এস ডি সুব্রত :
মনে রেখো ভোটের আমি
হইওনা কেউ অগ্রগামী
যে জন দেশের মঙ্গলকামী
সে আমার আপনজন।” ( শাহ আবদুল করিম) ।
আমাদের মধ্যে সাধারণভাবে একটা ধারণা এই যে, সাধু সন্ন্যাসী বা বাউল সাধকেরা এক অতিন্দ্রীয় জগতে বাস করেন, সংসার ধর্ম থেকে দূরে থাকেন, রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। যে জগতে তারা থাকেন সেখানে লোভ লালসা নেই, দ্বন্দ্ব সংঘাত নেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটাই হয়। কিন্তু ভাটির বাউল শাহ আবদুল করিম ছিলেন এ ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। শাহ আবদুল করিম একই সাথে বাউল সাধনা করেছেন, ছিলেন গণমানুষের কবি এবং রাজনীতি সচেতন মানুষ। বিপরীতধর্মী দুই ধারার মধ্যে সমন্বয় ঘটেছিল শাহ আবদুল করিমের চিন্তা চেতনায় তা ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ, সংগীত ও রাজনীতির এক দুর্লভ বাস্তবতার ইতিহাস।
এ সম্পর্কে শাহ আবদুল করিম গ্রন্থের প্রণেতা সালেহ মাহমুদ রিয়াদ বলেন — ‘এই সত্যের পাশাপাশি আমাদের একথাও ভুললে চলবে না যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়া কোনও ক্রমেই কোনও বাউলের পক্ষে সম্ভব নয়, তেমন সম্পৃক্ততা আমরা আশাও করি না। আবদুল করিম অত্যন্ত সচেতনভাবে আপন বাউলসত্তাকে সংরক্ষণ করেছেন আবার সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অঙ্গীকারের কথাও ভুলে যাননি। ”
অতএব, সেই ১৯৪৭ সালের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ক্ষতিকর সম্ভাবনা বুঝতে পেরে আবদুল করিম হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য গান গেয়েছেন। ধর্মীয় সংকীর্ণতার অনেক ওপরে মানবতার জয়গানে মুখর হয়েছেন তিনি।
বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিম যেমন গানের মানুষ তেমনি রাজনীতির মানুষও। রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকালে সহজেই দেখতে পাব এ উপমহাদেশের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর এবং সুন্দর সম্পর্ক।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটে গণসংযোগে আসতেন তখন সফরসঙ্গী হতেন ভাটির বাউল শাহ আবদুল করিম ১৯৫৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সিলেট আসা উপলক্ষে সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিস্টারি মাঠে আয়োজিত বিশাল জনসভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন শাহ আব্দুল করিম। তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জ্বালাময়ী বক্তব্য আর শাহ আবদুল করিমের কণ্ঠে গাওয়া গণসঙ্গীত জনসভায় উপস্থিত হাজার হাজার জনতাকে মুখরিত করে তুলেছিল, জাগিয়ে এক অন্যরকম প্রাণের স্পন্দনে। তারপর থেকে পূর্ববঙ্গের যে কোনও স্থানে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনসভা হলে শাহ আবদুল করিমের ডাক পড়ত। সে সব জনসভায় আবদুল করিম উপস্থিত জনতাকে গানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করত। নেতাদের ভাষণ আর করিমের গানে আবেগে আর আনন্দে ভাসছে উপস্থিত জনতা। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী থাকাবস্থায় সুনামগঞ্জে প্রথম সরকারি সফরে আসেন ১৯৬৭ সালে। কোনো এক কারণে সেদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী সুনামগঞ্জের মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে শীর্ষস্থানীয় নেতারা বঙ্গবন্ধুর জনসভা বর্জন করেন। ফলে জনসভায় লোক সমাগম খুব কম হয়েছিল। এ সময় এগিয়ে আসেন শাহ আবদুল করিম। জনসভায় লোক সমাগম নেই দেখে আবদুল করিম ভিন্ন পথ ধরেন। তিনি তার দরাজ কণ্ঠে গান ধরেন। করিমের গান শুনে মুহূর্তের মধ্যে জনসভাস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে সময় গান শুনে শেখ মুজিব করিমকে এক হাজার ১০০ টাকা বকশিশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি করিম ভাইকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। করিম ভাইয়ের মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হবে। এ দেশের উন্নয়নে আপনার মতো শিল্পীর প্রয়োজন আছে।’
এছাড়াও ১৯৬৯ সালে সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে করিমের গণসঙ্গীত শুনে শেখ মুজিব আবেগ আপ্লুত হয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বাঁচবেন এবং সে সময় শেখ মুজিব শাহ আবদুল করিমকে ৫০০ টাকা উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের প্রাক্কালে শেখ মুজিব লঞ্চে করে ভাটি অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আসেন। এ সময় হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং ও নবীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের দিরাই, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা এবং নেত্রকোণার খালিয়াজুরি ও মোহনগঞ্জ থানার জনসভাগুলোতে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন আবদুল করিম। জনসভায় গান গেয়ে নেতা কর্মীদের মাতিয়ে রাখতেন শাহ আবদুল করিম। ১৯৮৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাতে ভাটি অঞ্চলে আসেন তখন তাঁর সফরসঙ্গী হন শাহ আব্দুল করিম এবং গণসঙ্গীত গেয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করেন এবং আনন্দ দান করেন। ১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জের দিরাই সফরে এসে আবদুল করিমকে দিরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমার বাবা যার গানের গুণমুগ্ধ ছিলেন, আমি তাকে অবশ্যই উপযুক্ত সম্মান দেবো। ধর্মের বিভেদ ভুলে মানুষকে সামাজিক নিপীড়ণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে তিনি তাঁর গানে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন —
“বাংলা মোদের মা জননী, আমরা ভাই ভগিনী
ভেদনাই হিন্দু মুসলমান, বাঙালি, বাঙলা জবান।”
বাউল জীবনের শুরুতেই তাঁকে রোষানলে পড়তে হয় স্থানীয় ধর্মীয় মৌলবাদীদের। ঈদের দিন জামাতে তাকে গান গাওয়ার অপরাধে গ্রামছাড়া করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বাউলতত্ত্ব, আধ্যাত্মবাদ কিংবা দেহতত্ত্ব এসব তত্ত্বসাধনাকে ছাপিয়ে করিমের গানে ছিল মেহনতি মানুষের কথা। শাহ আবদুল করিম লিখেছেনÑ
“তত্ত্বগান গাইলেন যারা মরমী কবি,
আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি,
বিপন্ন মানুষের দাবি, করিম চায় শান্তিবিধান।’
১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তখনকার তরুণ রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে গান গাইতে গিয়েছিলেন শাহ আবদুল করিম। সেই সম্মেলনে করিমের গান শুনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাকে বলছিলেন, ‘একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে তুমি।’ শাহ আবদুল করিম গণমানুষের শিল্পীই হয়েছিলেন। রাজনৈতিক সচেতন করিমের গানে উঠে এসেছে মেহনতি মানুষের কথা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র, গণমানুষের প্রাণের দাবির কথা, জীবনসংগ্রামের কথা। ১৯৯৭ সালে টি এম আহমেদ কায়সারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, ‘আমি শুধু নিজের কথা বলে যাই, ভাটি অঞ্চলের একজন বঞ্চিত নিঃস্ব দুঃখী মানুষ আমি, আমার কথা সব হাভাতে মানুষের কথা হয়ে যায়।’
২০০১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে কর্মীসভায় বলেছিলেন, ‘শাহ আব্দুল করিম ৫৪ সাল থেকে এ দেশের মাটি ও গণমানুষের গান গেয়ে আসছেন তাঁর মূল্যায়ন করতে হবে। ‘আর রাজনীতি সচেতন ছিলেন বলেই করিম অকপটে লিখতে পেরেছেন —
“এই কি তোমার বিবেচনা,
কেউরে দিলায় মাখনছানা
কেউর মুখে অন্ন জুটে না
ভাঙা ঘরো ছানি নাই।”
১৯৪৭ সালে দাবিদার ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে পেরে আবদুল করিম হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য গান গেয়েছেন। সংকীর্ণতার অনেক ওপরে মানবতার জয়গানে মুখর হয়েছেন তিনি। ধর্মের আবডালে শোষকগোষ্ঠী শোষণ ও নির্যাতন করে আবদুল করিম বুঝতেন । ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, শাসকচক্রের প্রকাশ্য উন্মত্ত ষড়যন্ত্র শিরোনামে প্রকাশিত তাঁর একটি গ্রন্থে তিনি লিখলেন —
“জালিম ও দুশমন করিয়া শোষণ
দুর্নীতি এসেছে এই দেশে
দিনে দিনে সব নিয়েছে চুষে।”
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলায় কোনও বাউল সাধক, পির কিংবা ফকির এত নিবিড় ও প্রত্যক্ষভাবে শোষিতের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হননি। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের কোনও একসময় প্রকাশিত মাত্র এগারোটি গানের সংকলন ‘গণসঙ্গীত আমাদের সামনে নিয়ে আসে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন আবদুল করিমকে। পরবর্তী কালেও আমরা দেখব যেখানেই মানবতা দুষ্টিত হয়েছে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে চলছে শোষণ, গণমানুষ আক্রান্ত মুষ্টিমেয় আগ্রাসীর হাতে — সেখানেই করিম প্রতিবাদের সঙ্গীত রচনা করেছেন। তিনি -বলেছেন মানুষ ছাড়া বাউল হয় না। এই ‘মানুষ’ করিমের কাছে রক্তমাংসের শ্রমশীল মানুষ, দুঃখ-দারিদ্র সকাতর মানুষ, বঞ্চিত ও বিহ্বল মানুষ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালালে ছাত্র নিহত হন। নেত্রকোনার বিভিন্নস্থানে তখন বাউলগান পরিবেশন করছিলেন আবদুল করিম। সংবাদ পাওয়া মাত্র তিনি পরিবর্তন করলেন সুর, সঙ্গীত ও কণ্ঠ। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতেও তাঁকে একবার দেখি আমরা ১৯৫৪ সালে লীগের সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখা গঠিত হলে করিম ওই কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। এ সময় আবদুস সামাদ আজাদসহ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁর কাজ করার সুযোগ হয়। তার গানে উঠে এসেছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৫৭ কাগমারী সম্মেলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ এর নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদ এবং ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন।
এস ডি সুব্রত, কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ