এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৩৫- আজ: রবিবার-১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৩৫- আজ: রবিবার
১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

আমিও পুলিশ ছিলাম, (দ্বিতীয় পর্ব-৫ম অধ্যায়)

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে এস আই হিসেবে যোগদান করি। তারপর ২০০০ সাল পর্যন্ত এস আই পদে বিভিন্ন জেলায় চাকরি করি। ২০০০ সালে আমি সি এম পি, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় সেকেন্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ডিসেম্বর মাসে ইন্সপেক্টর হিসেবে আমার পদোন্নতি হয় এবং আমাকে রাজশাহী রেঞ্জে পোস্টিং করা হয়। এস আই হিসেবে চাকরির স্মৃতিকথা “আমিও পুলিশ ছিলাম’’- ১ম খÐ ২০১৭ সালে ঢাকার ‘পুঁথিনিলয়’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকপ্রিয় হওয়ায় আমি ২য় খন্ড লেখায় হাত দেই। প্রথম পর্ব ছিল এস আই হিসেবে চাকরি করার কাহিনি, আর দ্বিতীয় পর্ব হল ওসি হিসেবে চাকরি করার অভিজ্ঞতা। আমি যথা সম্ভব নির্মোহ থাকার চেষ্টা করেছি যেহেতু আমার অনেক সিনিয়র অফিসারের প্রসঙ্গ এখানে এসেছে যারা এখনো চাকরিতে আছেন। পাঠকের ভাল লাগলে আমার কষ্ট সার্থক হবে। উল্লেখ্য যে, আমি ২০১০ সালে পুলিশের চাকরি ছেড়ে আমেরিকা প্রবাসী হয়েছি, আমার হাতে স্মৃতির কোন ডাইরি নেই। যতকথা যতটুকু স্মৃতিতে আছে তার উপর নির্ভর করেই লিখেছি এই স্মৃতি কাহিনি। – সনতোষ বড়ুয়া

কাউখালি থেকে বদলী

একদিন সন্ধ্যার রোল কলে জানানো হয়Ñ আমাকে কাউখালি থেকে লংগদু থানায় বদলি করা হয়েছে। আমি যেন কাল সন্ধ্যার রোল কলে লংগদু থানা থেকে অংশ নেই। অর্থাৎ কাল সকালেই আমাকে কাউখালি ছাড়তে হবে। সকাল আটায় এবং দুপুর বারটায় দুটি লঞ্চ ছাড়ে রাঙামাটি থেকে লংগদু । তার যে কোন একটি ধরতে পারলেই পৌঁছা যাবে। কী আর করা। পরদিন ভোরে রওয়ানা হলাম লংগদু।

ইতোপূর্বে কখনো রাঙামাটি লেকের ওপাড়ে যাইনি। আমার চিন্তারও বাইরে ছিল যে, রাঙামাটির শুভ লং এর পর এতবড় লেক আছে। রাঙামাটি থেকে যখন লঞ্চ ছাড়ল মনে হল বিমানে চড়ে কোথাও যাচ্ছি। শুভ লং ফলস পেরিয়ে বামে মোড় নিলে এক বিরাট লেক। জানা গেল শুভ লং থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লেক বাঘাইছড়ি পর্যন্ত। লংগদু পর্যন্ত আড়াআড়ি এই লেক প্রায় ১৪ কিলোমিটার জলে পূর্ণ থাকবে মৌসুমে। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য বলাই বাহুল্য। শুভ লং থেকে অর্ধেক পেরিয়ে গেলে লেকের মাঝামাঝি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক টিলা কাটটলি বাজার। লংগদুগামী লঞ্চ সেখানে থামে, যাত্রী নামায়, যাত্রী ওঠায়। এখান থেকে দূরে আবছা দেখা যায় লংগদু তিন টিলা, যেখানে লংগদু থানা। এক সময় আমার লঞ্চ সেই থানা ঘাটে গিয়ে থামে।

নতুন থানা ভবন, নতুন কোয়ার্টার। সবই সুন্দর কিন্তু বিদ্যুৎ নেই। থানায় জেনারেটর আছে, বরাদ্দ আছে ডিজেলেরও। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চালানো হয় থানার জেনারেটর। তারপর অন্ধকারে হারিকেনের আলো। শুনতাম আগের দিনে থানার অফিসারেরা সন্ধ্যায় থানায় আসার সময় প্রত্যেকে একটা করে হারিকেন নিয়ে থানায় আসতেন। সেই হারিকেনের আলোয় থানার কাজ চলত। এখানেও সেই অবস্থা, তবে অফিসারদের হারিকেন নিয়ে থানায় আসতে হয় না, থানায় অনেক হারিকেন আছে, সেগুলো সন্ধ্যার আগেই কেরোসিন ভর্তি করে জ্বালিয়ে রাখা হয়।
থানায় যোগ দিয়ে পরদিন পরিচিত হয়ে আসলাম আর্মি জোন কমান্ডার কর্নেল শিকদার সাহেবের সাথে, টি এন ও সুপ্রিয় কুÐ, এবং থানা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অফিসারের সাথে। পরে এদের সাথেই অনেক কাজ করতে হয় আমার। এসবের পূর্বে সকালে ঘুম ভাঙতেই মাইকে শুনতে পাই এখানে ‘’রাবেতা’’ হাসপাতালে একজন রোগীর জন্য জরুরি ভিত্তিতে ‘ও’ পজেটিভ রক্ত দরকার। আমর রক্ত ‘ও’ পজিটিভ। থানার নৌকায় চলে গেলাম সেই হাসপাতালে। পরিচয় দিয়ে বললাম- আমি থানায় কাল নতুন এসেছি। আমার রক্ত ‘ও’ পজিটিভ। আমি রক্ত দিতে চাই রোগীর জন্য। জেনে রোগীর আত্মীয় স্বজন খুবই খুশি, আমিও খুশি মনে এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে থানায় চলে আসি। সেই রোগী সুস্থ হয়ে একদিন থানায় এসে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যান। বলেছেন তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মনে রাখবেন আমার রক্ত যেহেতু তার শরীরে আছে। মনে রাখলে ভাল, না রাখলেও অসুবিধা নাই।

পাহাড়ে হত্যাকান্ড
কাউখালি চাকরি কারার সময় আমি কাউখালি হত্যাকাÐের বিষয়ে জেনেছিলাম। লংগদু এসে জানলাম লংগদুতে ঘটে যাওয়া আদিবাসী হত্যাকাÐ নিয়ে। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে আমার আগ্রহ বিধায় আমি আদিবাসীদের উপর ঘটে যাওয়া এসব তথ্য জানতে চাই। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর রাজাকারেরা যেরকম অত্যাচার আমাদের উপর করেছিল, আমাদের কিছু বাঙালিও আদিবাসীদের উপর সেরকম হত্যা নির্যাতন করেছে। এখনো পুরোপুরি হত্যা নির্যাতন বন্ধ হয়েছে তা’ নয়। মূলত সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠির উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির হত্যা নির্যাতনের ইতিহাস মানব সভ্যতার কলঙ্কজনক আরেক অধ্যায়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

অনেক আগে লংগদুতে বাঙালি হত্যার প্রতিবাদে তিন টিলার সমস্ত বাড়িঘর একযোগে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। হত্যা করা হয় নির্বিচারে। সেই কষ্ট এখনো দগদগে হয়ে আছে বেঁচে থাকা আদিবাসীদের মনে। তারা আক্ষেপের সুরে জানায়, বাঙালিদের সেই ধ্বংসযজ্ঞে বাঁধা দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরাও। তাহলে তো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের নিরাপত্তা বিধান করতে না পেরে।

আমি ওসি থাকতেও সেখানে দু’জন বাঙালির লাশ পাওয়া যায় মাইনী খালে। সেনা বাহিনীর সদস্য ও আমরা গিয়ে সেই লাশ উদ্ধার করি। কিন্তু এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেওয়ায় সেনা জোন কমান্ডার , টি এন ও সাহেব এবং আমি নিহতদের পাড়ায় গিয়ে সাথে সাথে এক জরুরি শান্তি সভার আয়োজন করি। জোন কমান্ডার কর্নেল শিকদার সাহেব আমাকে বললেন- ভার্সিটি লেখাপড়া করার সময় নিশ্চয় রাজনীতি করেছেন। এখন যেভাবেই হোক বাঙালিদের মনোভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নেতাদের মত করে একটা উত্তেজিত বক্তৃতা যেন আমি বাঙালিদের উদ্দ্যশ্যে দেই, যাতে ওরা শান্ত থাকে। আমিও সেভাবেই বাঙালি ভাইদের মধ্যে দেখা যাওয়া উত্তেজনা প্রশমন করার জন্য তাদের উত্তেজনার ভার আমাকে দেবার আহŸান জানিয়ে তীব্র ভাষায় নিরীহ বাঙালি হত্যার নিন্দা করে বক্তব্য প্রদান করি। আর জোন কমান্ডার তাৎক্ষনিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে অনুদান প্রদান করেন। বুঝলাম এ ধরনের ঘটনার পর সেনা বাহিনী, পুলিশ আর স্থানীয় প্রশাসন যদি একযোগে এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্যোগ নেয়, তাহলে পরিস্থিতি কোনভাবেই আর বিপজ্জনক অবস্থায় যায় না। আমি দেখেছি বাঙালি হত্যাকাÐের জন্য বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও সেই ক্ষোভে দাঙ্গা সংগঠিত হয়নি। একটু খবর নিলে দেখা যাবে যেসব বড় বড় হত্যাকাÐ পাহাড়ে সংগঠিত হয়েছে সেখানে কোন না কোন ভাবে সেখানে কর্মরত বাহিনী সমূহের গাফেলতি ছিল।

এর মধ্যে আমার সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে লংগদুর হরটিকালচার অফিসার সামাদ সাহেবের সাথে। তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আমিও । তিনি আবার সবার সাথে মিশতে পারেন না। কিন্তু আমার সাথে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বোধ করতেন। সামাদ সাহেবের সাথে মিশতে মিশতে উদ্যানতত্ত¡ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা শুরু করেছিলাম। একদিন সাজেক ভ্যালির কমলা এনে তিনি উপজেলার সকল অফিসারকে দাওয়াত দিলেন কমলা খাওয়ার। আমার কমলা খেয়ে কমলার বিচি ফেলি আর তিনি সাথে সাথে পুঁতে দিচ্ছেন প্লাস্টিক ব্যাগের মাটিতে। জানতে পারলাম কমলার বিচি শুকিয়ে যাবার আগেই মাটিতে পুঁতে দিতে হয়, তাহলে গাছ ও ফলন ভাল হয়। একদিন দেখিয়ে দিলেন কীভাবে দেশী আমের চারার সাথে ভাল জাতের আমের কলম করতে হয়।

এ সময় রাঙামাটির এস পি হুমায়ুন স্যার রাঙামাটিতে পুলিশ লাইনের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় বিরাট এক ফলদ এবং বনজ বৃক্ষের বাগান গড়ে তুলছিলেন। তিনি আমার কাছে চাইলেন লিচু গাছের চারা। আমি হরটিকালচার অফিসার বন্ধু সামাদ সাহেবের কাছ থেকে অনেক লিচু গাছের চারা কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম এস পি সাহেবের ‘সুখি নীলগঞ্জ’ প্রজেক্টে। পাঠিয়েছিলাম তিন চারশ কলা গাছের চারাও। হুমায়ূন স্যারের মত বৃক্ষপ্রেমী মানুষ আমি তেমন দেখিনি। তিনি যতই বদ মেজাজি হোক না কেন, তাঁর জন্য আমার অনেক শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা থাকবে রাঙ্গামাটির ‘ সুখি নীলগঞ্জ “প্রজেক্টের কারণে। প্রায় ত্রিশ হাজার নানা জাতের বৃক্ষ তিনি রোপণ করেছিলেন সেই বাগানে। যে কারণে ‘পি পি এম-সেবা’ পদক পেয়েছিলেন। এই বাগানের সাথেই তিনি বেঁচে থাকবেন অনেকদিন আমাদের মনে, রাঙ্গামাটিবাসীর মনে।
এক সময় লংগদু বদলি হয়ে আসেন আমার আরেক প্রিয় বন্ধু কৃষি অফিসার কেশব লাল দাশ। লংগদুর টি এন ও সুপ্রিয় কুÐু, হরটিকালচার অফিসার সামাদ ভাই, কৃষি অফিসার তিন জনই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ছাত্র। আর তিনজনই আমার প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হলেন লংগদুতে। কারণ হল আমার চট্টগ্রাম কলেজের অনেক সহপাঠী ছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

গানের আড্ডা, আড্ডার গান-

লংগদুতে আমি আর টি এন ও সুপ্রিয় কুÐু আমারা দুজনই ছিলাম গান পাগল। সেকারণে নানা সময়ে নানা উছিলায় গানের অনুষ্ঠান হত। সাথে যোগ দিতেন থানা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, কৃষি অফিসার কেশব লালা দাশ, থানা মিহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, বি আর ডি বি অফিসারও। এরমধ্যে দুটি ঘটনা না বললেই নয়। একদিন রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। তখনও কৃষ্ণকীর্তন চলছিল মায়ানী বাজারের পাশে হিদু মন্দিরে। হঠাৎ জানালায় ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কে? বলতেই শুনলাম’ আমি টি এন ও, ও সি সাহেব ওঠেন ওঠেন। আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম এত রাতে টি এন ও সাহেব এসে জানলা দিয়ে আমাকে ডাকছেন কেন? তারপরই তিনি বললেনÑ শুনতে পাচ্ছেন কীর্তনের সুর? বললাম হ্যাঁ, শুনছি তো! টি এন ও সাহেব বললেন তাহলে আর ঘুমিয়ে লাভ নেই, চলেন সেখানে যাই। স্পিডবোট থানার ঘাটে প্রস্তুত আছে। আমি আধো ঘুমে আধো জাগরণে রওয়ানা হলাম। আমরা যখন মন্দিরে গিয়ে পৌঁছলাম তখন কীর্তনিয়ারা গান শেষ করে ¤্রদিাঙ্গ করতাল নিয়ে বিদায় হচ্ছেন মঞ্চ থেকে। এসময় তাঁরা আমাদের দেখে থমকে গেলেন। মন্দিরের লোকজন আমাদের বসার ব্যবস্থা করলেন। টি এন ও সাহেব বললেন- কীর্তন তো শেষ। তবে, আমারা বসতে পারি যদি আমদের কয়েকটি পদাবলি শোনানো হয় । রাত বারোটার পর মাইকে গান বাজানো ঠিক হবে না। আমারা বললাম- মাইকে বাজানোর দরকার নাই। মাইক ছাড়া গাইলে আমরা বসে বসে শুনব। গায়করা তাই করলেন। কী মজা করেই না আমরা সেখানে উপস্থিত অন্যান্য লোকজন সহ গভীর রাতে পদাবলী শুনলাম। রাধা যেন পুনরায় কুঞ্জ সাজাল কৃষ্ণের জন্য।

অন্য ঘটনা আরও মজার। পূর্ণিমা রাত, জ্যোৎস্না ভেসে যাচ্ছে লংগদু লেকের জলে। এই আয়োজনও ছিল টি এন ও সাহেবের। সাথে ছিলেন কৃষি অফিসার কেশব লাল দাস দাদা। ফিসারি অফিসের বোট সাজানো হয়েছে শতরঞ্জি আর বালিশ দিয়ে। মাঝখানে রাখা আছে হারমোনিয়াম আর তবলা। গায়ক হলেন লংগদুর গানের শিক্ষক আশিস বড়ুয়া, যিনি একনাগাড়ে অনেক গান গাইতে পারেন। কাটিয়ে দিতে পারেন পুরো রাতও। এক সময় আমরা উপজেলার অফিসারেরা গিয়ে সেই ইঞ্জিনচালিত বোটে উঠলাম। লেকের মাঝ বরাবর গিয়ে বোট থামল, বন্ধ করা হল ইঞ্জিন। শুরু হল গান। গানে মশগুল হলাম আমরা। বাতাসে বোট কোনদিকে যাচ্ছে সেই ভাবনা ভাবার অবসর কই আমাদের! রাতের বেলা কোন বোট চলে না লেকের জলে। শুধু আমরাই আছি গানের ভেলায়। লেকে ভাসা গানের আসর জীবনে আর কোনদিন পাব কিনা জানি না। রাতের শেষ প্রান্তে কোন এক সময় গান শেষ হলে পুনরায় ইঞ্জিন চালু করে আমরা ফিরে আসি লংগদু ঘাটে। ভরা জ্যোৎস্নায় লেকের জলে ভেসে থাকা আর গান শোনার কী যে আনন্দের সেটা আমার দুর্বল গদ্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

একজন নারী পুলিশ ও অন্যান্য

লংগদু থানায় একজন নারী পুলিশ ছিল। আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, আমি যেদিন রাজশাহী রেঞ্জ থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ডি আই জি অফিসে যোগদান করেছিলাম সেদিন সেখানে এক বিয়ের ঘটনা ঘটেছিল। সারদা প্রশিক্ষণকালে একজন ক্যাডেট এস আই এক নারী ট্রেইনি কনস্টেবলের প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষ হবার পর ঐ অফিসার সেই নারী কনস্টেবলকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। এ বিষয়ে ডি আই জি মহোদয়ের কাছে নারী পুলিশ সদস্য লিখিত অভিযোগ করলে দুজনকেই তলব করা হয়েছিল ডি আই জি কার্যালয়ে। ডি আই জি সাহেব বলেছিলেন হয় তাকে বিয়ে করতে হবে, নইলে বিভাগীয় মামলা ফেস করতে হবে। অভিযুক্ত এস আই সেদিনই ডি আই জি কার্যালয়ে বিয়ে করে ফেলেন সেই নারী পুলিশ সদস্যকে। উপস্থিত সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়েছিল। কিন্তু সেই মিষ্টি যে একসময় আর মিষ্টি থাকবে না সেটা আমি সেদিনই বুঝেছিলাম। কারণ চাপের বিয়েতে সুখ আসে না।
একদিন আমি রাঙামাটিতে এস পি হুমায়ুন স্যারের কক্ষে কোন এক বিষয়ে স্যারের সাথে আলাপ করছিলাম। তখন সেখানে নতুন যোগদান করা এক নারী কনস্টেবলকে হাজির করা হয়। আর.ও সাহেব সেই নারী কনস্টেবলকে নিয়ে যাবার পর আমি এস পি হুমায়ুন স্যারকে সেই বিয়ের গল্প বলেছিলাম এবং জানিয়েছি এই নারী কনস্টেবলের স্বামী লংগদুর পাশের থানা বাঘাইছড়ি কর্মরত আছেন। এস আই স্বামী, স্ত্রী কনস্টেবলের খবারাখবর না রাখায় তিনি রাঙামাটি বদলি হয়ে আসেন। এস পি সাহেব ঘটনা শুনেই নারী কনস্টেবলকে আমার লংগদু থানায় পোস্টিং করে দিলেন, বললেন – যদি পারি তাহলে যেন ওদের সংসারে শান্তি আনার ব্যবস্থা করি। সেই মতে আমি ও বাঘাইছড়ি থানার ও সি অনেক চেষ্টা করেছিলেম, কিন্তু পারিনি। মেয়েটি লংগদুতে একাকী থাকত এ এস আইদের একটি কোয়াটারে। স্বামী পাশের থানায় থাকলেও কখনো আসত না। দিনে দিনে মেয়েটি অন্য রকম হয়ে যেতে থাকে। মাঝে মধ্যে আমার সান্তনা দেয়া ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। থানার দক্ষিণ পাশে যেখানে থানার গোলঘর (ছনের ছাউনী গোলাকৃতি ঘর যেখানে মাঝে মধ্যে আমরা বসি, সভাও করি) তাঁর নিচে গভীর খাদ। অনেক নিচে লেকের জল। একদিন এক কনস্টেবল এসে আমাকে জানাল সেই নারী কনস্টেবল প্রায়ই সেই গোল ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যদি ওখান থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে তাহলে বিপদ হয়ে যাবে। কারণ সেই নারী কনস্টেবল আর সুস্থ নাই। একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমিও। সাথে সাথে এস পি সাহেবের সাথে ফোনে কথা বলে বিস্তারিত জানালাম এবং লংগদু থেকে বদলি করে সদরে নিয়ে যাবার অনুরোধ করলাম। এস পি সাহেব আমার কথা শুনেছিলেন, এবং সেই নারী কনস্টেবলকে বদলি করে সদরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি লংগদু থেকে সদরে পাঠানোর সময় দু’জন কনস্টেবল দিয়ে স্কট দিয়েছিলাম, যাতে পথে কোন বিপদ না ঘটে।

এরপর আরেকদিন এস পি সাহেবের অফিসে থাকা অবস্থায় দেখি রাঙামাটিতে সদ্য যোগদান করা দু’জন মহিলা কনস্টেবলের বাড়ি আমার ফটিকছড়ি থানায়। তার মধ্যে সাকলী বড়ুয়া আমার গ্রামের মেয়ে এবং সম্পর্কে আমার ভাতিজী, আরেকজন পাশের গ্রামের। আমি এস পি সাহেবকে অনুরোধ করলাম তাদের যেন সদরে রাখা হয় এবং একটু দেখেশুনে রাখা হয়। তিনি সাথে সাথেই দুজনকে আমার থানায় পোস্টিং করে দিলেন এবং বললেন- আপনার থানায় ওদের পোস্টিং করে দিলাম, আপনিই ওদের দেখেশুনে রাখতে পারবেন। ওরা যোগদান করার দু’দিন পরই দেখি আরও একজন মহিলা কনস্টেবল পোস্টিং করা হল। আমি এস পি সাহেবকে ফোনে বললাম এত নারী কনস্টেবল দিয়ে আমি কি করব? তিনি বললেনÑ আমার মাথায় বুদ্ধি কম তাই বুঝতে পারছি না। এস পি সাহেবের কথা হল যদি শধু দু’জন নারী কনস্টেবল থাকে, তাহলে একজন ছুটিতে গেলে অন্যজন একা কীভাবে থাকবে? সে কারণে তিনজন দেয়া হল। দুজনকে একসাথে ছুটি দেয়া যাবে না। ওরা একজন একজন করে ছুটিতে যাবে। বুঝতে পারলাম এস পি সাহেব অনেক কিছুই চিন্তা করেন। এ কথাও জানিয়ে দিলেন যে, আমার থানায় ‘ গন্দম’ পোস্টিং করা হয়েছে, আমি যেন সতর্ক থাকি এ বিষয়ে। আসলেই এদের নিয়ে লংগদুর মত মফস্বল এলাকায় আমার সব সময় সতর্ক থাকতে হত। আমি এখন আর পুলিশে নেই, কিন্তু তারা তো আছে। তাদের জন্য আমার শুভ কামনা এখনো ।

আবারও হত্যাকান্ড

আমি লংগদু থাকতে সেখানে ২০০৩ সালে স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। উপজেলা কনফারেন্স হলে ভোটের ফলাফল সংগ্রহ করা হচ্ছিল। কিন্তু সব কেন্দ্রের ফলাফল এসে গেলেও দুরবর্তী একটি কেন্দ্রের ফলাফল না আসায় ফলাফল রাঙামাটি পাঠানো যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় সেই কেন্দ্রের সাথে বেতারযোগেও যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় সেখানে রাতের বেলাতেই ব্যাটালিয়ন পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স পাঠানো হয়। তারা সেখানে গিয়ে কেন্দ্রের ফলাফল সহ নির্বাচন কাজে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপজেলা সদরে নিয়ে আসেন মধ্যরাতে। ঘটনা হল সেই কেন্দ্রে মাত্র ৩ ভোটে ইউ পি ডি এফ এর সদস্য প্রার্থী হেরে গিয়েছিল শান্তি চুক্তির পক্ষের প্রার্থীর কাছে। সে কারণে সেখানে সেই ভোটের ব্যালট দুইবার গননা করতে হয়েছিল। তারপরও সমাধান না হওয়ায় উপজেলায় উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে আবারও গণনা করা হয় এবং শান্তি চুক্তির পক্ষে প্রার্থীকে যথানিয়মে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচনের কয়েকদিন পরই একদিন সকালে থানায় সংবাদ আসে সেই বিজয়ী ইউ পি সদস্যকে প্রতিপক্ষ গুলি করে হত্যা করেছে। আমি ঘটনাস্থলে যাই এবং সেই ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসি। তদন্তকালে সেই বাড়ির লোকজন জানায় যে, দুষ্কৃতিকারীরা তাকে হত্যা করার জন্য বাড়িতে আক্রমণ করলে তিনি বাঁশের ঘরের ছপ্পরে ( ছাদ) উঠে যান, কিন্তু রক্ষা হয়নি। লোকটি প্রাণ ভয়ে ছপ্পরে উঠে গেলে দুষ্কৃতিকারীরা সেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে লোকটি ছাদ থেকে লাফ দিলে তাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কী নির্মম! অথচ একসময় তারা একসাথে যুদ্ধ করেছিল পার্বত্য এলাকার স্বাধিকারের জন্য। আজ তারা পরস্পর পরস্পরের শত্রু। বিশ্বে অনেক বিপ্লবের ইতিহাসই এরকম।

পার্বত্য জেলা থেকে বদলী

এরপর একদিন রাঙামাটি পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে ফোন করে জানানো হল, রাঙামাটিতে আমার প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। সিনিয়র হিসেবে বদলি হতে হবে। এও জানানো হল- একটি নমিনেশন খুলনা রেঞ্জে, অপরটি সিলেট রেঞ্জে। আমি কোথায় যেতে ইচ্ছুক? আমি চাকরি জীবনের শুরুতেই সিলেট এলাকায় চাকরি করেছি। তাই সিলেটই যেতে চাইলাম। খুলনা অনেক দূর, তাছাড়া সিলেট এলাকা এক সময় চট্টগ্রাম রেঞ্জের আওতায় ছিল। যাতায়াতও সুবিধাজনক। আমার আগ্রহ বা সম্মতিতে একদিন আমার বদলির আদেশ আসল সিলেট রেঞ্জে। কিন্তু পার্বত্য এলাকা থেকে সমতলে যাবার আনন্দ আমার কিছুদিনের মধ্যেই চুকে যায়। কারণ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, তখন পুলিশের পোস্টিং ক্ষমতা বিশেষ করে ও সি দের পোস্টিং করার ক্ষমতা আসলেই আর সিনিয়র পুলিশের অফিসারদের হাতে ছিল না। ২০০১ সালে বি এন পি ক্ষমতায় এসে সেই দায়িত্ব স্থানীয় এম পি / মন্ত্রীরা নিয়ে নিয়েছেন। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী তখন জেলা/ উপজেলার নানা পদে অফিসারদের পোস্টিং হচ্ছে। ব্যাতিক্রম ছিল না থানার ও সি পদের পোস্টিংও। সেই অবস্থা এখনো বহাল আছে মর্মে জানি। কারণ ধান্ধায় সব দলের নেতার খাসলত মূলত একই। বি এন পি’র নেতা মন্ত্রীরা আমাদেরকে সংখ্যালঘু হিসেবে আওয়ামী লীগের লোক মনে করে। সে কারণে সিলেটে গিয়ে আমাকে ইন্সপেক্টরের জন্য অগুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতে হয়। সেই প্রসঙ্গ আমি মৌলভীবাজার পর্বে উল্লেখ করব।

সিলেট রেঞ্জ কার্যালয়ে যোগদান-

সাত দিনের যোগদান ছুটি শেষে একদিন সিলেট সদরে রেঞ্জ কার্যালয়ে যোগদান করলাম। তখন সিলেটে রেঞ্জ ডি আই জি ছিলেন জনাব মাহফুজুর রহমান। প্রধান সহকারী বিস্তারিত জানালেন, যার সারমর্ম হল নেতাদের মনোনয়ন বা পছন্দ ছাড়া কোন থানায় পোস্টিং সম্ভব নয়। আমি ইতোপূর্বে মৌলভীবাজার জেলায় চাকরি করলেও বি এন পি’র কোন নেতার সাথে আমার তেমন পরিচয় হয়ে ওঠেনি।

৭১ এর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ

হোসাইন আনোয়ার ১৯৭১ সাল ১৪ ডিসেম্বর দিয়েই শুরু করছি। ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে লে. জেনারেল নিয়াজী ফোনে রাওয়ালপি-িতে সামরিক বাহিনীর প্রধান সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আবদুল হামিদকে

সেকাল ও একালের চট্টগ্রাম

মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি   নদী—পাহাড়—সাগর, অবারিত মাঠ, সবুজ— সোনালি ফসলের ক্ষেত, বৃক্ষরাজি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রাকৃতিক ভান্ডার—শ্বাশত বাঙালিয়ানার অফুরন্ত উৎস। সকালের সোনা মাখা হলুদ নরম

আমি শ্রাবণ!

সৈয়দ মনজুর কবির   মাস খানেক হলো হামিম সাহেব সিরাজগঞ্জের এডিসি হয়ে এসেছেন। শহরের ভেতর সরকারি বাড়ি। দুসপ্তাহ আগে পরিবার নিয়ে এসেছেন। পরিবার বলতে স্ত্রী