হানিফ ওয়াহিদ
নেপচুন গ্রহে বাস করে এক জ্ঞানী এলিয়েন। একবার তার খুব শখ হলো পৃথিবী নিয়ে গবেষণা করার। সেজন্য স্বচোখে পৃথিবী দেখতে চাইলেন।
গবেষণার জন্য সর্বপ্রথম পৃথিবীর কোন দেশে যাওয়া যায়?
নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন, আগে ভালো মানুষ নিয়ে কাজ করবেন, পরে খারাপ মানুষ।
সে চ্যাট জিপিটিকে সার্চ দিয়ে বলল, আমি পৃথিবীর এমন একটা দেশে যেতে চাই, যে দেশের মানুষ নিজেদের সবচেয়ে বেশি ধার্মিক মনে করে। আমি এদের কাছ থেকে সততা শিখতে চাই। প্রয়োজনে মাসখানেক থাকবো।
আমি নেপচুনে ফিরে এই বিষয়ে আলাদা একটা থিসিস লিখবো।
জিপিটি বলল, তাহলে বস্ এক দৌড়ে বাংলাদেশে চলে যান। পৃথিবীতে ওরাই নিজেদেরকে সবচেয়ে বেশি ধার্মিক মনে করে।
আচ্ছা আচ্ছা, তা ওখানে গেলে কী কী দেখতে পাবো? কীভাবে বুঝলা এরা পৃথিবীর সেরা ধার্মিক।
বস্, আমি বলছি না, এরা নিজেদের মনে করে। বাংলাদেশের রাজধানীকে বলা হয় মসজিদের শহর। পৃথিবীতে এতো মাদ্রাসা কোনো দেশে পাবেন না। ওখানে হাঁটে ঘাটে ওয়াজ মাহফিল হয়।
মাশাল্লাহ মারহাবা, তাহলে তো খুবই শান্তির দেশ। সবার আগে আমি বাংলাদেশেই যাবো তাহলে।
একদিন সকালে বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাধার পিঠে চড়ে সে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। নামলো গিয়ে ঢাকার কাওরান বাজারে। তখন শেষ রাত হয়ে গেছে। ফজরের আজান ভেসে আসছে।
আসতে তার বেশ সময় লেগেছে, খিদেও পেয়েছে । প্রথমেই সে খাবার হোটেল খুঁজতে লাগলো।
হোটেলের খোঁজে সে একটা মুরগির দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, গন্ধে তার নাড়িভুঁড়ি উল্টে যাচ্ছে। সে দেখলো এক লোক কতগুলো মরা মুরগী নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
নিশ্চয় এগুলো ফেলে দিবে। মনে মনে ভাবলো সে।
এই যে ভাই, আমি একজন এলিয়েন। নেপচুন গ্রহ থেকে এসেছি। এখানে ভালো হোটেল কোথায় পাওয়া যায়, যাদের খাবারের মান ভালো? আমার খুবই খিদে পেয়েছে। আমি কিছু খাবো। লোকটাকে বলল সে।
আপনি মানুষ না?
না ভাই। আমি এলিয়েন, নেপচুন গ্রহ থেকে এসেছি।
ও আচ্ছা। ভালো হোটেল খুঁজছেন? তাহলে আমার সাথে আসেন।
লোকটা একটা সুন্দর হোটেলের সামনে এলিয়েনকে নিয়ে গেল। হোটেলের নাম, বিসমিল্লাহ হোটেল। হোটেলের দেয়ালে মক্কা-মদিনার ছবি।
ফজর নামাজ পড়ে এসে তসবিহ জপতে জপতে হোটেল মালিক সব শুনে বলল, আপনি হাতমুখ ধুয়ে বসুন, খাবার আসতে আধাঘন্টা দেরি হবে। এখনো রান্না রেডি হয় নাই। বলেই সে আবার তসবিহ জপতে লাগলো।
আধাঘন্টা পর এলিয়েন হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসতে গিয়ে দেখে, সেই লোকটা মরা মুরগি হোটেলের মালিককে বুঝিয়ে দিয়ে টাকা গুনতে গুনতে চলে যাচ্ছে।
ওরে সর্বনাশ! এই হোটেলে মরা মুরগি দিয়ে রান্না হয়? সে দৌড়ে বাইরে চলে এলো।
হাঁটতে হাঁটতে সে ফার্মগেট এলাকায় চলে গেলো। ব্রিজের গোড়ায় দুই ভিক্ষুক ঝগড়া করছে। একজন কানা, অন্যজনের এক ঠ্যাং নাই, ল্যাংড়া।
কানা বলছে, ওরে ল্যাংড়া, তোর কাজকারবার সবই কিন্তু আমি দেখি, কিছু বলি না। এই জায়গায় ভিক্ষা কইরা গ্রামে দোতলা বাড়ি করছি, জমি কিনছি বিশ বিঘা। আমার সাথে টাল্টিবাল্টি করলে কিন্তু বনচটকানা খাবি,,,,
এক পা নিয়েই ল্যাংড়া তেড়ে আসে, ওরে কানা, তুই দোতলা বাড়ি করছোস, আমি কি আঙ্গুল চুষছি? আমার তিনতলা বাড়ি আছে। বাড়িভাড়া পাই মাসে সত্তর হাজার। বেশি তেড়িবেড়ি করবি, এমন লাত্থি দিমু না,,,,,
এলিয়েন হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালো। খিদার ঠেলায় পেট চো চো করছে। মুখ শুকিয়ে গেছে। রাস্তার ধুলায় তাকে চেনা দায়।
ব্রিজের ওপর বসে আছে এক জটাধারী সাধুবাবা। তার কপালে চন্দনের ফোঁটা, হাতে জপমালা। বড় বড় চুল,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দাঁড়ি। সে হাত দেখে মানুষের বর্তমান অতীত বলতে পারে। কামরুখ কামাখ্যা থেকে সে এই বিদ্যা রপ্ত করে এসেছে।
চোখ বুজে বসে বসে সে হরি নাম জপছে।
এলিয়েন গিয়ে তার হাত বাড়িয়ে ধরে বলল, বাবা, আমার হাতটা একটু দেখে দেন। সাধুবাবা চোখ খুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, পাথর নিবি?
পাথর নিবো কেন?
তোর চোখমুখ দেখেই বুঝেছি, ঝামেলায় আছিস। পাথর নে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বলেই সে খুকখুক করে কাঁশতে লাগলো।
পাথুরে সব সমস্যার সমাধান হয় বাবা?
পাথর সমাধান দেয় না, আমি সমাধান দেই। আমি মন্ত্র পড়ে পাথরের গায়ে ফু দিলেই কাজ হয়। সেজন্য আমাকে পাঁচ হাজার এক টাকা হাদিয়া দিতে হবে। আচ্ছা যা, তোর জন্য ডিসকাউন্ট, পাঁচশো এক টাকা দে। বলেই আবার কাঁশতে লাগলো।
এলিয়েন বলল, তাহলে আপনি পাথরে ফু দিয়ে আগে আপনার কাঁশি থামান, তারপর আমি চিকিৎসা নিবো।
এলিয়েনের কথা শুনে সাধুবাবা রাগী চোখে তাকিয়ে রইল।
সে এগিয়ে গিয়ে চা খাওয়ার জন্য একটা চায়ের দোকানে ঢুকলো। চায়ের কাপে মাছি ভনভন করছে এই দৃশ্য দেখে তার বমি আসতে চাইলো।
সেখানে দুইজন চা খেতে খেতে গল্প করছে। কথায় কথায় বুঝা গেল, এরা একজন রাশিয়াপন্থী অন্যজন আমেরিকা। তারা ঝগড়া করছে কে বেশি সামরিকভাবে শক্তিশালী, আমেরিকা না রাশিয়া।
একজন বলছে আমেরিকা শক্তিশালী , অন্যজন বলছে রাশিয়া।
রাশিয়াপন্থী লোকটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উষ্ঠা মেরে ফেলে দিতে চাইছে, শালা একটা প্রেসিডেন্ট হলো? ওর চেয়ে আমি ভালো দেশ চালাতে পারি।
এদিকে আমেরিকার সাপোর্টার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের চুলের মুঠি ধরে বনচটকানা মেরে গদি থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে!
এলিয়েন মনে মনে ভাবে, ওরে সর্বনাশ! এ আমি কোথায় এলাম! এরা দেখি মহা চাপাবাজ!
চা খাওয়া মাথায় উঠলো, সে চা না খেয়েই দোকান থেকে বেরিয়ে এলো।
সামনে এগুতে এগুতে এক জায়গায় জটলা দেখে থামলো। একজনকে জিগ্যেস করলো, ভাই, আমি একজন এলিয়েন, নেপচুন গ্রহ থেকে এসেছি। এখানে কী হচ্ছে?
লোকটা বলল, ভাই আমাদের এলাকায় এমপি সাব এসেছেন, গরীবদেরকে চাল, ডাইল, কম্বল বিতরন করবেন।
মাশাল্লাহ মারহাবা! আপনাদের এমপি নিশ্চয় মহান ব্যক্তি, একসাথে এতোকিছু দিচ্ছেন। নিশ্চয় উনার গরীবের প্রতি অনেক দরদ।
লোকটা বিরক্ত গলায় বলল, কীসের দরদ ভাই, আমরা উনার রাজনৈতিক কর্মী। ঘুরে ঘুরে লোকজন থেকে টাকা তুলেছি আমরা, নাম ফাটছে তার। যা চাঁদা তুলেছি,অর্ধেক গেছে এই শালার পকেটে। শালা মহা দুর্নীতিবাজ!
তাহলে এদেরকে ভোট দেন কেন?
ভাই রে, এরে ভোট না দিয়ে অন্য কাউকে দিলে আরও বেশি দুর্নীতি হবে। এটাই এখানকার সিস্টেম।
নেতা তখন ভাষণ দিচ্ছে, ভাইসাব, আমাদেরকে সামনের ইলেকশনে আবার নির্বাচিত করেন, এই দেশকে আমরা পৃথিবীর সেরা ধনী দেশ বানিয়ে দেবো। আমেরিকাকে আমরা ঋণ দিবো। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাদের কথায় উঠবস করবে। দেশে কোনো অন্যায় অবিচার থাকবে না ইনশাআল্লাহ!
ওরে শালা! এই দেশের জনগণ যেমন চাপাবাজ, নেতারা দেখি আরও বেশি চাপাবাজ! মনে মনে ভাবলো এলিয়েন।
ক্ষুধার ঠেলায় বেচারার অবস্থা খুবই কাহিল। কোনো হোটেলে গিয়ে খেতে সাহস হচ্ছে না, সকালে যা দেখেছে! এসব খাবার খেয়ে সে আর নেপচুনে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। ডায়রিয়া হয়ে এখানেই মরে থাকতে হবে।
সে ক্ষুধা নিয়েই সামনে এগুতে লাগল আর ভাবতে লাগল, এই দেশের মানুষ এমন কেন? দেশটা কী নোংরা! রাস্তাঘাট নোংরা, মানুষ নোংরা, বাতাস নোংরা। এখনই তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের নেপচুনে তো কেউ জানেও না, দুর্নীতি কাকে বলে!
সে আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে এবার একটা বিশাল প্যান্ডেল দেখতে পায়। চারিদিকে মাইক, লক্ষ লক্ষ মানুষ ।
ভাই, আমি এলিয়েন, নেপচুন গ্রহ থেকে এসেছি। এখানে কী হচ্ছে ? একজনকে জিগ্যেস করে সে।
এখানে মাহফিল হচ্ছে, দেশসেরা বক্তা আসছেন,এজন্যই লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসছে তার কথা শোনার জন্য।
মাশাল্লাহ মারহাবা! খুবই ভালো কথা। লোকজন ধর্মের কথা শুনবে। তা ভাই, ওয়াজ কতক্ষন চলবে?
ওয়াজ তো অনেকক্ষণ চলবে, বড় হুজুরের কথা শুনতেই সবাই আসে। উনি এক্ষুনি আসবেন।
খুবই সুন্দর আয়োজন, তা ভাই এসব করার খরচ দেয় কে? নিশ্চয় সরকার?
কী কন ভাই? এসব টাকা আমরা রাস্তাঘাটে গাড়ি থামিয়ে, এরওর কাছ থেকে চাঁদা তুলে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করি। টাকা তুলতে আমাদের মাসখানেক সময় লেগে যায়।
কী কন ভাই, একমাস কষ্ট করেন? খারাপ লাগে না?
লাগে না আবার! প্যান্ডেল খরচ কতো জানেন? বড় বক্তাকেই তো একঘন্টা ওয়াজের জন্য দুই আড়াই লাখ টাকা দিতে হয়,,,,
এতো টাকা দিয়ে উনি কী করেন?
জানি না ভাই। শুনেছি আলীশান বাড়ি করেছেন। প্রতিদিন তিন চার জায়গায় ওয়াজ করেন, এবার বুঝেন উনার মাসিক ইনকাম কতো।
কথা বলতে বলতেই দেখা গেল বড় বক্তা হেলিকপ্টারে করে চলে এসেছেন। লোকজন আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। হেলিকপ্টার থেকে নেমেই তিনি এক মিনিটের পথের জন্য একটা দামী গাড়িতে চড়ে বসলেন। তার শরীরে দামী পোশাক, পৃথিবীর সেরা দামী ঘড়ি। লাখ টাকা দামের চশমা।
চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেছে। সবাই বড় হুজুরকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। পুলিশ চারদিক থেকে হুজুরকে ঘিরে রেখেছে।
বড় হুজুর স্টেজে বসেই ওয়াজ শুরু করলেন। তার ঘড়ি বাঁধা সময়। আরও কয়েক জায়গায় প্রোগ্রাম আছে। হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে।
তিনি প্রথমেই বললেল, সৎ জীবন যাপন করতে হবে, কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালা গরীবদের খুবই পছন্দ করেন। গরীবরা ধনীদের থেকে পাঁচশো বছর আগে বেহেশতে যাবে,,,,
এলিয়েন মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগল, আল্লাহ তায়ালা যদি গরীবদের এতো পছন্দ করে, তাহলে এই বক্তা গরীব না হয়ে ধনীর মতো জীবনযাপন করে কেন? তার কি পাঁচশো বছর আগে বেহেশতে যাওয়ার ইচ্ছা নাই? লোকজন কষ্ট করে মাস ব্যাপি টাকা তুলছে, আর এই বক্তা এক ঘন্টা ওয়াজ করে এতো টাকা নিয়ে নিচ্ছে কেন?
নাহ্ এইদেশে আর থাকা যাবে না, একমাস দূরে থাক, আজই চলে যেতে হবে। এই দেশের মানুষ কেউ ভালো না। এখানে থেকে না খেয়ে মরবো নাকি!
সে হাঁটা দিল আবার কাওরান বাজারের দিকে। ওখানে তার গাধা বাঁধা আছে। গাধায় চড়ে তড়িঘড়ি বাংলাদেশ থেকে চম্পট দিতে হবে। পরে সময় করে অন্য দেশে যাওয়া যাবে।
কাওরান বাজার এসে সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। তার গাধাটা চুরি হয়ে গেছে!
সে চ্যাট জিপিটিকে বলল, ওরে শালা চ্যাট, তোকে বললাম একটা ধার্মিক দেশের কথা, তুই আমাকে কোথায় আনলি?
চ্যাট একটু কেঁশে বলল, বস, আপনি ভুল করছেন। আপনি আমাকে বলছেন কোন দেশের মানুষ নিজেদেরকে বেশি ধার্মিক মনে করে। আমি বলেছি, বাংলাদেশ। আপনি তো বলেন নাই, সবচেয়ে বেশি ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশে যেতে চান। এই দেশের মানুষ সবাই নিজেকে ধার্মিক মনে করলে কী হবে, অধিকাংশই অসৎ এবং ভন্ড।
আপনি ফেঁসে গেছেন, বস!
হানিফ ওয়াহিদ : গল্পকার ও রম্য লেখক, ঢাকা