জয়নুল টিটো : প্লেয়ারে কথা কইছে রবীঠাকুর…সাগর সেনের ভেতর।
আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে
দিবস গেলে করব নিবেদন…
দারুণ ছটফট করা রাত্তির এখন। একাকী। নির্জন প্রহর। ভেতরে রিপুর দহন। খুনোখুনি। তীব্র নি:সঙ্গতায় পেয়ে বসেছে মন।
বাঁশঝাড়ের আগায় জোনাকির ঘর। গোরস্থানে ভূতের আলেয়া। মনজমিনে ফুঁসে ফুঁসে ওঠে গোখরো নাগিন।
আত্মদংশনে বিষাক্ত শরীর। ওঝা নেই। বৈদ্য নেই। মৃত্যুও নেই। এ যেন ভয়ংকর রসিকতা।
ফোনটা এলো বলে কিছুটা ভালো লাগছে। প্রিয় কন্ঠস্বর। কাঁপা কাঁপা। যেন লজ্জাবতী পাতার উপর এইমাত্র ঝরে পড়লো নিষ্পাপ শিশির।
কেমন আছো? এই দুটো শব্দের প্রতীক্ষায় থাকা যায় দীর্ঘ প্রহর।
ভালোলাগা টেকেনি। প্রতিকূলে ভাসে ওপারের ফোন। স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় বাওয়া দায়। ক্ষমাই প্রাপ্য। অসৌজন্য সমাপ্তির।
তুমি স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় বাওয়া মাঝি। উথালি-পাতালি ঢেউয়ে তাল রাখা কঠিন। বড়ই কঠিন। সেই কঠিনেরে ভালো বাসিলাম। পৃথিবী আর চাঁদ। মাঝে তিন লাখ চুরাশি হাজার চারশত কিলোমিটার। তবু তো মানুষ ভালোবাসে চাঁদ। তোমার দূরত্ব তার ও বেশী।
Ñ সৈকতের তীর ঘেঁষেই বসতি তোমার/ঢেউয়ে ভাসো/
ঢেউয়ে হাসো/ঢেউয়েই করো খেলা।
চোখে ঢেউ/ বুকে ঢেউ/ঢেউয়ে কাটে বেলা।
এই মুহূর্তে তুমি ঢেউয়ে করছো খেলা। আলফা লেভেলে মনের ঢেউয়ে ভাসছে তোমার অভিসার।
অভিসার!
দারুণ শব্দ। ঈর্ষাত্মক বটে। রবী ঠাকুর খোঁচা দেয়,
Ñ তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে।
অগমপার!
সত্যিইতো ।
এতো প্রতিকূলে কি করে ধরো হাল! কি করে বাও তরী! আমি পাগলপারা। ভেবে হয়রান। তুমি বিস্ময় চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছো আমার অবয়ব জুড়ে । তোমাকে কি ছোঁয়া যায়? তুমি মিষ্টি অনুভব।
জীবনানন্দ উল্টায়। জীবনানন্দে থমকে যাই। জীবনানন্দে সাঁতার কাটি…ভেসে যাই। তোমার আমার ভেতরেই যেন জীবনানন্দের বসবাস।
Ñ তোমার নিকট থেকে/যত দূর দেশে/ আমি চলে যাই/
তত ভালো।
সময় কেবলি নিজ নিয়মের মতো; তবু কেউ/
সময়স্রোতের ‘পরে সাঁকো/বেঁধে নিতে চায়;
ভেঙ্গে যায়;
যত ভাঙ্গে তত ভালো।
….. …..
….. …..
তুমি তত বয়ে যাও/আমি তত বয়ে চলি/
তবুও কেহই কারু নয়।
আহা! কবিতা। কত মায়াময়! তোমারই মতো। কেবলই চোখ বুজা অনুভব। স্পর্শহীন। গ্রহের ফারাক।
লেখালেখি গোল্লায়। বাক্যরা নির্বাসনে। শব্দরা অভিমানে। উপমা, অলংকার যেন পথ ভোলা কেউ।
মাথার ভেতরে ভ্রমর নাঁচে। কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি। তলিয়েই গেছি হয়তো। অজানা সাগরে।
মোহহীন, মায়াহীন, দাবিহীন এক গোল চক্করে ঘুরপাক খেয়ে চলি। যেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে ঘুরতে থাকা দিশাহীন কোন জাহাজ। অপারগতার বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে অসহায় নাবিক চোখ লাল আসমান পানে।
একবার কাছের একজন সব শুনে বলেছিল, এ আমার দু:খ বিলাস। হুমায়ুন থেকে ধার করা শব্দটি নির্দয়ের মতো মুখের উপর ঠাস করে বলে দেয় সে। আর আমি বুঝে যাই, অসময় কারো সাথে শেয়ার করতে নেই। চপোটাঘাত হয়ে ফেরে।
নাহ! আমার কোন দু:খ কিংবা দু:খবোধ নেই।
এক ধরণের তলিয়ে যাওয়া আছে। তলিয়ে যাওয়াকে কি দু:খ বলা যায়? জানিনা।
যে চলে গেছে অপরের মঙ্গলের দোহাই দিয়ে। আমি জানি, সেটা তার নি:শব্দ পলায়ন। কিংবা যে চলে যায় দারুণ সর্বনাশ শেষে বন্ধুত্বের বেহালা বাজিয়ে, অপেক্ষাকৃত সুন্দরের আশায়। আমি জানি, সেটা তার স্বার্থিক প্রস্থান।
সবাই পালিয়ে যায় যে যার মতো করে। অথচ আমার পালানো হয়না। পালাতে পারিনা। তলিয়ে যাই।
নাহ! কোন অভিযোগ নেই। করিনি কখনো। অপমানবোধ ও নেই।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে তলিয়ে যেতে থাকা জাহাজের কোন অভিযোগ বা অপমানবোধ থাকেনা।
যে চলে গেছে, চলে যাক/ যা বলে গেছে থেমে থাক/
স্মৃতিগুলো ধুয়ে যাক/ শুধু ভেতরের আগুনটাই রয়ে যাক/
রয়ে যাওয়া আগুন সয়ে সয়ে আমি ডুব সাঁতরে খুঁজি আশ্রয়/
খোঁজে ফিরি জেগে উঠা নতুন চর/ বন্দর….পোতাশ্রয়/
সৈকতের তীর ঘেঁষে আপন ঠিকানায় তুমি। তুমি জেগে ওঠা নতুন চর। নতুন গজানো কাশের বনে হাওয়ায় দোলা কাশফুল। কাশফুলে কি গাঁথে মালা? ঠাঁই মেলে খোঁপায়?
মনে পড়ে? এক আলো মরা সন্ধ্যায়, তোমার চোখে নেমেছিল যমুনার জল। মৃত্যুহীম শিতলতায় বদলে গিয়েছিল কপালের রেখা। কলাপসিপলের গায়ে সেঁটে ছিল তোমার বোবা চাহনি।
কি হতে পারতো সেদিন? বড় জোর একটা বুলেট।
এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিত মাটির দেহ। সবুজ ঘাসের বুকে ভেসে ওঠতো রক্তের কারুকাজ। কালো হরফে পরের দিনের কাগজের শিরোনাম।
ভয়হীন বোবা দৃষ্টি ছিল আমার। হায়েনাদের চোখে- মুখে ছিল উল্লাস। যেন মোহাম্মদি বেগের প্রেতাত্মা।
রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতা না করা এমন একজনের রক্ত শুষে নিতে তাদের কি যে লুলুপ উল্লাস! আমি জানি সেদিনের মুহূর্তটুকু তোমার চোখের তারায় লুকিয়ে আছে। হয়তো এখনো তোমার মাঝরাতে ঘুম ভাংগার কারণ হয়ে আছে সেই নির্বাক মূহুর্ত। ঘটনাটি না ঘটলে কোনদিনও তোমার চোখের জলের অনুবাদ করা হতোনা আমার।
আমি এখনো দেখতে পাই, কলাপসিপলের ফাঁক গলে তোমার দু ‘চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা। অসহায় চাহনি।
এত উৎকন্ঠা ছিল কেন তোমার? মায়া! নাকি দায়বদ্ধতা? নাকি ভালোবাসা?
যদি ভালোবাসা হয়, তবে মরেছ মেয়ে। সম্মুখে কাঁচের দেয়াল। স্পর্শহীন শুধুই অনুভব। ভাংগে কার সাধ্য।
বাঁশপাতার আগায় জমে আছে রাতের কান্না। তার ফাঁক গলে বকের গলার মতো চাঁদ। বুনো ঝোপের আড়ালে মোচড় দিয়ে ওঠে নিশাচর চতুষ্পদ।
এটা ব্যর্থ প্রহর। এই প্রহরে মনের গহীনে জমে থাকা তলানিগুলো ঘাঁই মেরে ওঠে। কান্নারা জল ডাকাতের মতো ঝড় তোলে জড়ো হয় চোখের কোণে।
নীলিমায় আধখাওয়া একাকী চাঁদ। সফেদ পর্দার আড়ালে একাকী আমি।
না মেলা হিসাবটুকুন ভাতের হাঁড়ির ফুটন্ত জলের মতো বুদবুদিয়ে ওঠে। ঢাকনি দিয়ে চেপে রাখা যায়না।
এই ফুঁপিয়ে ওঠা প্রহরে সব প্রতিরোধ ভেস্তে যায়। সব সতর্কতা সংকেতের মৃত্যু ঘটে।
যে হাত পুড়ে গেছে আগুনে। সে ক্ষত হয়তো যাবে শুকিয়ে। দাগ কি মিলায় কভু? যন্ত্রণা কি ভোলা যায়?
এটা পরাজিত সময়। এ সময়ে মিত্র থাকেনা। তবুও তুমি জেগে উঠা নতুন চর। তোমার হাতে আধেক উড়ানো আধেক ভাঁজ করা সাদা পতাকা। না পারছো উড়াতে, না পারছো গুটাতে।
অথচ, আমার কাছে তুমি মিয়ানমার সিমান্ত। শরীরে লেপ্টে থাকা সেমিজের মতো তোমার অস্তিত্ব জুড়ে লেপ্টে আছে ভয়ংকর নাসাকা বাহিনী। সীমান্ত প্রহরী অক্টোপাসের মতো খাবলে ধরে আছে আমায়। মাঝ দিয়ে বর্শার ফলার মতো নিষ্ঠুর ক্ষিপ্রতায় বয়ে চলেছে নদী নাফ।
একটা সাঁকো। একটা সেতু। পারাপারের একটা তরীর জন্য এ এক অদ্ভুত হাহাকার।
সরোদ বেহালার একটা যুগলবন্দি। কিংবা, একটা পরিপূর্ণ গীতিকবিতা।
কিন্তু এ কি সম্ভব?
ধ্বংসস্তুপের উপর কি ট্রয় গড়েছে কখনো ? ফিরেছে কি পুরোনো জৌলুস?
সংশয়! দ্বিধা! পারা না পারার কাব্য।
রড- সিমেন্ট আর ইট- সুরকির গাঁথুনিতে সাঁকো গড়ে। সাঁকো ভাংগে।
দুই দিকে তাক করা নাসাকা আর সীমান্তরক্ষীর মেশিনগান।
অতএব, এ এক অসমাপ্ত কাব্য। অমীমাংসিত সুন্দর।
এটাকে দু:খ বলেনা। দু:খের চেয়ে সীমাহীন এক আড়ষ্টতা চেপে আছে বুকে।
এটা দু:খ নয়। কষ্ট ও নয়।
এর নাম তলিয়ে যাওয়া। তলিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ:। তলিয়ে যেতে যেতে জীবনানন্দ ভেসে ওঠে মুমূর্ষু দুইচোখে –
Ñ আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের
জল, /
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! /
শুধু তার স্বাদ/
তোমারে কি শান্তি দেবে! /
আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ/
তোমারে রাখিবে ধরে, সেই দিন পৃথিবীর পরে, /
আমার সকল গান, তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অতনুর কলম থামে এখানে।
জানালার শিপন পর্দাটা দোলে ওঠে রাতের মৃদু হাওয়ায়। কড়ইয়ের আড়ালে থেমে আছে নীরব রাত। থেমে যায় অতনুর কলম। সে উঠে দাঁড়ায়। পায়চারী করে বারান্দায়।
বারান্দার লোহার গ্রীলের ভেতর উঁকি দিয়ে আছে হাসনাহেনা। মোহময় ¯িœগ্ধতায় ভরে আছে চারিপাশ। আকাশে ভাসছে আধখাওয়া চাঁদ। তার গায়ে লুটোপুটি খায় পেঁজাতুলো মেঘ। মেঘের ভাঁজে ভাঁজে ভেসে ওঠে মায়াবী অবয়ব।
অতনু আনমনে চেয়ে থাকে আকাশপানে। ফেলে আসা সময়ের না মেলা অংকের হিসাব সে মেলাতে পারেনা।
লেখার টেবিলে লুটোপুটি খায় কাগজ। ব্যাঙ্গ হাসে মুখ খোলা বলপেন। টেবিলের একপাশে লো ভলিয়্যূমে বাজে প্লেয়ার। সাগর সেন গেয়ে চলে,
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে……।
অতনু তার লেখার টেবিলে ফিরে আসে। লিখে যায়।
হাতের মুঠোয় দলাপাঁকে এ ফোর সাইজ। ঠাঁয় নেয় ময়লার ঝুড়িতে।
নাহ্!
ফেলে আসা নিজের গল্পটা তার আজও শেষ করা হলোনা।
জয়নুল টিটো, কথাসাহিত্যিক