকার নেই কিন্তু জন্মের শিক্ষা দিতে হবে মেয়েটাকে। এখন মাহির গেছে সবটা বৃত্তান্ত নখদর্পণে নিয়ে আসতে। কখন কোথায় যায় মেয়েটা, কোন্ পথ দিয়ে হাঁটে। রিক্সা-টেক্সি-বাস এসবের কোনটাতে চড়ে। ঠিক কোন্ সময়টায় সে ঘরের বার হয় এবং কখন সে ফেরে ঘরে। অর্থাৎ তার পুরো গতিবিধিটাকে এক ধরনের গুগল-জিপিএসে নিয়ে আসতে পারলেই কেল্লা ফতে। রাস্তায় সে মোটামুটি একাই হেঁটে যায়। অনেক সময় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যাও উৎরে যায় খানিক। দু’টো টিউশনি করে। রাফসান জেনেছে টিউশনি না করলেও তার চলতো কিন্তু তিনি নাকি বিসিএস দেবেন। দিয়ে প্রশাসক হবেন। সেটা দিতে গেলে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের অংক ইংরেজি গ্রামার এসবের একটা চর্চা রাখতে হয়। টিউশনি করে একদিকে সেই চর্চাটা রাখা গেল আবার তাতে কিছু আয়ও হলো। ওর বন্ধুদের অনেকেই এই টিউশনি করেই আইফোন-স্যামসাং-আইপ্যাড-আইপডের মালিক। একেকটা সেট দেখলে মনে হয় দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা অধিষ্ঠিত অথচ সুযোগ পেলে একে অন্যের পকেটনির্ভর হয়ে সিঙ্গারা সমুচা ডালপুরি আর গোটা দিনের শর্করা মেরে দেয় চার-পাঁচ কাপ চায়ের বদৌলতে। মাঝে-মাঝে খায় ফেন্সিডিলও। রাফসানের সেটা একেবারেই অপছন্দ। বিরক্তিভরে বলেছিল একদিন একটাকে— ক্যান্ যে তোরা এই বাল্ খাস। খাইয়া চায়ের দোকান থিক্যা এক কাপ চায়ে চার চামচ চিনি খাস। ওদেরও যুক্তির অভাব হয় না। চিনি কি আর সাধে খায়। ফেন্সিডিলের নেশার বাইপ্রোডাক্ট হলো চিনির অদম্য বাসনা। তখন চিনিই বুঝি প্রিয়ার গ্রিবা কিংবা বাহু, কিংবা এমনকি মসৃণ গাল। ধমকে উঠেছিল রাফসান— ক্যান্ ওয়াইন খা। ওয়াইনে কি সমস্যা। সমস্যা আছে। কারণ রাফসানের কাছে সেটা সমস্যা নাও হতে পারে। ও তো জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই মদের ঘ্রাণে অভ্যস্ত। বাবা-মা দু’জনেই বেশ দামি মদ খায়। বাজে মদ খেয়ে শরীর খারাপ করবার লোক ওরা নয়। কিন্তু সবার বাবা-মা তো আর রাফসানের বাবা-মা না। তাদের মৌলিক সমস্যা হলো, গন্ধ। মদ খেলে একটা বোঁটকা গন্ধ বেরোতে থাকে মুখ নাক দিয়ে এমনকি সারা শরীর দিয়ে। খেলেই ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ধরা। তার চেয়ে ফেন্সিডিলটা নিরাপদ। খাবে নেশা হবে।
প্রথম প্রেমের মত একটা ঘোর সারা সত্তাকে চাদরমুড়ি দিয়ে রাখবে। চাই কি চেহারায় একটা গুরুগম্ভীর ভাবও ফুটিয়ে রাখা যাবে। তোমার শরীরভর্তি নেশার তরঙ্গ বইছে অথচ ভাবখানা এমন তুমি জীবনেও নেশাজাতীয় দ্রব্যের সংস্পর্শে আসো নি। তবে সমস্যা একটাই, ভয়ংকর কোষ্ঠকাঠিন্যের কবলে পড়তে হয়। রাফসানের এক ক্লাসমেটের তো এমনই বাওয়েলস্-এর সমস্যা হলো শেষে মনে হচ্ছিল ক্লিনিকে যেতে হবে। কিন্তু না, পাঁচদিনের মাথায় তার অবমুক্তি ঘটে। তার তো সুরাহা হয় তবে কমোডের সরু পাইপের মধ্যে আদিম কালের শিলীভূত অস্থির মত পুরীষ এমন অবরুদ্ধতার সৃষ্টি করলো শেষে দ্বারস্থ হতে হলো প্লামারের। প্লামার পর্যন্ত সংশয়াচ্ছন্ন, সেটা কি আদৌ মনুষ্যবর্জ্য নাকি শয়তানি করে নিক্ষেপ করা কারও পাথর সেটা বের করতে তার লাগে পাক্কা ত্রিশ মিনিট। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে রাফসানের দৃষ্টিতে ফেন্সিডিলের পক্ষ নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অবশ্য সায়েন্সপড়া সচেতন একজনের উদ্ভাবনা ভালো লেগেছিল তার। বললো, নেশাটা কেটে এলেই হয় ডালকোলেক্স খাও, নইলে ভালো কোনো ল্যাক্সেটিভ খাও। তাতেও মজার সমস্যা উটকো হামলায়। এক ব্যাটা খেলো তো খেলো তার হয়ে পড়লো লুজ মোশন। ছেলেটার স্মৃতিদৌর্বল্য ছিল। খেয়েছি না খাইনি এই ভাবতে ভাবতে খেয়ে ফেলে দশ মিনিটের ব্যবধানে দুই ডোজ। আর যায় কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে ধরাশায়ী। তবে ছেলেটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। রাফসানের ধারণা সেটা তার বিজ্ঞান পড়বার হাতে-হাতে ফল। শেষে ঐ ফেন্সিডিল খেয়েই বন্ধ করা গেল লুজ মোশনের গতি। কাজেই সবকিছুতেই সমস্যা যেমন থাকে আবার থাকে সম্ভাবনাও।
নিশ্চিত সমস্ত সংবাদ নিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় মাহিরের। তার বয়ে আনা সংবাদে গুরুত্ব ও উত্তেজনা দুই-ই থাকে। নিরার চলা পথের শরণ তত কঠিন না। বিশেষ করে বাসায় ফেরার সময় সে রাফসানদের বাড়ির বেশ খানিকটা কাছ দিয়েই যায়। একটা তেরছা বাঁকের মত আছে। সেখানটা আবার নির্জন। ঠিক সেই জায়গাটাতে সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারলেই সাফল্য হাতের মুঠোয়। তবে মাহিরের সংবাদে বাড়তি একটা মাত্রা থাকে। মেয়েটার সঙ্গে সম্ভবত একটা ছেলের সম্পর্ক হয়েছে কয়েক মাস আগে। ছেলেটা গরিব কিন্তু মেধাবী। একদিন হয়তো সেই ছেলেটাও বিসিএস দিয়ে তার নিজের গরিবত্ব সমূলে উৎপাটন করতে সক্ষম হবে এবং তারপর সে আর নিরা দুইজনে মিলে বেশ কয়েকটা বছর সেবা করতে পারবে দেশ ও দশের। তা যদি না হয় তাহলে কেন তাদের দু’জনকে এখানে ওখানে দেখা যাবে একসঙ্গে। শুনে রাফসানের মনে হলো এটা কোনো সমস্যা না। আগে মেয়েটাকে সাইজ করতে হবে তার কৃতকর্মের ফল তাকে নগদানগদ ফেরত দিয়ে। তারপর প্রয়োজন হলে ধরবে ছেলেটাকে। এমনও হতে পারে ছেলেটাকেও সাইজ করতে হলো। হতে পারে সেটা করে মেয়েটাকেও দেওয়া যাবে শিক্ষা। এরকম সাইজের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওদেরই এক বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড একই সঙ্গে দু’জনের সঙ্গে প্রেম করছিল। তাদের একজনের ছিল মানিব্যাগের পুরুত্ব এবং অন্যজনের মেধার ঘনত্ব। মানিব্যাগ যার ভারি তার ছিল না মেধা আর মেধা যার ভারি তার ছিল না মানিব্যাগের খোপ ভরার নোট। ভারি মানিব্যাগঅলা একদিন মেধাবীটাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নির্জন পথে হামলে পড়লো ছুরি নিয়ে। ঠিক মেরে ফেলবার উদ্দেশ্য তার ছিল না। কেবল ছুরির একটা খোঁচা দিয়ে দিনকয়েকের জন্য হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রাখা। কিন্তু কার্যত দেখা গেল কি করে কি করে যেন তার নিজের চাইতেও তার মুঠোবদ্ধ ছুরি অনেক বেশি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠলো। যেন ছুরিই প্রতারণার শিকার। চাইলো সে তলপেটের ডানদিকে বসাতে অথচ শালার ছুরি গিয়ে ঢুকলো নাভি আর বুক বরাবর। তার মানে ব্যাটা দুই ঘণ্টার মধ্যেই নিঃশেষে বিভাজ্য। এটা নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়েছিল কিন্তু টাকায় কথা বলে। মানিব্যাগঅলার বাপটা আবার মহাপরাক্রমশালী। ব্যাংকগুলো নাকি তার কথায় ওঠে আর বসে। ওদের খরচ অবশ্য হয়েছিল লাখ পঁচিশেক টাকা। যাহোক, রাফসান ভাবে, ছুরির বাঁটে হাত লাগিয়ে হাত নোংরা করার কোনো মানে হয় না। তার তো পিস্তলই রয়েছে। বাপের আবাসিক হোটেলের মতোন পিস্তলটাও চাইলে কব্জা করা যায় যে-কোনো মুহূর্তেই। ঠিক মতো টার্গেট করতে পারলে এক গুলিতেই কাজ শেষ।
মনে-মনে সময়ের হিসেবটা মেলায় রাফসান। যেভাবে মাহির পুরো প্রজেক্টটা আঁকলো তাতে মেয়েটাকে সাইজ করতে তার একটা দিন লাগে না। তখনও আকাপুলকোয় কত সূর্যোদয় আর কত সূর্যাস্তের ঘটনা ঘটে যাবে। ওরা আবার আসবে ভার্জিন এয়ারলাইন্সে প্যাসিফিক হয়ে যেটার ফ্লাইট দিল্লি হয়ে। দারোয়ানটাকে বুদ্ধি করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই লোক আবার পাহাড়ের— কোনো জিনিস জটিল ও প্যাঁচালো ধরনের হলেই তার মাথায় জট লেগে যায়। রাফসানের কথা সরলরেখায় আঁকা: মানুষ তো আমরা দু’জনই। আর খাবারদাবারের স্টক তো রয়েছেই। তার চেয়ে ভালো সে দু’টো দিন ঘুরে আসুক তার লংগদু’র নিজের নিবাস থেকে। মন ভালো থাকলে এবং ফেরার সময় স্মৃতিশক্তি দোচুয়ানিতে আবরিত না হয়ে গেলে তার জন্যে চার পাইন্টের একটা চারচুয়ানি নিয়ে আসতেও পারে। এটা তাদের দু’জনের মধ্যকার একটা অলিখিত চুক্তির পরিণাম। মাঝে-মাঝে রুচিবদলের জন্য রাফসান হুইস্কি-জিন-ভদকার বদলে একদম খাঁটি পাহাড়ি দো কিংবা চারচুয়ানিতে চলে যায়। নিজের নির্জন কামরায় বসে মধ্যরাতে কাঁকড়া কি ঝুড়িভাজা দিয়ে উদযাপন এক কথায় অনবদ্য। মাহিরের অবশ্য পছন্দ ড্রাইজিন। তা ভদকা হোক বা ড্রাইজিন হোক কিংবা হোক হুইস্কি নেশার লাটিম ঝিম ধরতে বেশিক্ষণ লাগে না। বিরাট দোতলা বাড়িতে তার আর মাহিরের কথাগুলো এদিকে ওদিকে ধাক্কা খেয়ে স্ক্রিন থেকে ভেসে আসা কথা ও গানের সঙ্গে মিশে অন্য এক রূপের নকশা আঁকে। ঝিমধরা লাটিমের ঘূর্ণনের মধ্যেই ভেসে ওঠে নিরা নামের মেয়েটার মুখ আর একটা আগুনে অশান্তির আচ্ছন্নতা দখল নেয় রাফসানের। মাহিরের সুবাদে শেল্ফ থেকে নামানো ড্রাইজনের প্রকোপেও কাটে না সেই আচ্ছন্নতা। স্ক্রিনে তখন মিউজিক চ্যানেলে জড়ানো গলায় বারব্রা স্ট্রাইসেন্ড গাইতে শুরু করেছে ‘মেমোরি’ আর সঙ্গে রবার্ট রেডফোর্ডের ফিল্মেও ক্লিপিং। বারব্রা’র এই গানটা সহ্য করা মুশকিল। গানের শুরু’র হামিংটাই এক ভয়ংকর হৃদয়বিদারক শূন্যতাকে বিদ্ধ করে দেয়। অন্য সময় হলে আধোঘুমের মত নেশার ঘোরে মন্দ লাগতো না। কিন্তু তখন তার সারা অন্তর জুড়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল শিখার ঝলসানো দ্যুতি নিয়ে যে-শিখার নিবারণ একমাত্র মেয়েটাকে তার কৃতকর্মের উচিৎ সাজা পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব।
কাজেই চ্যানেল বদলে হিপহপের মত কিছু একটার সন্ধান করে মাহির এবং অচিরে খুঁজে পাওয়া গেল নোয়েল বিয়োঁশেকে। এক যুগ আগে লাসভেগাসে লাইভ করা তার হালো গানটা মাত্রই শুরু। উর্ধাঙ্গে পরা জিন্সের হাতকাটা জিন্সটা যত পুরুই হোক সামনেটা প্রায় হাট করে খোলা থাকায় বিয়োঁশের বক্ষটাকেই মনে থাকে অমৃতকুম্ভের দু’টো মূল্যবান সঞ্চয়। যেমন পরিপুষ্ট তেমনই মসৃণ দেখায়। মুহুর্মূহু দিকপাল্টানো আলোকরেখায় সেই মসৃণতাকে মনে হয় ভিন্নলোকের ইশারা। আর ওদের মানে নোয়েল মারায়া কিংবা সেলিনদের পোশাকগুলো এমনই যে মনে হয় ইচ্ছে করলেই সেই উন্মুক্ততা সরিয়ে চট্ করে ঢুকে পড়া যাবে। কিন্তু রাফসান দেখেছে তা নয়। ঐটুকু ইশারা শেষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থেকে যায় ইশারাতেই। এদিকে ড্রাইজিনের দাপট তখন আরম্ভ হয়ে গেছে দুই করোটিতেই। বিয়োঁশের উর্ধাঙ্গের জিন্সের সঙ্গে নিম্নাঙ্গে কি থাকতে পারে সেই গবেষণায় লেগে পড়ে তারা দু’জন। হতে পারে কিছুই নেই। তা না থাকুক। কিছুই না রেখে সে যদি তার গানটাকে দারুণভাবে গেয়ে দর্শকের মন জয় করে নিতে পারে সেটাকেই তো বাহবা দিতে হয়। এটা ঠিক বিয়োঁশের কোমর থেকে যে তরঙ্গ তার আকর্ষণীয় বল্লরীর সঙ্গে মিলিয়ে একটানে নেমে গেছে তার আঙ্গিকগত অবলম্বন হয়ে এবং নেমে শিল্পীর ব্রাশে আঁকা পায়ের পাতায় গিয়ে থেমেছে সেটাকে তুলনাহীন বলতেই হবে। আরেকটা গান আছে বিয়োঁশের যেখানে তাকে মনে হয় স্বর্গের অপ্সরীর মতোন। পুরো নিম্নাঙ্গ জুড়ে ঝালরের পোশাক। ঠিক যেন অশান্ত এক আলোর নাচন বাইরের আর ভেতরের পৃথিবীর। রাফসান ভেবেছেও অনেক। মিক্স কমপ্লেকশনের মেয়ে বিয়োঁশের এমন সৌন্দর্যের হেতু কি। নাওমি ক্যাম্পবেল ধরা যাক পুরোটাই ব্ল্যাক পার্ল। হাঁ, সেটাও অসাধারণ। বিশেষ করে ক্যাটওয়াকে নাওমির হাঁটা দেখলে মনে হয় আফ্রিকা নয় তার উৎস হলো মিশর। হয়তো মিশরের নেফারতিতিরই কোনো এক ধারার উত্তরসুরী সে।
রাত বাড়ে। রাফসান আর মাহিরের ওপর নেশার রাজত্বও মজবুত হয়ে ওঠে। অদূরে বাড়ির সীমানাদেয়ালের অপর পারে সদর রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর ছুটন্ত গাড়ির ঘষটানো শব্দ আসে। রাস্তাটা মসৃণই কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে রাফসানদের গেটের কাছ দিয়ে বাঁক পেরোতেই প্রায়সব গাড়ির চাকাই একটা বাড়তি ঝোঁকের ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। তা যাক, অদূরের শব্দ দূরগামী হয়। নেশার পাতলা পর্দাটা চোখের সামনে দুলতে থাকলে সেই দুলুনির মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে ওঠে সেই মেয়েটা— বসে বসে মালই টানতে পারবা তোমরা। ঐটাই তোমাদের মুরোদ। কিন্তু রাফসান জানে মেয়েটার এমন দম্ভ ও অহংকার আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারই পায়ের পাতায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তখন পায়ের তলে পিষে ফেলা পত্রে কোটিবার চুমু খেলেও কোনো লাভ হবে না। একটা চ্যানেলে তখন দুম্ করে রাশান ব্লু ফিল্ম লাফ দিয়ে ঢুকে পড়লে নেশা-নেশা ঘোরের মধ্যেও চেঁচিয়ে ওঠে মাহির— শালারা কি দেখাচ্ছে দ্যাখ্! এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, কিংবা নয় কোনো আশ্চর্যজনক ঘটনা। একসময় সিনেমাহলেও দর্শক বাড়াবার জন্য হলমালিকেরা কিংবা তাদের অধীনস্থরা সিনেমার মাঝখানে আচমকা ব্লুফিল্মের ক্লিপিংস দেখাতো। দিনের কর্মক্লান্ত দর্শকেরা হয়তো নায়ক-নায়িকার বিরহমিলনে ক্লান্ত হয়ে ঝিমোয় আর নীলের আচমকা আবির্ভাবে তাদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায় এবং তারা উৎসাহভরে চোখের সমস্ত আলো ছুড়ে দেয় পর্দার দিকে। ভাগ্য ভালো হলে টানটান শেষ কয়েকটি মুহূর্তের উত্তেজনা তাদের ভাগে পড়ে। এতে সমস্যাও হয়েছিল। একবার নায়ক নায়িকাকে নিয়ে ফুলের ছবি আঁকা বেডকভারের বিছানায় কেবলই শুয়ে পড়েছে আর পর্দাজুড়ে নায়িকার উহ্ আহ্ শীৎকারের শুরু। পরে দেখা গেল সেটা ছিল এক মারাত্মক যান্ত্রিক ত্রুটির ফল। যখন তারা সঙ্গম শুরুই করে নি তখন শব্দযন্ত্রে ফেটে পড়ে সঙ্গমসমাপ্তির চিৎকার। আর যায় কোথায়। হল জুড়ে বাজতে থাকে হতাশ দর্শকের হৈচৈয়ের ধ্বনি। শেষে আসে পুলিশ এবং হলমালিক কিংবা কর্তৃপক্ষের লোকজনকে না ধরে নিয়ে যায় কয়েকজন দর্শককে যাদের একজন আবার ছিল শতভাগ বধির। সে গিয়েছিল সিনেমা দেখতে অর্থাৎ পর্দায় প্রদর্শিত গল্পের রেখার অনুসরণই তার কাম্য ছিল। পর্দায় কি ধরনের শব্দ ভেসে আসছিল সেটা মোটেও তার জানবার কথা নয়। হাঁ, পর্দাজুড়ে ছিল সুঠামদেহী একজন যুবক এবং অতীব সুন্দরী এক যুবতী যারা ছিল সামগ্রিকভাবে নগ্ন। তাদের শরীরে ছিল না ন্যূনতম বস্ত্রটিও। রাশান ছবিটাতে অবশ্য সেই তুলনায় খানিকটা রাখঢাক লক্ষ করা যায়। সব কাজই তারা করছিল। বেশ শিল্পিত ধরনে উপস্থাপন করা হচ্ছিল গল্পটা। একটা ব্রডওয়েতে অপেরা দেখতে গেছে কথিত ছবির নায়ক ও নায়িকা। ওরা গিয়েছিল ‘ম্যারেজ অব ফিগারো’ দেখতে কিন্তু যার বিয়ে সে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ায় মোৎসার্ট-এর বদলে ওরা দেখাতে আরম্ভ করে চায়কোভস্কির ‘সোয়ান লেক’। অপেরার রূপে মোহিত মেকাপম্যানটা দু’টো দৃশ্যের মধ্যবর্তী সময়ে, যেখানে নায়িকা থাকছে না, সেই সময়টুকুতে গ্রিনরুমের একটা কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভোগ-উপভোগ করতে শুরু করে পরস্পর পরস্পরকে। পরিধেয় দু’জনেরই বর্তমান কিন্তু দর্শক ঠিকই অনুভব করতে পারে তাদের বাস্তব নাট্যের আদিমতাটুকু। বুঝলি এটা হলো ট্রিক্স, দর্শকরে এ্যাট্রাক্ট করার একটা কৌশল। মানে দর্শক সারাক্ষণ ঘুরেফিরে অপেক্ষা করতে থাকবে এই চ্যানেলটার দিকে তাকায়া কখন হালায় এমন প্রেম-প্রেম খেলার দৃশ্য দেখন যাইবো!
বিকিনি বিচ ন্যুড বিচ মিউজিক চ্যানেল এবং রাশান চ্যানেল হয়ে একসময় তারা দু’জনেই হারিয়ে যায় নিদ্রার অতলে। সকালের দিকে হ্যাংওভারের মতোন একটা চাপ থাকে কিছুক্ষণের জন্য। একটু পরেই রাফসান ওর সিলভার রংয়ের টয়োটা নিয়ে চলে যায় জিমে এবং মাহির ততক্ষণে তাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ডের জন্য উপযোগী করে নেয় রাফসানদের দোতলা বাড়ির বিশেষ একটি কক্ষকে। ওখানেই তারা আজ রাতে একটা দারুণ ঘটনা ঘটাতে চায়। জিমে ঘণ্টাখানেক কাটালেই দেহের পেশি থেকে ক্লান্তি ও অস্বস্তি দূর হয়ে পরিবর্তে একটা চনমনে ভাব আসে। লাঞ্চে বিফ কাবাবের সঙ্গে বাডওয়াইজারটাও দারুণ জমে উঠলে তারা দু’জন অনেকটা সময় ধরে দেশ জাতি ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলাপে মশগুল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মাহিরের জানার বিষয়, দশমিকের ঘরে ক’টা ঘরের হিসেব ব্যাংকগুলোতে থাকে। ঘর তো অনেকগুলোই। যে-ঘরগুলো ওদের হিসেবের বাইরে তাতেও অনেক অর্থের সম্ভাবনা। সেই কয়েকটা ঘরকে ম্যানিপুলেট করতে পারলেই তো অল্পদিনে কোটিপতি হয়ে যাওয়া যায়। আগে আজকের খেলাটা শেষ করতে দে, তারপর কোটিপতি হওয়া যাবে। এভাবেই অপরাহ্ন উৎরে নামে গোধূলি। রাফসানদের বাসার কোণের দিকটায় যেখানে বাঁকের মত জায়গাটাতে নিরা বাম থেকে এসে ডানে মোড় ফেরায় সেখানটা এরিমধ্যে নির্জনতার একটা এলাকা হয়ে উঠেছে। আশেপাশে একটু দূরত্বে লোকেদের আনাগোনা। তারা হয় মোবাইলের পর্দায় উৎসাহী ও নিরুৎসাহ চোখ রাখে নয় পকেট থেকে মোবাইল বের করে অথবা পকেটে মোবাইল রেখে দেয়। আর যাদের হাতে মোবাইল থাকে না মাহির নিশ্চিত তাদেরও মোবাইল থাকবে কোথাও না কোথাও। ভাবতেই একটা রিক্সাঅলাকে দেখা গেল, ঝুঁকে পড়ে একটু উঁচুমত জায়গাটাতে প্যাডেলে সজোর চাপ দেয় আর ডান কাঁধ আর চোয়ালের যৌথ প্রক্রিয়ায় চালু রাখে আলাপ। থাকুক যে যার আলাপ নিয়ে ব্যস্ত। তাতে সুবিধারই সুযোগ রাফসান মাহিরের। বাঁকের ঠিক কয়েক গজ পরেই রাস্তার বাম দিকে পার্ক করা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে মাহির। বাম দিককার পেছনের দরজাটা খোলা। দরজার গায়ে ঠিক ঠেস দিয়ে নয় ঠেসের মত করে দাঁড়ানো রাফসান। কিন্তু তার তেরছা চোখের লক্ষ্য পশ্চাতের বাম।
একটা কাক দিনের উদ্দেশে তার শেষ ডাক দিয়ে পেরিয়ে যেতে থাকে নগরাংশের আকাশ। একটা কালো হাইউন্দাই সাঁই করে চলে যায় পাশ দিয়ে। তারপর আবার চুপচাপ। ঠিক তখনই রাফসানদের প্রত্যাশার সপক্ষে ঘটে ঘটনাটা। মেয়েটি যার নাম নিরা, ছিপছিপে গড়নের, ফর্সা ও মধ্যম উচ্চতার তরুণি, চমৎকার গোছানো চুলের মালিক মেয়েটি বাম থেকে ডানে মোড় নেয় আর মাহিরের রেকির আগাম অনুমান ও ফলাফল মিলে যায় খাপে-খাপে। আকাশি ডেনিমের প্যান্ট ও ফতুয়ার মত দেখতে গোলাপি শেমিজ আবছা আলোছায়াতেও মূল রংয়ের ঝলকানি দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাফসানের হাতে ধরে থাকা বড় রুমালটা চলে যায় নিরার মুখ বরাবর। আর ধাতস্থ হয়ে মুহূর্তে নিজের বর্তমানতায় সচেতনভাবে ফিরে আসার আগেই যা ঘটবার তা ঘটে যায়। মেয়েটি বুঝতে পারে সে কারও কবলিত হয়েছে। কোনো এক তরুণের শক্তিশালী পেশল হাতের থাবা তাকে প্রায় জাপটে ধরে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে একটা গাড়ির ব্যাকসিটে। চালক এবং একমাত্র যাত্রী দু’জনেরই মুখে মাস্ক। ফলে তারা আড়াল হয়ে যায় অপরিচয়ের আবরণের নিচে। হতভম্ব নিরা নিজেকে সামলে নিয়ে খানিকটা প্রতিবাদী ও খানিকটা গোবেচারা ধরনে প্রশ্ন করে, কি চাচ্ছো তোমরা? আমার কাছে টাকাপয়সা তেমন নাই। তিনশো টাকা আছে। গলার চেনটা ইমিটেশনের, জিরকোনিয়ার পেনড্যান্ট, ডায়মন্ড না। কাঁচতোলা শীতাতপে আশপাশ ঠাহর করা না গেলে নিরা পার্শ্ব ও সম্মুখবর্তী দুই মানুষকে পরখ করবার চেষ্টা করতে থাকে। মাহির দ্রুত গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসে রাফসানদের সদর দরজায়। রাফসান বসা থাকে সিটে। ইশারায় নিরাকে নীরবতা পালনের নির্দেশ ছোঁড়ে সে। গাড়ির স্টার্ট চালু রেখে গেটের তালা খুলে ফের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে তারা নিরাকে নিয়ে পৌঁছে যায় দোতালায়। সবই খুব পূর্বপরিকল্পিত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটমান মনে হতে থাকে নিরার। শাদা এলইডি বাতি জ্বলে উঠলে সেই আলোয় মাস্কপরিত্যক্ত একজনকে চিনতে পারে নিরা যে রাফসান। চিনতে পারাটা তার সহজাওতার মধ্যেই পড়ে। কেননা সে-ই শিকার হয়েছিল তার প্রত্যাখ্যানের। আরও ভালোভাবে বললে সে নিরার শিকার হয়েছিল তারই স্বভাবদোষে। মনে পড়ে, ছেলেটা বলেছিল, সে তাকে দেখে নেবে। যদিও এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তাকে দেখে নিতে চাওয়া ছেলের সংখ্যা একের বদলে দুই এবং তারা প্রকৃতই তাকে দেখে নিতে আরম্ভ করে দিয়েছে। নিরা বুঝতে পারে সে ছেলেটির প্রতিশোধপরায়ণতার শিকার। প্রত্যাখ্যানকে সে অপমান জ্ঞান করে তারা আজ সেটারই বদলা নিতে চাইছে। কিন্তু সে-ও উপস্থিত চেতনতা হারাতে রাজি নয়। শহরের গলি ও রাজপথে মেলা দিন ঘুরেফিরে সে বুঝে গেছে দেশের শহরে মেয়েদের বিপরীত শব্দই শুধু পুরুষ নয় বিপরীত পক্ষও আসলে পুরুষ। তাই মনে-মনে একটা দৃঢ়তার প্রাকপ্রস্তুতি তার তৈরিই থাকে। তার জানা, এসব ক্ষেত্রে মনোবল হারালে চলে না। থাকতে হয় শক্ত ও হার-না-মানা প্রচেষ্টা নিয়ে স্থির। প্রতিপক্ষকে পরিস্থিতিমাফিক ও কায়দামত মোকাবেলা করতে হবে। একজন হলে হয়তো এরিমধ্যে সে ব্যাগ থেকে আমেরিকা থেকে ভাইয়ের পাঠানো রেডচিলি-স্প্রে’টা বের করেই আচমকা কয়েকটা চাপে ঘায়েল করতে পারতো তাকে। কিন্তু দু’জন তারা এবং তার ভ্যানিটি ব্যাগটা ততক্ষণে কব্জা করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পাশের টি-টেবিলে ছুঁড়ে দিয়েছে মাহির। মোটকথা এখন আর শরীর বা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কোনোটাই তার সহায়কশক্তি নয়, এখন কথা বা শব্দই তার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু কথাকে শব্দকে এমন উদ্ধত দুই যুবকের উদ্দেশ্যে কিভাবে অস্ত্রের মত প্রয়োগ করা যাবে সেটা নিয়ে কিছুটা ভাবিত হওয়ার মুহূর্তেই তাকে ধাক্কা দিয়ে দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসিয়ে দেয় মাহির। রাফসানের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে দৈববাণীর মতোন।
ঃ তুই আমারে চরম অপমান করছোস। আমি সেই অপমানের প্রতিশোধ নিমু আজকা। তোরে আমরা রেপ করবো, মানে ধর্ষণ করবো। তুই রেপড্ হবি মানে ধর্ষিত হবি। ফার্স্ট আমি তারপর আমার দোস্ত। বেশি না, শুধু আমরা দুইজন।
রাফসানকে মনে হয় অন্য পৃথিবীর অন্য কারো কণ্ঠস্বর, মানুষের না। কাঁদতে চায় না নিরা কিন্তু তার চোখে পানি। কোনোভাবেই সে বুঝতে পারে না, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে সম্পর্কের প্রস্তাবনা সভ্যসমাজের নিয়মরীতির মধ্যে পড়ে কিনা। আর সেটাকে অগ্রাহ্য করলে কোথায় এমন দানবিক পদক্ষেপের চল চালু আছে। দুই ফোঁটা পানি নিজের উরুর ওপর পড়তেই নিজেকে সামলে নিতে চায় সে। ভেঙে পড়লে চলবে না। তার ডান দিকে সোফার আরেকটা টুকরোয় মাহির এবং সে যেনবা কোনো নির্দেশের অপেক্ষায়। কণ্ঠে দৃঢ়তা আনবার চেষ্টা চালায় যদিও দ্রুতরেখ পর্যবেক্ষণ চালিয়ে সে এরিমধ্যে বুঝে নিয়েছে, ছেলে দু’টোর চোখেই জ্বলে ঝলসে দেওয়ার আলো। সেই আলোক থেকে নিজেকে রক্ষার কৌশল তার জানা নেই, কারণ এমন প্রতিশোধস্পৃহার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা তার এটাই প্রথম। পুরুষকারের আগ্রাসন-পরিস্থিতি অনেকই তাকে সামলাতে হয়েছে সেই শৈশব থেকেই কিন্তু সেসব এমন মারণোদ্ধত ও অভাবনীয় ধরনের ছিল না। রাফসানের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করে নিরা:
ঃ আমি কোনো অন্যায় করি নাই। তোমরা যা করতে চাচ্ছো সেটাই চরম অন্যায়। ধরা পড়লে কিন্তু তোমাদের চরম শাস্তি পাইতে হবে। মৃত্যুদণ্ডও হইতে পারে। তাই বলতেছি, আমাকে যেতে দাও। আমি একটা নগণ্য মানুষ। তারপরেও যদি কোনো অপরাধ করছি বলে মনে করো দরকার হলে আমি তোমাদের পা ধইর্যা মাফ চাই। আমার এতো বড়ো ক্ষতি তোমরা করো না।
রাফসানদের শারীরিক ভাষায় অস্থিরতা থাকলেও নিরাকে শোনার ব্যাপারে তারা ধৈর্য্যরে পরিচয় দেয়। সবটাই শোনে। কিন্তু নিরার কাকুতিমিনতিভরা কথায় খুব একটা কাজ হয় না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাফসান হামলে পড়ে। একটা হাতলঅলা চেয়ারে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আগের চাইতে তীক্ষ্ম শোনায় তাকে—
ঃ তোর অনেক দেমাগ বুঝছোস। আজকে তোর দেমাগ ঠাণ্ডা করমু। আমার এই লোহাটা আছে না, এইটা তোর দেমাগের মধ্যে ঢুকামু। ঢুকাইয়া চিরদিনের জন্য ঠাণ্ডা কইর্যা দিমু তোর মতো একটা খানকির দেমাগ। তইলে বুঝবি আমারে অপমান করার কি ফল হইতে পারে। শুনছোস, হ!
শোনে নিরা। কিন্তু সে নিজেকে এমন একটা জায়গায় দেখতে পায় যেখান থেকে সহজেই উদ্ধার অসম্ভব। আশপাশটা দ্রুত বয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলোর মধ্য দিয়ে অনুভবের চেষ্টা চালালেও কোনো ইতিবাচক বা আশার ইশারা মেলে না। স্থানটা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আন্দাজ করা গেলেও নিশ্চিত কোনো ধারণা নেই তার। এটা বোঝা যায়, জায়গাটা বেশ নির্জন আর শহরের সাধারণ লোকচলাচল হয় এমন রাস্তা থেকে ভেতরের দিকেই। জোরে একটা চিৎকার হয়তো দেওয়া যায় ‘বাঁচাও’ বলে কিন্তু কামরার দেয়ালগুলো বেশ পুরু দেখায়। ডান দিককার জানলাটা বেশ খানিকটা ওপরের দিকেই, বড়ো আকারের ঘুলঘুলির মতো। তার আর্তনাদ মনে হয় না সেইসব পুরু অবরুদ্ধতা আর সংকীর্ণ পথ দিয়ে কোথাও পৌঁছাবে। বরং তাতে ঝুঁকিরও সম্ভাবনা। নিজেদের অবস্থান সংকটের মুখোমুখি দেখলে ছেলেদু’টো তাকে খুনও করে ফেলতে পারে। ক’দিন আগেই খবর বেরিয়েছিল পত্রিকায়। যুবতী মা ও তার শিশুকন্যা দু’জনকেই ধর্ষণ শেষে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ঘর থেকে বেরোতেই নিরার মনে হতো পথে যে-দশজনের সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্তত একজনের চোখে ভয়ংকর রেখার বিদ্ধতা। এইভাবে ঘর থেকে বেরোলে এবং ঘরে ফিরলে হয়তো এমন বিদ্ধতার দেখা মেলে অন্তত জনাদশেকের মধ্যে। সে-হিসেবে প্রতিদিনই তার সঙ্গে ধর্ষকের দেখা হয়। পার্থক্য হচ্ছে নিরা তাদের ধর্ষণের শিকার হয় না। কিন্তু সে না হলে কি হবে আরেকজন তো হচ্ছে। তাহলে সেই আরেকজনের ধর্ষক হত্যাকারী তো তারই পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল। তারা তো অন্য কোনো পৃথিবী থেকে আসে না। তারা থাকে তারই আশেপাশে কাছাকাছি। পত্রিকায় একজনের ছবি ছেপেছিলও। দেখেই তার মনে হয়েছিল, লোকটাকে কোথাও যেন দেখতে পেয়েছিল, হতে পারে রাস্তায় কিংবা বাসে কিংবা কোনো শপিং মলে। সিগারেট ফুঁকছিল একটু দূরে দাঁড়িয়ে আর ফাস্টফুডের দোকানে অপেক্ষমান নিরার সর্বাঙ্গ যেন সে চেটে যাচ্ছিল একটা অদৃশ্য জিভের আঁকশি দিয়ে। পারলে তখনই এসে লোকটা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় কোনো অশুভ অন্ধকারে। কিন্তু ছেলে দু’টি এমন চোখ ঝলসানো আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে যে-ভাষায় নিজেদের ভেতরের শয়তানকে প্রকাশ করে যায় সেটিকে সম্পূর্ণ অচেনা ও প্রত্যাশাতীতই ঠেকে। এটা যেন কোনো বিচারিক আদালতের রায় যেখানে সমস্ত রায়ই ঘোষিত হবে তাকে অপহরণ করে নিয়ে আসা যুবকদেরই সপক্ষে। যেখানে ভদ্রবেশি দানবেরা বাছুরের মতো নিরীহ কাউকে অনেক ধারালো ছুরিতে জবাই করবার মতো প্রস্তুত। নিরার ধারণা ও প্রত্যাশাকে আর বিস্তারী করবার সুযোগ না দিয়েই ডান দিকে বসা মাহির তাকে সোফার ওপর সজোর চেপে দুই দিক থেকে দুই হাতে ফতুয়ার মত তার শেমিজটা খুলে নিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে দেয় একটু আগে নিক্ষিপ্ত তার ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে। ফর্সা নিরার ত্বকের ঔজ্জ্বল্য আরও বাক্সময়তা পায়। তার বক্ষের বাদামি বর্ণের অন্তর্বাসটুকু প্রথমত তার নারীত্বের নির্জনতাকে তুলে ধরে এবং দ্বিতীয়ত তার প্রতিপক্ষ পৌরুষের অন্তর্গত অগ্নিকে করে তীব্রতর।
করণীয় সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিতই নাগালে মেলে না হতবিহ্বল নিরার। নিজের অবস্থান থেকে এটুকু তার স্পষ্ট জানা হয়ে গেছে, আজ সে ধর্ষিত হবে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার জন্যই তার এখানে আগমন। কিন্তু প্রায় সব ধর্ষণের শেষ দৃশ্যে ঘটে যে-মৃত্যু সেটাও কি তার জন্য নির্ধারিত এবং তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ যেটা, মৃত্যু হলে সেই সংবাদটা কি কারও পক্ষে জানা সম্ভব হবে নাকি তা-ও কোনো গুমের শিকার হয়ে চাপা পড়ে পাবে চিরকালের আস্তরের নিচে। দুই যুবকের সামনে নিজের উন্মুক্তবক্ষ উপস্থিতির জন্য নিজেকে একটুও করুণাময় মনে হয় না নিরার। বরং তার এই বোধ হয়, কেবল নারীত্বের মতো এক কোমল অবলম্বন দিয়েও তারা অনেকটা সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে প্রতি মুহূর্তে নিজেদের পৌরুষ প্রদর্শনে উদগ্রীব ব্যাটাছেলেদের সঙ্গে। সেটা তাদের করতে হয় সারাক্ষণই এবং প্রকাশ্যেও। আজ না-হয় জনান্তিকে নির্জনতায় সেরকমই একটা লড়াইয়ের মুখোমুখি সে-ও, যদিও তার জানা নেই সেই লড়াইতে জিৎটা অপেক্ষা করছে আসলে কার জন্য। একটা জিনিস সে তার মধ্যকার কোনো একটা ইন্দ্রিয়যোগে হৃদয়ঙ্গম করে, এক ধরনের মৌন নিশ্চেষ্টতাই শ্রেয় কারণ এই সহায়সম্বলহীন একাকিত্বের সীমানায় যে-কোনো ধরনের আত্মরক্ষা কিংবা কূটকৌশলের পরিণাম হবে পাল্টা আক্রমণ যে-আক্রমণের ফল হতে পারে প্রাণহারানোর মত বিপজ্জনক পরিণতি। তার অপেক্ষা সেই মুহূর্তের জন্য যখন সামনেকার যুবকদ্বয়ের প্রথমটা ফেটে পড়তে শুরু করবে উদগীরণ নিয়ে। নিজেকে সে ধর্ষিত হওয়ার জন্যে মনে মনে তৈরি করতে থাকে কিন্তু একই সঙ্গে তার আপ্রাণ ভাবনা, বেঁচে থাকতে হবে। মরে গেলে তার সত্তার বিন্দুমাত্র দাম থাকবে না। বেঁচে গেলে বরং সেখান থেকে সেই মুমূর্ষতা থেকে আবারও এক ধরনের লড়াই শুরু করা যাবে। মরে গেলে কোনো কিছুরই আর সম্ভাবনা থাকবে না। কাজেই ধর্ষণের চাইতেও মৃত্যুর পরিণতি তাকে অধিক ভাবিত করে। ওরা কি তাকে ধর্ষণশেষে মেরে ফেলবে!
সেই আশঙ্কাটা হয়তো অমূলক নয়। তখনই প্রথমে মাহির পাশ থেকে এবং সামনে থেকে এগিয়ে এসে রাফসান দু’জনে মিলে তার ডেনিমের প্যান্টটা দু’দিক থেকে টেনে খুলে ফেললে সোফার ওপর নিরা কেবল বক্ষে ব্রেসিয়ার এবং নিম্নাঙ্গে প্যান্টি নিয়ে প্রায় নগ্ন। ওরা তাকে বসিয়ে দিলে তার পোশাকবিহীনতায় সংকুচিত হওয়ার কথা কিন্তু নিরার লজ্জাবোধ হয় না। কারণ পোশাক পরা থাকলেও তাদের দৃষ্টির ভয়ংকরতা সেই আবরণ ভেদ করে দেখে নিতে পারবে তার অন্তর্নিহিত কাঠামো। আর কার সামনে লজ্জাবোধ করবে সে। যে-মুহূর্তে সোফায় বসা ছেলেটা তার গা থেকে পোশাক খুলে নেয় সে-মুহূর্ত থেকেই তারা নিরার নিকটে আর মানুষ নয়, বোধহীন পশু বা পশুরও অধম। পশুর সামনে আবার লজ্জা কী! নিজেকে সে লজ্জা-সংকোচের উর্ধ্বে অন্য এক অনুভূতির সীমানায় নিয়ে যায়। নিজের শরীরের পরিণতির চাইতেও তার কাছে তার প্রাণের বিষয়টা অনেক বেশি গুরুত্বের মনে হয়। প্রাণই যদি চলে যায় তাহলে তার নারীত্বের সংরক্ষণের কী মূল্য! বইয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি মা-বোনেদের ইজ্জত ছিনিয়ে নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। পার্থক্য হলো, তাদের নিকটে ছিল মারণাস্ত্র আর এরা অস্ত্রহীন। কিংবা হয়তো এদেরও রয়েছে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র। প্রতিরুদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিলে অনায়াসে সেই অস্ত্র হয়ে উঠবে প্রকাশ্য। নিরা যখন তার প্রাণ তার সম্ভ্রমরক্ষা এইসব নিয়ে মুহুর্মূহু ভাবছে তখন রাফসান এবং মাহির বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে তার নিম্নাঙ্গে পরিহিত অদ্ভুত ধরনের প্যান্টির দিকে। কেননা তারা তাদের দু’জনের জীবনে এমন পোশাক দেখে নি। বিকিনি বিচ আর ন্যুড বিচ কিংবা মিউজিকের হাজার-হাজার ভিডিও দেখে অভিজ্ঞ তারাও এমন কিম্ভূত প্যান্টির দেখা পায় নি। বলতে গেলে নিরার পরনের এমন পোশাকের সঙ্গেও তাদের দেখা হয় নি কখনোই। দু’জনকেই একটা বিমূঢ়তার ভাব কিছুক্ষণ ধাঁধায় ফেলে দিলে মাহির এবং রাফসান পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিন্তু তাদের নিজেদের পক্ষে সেই দুর্বোধ্যতার সুরাহা সম্ভব না হলে দুয়ের পক্ষ নিয়ে রাফসানই ধমকে ওঠে তীক্ষ্ম স্বরে:
ঃ এই হারামজাদি, এইডা কি পরছোস?
এমন প্রশ্নের কী উত্তর হয়। ওদের স্ল্যাং আর খিস্তিতে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে আসা নিরা ভাবে। দেখাই যাচ্ছে তার পরনে প্যান্টি যা এমন কোনো আশ্চর্যজনক জিনিস নয়। পরে ছেলেরাও এবং তার জন্যে ভিন্ন নাম নির্দিষ্ট। তাই নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় মনে হলো নিরার। তার নিরব অবস্থান দু’জনকেই ভেতরে-ভেতরে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট করে তোলে। নিরার পরনের সংক্ষিপ্ত বস্ত্রবিন্যাসকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা সর্বজনবিদিতই কিন্তু লোকের এবং এই মুহূর্তের দুই প্রত্যক্ষদর্শী মাহির ও রাফসানের পক্ষে কোনোভাবেই জানবার কথা নয়, কেন প্যান্টি থেকে এমন উজ্জ্বল আলো ছিটকে আসবে। হ্যাঁ, বাইরের আলো বস্তুর ওপর পড়লেই তবে অপটিক্সের নিয়মে সেই বস্তু দৃশ্যমানতায় গ্রাহ্য হয়। সেক্ষেত্রে বস্ত্রনির্মিত পোশাক থেকে আলোকের প্রতিফলন অসম্ভব ও অলৌকিক ব্যাপার। কিন্তু নিরার নিম্নাঙ্গের পোশাক থেকে বিচ্ছুরণ ঘটেই চলে আলোকের। তখন রাফসান দৃষ্টির গভীরতা দিয়ে খনন চালাবার উদ্দেশ্যে নিরার সামনে উবু হয়ে ডান হাতটা তার প্যান্টির ওপর বুলিয়ে নিলেই বোঝা গেল সেটা আসলে কাপড়েরই নয়, লোহার। সম্ভবত স্বাভাবিকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে হাল্কা ও পাতলা স্টেনলেস লোহা দিয়ে বানানো প্যান্টিই পরে আছে নিরা। সেটা এক টানে খুলে ফেলতে চাইলেও কোনোভাবে সম্ভব নয়। এমনিতে তা স্বাভাবিক অন্তর্বাসই। তবে কোমর ও উরু ঢেকে দেওয়া আবরণটা দুই ঢাকনাবিশিষ্ট। দু’দিক থেকে দু’টো ঢাকনা দরোজার মত (এক্ষেত্রে ছোট দরজা) এসে মিলেছে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে। এমনভাবে মিলেছে যে দুই ঢাকনার মধ্যবর্তী সরু পথ দিয়ে কেবল একটি চিকন চুলের যাতায়াতই সম্ভব। আর সেটাই শেষ কথা নয়। নিরার অন্তর্বাসের সেই দরজার কেন্দ্রভাগে দরজায় ঝোলানো কড়ার মতোনই ছোট দুটি কড়া লাগানো। সেটাও সর্বশেষ নয়। সেই কড়ায় ঝুলছে একটি ছোট্ট তালা। টিপ না ঘোরানো তালা সেটা চাবি না দেখে এবং তালা না খুলে বোঝা মুশকিল। কথা হলো সেই তালার চাবি কোথায় এবং এমন লোহার প্যান্টি এমন দরজাব্যবস্থা এবং এমন কড়া-তালাচাবিরই বা বন্দোবস্ত কেন! আর সেটা এমনভাবে তৈরি যে মনে হয় যেন নিরা কাপড়ের অন্তর্বাস পরেই সোফায় বসা। অর্থাৎ স্টেনলেস লোহার তৈরি প্যান্টি পরে বসে থাকাটা দেখতেও তত অস্বাভাবিক লাগছে না এবং তাতে করে আসীনেরও তেমন সমস্যা হয় বলে প্রতীয়মান নয়। ঘরের দুই/তিন দিক থেকে আসা বাল্বের আলো নিরার পরিহিত লোহার প্যান্টিতে প্রতিফলিত হয়ে চারদিকে ছিটকায়। অসহিষ্ণুতা আর অধৈর্য্য’র তীব্র হানায় চিৎকারের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে রাফসান—
ঃ হারামজাদি মাইয়া মানুষ, তুই কি সার্কাসের নটি? রাইতের বেলা যাত্রা-সার্কাস পার্টিত্ খেলা দেখাইয়া টাকা কামাস? বল্ কি পরছোস্ এইডা? আর তুই কি ভাবছোস্ তোর ইয়ার দরজায় তালা লাগাইলে আমরা সেই তালা খুলতে পারুম না? পাঁচ কেজি লোহার তালাও আমরা খুলতে পারি আর এইডা তো একটা শিশু-তালা!
রাফসানের ধমকলাগানো কথাগুলো রুদ্ধ ঘর থেকে বেরোবার পথ না পেয়ে সারা ঘরে ছোটে এবং সবচেয়ে বেশি ধ্বনিত হয় নিরার কানের কাছে। কি উত্তর করা যায় এমন প্রশ্নের। কখনও কেউ এমন দানবিকভাবে তাকে নগ্ন করে নি, ফলে এমন প্রশ্নেরও মুখোমুখি হয় নি সে। কিন্তু রাফসান-মাহিরের নিকটে যা অস্বাভাবিক-অবাস্তব ঠেকে সেটাই নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ের কারণে নিরার কাছে মনে হয় সরলভাবে স্বাভাবিক। হতে পারে আপাত সে-অস্বাভাবিকতার শেকড় তারই মনোজগতের গভীরে কিন্তু সেই শেকড়ের চারপাশে একক ব্যক্তির পরিবর্তে থাকে ব্যক্তিসমষ্টি যে-সমষ্টিকে সমাজ নাম দেওয়া হয়েছে। নিরার বেড়ে ওঠা সেই সামাজিক দৃষ্টির আওতায় যে-পথ সে-পথের মধ্য দিয়েই। সেই পথে ঝুঁকির দেখা তার সুদূর শৈশব থেকে। মনে পড়ে একবার বাসায় বেড়াতে এসেছিল তার বাবার এক দুসম্পর্কীয় ভাই। নিরার তখন চলছিল পাঁচ কি ছয়। লোকটা তাকে আদর করছিল কোলে বসিয়ে। কিন্তু নিরার সে-আদর খুব অস্বস্তিকর লাগে এবং সে উসখুশ করতে থাকে লোকটার কোল থেকে নেমে যাওয়ার জন্য। মা তখন চা করছিল রান্না ঘরে। ঘরে তারা তিনজনই। নিরা অনুভব করতে পারে, যেখানটায় লোকটা তাকে কোলে বসায় সেখানে একটা শক্ত কিছু কাঠ বা প্লাস্টিক বা লোহা যেমন শক্ত সেরকম একটা শক্ত জিনিস তার শরীরের পেছনভাগে ধাক্কা দিচ্ছে অবিরাম। অনেকক্ষণ ধাক্কা খাওয়া চলতে থাকলে একপর্যায়ে নিরা যথেষ্ট বল প্রয়োগ করে নেমে যায় তার কোল থেকে। ততক্ষণে মা-ও চলে এসেছে রান্নাঘর থেকে। একটা বাক্য আজও কানে বাজে। লোকটা বলছিল তার মা’কে— আপনার মেয়েটা খুব লক্ষ্মী! কলেজে পড়ার সময় যখনই বাসে উঠতো ভিড় ঠেলে তখনই তার শরীরের নানা জায়গায় অযাচিত স্পর্শ করতো পুরুষেরা। আচমকা স্পর্শ লেগে যাওয়া এবং সউদ্দেশ্য স্পর্শের পার্থক্য সে বুঝতো। একবার শহর এলাকার বাসে বাড়িফেরা ক্লান্তিতে খানিকটা ঝিমুনির মত আসে। ভেবেছিল পাশের সিটে বসা লোকটা প্রোঢ়প্রায়, নিরাপদ ধরনের। কিন্তু না, সম্পূর্ণ বিপরীত। সে ছিল ডান দিককার সিটের জানলার পাশে। লোকটার ডান হাতের মধ্যমা তার উর্ধাঙ্গের কামিজের নিচ দিয়ে তার যৌনাঙ্গের দিকে ক্রমধাবমান। আচমকা তার ঝিমুনি ছুটে যায় এবং দ্রুত লোকটাও সরিয়ে নেয় তার হাত। আর লোকটা তড়াক করে সিট থেকে উঠে নেমেও পড়ে। সেটা তার গন্তব্য নিকটবর্তী হওয়ার কারণে না নিরাকে তাৎক্ষণিক ভয় পেয়ে বলা দুরূহ। কিন্তু নিরা নিশ্চিত, ব্যাপারটা তেমনই ঘটেছিল। সেইসব পুরুষাক্রান্ত ঘটনাগুলো কাঁটার মত বেঁধে। বছরপাঁচেক আগে একটা অনুবাদের অফিসে কাজ নিয়েছিল। দুপুরের অবসরে প্রায় সকলেই চলে গেছে লাঞ্চে বা অন্য কোনো কাজে। নিরা এবং তার এক সহকর্মী ব্যস্ত নির্ধারিত কাজে। কাটাকুটির এক পর্যায়ে নিরা তার পাশের টেবিলের সহকর্মীকে বলে, আপনার রাবারটা দিন তো? সেই যুবক প্রথমটায় মুখ তুলে স্মিত হেসে বলে, দিচ্ছি। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রাবারের সন্ধানে। হতবাক নিরা দেখলো রাবারটা তার চোখের সামনে টেবিলেই কিন্তু লোকটা তার মানিব্যাগে রাখা একটা সিঙ্গল প্যাকেটের কনডম তাকে দিয়ে বললো: এই নিন রাবার! ডনরা জানতো, আমেরিকায় কনডমকে রাবারই বলা হয় কিন্তু লোকটা তাকে এমন অশ্লীলভাবে অপমান করবে সেটা ছিল তার ধারণারও অতীত। ব্যাপারটা অনেকটা দূর গড়ালে শেষে চাকরিটাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল নিরা।
সেই ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঘটলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতোন ঘটনাটি। শহর থেকে ঠিক গ্রাম নয় মফস্বলে তাদের নানা-বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। গায়েহলুদের রাতে দারুণ নাচগান আর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রায় মধ্যরাতের পরে ঘুমোতে যায় সবাই। নিরার স্থান হয়েছিল মেয়েদের মধ্যেই। কক্ষে ঘুমন্ত সকলেই নারী। সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। আচমকা তার ঘুম ভেঙ্গে যায় ভোররাতের দিকে। সারাঘরে অন্ধকার। অনেক দূর থেকে আসা রাস্তার একটা স্বল্পালোক-বাতি সেই আঁধারকে আরও রহস্যময় আঁধারে পরিণত করে। মেয়েদের সেই কক্ষে কোনো পুরুষের অবস্থিতি ছিল অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার। সেই অসম্ভব ঘটনাই সম্ভাব্য হয়ে উঠেছিল সেদিনকার রাতে। দু’টো শক্তিশালী হাত তার পরনের সালোয়ার নিচের দিক থেকে টেনে তার নিম্নাঙ্গকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলেছে। ক্লান্তি ও ঘুমঘোর নিরাকে মুমূর্ষপ্রায় করে রাখে কিন্তু অন্ধকারে নিজের ক্লান্তিকে জয় করতে না পারলে যে সমূহ সর্বনাশ ঘটবার উপক্রম সেটা সে অনুভব করতে পারে তাৎক্ষণিকভাবে। নিজের চোখকেই তার বিশ্বাস হতে চায় না। পরের দিন বিয়ে হওয়ার কথা তার এক মামা’র। আর তারই ছোট ভাই মানে তার আরেকটা মামা এসেছে তারই চরম সর্বনাশ করতে। এমন নয় যে সে মস্তিষ্কবিকৃত উন্মাদ। সন্ধ্যায়ও তাকে একটা সন্দেশ খেতে দিয়ে বলছিল, তুই তো অনেক মিষ্টি হয়ে গেছিস! সে কেবল নিরাকেই অর্ধনগ্ন করে তা-ই নয়, নিজেও সে নিম্নাঙ্গে নগ্ন। পরনের প্যান্টটা হয়তো রেখে আসে কামরার বাইরে। সে হয়তো নিশ্চিতই ছিল অন্ধকারে নিরাকে নগ্ন করে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে চলে যাবে। তখন আশেপাশে নানা বয়সী নারীরা সকলেই নিদ্রাভিভূত। চোখের পলকে নিরা দেখতে পায়, তার শিশ্নটা সুতীব্র তীরের মত তাক করে তারই দিকে। কেমন এক আগ্রাসী ভঙ্গিতে সেটা অস্থির। মামা কিছু বুঝে ওঠার আগেই উদোম ডান পা’টা আচমকা ছুঁড়ে দেয় আগুয়ান অবস্থানের দিকে। হামলে পড়া লোক হয়তো সেই পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। লোকটাকে আঘাত করার মানসিকতা ছিল না নিরার। সে কেবল তার প্রত্যাখ্যানের মুদ্রার জানান দিতে চাইছিল প্রতিপক্ষকে। অথবা হয়তো সে এমন একটা কাণ্ড করতে চায় যাতে অগ্রবর্তী লোকটা নিবৃত্ত হয়ে পিছু হটে পড়ে। কিন্তু ঝটিতি নিরার প্রত্যাখ্যানের মুদ্রা রূপান্তরিত হয় সপাট লাথিতে। সেই লাথিটা পড়তে পারতো মামা’র টানটান মাংসপিণ্ডে কিন্তু সেটা গিয়ে পড়ে তার তলপেটে। পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনে বা আঘাতের অসহ্য ব্যাথায় মৌহুর্তিক কাতরতা নিয়ে অন্ধকার কক্ষ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায় মামা। সকালে সেই মামা’র সঙ্গে দেখা কিন্তু ভাবখানা এমন যে রাতে সেরকম কোনো ঘটনাই ঘটে নি। নিরাও এমন ভাবভঙ্গি করে, যার সঙ্গে তার অপ্রীতিকর মোকাবেলা ঘটেছিল সে যে সে-ই সেটা সে বুঝতে দেয় না। ফলে মামা হেসে-হেসে তার দিকে নাস্তার প্লেট বাড়িয়ে দিলে মনে-মনে নিরা শুধু নিজেকে শুনিয়ে বলে, জানি তুমি তোমার প্যান্টের নিচে লুকিয়ে রেখেছো তোমার সেই শয়তান অস্ত্রটা যে এই আলোয় নিরীহর মতোন কিন্তু অন্ধকারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে হিংস্রতায়। সেই সপ্তাহেই পেপারে বেরোলো দশ বছরের একটা মেয়ের ধর্ষিত-নিহত হওয়ার সংবাদ। গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। প্রতিবেশি যুবকের রিরংসার শিকার হয়ে করুণভাবে মারা যায় মেয়েটি।
সেই থেকে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ বাসা বাঁধে নিরার করোটিতে। রোজ ঘর থেকে বেরোবার সময় মনে হতো সেদিনই হয়তো সে হবে কোনো আগ্রাসী পুরুষকারের শিকার। একদিন তাকে নিয়েও সংবাদ ছাপা হতে পারে পত্রিকায়— তরুণি নিরা ধর্ষণের শিকার। এমনও হয়েছে বাসে করে রাজধানি শহর থেকে যাচ্ছে অন্য জেলায়। সারা পথ তার ঘুম নামে না চোখে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর কিন্তু মন তবু বলে জেগে থাকো। অনেকবারই জিজ্ঞ্যেস করেছে নিজেকে— এমন আশঙ্কা কী প্রকৃতই অমূলক নাকি সেটা তার অবচেতন মনেরই কোনো অশুভ চেতনার ফল। দূর শৈশবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাম্প্রতিকতার অভিজ্ঞতার মিশেলেই কি তার মনোচেতনা এমন জটিলতার সম্মুখীন। শেষে কলেজ-জীবনের এক বান্ধবী তাকে বাৎলে দিল পথ। সেই মেয়েটিও নিরার মতোন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল অনেকবারই। সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, তাদেরই গৃহকর্মী তাকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে অচেতন করলে সেই বাড়ির ইলেকট্রিশিয়ান তাকে ধর্ষণ করে নিদ্রিত অবস্থায়। বেশ বড় অংকের টাকার বিনিময়ে কাজটা করেছিল গৃহকর্মীটি। লজ্জায় কাউকে সে বলতেও পারে নি ঘটনাটা। কিন্তু তারপরেই সে সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধিতে নিজেকে রক্ষা করবার পন্থাটি আবিষ্কার করে। তার ধারণা হয়, যদি নিজের নারীত্বকে এমন কঠিন প্রতিরক্ষার ব্যূহে সংরক্ষিত করে রাখা যায় তাহলে অন্তত ধর্ষণকারীকে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে কিছুটা সময়ের জন্য। বিশেষভাবে তৈরি স্টেনলেস স্টিলের অন্তর্বাসের ধারণাটা সে তার নিজস্ব পরিমণ্ডেেলর অনেক মেয়ের মধ্যেই ছড়িয়ে দিয়েছে। তার মত অনেকেই সেটার অনুসরণ করে সুফলও পেয়েছে। নিরার কাছেও মনে হয়েছে, এটা একটা সত্যিকারের প্রতিরক্ষা-প্রকল্পই। কিন্তু এমন কঠিন প্রতিরোধ্য ব্যবস্থার আশ্রয় নিয়েও সে ঠিকই শিকার হয়ে পড়লো ধর্ষণকারীদের। মনে মনে নিজেকে শুনিয়ে সে বলে, এই ব্যবস্থাটা নিয়েছি তোদের মত দানব আর শয়তানদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করবার জন্য। তবু মনে হয় নিরার শেষরক্ষা সম্ভব হবে না। সোফায় বসা ছেলেটা হাজতের কয়েদিদের জিজ্ঞাসাবাদের মতোন তাকে চেপে ধরে। নিম্নাঙ্গের প্যান্টির দিকে নির্দেশ করে তর্জনি দিয়ে—
ঃ তালার চাবি দে। বেশি তেড়িবেড়ি করবি তো একদম ফাইড়া ফেলমু। এখনও তো ছুরি-পিস্তল বাইর করি নাই। ভালো মানুষের মতন চাবিটা দিয়া দে।
রাফসান ইশারায় কিছু একটা বলে মাহিরকে। অদূরের শেল্ফে একটা স্কচের বোতল উজ্জ্বল সত্তা নিয়ে সাড়া দেওয়ার ইশারায় চকচক করে। তালুবন্দি করে রাফসান সেটিকে রাখে টেবিলের ওপর কিন্তু সেটি ছিপিরুদ্ধই থাকে। হয়তো এসবই মূল পর্বের অনুষঙ্গ। নিরা ততক্ষণে নিশ্চিত ধরেই নিয়েছে, আজ ধর্ষণের ভাগ্যই নির্ধারিত হয়ে আছে তার জন্য। এতোদিন পত্রিকায় পড়েছে ধর্ষণের সংবাদ আর এখন সে-ই সংবাদ কিন্তু সে-সংবাদ কি শব্দরূপ পেয়ে কোথাও পৌঁছাবে নাকি এমন নিস্তব্ধতার সীমানায় আটকা পড়ে থাকবে চিরকালের জন্য। এমন দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ঠ থেকে যে বেরোবে তারও কোনো উপায়-উদ্ভাবনা কাজ করে না মাথার ভেতরে। একবার ভাবলো, যতটা শক্তি আছে শরীরে সবটা জড়ো করে একটা চিৎকার দেয়। কিন্তু যদি তাদের কাছে ছুরি-পিস্তল সত্যি থেকে থাকে তাহলে নির্ঘাৎ বেঘোরে সে প্রাণ হারাবে। ছেলেদু’টো তাকে একটুখানি এদিক-ওদিক ভাববার সুযোগও দিচ্ছে না। নইলে বলা যেতো, একটু ওয়াশরুমে যাবো। গিয়ে সেই অবকাশে পরখ করে দেখবে বাড়িটা থেকে বেরোবার কোনো উপায় কোথাও একটুখানি ইঙ্গিতের মতও দেখা যায় কিনা। বুদ্ধি খাটিয়ে সেটাকে করা যেতো সুপরিসর। কিন্তু তাদের চোখে জ্বলে আক্রমণকারীর বিতৃষ্ণা-ক্রোধ এবং তাদের সমস্ত শরীরে ছড়ায় গ্রহণ ও গ্রাসের ভাষা। নিরার মৌনতায় ফের চিৎকৃত মাহির—
ঃ কি বললাম, কথা কানে যায় না? চাবিটা কই রাখছোস্ বাইর কইর্যা দে!
চাবিটা আসলে রয়েছে তার ব্যাগের মধ্যে রাখা একটা ছোট পার্সের মধ্যে। সেটাই শেষরক্ষা। এখন সেটা বের করে দিলেই কাজটা সহজ হয়ে আসে তাদের জন্য। তাই সে আশ্রয় নেয় মিথ্যার-অভিনয়ের। আত্মরক্ষার একটা চেষ্টা চালিয়ে দেখতে চায় সে—
ঃ চাবি নাই, হারায়া ফেলছি। আজই মনে হয় কোথাও হারাইছি।
কিন্তু চাবি হারালে তো চলে না। চাবিটাই তো আসল। রাফসানের চোখেমুখে সেরকম একটা ভাষারই আভাস। মাহির ততক্ষণে নিরার ব্যাগ হাতড়ে ছোট্ট পার্সটা বের করে নিলে সেখান থেকে বেরিয়ে আনা যায় রুপালি রংয়ের ছোট্ট একটা চাবি। দেখে টিপতালারই মনে হয়। চাবির মাথাটা চ্যাপ্টা। দুই দিকে কিছু খাঁজকাটা। চাবিটা হাতে নিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে মাহির ধমকে ওঠে নিরাকে—
ঃ বল্ এইবার তোর কোন্ বাপে রক্ষা করবো তোকে? বেয়াদবির শাস্তি আইজ হাড়ে-হাড়ে টের পাইবি!
নিরার মাথাটা তখন চক্কর দিতে শুরু করেছে। রাফসানের চোখের সামনে তার নগ্ন শরীরটা এক লাফে বিকিনি বিচ থেকে উঠে আসে এবং তার কানে বাজতে শুরু করে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ। সেই অদৃশ্য ঢেউয়ের কল্পিত শব্দের মাঝখানে সুবিধামত একটা জায়গায় মেয়েটাকে বসিয়ে দেওয়া যায় সহজেই। কেবল একটা উর্ধাঙ্গ-অন্তর্বাস আর একটা নিম্নাঙ্গ অন্তর্বাসের দুর্বল প্রতিরক্ষাকে মুহূর্তে ছিন্ন করে মেয়েটাকে কব্জা করে নেওয়াটা কেবল সময়ের ব্যাপার। নিরার তখন প্রথমটায় মাথায় একটা প্রবল ঘূর্ণন এবং প্রায় সমান্তরালে তলপেটের দিকে চক্রাকার একটা অস্বস্তি আর ব্যাথার হামলা শুরু হয়ে যায়। মনে হতে থাকে ধর্ষিত হওয়ার আগে তার মৃত্যুই ঘটে যাবে। কিন্তু পত্রিকায় এমনও সংবাদ পড়েছে, মৃত নারীকে ধর্ষণ। মানে মর্গের লাশকে ধর্ষণ করতে পারে এমন দানবও রয়েছে জগতে। এরাও যে সেই দানবের সগোত্রীয় নয় সেটা কে বলবে! মুহূর্তই কেবল, সেই ভাবনায় স্থির থাকা যায় না। মাথায় যখন চক্কর আর অস্বস্তির হানা তখন তলপেটের দিক থেকে আসে বমনোদ্রেকের মত একটা চাপ এবং একই সঙ্গে কোমরের দুই পাশ থেকে দলাপাকিয়ে উঠতে থাকা অস্বস্তিকর যন্ত্রণার একটা স্রোত। একবার মনে হয় সেটা মিলিয়ে যাবে কিন্তু না মিলিয়ে তা নতুন শক্তি নিয়ে আবার গতি নিয়ে নিম্নাঙ্গের দিকে চলমান হতে শুরু করে। একটু বুঝি ঝাপসাও লাগতে থাকে চোখের সীমানায় থাকা সম্মুখভাগটা। আগুয়ান ছেলেটা মাহির না রাফসান, সোফার না সামনেকার চেয়ারের সেটাও ধাঁধালাগানো মনে হয়। মাহির তখন পৌঁছে গেছে নিরার একেবারে সামনেই। হ্যাঁচকা টানে কোমরের দু’দিক থেকে সোফা থেকে টেনে তুলে নিরাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে রাফসান তার ওপর জারি রাখে সজোর নিয়ন্ত্রণ। চাবিটা মাহিরের হাতে। সে-ই খুলবে নিরার প্যান্টিতে লাগানো ছোট্ট তালাটা। নিরার শেষ প্রতিরোধের অবস্থানে করবে মূলউৎপাটন করা আঘাত। বাস্তব জীবনে নিজেকে সামলে ও রক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার যত কৌশলের আশ্রয়ই তুমি নাও মনে রাখবে তুমি মেয়েমানুষ। আর আমরা হলাম তোমার নিয়ন্ত্রণকারী পুরুষ— রাফসানের করোটিতে মুহূর্মুহু ঘোষিত হতে থাকে সেই বার্তা। নিরার মনে হয় সে জ্ঞান হারাবে। একটা দুর্বোধ্য ব্যাথা তখন সেই মুহূর্তেই চরম আঘাতের মত তলপেটের মধ্যে ফুঁসলে ওঠে। কেউ যেন তার নাভিমূলে বসিয়ে দেয় ছুরি এবং সেটা কী সত্যিই ছুরি কিনা কে জানে, হয়তো নিরারও জানা থাকে না, জানা হয়তো যুবকদেরই, তার স্টেনলেস স্টিলের প্যান্টির দুই পাশের ফাঁক গলে বেরোতে থাকে আকস্মিক ওগরানো রক্তধারা।
উদ্ভাসিত আলোয় রক্তের ধারা দেখে চমকায় মাহির রাফসান দু’জনেই। নিরারও তখন সেই বোধ তার নিজের শরীরের সমস্ত ধারা-উপধারায় জানান দিয়ে যায়, সে এক রক্তপাতেরই উৎস এবং তা আর কোনো অবাস্তব কল্পনার ফল নয়। গতকাল রাতেই কোমরের দুই পাশে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি টের পাচ্ছিল। আজ সকালের দিকে একবার বমিভাবও লাগে কিন্তু কর্মব্যস্ততায় সেটা গায়ে মাখে নি নিরা। চাবিহাতে মাহির রক্ত দেখে খানিকটা পিছিয়ে যায় এবং একটা অস্বস্তির ভাব নিয়ে রাফসান নিরাকে বসিয়ে দেয় সোফায়। রক্তের প্রস্রবন থামে না। নিজের শরীরের গহিন থেকে নির্গত হতে থাকা সেই রক্তের দিকে তাকিয়ে নিরার মনে হয়, হাঁ দুজন ভয়ংকর পুরুষের মারণায়োজনের মধ্যেও এখনও সে নারী বেঁচেই রয়েছে।
মহীবুল আজিজ, কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক