এখন সময়:রাত ৯:৪৫- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:৪৫- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

একজন তারা ডাক্তার

রোকন রেজা

ভয়ানক নিরবতা তখন।
তারা ডাক্তার খুবই সতর্কতার সঙ্গে কাচের জগ থেকে কাচের গøাসে পানি ঢাললেন। তারপর গøাসের স্বচ্ছ পানির দিকে অনেকটা সময় ধরে তাকিয়ে রইলেন। দেয়ালঘড়িতে তখন সন্ধ্যে সাতটার মতো বাজে।
তাঁর যে খুব পিপাসা লেগেছে, তা নয়। এইসময়, ঠিক এইসময় তিনি ভেতরে আসতেন। মমতা একটা পিরিচে করে টোস্ট বিস্কুট সাজিয়ে রাখত। ঝকঝকে কাচের গøাসে করে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসত। তারা ডাক্তার বিস্কুট খেতে খেতেই মমতা চা নিয়ে আসত। ডাক্তার বাকি বিস্কুটটুকু চা’য়ের মধ্যে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেতেন আর দু’একটা টুকটাক কথা বলতেন। সারাদিনের মধ্যে এই সময়টুকুই খুব প্রিয় ছিল তাঁর। এই সময়টার তিনি মনে মনে একটা নামও দিয়েছিলেন। কী নাম দিয়েছিলেন তিনি? সেটা একমাত্র তারা ডাক্তারই জানেন।
টোস্টের একটা প্যাকেট কেনা হয়েছে দু’দিন আগে। ভাঙা হয়নি এখনও। চিত্রাকে বললেই ভেঙে দিয়ে যায়। কিন্তু কেন জানি চিত্রাকে বলতে একবারেই ইচ্ছে করল না তারা ডাক্তারের।
ছোট ছেলে সাকিবের বউ চিত্রা ইদানীং তাঁকে এড়িয়ে চলছে। কেন চিত্রা তাঁকে এড়িয়ে চলছে তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। চিত্রা এখন আর ঘরে খাবারও দিয়ে যায় না। টেবিলেই ঢাকা দিয়ে রাখে। ডাক্তারের যখন ইচ্ছা হয় তখন টোবলে গিয়ে খেয়ে আসেন। মাঝে মাঝে টেবিলেই আসেন না তিনি। চিত্রা তার মেয়েকেও এখন আর তাঁর কাছে খুব একটা ঘেঁষতে দেয় না।
ছোট ছেলে সাকিবের লেখাপড়াটা বেশিদূর এগোয়নি। এখানকার বাজারেই ভূষিমালের বড় দোকান। সারাদিন দোকানেই ব্যস্ত থাকে সে। দোকানের হিসাব নিকাশ মিলিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়ই তার রাত হয়। একদিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তার বউ চিত্রা মশারির খুঁট লাগাতে লাগাতে বলল, তোমার বাপ কেমন করে জানি তাকায় আমার দিকে। আমার ভয় করে। আমি আর একা একা ওঘরে যাব না। খাবার দিতে হয় তুমি দিও। আমি আর না।
কথা শুনে সাকিবের রেগে যাবার কথা। কিন্তু রাগল না। ঘুমাতে না এসে ঝিম মেরে বসে থাকল সোফায়। চিত্রা মজা পাবার ভঙ্গি করে বলল, মা মরার পর থেকে তোমার বাপের মাথা বোধহয় ঠিক যাচ্ছে না। শুনেছি বুড়ো হলে পুরুষ মানুষের ভীমরতি ধরে। তোমার বাপেরও নিশ্চয় ধরেছে।
সেই থেকে চিত্রা আর শ্বশুরের ঘরে ঢোকে না।
তারা ডাক্তারের বড় ছেলে রাকিব ইঞ্জিনিয়ার। কুমিল্লায় পোস্টিং। মা’র মৃত্যুর দিন বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছিল। রাত থেকে পরেরদিন চলে গেল। যাবার সময় চিত্রার হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে গেল আর বলে গেল বাবার প্রতি যেন খেয়াল রাখে। চলে যাবার মুহূর্তে বড় ছেলের বউ পা ছুঁয়ে যখন সালাম করতে এলো কেন জানি কোথা থেকে তারা ডাক্তারের চোখে একরাশ পানি এসে গেল। ডাক্তার ছোট নাতনিটির মাথায় হাত রেখে বললেন, আবার এসো দাদুভাই।
রাকিব বাবার চোখের দিকে তাকাল না। কেন তাকাল না কে জানে! তাকালে কি মায়া বাড়ত! বাবার প্রতি এখনও কি কোনো মায়া অবশিষ্ট আছে তার!
তারা ডাক্তার এটা নিশ্চিত জানেন যে বড় ছেলে রাকিব আর আসবে না। আসবার মতো সময় তার হবে না। ওরা আবার আসবে তাঁর মৃত্যুতে। তাই তিনি মনে মনে এটা ভাবলেন যে জীবিত থাকতে এটাই হয়তো ওদের সাথে তাঁর শেষ দেখা। সরাসরি শেষ কথোপকথন।
তারা ডাক্তার চেয়ার টেনে বসলেন। ধীরে ধীরে গøাসের পানি শেষ করলেন। গøাসের পানি শেষ করে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। জানালার ওপাশে দু’ঝাড় রজনীগন্ধার গাছ হয়েছে। তাতে এখন ফুল এসেছে। এই ভর সন্ধ্যাতেই সুবাস ছড়াচ্ছে ফুলগুলো। তারা ডাক্তার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নিশ^াসে সুগন্ধ নিলেন ফুলের। আর ঠিক সেইসময় তাঁর বুকের মাঝখানে যেন একটা ছেঁড়া ছেঁড়া দুঃখ হঠাৎ করেই খলবলিয়ে উঠল। বড়ই নিঃসঙ্গ অনুভব করতে লাগলেন তিনি। তাঁর খুবই একা একা লাগতে লাগল। ফুলের গন্ধ কি মানুষকে আবেগতাড়িত করে! অতীত মনে করিয়ে দেয়!
কোনো কোনোদিন দুপুরের দিকে তারা ডাক্তার গৌরিপুরের এক মহিলার সাথে চেম্বারে বসে গল্প করেন। তাঁর ছোট ছেলে সাকিব এই মহিলা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছে। তার বয়স ৩৫/৪০ এর কোঠায়ই হবে হয়তো বা। অসহায় এই মহিলার স্বামী দুইবছর আগে রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে। এক ছেলে মোটর গ্যারেজে কাজ করে। রাতে সে সেখানেই থাকে। মা’র কোনো খোঁজখবর সে রাখে না। আরেক ছেলে নিরুদ্দেশ।
এই মহিলাকে গৌরিপুরে চারশতক জমি কিনে দিয়েছেন তারা ডাক্তার। সেখানে টিনসেডের দুইরুমের ঘরও তুলে দিয়েছেন তিনি। তাছাড়া এই মহিলা প্রায়ই তারা ডাক্তারের চেম্বারে বসে থাকে। সাকিব তাই মনে মনে এটা ভেবে নিয়েছে যে তার বাপ তারা ডাক্তার নিশ্চয় এই মহিলাকে খুব শিগগিরিই বিয়ে করতে যাচ্ছে।
আজ শুক্রবার। শুক্রবারে কাজের ছেলেটার ছুটি থাকে। সাকিব তাই একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফেরে। সাকিব বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখল বাবার ঘরে আলো জ¦লছে। তার মানে বাবা জেগে আছে অথবা আলো বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
সাকিব বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। বাবার কন্ঠের চাপা হাসির আওয়াজ পেল। বাবা একা একাই হাসছেন। বাবা কি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাচ্ছেন! একজন মানুষের শূন্যতা আরেকজন মানুষকে কি এতটাই উতলা করে দিচ্ছে! দরজা ধাক্কা দেবার আগেই তারা ডাক্তার মোলায়েম কন্ঠে ডাকলেন, ভেতরে এসো সাকিব।
সাকিব ঘরের মধ্যে ঢুকে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিছুই বলতে পারল না। তারা ডাক্তার সাকিবের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, কৌতুকের একটা বই পড়ছিলাম। মজার মজার কৌতুক। বড়ই হাস্যকর। তুমি কী একটা শুনবে? একরাজা…
না বাবা আমি কৌতুক শুনতে আসিনি। আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে এসেছি।
তুমি কি বলবে সেটা আমি জানি। কথাটা বলে তারা ডাক্তার তীক্ষèচোখে তাকালেন ছেলের চোখের দিকে। সাকিব চোখে-মুখে গাঢ় বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, আপনি জানেন!
হ্যাঁ, জানি। তুমি জানতে এসেছ আমি গৌরিপুরের ঐ মহিলাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি কিনা। একটু থামলেন তারা ডাক্তার। তারপর বললেন, কী আমি কি ঠিক বলেছি?
সাকিব বড়ই আশ্চর্য হলো। তার গলা শুকিয়ে যেতে লাগল। সে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে। তারা ডাক্তার বললেন, বিয়ে করব কিনা এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। তার কিছু সমস্যা আছে। সমস্যা কাটলে ঐ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করব।
তারা ডাক্তার আবারও থামলেন। ছেলের প্রতিক্রিয়া বুঝবার চেষ্টা করলেন। কিছুই বুঝতে পারলেন না। চোখের চশমাটা নামিয়ে খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে তিনি বললেন, তুমি এতরাত করে বাড়ি ফিরো না। তোমার সঙ্গে টাকা-পয়সা থাকে। কখন কী হয় বলা যায় না।
সাকিব ঘর থেকে বেরুবে কি না বুঝতে পারল না। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আহত গলায় সে বলল, বাইরে আপনার বড়ই দূর্নাম হচ্ছে।
হওয়াটাই স্বাভাবিক। দূর্নাম বাতাসের আগে আগে ছড়ায়। সুনাম ছড়ায় না। মানুষ মন্দ কথা বলে আনন্দ পায়। ভালো কথা বলে আনন্দ পায় না। ভালো কথায় আনন্দ নেই।
কথাগুলো একনিশ^াসে বলে তারা ডাক্তার থামলেন। হাতের বইটার মধ্যে ছোট একটা কাগজ ঢুকিয়ে বন্ধ করলেন। তারপর হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন তিনি। বললেন, তুমি যাকে বিয়ে করেছ তুমি কি তার বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানো?
সাকিব হঠাৎ এই প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কিছুটা যেন ঘাবড়ে গেল। কী বলতে চায় তার বাবা। নিজের অপরাধ ঢাকতে অন্যের দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে চায়।
হাতের বইটা বিছানার ওপর রাখতে রাখতে তারা ডাক্তার বললেন, তুমি বোধহয় জানো তোমার নানা শ^শুরের অনেক জমি-জমা ছিল। দশ গ্রামের লোক তাকে একনামে চিনত। তাঁর অনেক নাম-ডাক ছিল। কিন্তু একটা সময় তিনি তাঁর সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করতে লাগলেন। কেন বিক্রি করতে লাগলেন জানো? কারণ তাঁর একটা দোষ ছিল। খুবই খারাপ একটা দোষ।
এই পর্যন্ত বলে তারা ডাক্তার আবার থামলেন। সাকিবের মুখের পানে চেয়ে নরম কন্ঠে বললেন, এসব কথা শুনতে তোমার এখন ভালো লাগছে না। তুমি যাও। বিশ্রাম করো। অনেক রাত হলো।
তারা ডাক্তার মনে মনে অনেকগুলো কথা গুছিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তা বলতে পারলেন না। তিনি বলতে পারলেন না তোমার নানী শ^াশুড়িকে যাত্রাদল থেকে জোর করে তুলে এনেছিলেন তোমার নানা শ^শুর। তুলে এনে বিয়ে করেছিলেন। তখন তোমার শ^াশুড়ির বয়স ছিল নয়। সেও তখন তার সঙ্গেই যাত্রাদলে ঘুরে বেড়াত। চিত্রা তোমাকে আমার সম্পর্কে কিছু ভয়ংকর কথা বলেছে। শুধুমাত্র গান-বাজনা করা বাড়ির মেয়েরাই এসব কথা বলতে পারে।
কিন্তু তারা ডাক্তার এসব কথা বলতে পারলেন না। তাঁর সূ² রুচিবোধে আটকে গেল। বাপকে নিয়ে ছেলে সারাজীবন থাকবে না। থাকবে বউ নিয়ে। তিনি এখন বোঝেন বউ’য়ের চেয়ে আপন পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
কোনোদিন কোনোদিন মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ তারা ডাক্তারের ঘুম ভেঙে যায়। তখন ঘরের বাতি জ¦ালিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। নিজেকে তখন একেবারেই নিরাত্মীয়, স্বজনহীন মনে হয়। মনে হয় এই বিরাট পৃথিবীতে তিনি বহুকাল ধরে একা। আশ্চর্যভাবে নিঃসঙ্গ। তিনি তখন বিছানায় উঠে বসেন। নিজের নিশ^াস নিজের কাছেই কেমন ভৌতিক মনে হয়। জানালা খুলে দিয়ে তিনি তখন রাত্রির নিস্তব্ধতা দেখেন। আবার কখনো কখনো দেখেন কৃষ্ণপক্ষের বিষাদময় গাঢ় অন্ধকার।

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে