বিভা ইন্দু
অনেক দিন পর স্কুল খুলেছে।
শিক্ষক মিলনায়তন থেকে বের হতেই কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেলাম। চারপাশের গুমোট পরিস্থিতি মনের ভেতরটাকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পঞ্চম পিরিয়ডের ক্লাস। সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরের দিকে যেতে যেতে বারবার কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুমের মুখোমুখি পর্যাপ্ত সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহী নারকেল গাছটার সামনে এসেই থমকে গেলাম।কিছু একটা হতে যাচ্ছে। পুরো বারান্দা জুড়ে ভয়ংকর গুমোট অন্ধকার। এমন রুক্ষ রুদ্র বেশ!কীসের আড়ম্বর!সে আসতে এখনও অনেক দেরি!তবুও এ কিসের আয়োজন! জানি না, আজকাল চারপাশের খামখেয়ালিপনাও চমকে দিয়ে যায় মানষের আটপৌরে জীবনকে। মোটামুটি সব ক্লাসের শিক্ষকদের ক্লাসের উপস্থিতি টের পেয়েই পা দুটোকে মনে মনে শাসন করলাম। শাসন করলাম পাঁজরের খাঁজে লুকানো মনটাকে। এতোটা ভাবকাতর হলে চলবে কী করে! ওদের এগিয়ে নিয়ে যেতে মনোযোগ বাড়িয়েছি। কাজেই এ বেলা মন হারানোর সুযোগ নেই। টপাটপ পা ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে উঠে গেলাম চারতলায়।
নারকেল গাছটিকে দেখেও না দেখার চেষ্টা করে ক্লাসে ঢুকলাম। কিন্তু এমন তর্জন গর্জন আমার চোখে না পড়লেও কানকে লুকানো গেলো না।ক্লাসে পা পড়তেই আমার কন্যারা সমস্বরে বলে উঠলো—–
আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে আমিও বললাম তোমাদের ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক।চেয়ারে বসে পাঠ্যবইয়ের পাতা উল্টিয়েই বের করলাম —-দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান ” নিবন্ধ খানি।
ক্লাসরুমের পাশেই অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একপাশে নারকেল গাছ আর অন্যপাশে কদমের ডালে থোকা থোকা কদমের সৌন্দর্য বিলাসিতা, বার বার আমার মনের গোপন দুয়ারে হানা দিচ্ছিলো।
কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলি!বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার আগেই কেমন যেন অজ্ঞান হবার দশা।
মনের মাঝে অবদমিত ইচ্ছার বিরোধী আচরন।
এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া—–
কিন্তু গত সপ্তাহের তীব্র তাপদাহের কারণে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা পুষিয়ে দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা! কী হবে বিপরীতমুখী পরিস্থিতির!ছাত্রীদের মধ্যে গুঞ্জন। কারোরই পাঠ্যবইয়ের বিজ্ঞান ও তার যাবতীয় অবদান, আয়োজনে কোন মনোযোগ নেই। নারকেল গাছটার থরহরি কাঁপন আর কদমের ডালের নুয়ে পড়বার রমনীয় আচরণ আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো তেপান্তরের মাঠে।খুব কষ্ট হচ্ছিল নিজেকে এ অবস্থায় আটকে রাখতে।মনে মনে জপছিলাম আরেকটু দেরিতে এসো।আমি আপাতত ক্লাসটা শেষ করি। অনেকদিন পর ওদের সামনাসামনি ক্লাসে পেলাম। প্রচ- তাপদাহ ও দমবন্ধ হওয়া গুমোট আবহাওয়ায় জীবনটা থেমে যাচ্ছিলো। গৃহ আবর্তে থেকে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু এ কী! হঠাৎ ক্লাসরুমে এক দৈত্যের আবির্ভাব? সাথে সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলো। সে কী! বিজ্ঞানের অবদান পড়াবো কী করে?। মাথার ওপরের পাখাটা কী থেমে গেছে! আমি বিশ্রী রকমের ঘামছিলাম। তবে কী দৈত্যের ভয়ে আমার প্রেশার সমস্যা দেখা দিলো! ক্লাসের বাতিগুলোও হঠাৎ করে নিভে গেলো। সেই বীভৎস অন্ধকারে বাচ্চাদের চিৎকার। এ মুহূর্তে বিজ্ঞান দারুণভাবে অসহায়।
দৈত্যের অবয়বে অন্ধকারের গভীরতা আমাদের চারপাশটাকে গিলে খেতে আসছে।গা ছমছমে অন্ধকার।সবুজ পাতার ফাঁকে হলুদ কদমের আধিপত্য নিস্তেজ। দেখতে পাচ্ছিলাম না কেউ কাউকে।
কন্যাদের বললাম জানালাগুলো ভালো করে খুলে দাও।যেই ওরা জানালা খুলতে গেলো অমনি সহগ্রাধিক দাঁত বের করে বিরাটকায় দৈত্যের ভয়ংকর আচরণ।কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো ম্যাএএএএএম চারপাশে কী ভয়ংকর অবস্থা!আমরা কীভাবে বাড়ি ফিরবো?কী ভয়ংকর আচরণ প্রকৃতির। মনটাকে আটকে রাখতে পারছিলাম না।মনে পড়ছিল বার বার কালো তা সে যতোই কালো হোক
আমি দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।
নিশ্চয়ই পুরোটা আকাশে সেই শ্যামা মেয়ে নেচে বেড়াচ্ছে।মেঘের হুংকার। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ।সাথে বিদ্যুৎ পরীর রূপালি আঁচলের ঝাপটা।চারপাশ যেন লন্ডভন্ড করে দেবে।জাতীয় কবি নজরুলকে মনে পড়ছে—-
মেঘের ডমরু ঘন বাজে
বিজরিয়া চমকায় আমারও মন ছায়
মনের ময়ূর যেন সাজে”।
অচিনপুরের সেই রাজপুত্রের পথ চেয়ে জানালায় উঁকি দিয়ে কতো কতো ভেবেছি—-
আহা! এমন দিনে তারে বলা যায়, এমনি ঘন ঘোর বরষায়।
সমস্ত ভাবাবেগকে উড়িয়ে দিয়ে মনোযোগ দিতে চাইলাম ক্লাসের প্রতি।কীভাবে আমার আদরের কন্যাদের সামলাবো! হৈচৈ, চিৎকার চেঁচামেচি।
ম্যাম আমাদের একটু বারান্দায় যেতে দেন প্লিজ।এমন সুন্দর প্রকৃতি! ওরা যেন বর্ষার নূপুর পায়ে দিতে চায়।আমিও মনে মনে উতলা।কিন্তু —
ঐ যে,পড়াতে নিয়েছিলাম “দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান”! কী হবে আমার রচনা ক্লাসের!কী হবে আমার আগামী সম্ভাবনার প্রাণশক্তি উচ্ছ্বসিত একদল প্রজাপতির
মনে মনে আওড়াচ্ছি।কী দরকার এতোটা শাসন ত্রাসন!খুলে দিতে পারতাম যদি এই রুদ্ধ দ্বার!
আমি ঢালিব করুণাধারা
আমি ভাঙিব পাষাণ কারা
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াবো গাহিয়া আকুল পাগল পারা।
এমন অবস্থায় কঠিন তপস্যার হেরফের হবেই।আজকের দিনের বিশাল ক্ষতিটা অন্যদিন পুষিয়ে দেবো মনে করেই চেয়ার ছেড়ে ক্লাসের দুয়ারে উঁকি দিলাম।বাতাসের দাপটে নারকেল গাছটার সফল মাতৃত্বের জয় জয়কার। এলোপাথারি বিশৃঙ্খলায় একের পর এক নারকেল নিচে পড়তে শুরু করলো।
সারা স্কুল জুড়ে হৈচৈ।অভিভাবকদের ফোন কল।
এখন কী স্কুল ছুটি হয়ে যাবে! কালবৈশাখী ঝড়ো হাওয়া। বাচ্চাদের নিরাপদে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।সব কিছু সামলে চোখজোড়া উন্মুখ ভয়ংকর সুন্দরের রূপসজ্জায়।সে কী বালি উড়ে এসে চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিলো।চোখ ঢলে ঢলে অতি উৎসাহ নিয়ে হঠাৎ আগত বিস্ময়ের পুরোটা উপভোগ করতে চেষ্টা করলাম।কদমের ডালে বিজলী পরীর লীলা।কদম ফুলসমেত ভেঙে পড়ছে ডালগুলো।সবুজ ঘাসের ওপর হলুদ কদমের আনন্দ উচ্ছ্বাস।
রূপসী মেঘবতী কন্যার আর ভেসে বেড়ানো হলো না। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে বেলিফুলের রূপ-লাবণ্যে সে শিলাবৃষ্টি রূপে স্কুলের সবুজ মাঠে গড়াগড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।দমকা হাওয়ার সাথে নাচতে নাচতে চারতলার বারন্দায় এসে গুড়ি গুড়ি আকার নিয়ে জানান দিলো—-
আমি যার নূপুরের ছন্দ বেণুকার সুর
কে সে সুন্দর কে সে সুন্দর!
হায়রে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আমার কন্যারা বরফের টুকরো কুড়াতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।আর কী ওদের শৃঙ্খলায় রাখা যায়!
সেই মুহূর্তে ইস্তফা দিলাম দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব পড়ানোয়। এবার আমি ও বিশৃঙ্খলা কমাতে পাঁচজন,সাতজন, আটজন করে ডেকে নিলাম —–
কন্যারা এসো,তবে অবশ্যই সাবধানে সুশৃঙ্খল হয়ে। পুরো বারান্দা বাতাসের ঝাপটায় শিলাময় হয়ে পড়েছে।
এসো এসো অরণ্য বালিকারা, দেখো চারপাশের
তোমাদের তেষ্টার সুখে সুখি দিগন্তের লু বাতাস
বর্ষানূপুর, মুক্তার গহনা,আর মেঘের চেলি পরে সবুজ ধরিত্রীর সৃজন ছন্দের জাদুকরী সব আচরণ—–
হঠাৎ কানে এলো ঢং ঢং ঢং। ষষ্ঠ পিরিয়ডের ঘন্টাটা একটু তাড়াতাড়িই যেন বেজে উঠল। আমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্লাসরুম ছাড়তে যাবো অমনি আমার অরণ্য বালিকাদের বহুসময় ধরে আগলে রাখা জমাট আবদার——
ম্যাম—-
প্লিজ এই গানটা একটু শোনান—-
অনেক দূরে দৃষ্টি রেখে গেয়ে উঠলাম—-
আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে।
বিভা ইন্দু, শিক্ষাবিদ, কবি ও গল্পকার