আলম খোরশেদ
জন্মেছিলেন নরেন নামে, ১৮৮৭ সালে, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণায়, এক বামুন পন্ডিতের ঘরে। কিন্তু পাড়াগাঁর সেই গরীব-গুর্বো, ভেতো ছেলেটিই কালক্রমে ধুতি-পৈতে ছুড়ে ফেলে, মানবেন্দ্রনাথ, সংক্ষেপে এম. এন. রায়, নাম ধারণ করে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন একজন ডাকসাঁইটে, সত্যিকারের ভুবন-বিপ্লবী হিসেবে।
এম. এন. রায়ের কথা প্রথম জানতে পারি তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী, যশস্বী লেখক শিবনারায়ণ রায়ের লেখার মাধ্যমে। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার দীর্ঘ প্রবাস-জীবনে ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর আরেক অন্ধ অনুরাগী, প্রবীণ বিদ্যোৎসাহী জনাব আবদুল মালেকের সঙ্গে, যাঁর মুখে এম. এন. রায়ের রোমাঞ্চকর জীবনের নানা খুঁটিনাটি তথ্য জেনে তাঁর ব্যাপারে প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠি। তিনি তখন নিজেই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বহুভাষী ও বহুপ্রজ, সুলেখক এম. এন. রায়ের বেশ কিছু গ্রন্থ, যার মধ্যে অন্যতম Memoirs নামে প্রায় সাতশত পৃষ্ঠার সুবিশাল স্মৃতিকথাটিও ছিল।
এটি তিনি রচনা করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে, ভারতবর্ষে তাঁর কারাবাসের সময়টাতে, পরে যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯৬৪ সালে। এম. এন. রায়ের ইংরেজি গদ্য এমনই স্বাদু, সাবলীল ও সাহিত্যগুণসম্পন্ন, আর তাঁর জীবনকাহিনিও এমন বর্ণাঢ্য, ঘটনাবহুল ও উদ্দীপনাময় যে, এই ঢাউস বইটিও রুদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করতে বাধ্য হবেন যেকোনো আগ্রহী পাঠককে। বস্তুত এই মহাগ্রন্থটি পাঠে তাঁর মহাকাব্যিক জীবন ও কর্মের যতটুকু জানতে পারা গিয়েছিল তারই একটি অতি সংক্ষিপ্ত সারাৎসার তুলে ধরা হচ্ছে এই নিবন্ধে আন্দরকিল্লার পাঠকদের জন্য।
বঙ্কিম-বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধক সাহিত্য পাঠ করে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ নরেন উত্তীর্ণ-কৈশোরেই নাম লেখায় অনুশীলন নামক বিপ্লবী দলে এবং আমাদের কুষ্টিয়ার সন্তান, কিংবদন্তিতুল্য বিপ্লবী বাঘা যতীনের সংস্পর্শে এসে স্বদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশ-বিতাড়নকেই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান কল্পনা করে। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় বিপ্লবীরা জার্মানদের সাহায্য নিয়ে, সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশদের উৎখাত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এম. এন. রায় প্রথমে জাভা ও পরে সুমাত্রা যাত্রা করেন এবং সেখানে বিফলমনোরথ হয়ে নানাঘাটের জল খেয়ে এক পর্যায়ে জার্মানি, জাপান, চিন, কোরিয়া হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে উপস্থিত হন। তারপর দীর্ঘকাল দেশের বাইরেই কাটিয়ে দেন ফেলে-আসা স্বদেশে বিপ্লব সংঘটনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
তবে এম. এন. রায় ¯্রফে একজন আদর্শবাদী স্বাপ্নিকমাত্র ছিলেন না, ছিলেন যথার্থ কর্মবীরও। আর এই পূর্ণাঙ্গ স্বরূপেরই প্রকাশ দেখা যায় তাঁর এই দীর্ঘ প্রবাসজীবনে। সানফ্রান্সিসকোতে সংক্ষিপ্ত বসতিকালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে ইভলিন ট্রেন্ট নামে এক বিদুষী নারীর, যা অচিরেই পরিণয়ে পর্যবসিত হয় এবং তাঁরা দুজনে একসঙ্গে ন্যুয়র্কে পাড়ি জমান। এই নিউ ইয়র্ক শহরের গণগ্রন্থাগারগুলোতে নিয়মিত অধ্যয়নকালেই তিনি প্রথম পরিচিত হন মাক্র্সীয় দর্শনের সঙ্গে যা তাঁর জীবনে অনপনেয় প্রভাব ফেলে। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি এড়াতে এই দম্পতি অতঃপর পাশের দেশ মেহিকো পালিয়ে যান। সেখানে হিস্পানি ভাষা শিখে তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী পত্রিকা এল পুয়েব্লো-তে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন যার মাধ্যমে তিনি অচিরেই মেহিকোর বিপ্লবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন এবং তাঁদের সঙ্গে মিলেই কালক্রমে, ১৯১৭ সালে, প্রতিষ্ঠা করেন মেহিকোর কম্যুনিস্ট পার্টি, যা ছিল রাশিয়ার বাইরে পৃথিবীর প্রথম কম্যুনিস্ট পার্টি। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় রুশ বিপ্লবী মিখাইল বরোদিনের, যাঁর আমন্ত্রণে তিনি ১৯২০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গমন করেন কমিন্টার্ন-এর দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেসে যোগদানের উদ্দেশ্যে।
সেখানে খোদ লেনিন ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন এবং সেই কংগ্রেসে উত্থাপিত ‘জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে’ তাঁর যুগান্তকারী থিসিসের ওপর এম. এন. রায় নিজের একটি পরিপূরক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীতও হয়। এর পরপরই তিনি রুশ বিপ্লবীদের সহায়তায় তাঁর স্বদেশী সহযাত্রী কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ, সাজ্জাদ জহির প্রমুখের সঙ্গে মিলে ১৯২১ সালে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এইসব কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে জোসেফ স্তালিনের সঙ্গেও তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে এবং স্তালিন তাঁকে বরোদিনসহ চিনদেশে পাঠান কৃষক বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য। এই কাজে যথেষ্ট সফল হওয়া সত্ত্বেও চিনা কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তাঁকে যে শুধুমাত্র চিন ত্যাগ করতে হয় তা-ই নয়, খোদ স্তালিনের বিরাগভাজন হয়ে এক পর্যায়ে তাঁকে আরেক বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক, লিয়ন ট্রটস্কির ভাগ্য বরণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন পর্যন্ত ছাড়তে হয়। আর এর মাধ্যমেই সাঙ্গ হয় তাঁর প্রবাসী বিপ্লবীর জীবন এবং অতঃপর ১৯৩০ সাল নাগাদ, দীর্ঘ ষোলো বছর বাদে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন।
দেশের মাটিতে পা দিয়েই তিনি নেহেরু, সুভাষ বসু প্রমুখ জাতীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁর এই নব-পর্যায়ের রাজনৈতিক জীবন তেমনভাবে দানা বাঁধবার আগেই পুরনো এক সন্ত্রাসবাদের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরালে নিক্ষিপ্ত হন ১৯৩১ সালে। এই কারাবাসের সময়টাতেই তাঁর ভাবনা-চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং তিনি মার্ক্সবাদ, সাম্যবাদের পথ থেকে সরে এসে র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম নামে এক বিশেষ মতবাদের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, যার কেন্দ্রে রয়েছে এক ও অবিভাজ্য মানুষ এবং মানবতা। স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৩৬ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এলেন গট্শচককে নিয়ে দেরাদুন শহরে থিতু হন এবং তাঁর নতুন মতবাদ প্রচারের কাজে পূর্ণ সময় নিয়োগ করেন। পাশাপাশি দুই হাতে লিখে চলেন সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন বিষয়ে মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ অসংখ্য গ্রন্থ। এসবের মধ্যে কয়েকটি মাস্টারপিস হচ্ছে, Reason, Romanticism, Revolution; India in Transition; Beyond Communism; Future of Socialism; From Savagery to Civilization; Science, Philosophy and Politics এর নামোল্লেখ করলেই তাঁর পান্ডিত্য ও মনস্বিতার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। ১৯৫৪ সালে এই মহাত্মার মৃত্যু হয়।
লেখকের জানামতে ভারতীয় নারীত্বের আদর্শ ও ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা বই দু’টি ছাড়া তাঁর প্রায় কোনো গ্রন্থই বাংলায় অনূদিত হয়নি। খুব সম্প্রতি বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক প্রিসিলা রাজ তাঁর উল্লিখিত Memoirs গ্রন্থটি অনুবাদের কাজ শুরু করেছেন, যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও প্রয়োজনীয় একটি উদ্যোগ। এম. এন. রায়ের প্রায় শতাধিক গ্রন্থ ও অসংখ্য বক্তৃতা, চিঠিপত্র, প্রচারপুস্তিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে তাঁর লেখাপত্র খুঁজে পাওয়াটাও খুব দুরূহ হয়ে পড়েছে আজ। ১৯৮৭ সালে তাঁর একলব্য-প্রতিম ভাবশিষ্য শিবনারায়ণ রায়ের সম্পাদনায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে সিলেক্টেড ওয়ার্কস অভ এম. এন. রায় নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের কাজ শুরু হলেও মাত্র চার খ- প্রকাশের পর সম্পাদকের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে সেটিও স্থগিত হয়ে যায়। সেই অর্ধসমাপ্ত কাজের পুনরারম্ভ ও সমাপ্তিকরণ এবং তাঁর অন্তত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের বাংলা অনুবাদের মাধ্যমেই কেবল এই অনন্যসাধারণ বাঙালি ভাবুক ও বিপ্লবীর প্রতি আমাদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব সেই উদ্যোগে অগ্রসর হওয়াটাই হোক আমাদের এই মুহূর্তের প্রধান অঙ্গীকার।
আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক