এখন সময়:বিকাল ৫:৩৯- আজ: সোমবার-২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

এখন সময়:বিকাল ৫:৩৯- আজ: সোমবার
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-গ্রীষ্মকাল

চট্টগ্রামী প্রবাদের প্রথম গ্রন্থ : রচয়িতা জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সন

মহীবুল আজিজ

জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সন (১৮৫২-১৯২০), সংক্ষেপে জে ডি এন্ডার্সন আজ থেকে একশ’ সাতাশ বছর আগে চট্টগ্রামী প্রবাদের সর্বপ্রাথমিক গ্রন্থটি রচনা-সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। চট্টগ্রামী প্রবাদবিষয়ক এটাই যে প্রথম গ্রন্থ সেটি সন্দেহাতীত। মাঘ ১৩১২ (ইংরেজি ১৯০৫ সাল) সনের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর চট্টগ্রামী ছেলে ঠকান ধাঁধা’ প্রবন্ধে স্পষ্ট জানান, এন্ডার্সনের গ্রন্থই এ-বিষয়ে পথিকৃৎ। গ্রন্থটির প্রশংসায় সাহিত্যবিশারদ আরও লেখেনÑ লোকমুখ হইতে সংগ্রহ করিয়াই আমাদের ভূতপূর্ব ম্যাজিস্ট্রেট এন্ডারসন সাহেব বাহাদুর  Chittagong Proverbs নামক সুন্দর গ্রন্থ বঙ্গসাহিত্য ভা-ারে উপহার দিয়া গিয়াছেন।” এন্ডার্সনের গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ শিরোনাম ‘সাম চিটাগাং প্রোভার্বস’ এবং উপশিরোনাম ‘এ্যাজ এ্যান এক্সামপল অব দ্য ডায়ালেক্ট অব দ্য চিটাগাং ডিস্ট্রিক্ট’।

এটি প্রকাশিত হয় কলকাতার ৪৬, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের হেয়ার প্রেস থেকে। এর মুদ্রক-প্রকাশক ছিলেন আর. দত্ত। বর্তমানে গ্রন্থটি ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এটির ক্যাটালগ নম্বরÑ ৮৩৬:১১.সি.৮৫.২৪। গ্রন্থের গায়ে হস্তাক্ষরে লিখিত তথ্য থেকে জানা যায় জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে তাঁর স্ত্রী মিসেস এন্ডার্সন সেটি কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরিকে দান করেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯২০ সালের ২৪ নভেম্বর এন্ডার্সনের মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহে থাকা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বইগুলো তাঁর স্ত্রী কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরিকে দান করেন।

পরবর্তীকালে তাঁর সম্মানে একটি কক্ষের নামকরণ করা হয় ‘এন্ডার্সন কক্ষ’ যেখানে অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে এন্ডার্সন-সংগ্রহের বইগুলোও রয়েছে।

এন্ডার্সনের জীবনী সম্পর্কিত  তথ্যের জন্য তিনটি উৎস দ্রষ্টব্য। ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় প্রেস থেকে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত  ‘বায়োগ্রাফিক্যাল হিস্ট্রি অব গন্ভিল এ্যান্ড কী’জ কলেজ’ গ্রন্থানুসারে(৪র্থ খ-) জানা যায় তাঁর পুরো নাম জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সন, জন্ম ১৮৫২ সালের ১১ নভেম্বর। তাঁর পিতা জেমস এন্ডার্সন ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলা অঞ্চলের হাসপাতালসমূহের ইন্সপেক্টর জেনারেল। তাঁর মাতার নাম এলেন গার্স্টেন। তাঁর লেখাপড়া ইংল্যান্ডেই হয়। ১৮৬২-১৮৬৬ চেতেনহ্যাম কলেজ, ১৮৬৭-১৮৭২ রাগবি স্কুল এই দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেষ করে ১৮৭৫ সালে তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে কর্মজীবন শুরু করেন বাংলা অঞ্চলে সরকারি পদে যোগদানের মধ্য দিয়ে। বাংলা অঞ্চলেরই বিভিন্ন স্থানে কাটে তাঁর কর্মজীবনের অধিকাংশ কাল। ১৯০০ সালে চট্টগ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯০৭ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস বোর্ডের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৯০৯ সালে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক এম. এ. ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি লুসাই, ত্রিপুরা, দেউড়ি ছুটিয়া এবং আকা ইত্যাদি ভাষার শব্দসংগ্রহ এবং কাছাড়ি গল্পের সংকলন সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। উপর্যুক্ত গ্রন্থেও ১৯৪৮ সালের ৫ম সংস্করণ থেকে এন্ডার্সনের জীবনী সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য মেলে। ১৯১৯ সালে কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট ডিগ্রি দেয়। তাঁর কর্মজীবনের তথ্যাদি থেকে দেখা যায় চট্টগ্রাম ছাড়াও অন্যত্র তিনি চাকুরিরত ছিলেন। আসামে সহকারী কমিশনার ছাড়াও তিনি স্থানীয় সরকারের সহকারী সচিব, ডেপুটি কমিশনার, স্কুল ইন্সপেক্টর এবং পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন সেখানে। ১৮৯৪ সালে তিনি আসাম থেকে পুনরায় বাংলায় চলে আসেন। ১৯১৯ সালে তাঁকে কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় প্রেসের সিন্ডিকেট-সদস্য মনোনীত করা হয়। এন্ডার্সন রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন বহু বছর, অধ্যাপনা করেন লন্ডনের ওরিয়েন্টাল স্কুলে।

জেমস এন্ডার্সনের আরও যেসব উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের হদিস পাওয়া যায় সেগুলো হলো রেভারেন্ড এস এন্ডেল রচিত দ্য কাছাড়িজ গ্রন্থের একটি চমৎকার ভূমিকা ও অন্যান্য গ্রন্থÑ এ ম্যানুয়েল অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, ফরাসি ভাষায় রচিত লে ভোয়া দ্যু ভের্ব বেঙ্গলি, দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া এবং ফনেটিক্স অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। ১৯২০ সালের ২৪ নভেম্বর জে ডি এন্ডার্সন মৃত্যুবরণ করলে তাঁর সম্মানে কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের গন্ভিল এ্যান্ড কী’জ কলেজ থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় ইন মেমোরিয়াম : জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সন লিট ডি শিরোনামে যেটির রচয়িতা এইচ টি. ফ্রান্সিস এম. এ.। ইনি ছিলেন গন্ভিল এ্যান্ড কী’জ কলেজের ফেলো এবং কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরির উপ-গ্রন্থাগারিক। ফ্রান্সিসের রচনা থেকে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মেলে তাঁর সম্পর্কে। গ্রন্থে উদ্ধৃত বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক জর্জ গ্রিয়ার্সনের একটি চিঠির সূত্রে জানা যায়, গ্রিয়ার্সন এবং এন্ডার্সনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। গ্রিয়ার্সন জানান, এন্ডার্সন তাঁর নিজের দেশিয় সত্তাকে সংরক্ষণ করেই উদারচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতিকে। এর ফলে বাঙালি হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন তিনি। অনেক ভারতীয় ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মিল না থাকলেও তিনি তাঁদের শ্রদ্ধা-সম্মান আদায় করতে সক্ষম হ’ন। গ্রিয়ার্সনের মতে, বাংলা ভাষা আসলেই একটি দুরূহ ভাষা কিন্তু তা সত্ত্বেও এন্ডার্সন বিস্ময়কর দক্ষতা প্রদর্শন করেন বাংলা ভাষার চর্চায়। কেবল বাংলাই নয় এন্ডার্সন ফরাসি ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন। অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন ফরাসিতে। ছাত্রজীবনের এক পর্যায়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি প্যারিস যান কিন্তু ফ্রান্সে দীর্ঘকালীন বসবাসে অনীহা জেগে উঠলে ফিরে আসেন স্বদেশে। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণের পর  পাকাপাকিভাবে তিনি চলে আসেন তাঁর নিজের শহর কেম্ব্রিজে। ১৯০৭ সালে কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক নিযুক্ত হ’ন তিনি। প্রথম বিশ^যুদ্ধের সময়টাতে ব্যস্ততা বেড়ে যায় তাঁর। কেম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত লন্ডন ওরিয়েন্টাল স্কুলে বক্তৃতা দেয়া ছাড়াও আরও এক কঠিন দায়িত্ব তাঁর কাঁধে বর্তায়। সে-দায়িত্ব ছিল প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ সরকার অর্পিত। বাংলা ভাষায় লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্রের পাঠোদ্ধার এবং কোনো আপত্তিকর অংশ থাকলে সেগুলোর সনাক্তকরণ এবং ব্যাখ্যা-প্রদান। এসব চিঠিপত্রের অনেকগুলোই ছিল জাহাজের লস্করদের লেখা। এসব চিঠিতে থাকতো জাহাজে প্রচলিত বিশেষ ধরনের ভাষার ব্যবহার। এসব পত্রে থাকতো রচয়িতাদের কাজকর্ম, পেশা এবং তাদের পরিবারসংক্রান্ত নানা বিষয়ের বিবরণ। পরবর্তীকালে জে ডি এন্ডার্সন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, জাহাজে কর্মরত এসব লোক অত্যন্ত বিশ^স্ততা আর খাটাখাটুনির সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতো। কিন্তু তারা তাদের সেই ভূমিকার প্রতিদান পায় নি কখনও। হয়তোবা যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ জুটেছিল কারও কারও ভাগ্যে। প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর থেকেই এন্ডার্সনের শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যেতে থাকে। এসব ব্যস্ততার মধ্যেও লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য টাইমস্’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। তাছাড়া ‘স্পেকটেটর’ পত্রিকায় লিখতের জে. ডি. এ. নামে।

জেমস এন্ডার্সন তাঁর ভারতবর্ষে বিশেষ করে বাংলায় বসবাসকালে সারস্বত সমাজে সাদরে গৃহীত হয়েছিলন। ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ১ জ্যৈষ্ঠ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দির-এর সহযোগী সম্পাদক শ্রী ব্যোমকেশ মুস্তফী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয় কেম্ব্রিজনিবাসী এন্ডার্সনের নিকটে। সেই চিঠিতে সমকালীন বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এন্ডার্সনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ভূমিকাকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৬শ বার্ষিক অধিবেশনে ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে এবং হেমচন্দ্র দাশগুপ্তের সমর্থনের সাহিত্য-পরিষৎ-এর সদস্য নির্বাচিত হ’ন এন্ডার্সন। ১৩১৮বঙ্গাব্দের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ৬২-সংখ্যক পৃষ্ঠায় ‘মফস্বল’ বিভাগের সভ্যদের যে-তালিকা মুদ্রিত হয় তাতে ৮৮-সংখ্যক সভ্য হিসেবে স্থান লাভ করে এন্ডার্সনের ইংল্যান্ডস্থ বাসভবনের ঠিকানাÑ জে ডি এন্ডার্সন, এম. এ., আই. সি. এস., মস্টিন হাউজ, ব্রুকল্যান্ডস্ এভিনিউ, কেম্ব্রিজ, ইংল্যান্ড। ১৩১৩-১৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার চতুর্দশ ভাগ, অতিরিক্ত সংখ্যায় পরিষৎ সচিব রাজা যতীন্দ্রনাথ চৌধুরীর একটি চিঠি (১৯ মে ১৯১৩ তারিখে লেখা) থেকে জানা যায়, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত জে ডি এন্ডার্সনের রচনায় সাহিত্য পরিষৎ-এর কর্মোদ্যোগ ও ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। চিঠিতে রাজা যতীন্দ্রনাথ তাঁর দৃঢ় মত ব্যক্ত করে জানান, ভবিষ্যতে এন্ডার্সনের মাধ্যমে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর বার্তা ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্বৎসমাজের নিকটে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল জে ডি এন্ডার্সনের। তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ এবং পত্রযোগাযোগের অনেক ঘটনা রবীন্দ্রজীবনী থেকে জানা যায়। এন্ডার্সন তাঁর এ ম্যানুয়েল অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থে লিখিত বাংলা লিপির বৈশিষ্ট্যের নমুনা উপস্থাপন করতে গিয়ে তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৩২০ সালের ৬ ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চিঠিটি লেখেন। চিঠিখানার বিষয়বস্তু বাংলা ছন্দ। এন্ডার্সন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বাংলা ছন্দের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কবি তাঁকে পত্র দেন বিস্তারিত আলোচনা করে। সেই পত্রই পরে ছন্দ বিষয়ক আলোচনায় প্রবন্ধাকারে মুদ্রিত হয় যা বিশ^ভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলির একাদশ খ-ে স্থান পায়। বিশ^কবির প্রতি এন্ডার্সনের ধারণা কতটা উচ্চ ছিল তা বোঝা যায় চিঠিগুলো সম্পর্কে তাঁর ব্যক্ত মত থেকে। চিঠিগুলোকে তিনি তুলনা করেন ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো রচিত তাঁর নিজস্ব উপন্যাসের ভূমিকার সঙ্গে। এই সঙ্গে এন্ডার্সন রচিত আরও কয়েকটি গ্রন্থের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯১৭ সালে প্রথমে ছয় পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা ছাপেন তিনি ফনেটিক্স অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ শিরোনামে। এটির প্রকাশক ছিল লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ। লন্ডনের ওরিয়েন্টাল স্কুল এবং কেম্ব্রিজে বাংলা বিষয়ে পাঠদান করতে গিয়ে এন্ডার্সন বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাছাড়া বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘকালীন বসবাসের ফলে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপভাষিক রূপ সম্পর্কেও তাঁর যথেষ্ট ধারণা হয়। এরই একটা চূড়ান্ত ও বিশিষ্ট রূপ তাঁর রচিত এ ম্যানুয়েল অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ। ১৭৮ পৃষ্ঠার (১৮ পৃষ্ঠার ভূমিকাসহ) গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে তাঁর মৃত্যুর বছরে। এ-গ্রন্থের সূত্রে এন্ডার্সনের উদার ও প্রশস্ত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে বলা যেতে পারে ব্যতিক্রমী ঘটনা। কেননা, উপনিবেশিত দেশের একটি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত তাঁর অনুশীলন মোটেও প্রাথমিক স্তরের ছিল না, ছিল উচ্চ স্তরের। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৌন্দর্য ও ঐশ^র্যকে তিনি বিদেশি-বিভাষী পাঠকদের জন্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। মনে হতে পারে যে গ্রন্থটি আসলে একজন বাঙালির লেখা। গ্রন্থের উৎসর্গপত্রটির বিশেষত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। গ্রন্থোৎসর্গের তারিখটি এন্ডার্সন দিয়েছেন তাঁর নিজের ভাষা ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় (ভাদ্র ১৩২৫)। তথ্য হিসেবে এটি ক্ষুদ্র হলেও এর ব্যাপ্তি অনেকখানি। শুধু তা-ই নয় তিনি তাঁর বিদেশি বন্ধু ‘শ্রী আলফ্রেড রেবেলিউ’-এর উদ্দেশে উৎসর্গপত্রটি রচনা করেন বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালার রূপে। অর্থাৎ শাসকের ভাষাকে এড়িয়ে তিনি গ্রহণ করেন শাসিতের ভাষা।

জেমস এন্ডার্সনের সুপরিকল্পনা গ্রন্থটিতে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। সর্বমোট ছয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত গ্রন্থটির উপশিরোনামগুলো লক্ষ করা যাকÑ বানানপদ্ধতি, ব্যাকরণ, নমুনা, নমুনাসমূহের ভাষান্তর, বাংলা লিপির মুদ্রিত ও লিখিত রূপ এবং শব্দভা-ার। বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ধারাক্রম এবং বাংলা সাহিত্যের

ক্রমবিকাশ ও সমকালীন অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি যে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন তা এ-বইয়ে পরিদৃশ্যমান। তাঁর মূল্যায়ন কেবলই দায়সারা গোছের নয় বরং তাতে অনেকখানি মৌলিকতার ছাপ লক্ষ করা যাবে। কেন বাংলা ভাষায় এত বিপুল পরিমাণে সংস্কৃত শব্দের সঞ্চয় সেটির উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি জানান, বহু প্রাচীন কাল থেকে বাঙালিরা বিপুল উৎসাহ ও সফলতার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার চর্চা ও অনুশীলন করেছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি দেখান, সংস্কৃত সাহিত্যের সমৃদ্ধির যুগে বাঙালি রচয়িতাদের রচিত গ্রন্থাদির দৃষ্টান্ত রয়েছে। তুলনা হিসেবে তিনি দেখান, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল উনিশ শতকের রোমান সাহিত্যে। এই সময়কার রোমান সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল অ-রোমান লেখকদের দ্বারা, তাঁরা ছিলেন স্প্যানিশ ও আফ্রিকান যাঁদের পূর্বপুরষেরা কেউই রোমান ছিলেন না। ‘গীতগোবিন্দ’ এবং এর রচয়িতা জয়দেব চক্রবর্তী সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন তিনি। পাশাপাশি এটাও এন্ডার্সনের ধারণা ছিল, সংস্কৃতের প্রভাব বাংলার নিজস্ব ভাষার সাহিত্যের বিকাশকে কখনও কখনও বাধাগ্রস্ত করেছিল। তথাপি, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম এঁদের মেধা ও প্রতিভাকে তিনি অতি উচ্চ স্তরের বলে মনে করেন। বঙ্কিমের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি দেখান, দুই ধরনের রচনারীতিতে পারঙ্গমতা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রেরÑ অতি পরিচিত ঘরোয়া হাটবাজারের প্রাকৃত বাগভঙ্গিনির্ভর রচনায় কুশলতা ও সাহিত্যগুণ এবং নিরাভরণ করুণ রসনির্ভর কিংবা আটপৌরে কৌতুককর দৃশ্যকল্প নির্মাণে তাঁর অনির্বচনীয়তা তাঁকে বিশিষ্ট করে তোলে। একই সঙ্গে লোকজীবনের অধ্যয়নে কিংবা কটুকাটব্যপূর্ণ ও বিদ্রƒপাত্মক ধারায় তাঁর সংস্কৃত ভাষার ব্যবহারকে অত্যন্ত শক্তিমান শিল্পের কাজ বলে মনে করেন এন্ডার্সন। ক্ষীণকায় অথচ ‘শক্তিমান ব্যঙ্গাত্মক রচনা’ হিসেবে ‘লোকরহস্য’ অপরিসীম মূল্যবাহী বলে মত প্রকাশ করেন এন্ডার্সন।

একজন বিদেশি হয়েও বাংলা ভাষা-সাহিত্যের মূল্যায়নে এন্ডার্সনের দৃষ্টির মৌলিকতা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচ্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর কবিদের অবদান এন্ডার্সনের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত তিনি শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেনের সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের প্রশংসা করে জানান, মধ্যযুগের অশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত বৈষ্ণব কবিদের রচনায় সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত বাংলা ভাষা অপূর্ব রূপশ্রীম-িত হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। এটাও তাঁর নজর এড়ায় না, সমকালীন লেখকদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে নিজেদের রচনায় সাবলীল ও বহুমাত্রিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্বও বিশেষভাবে স্মরণীয়। বাংলা গদ্য ও সাহিত্যিক নমুনার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে এন্ডার্সন যেসব উদ্ধৃতি এবং সেগুলোর অনুবাদ করেছেন সেসব থেকে তাঁর সাহিত্যরুচি এবং উপলব্ধির গভীরতা অনুমেয়। বিদ্যাসাগরের গল্পমালা, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বর্ণলতা, শরৎচন্দ্রের মেজদিদি উপন্যাসের এন্ডার্সনকৃত অনুবাদ থেকে তাঁর উদার মানবিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাবে। তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য থেকে অনুবাদের সূত্রে তিনি বঙ্কিমের আদি অনুবাদক হিসেবেও আবির্ভূত হ’ন। সেই সঙ্গে বঙ্কিম-সাহিত্যের আদি যুগের একজন সমালোচক কিংবা মূল্যায়নকারী হিসেবেও তাঁর একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসের দশম অধ্যায়ের আংশিক অনুবাদের সূত্রে তিনি বলেন, উপন্যাসটি অষ্টাদশ শতকের শেষে বাংলায় মুঘল ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহের কাহিনী। ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীত প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, এটি সারা ভারতে এতটাই জাতীয়তাবাদী প্রেরণার সঞ্চারক হয়েছে যে একে ফরাসি জাতীয় সঙ্গীত ‘লা মার্সেই’-এর সঙ্গে তুলনা করা চলে। এন্ডার্সন এটিও লক্ষ করেন যে বঙ্কিম বিশেষ কুশলতায় সমগ্র কবিতাটি রচনা করেছেন তৎসম শব্দে যেজন্যে এটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে এমনকি ইন্দো-আর্যভাষী জনগোষ্ঠির কাছেও পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকাডুবি উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় থেকে তিনি অনুবাদ করেন ‘দ্য শিপ রেক’ শিরোনামে। স্থানীয় লোকেদের কথ্যভাষার উদাহরণ হিসেবে তিনি বেছে নেন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে লেখা স্বর্ণকারের আবেদনের একটি নমুনা। নমুনাটি লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন চিঠিপত্রের সংগ্রহ থেকে নেওয়া। পরবর্তীকালে আনিসুজ্জামানের গবেষণায় সংগ্রহটির ভিন্নমাত্রিক পরিচয় আমরা পাই। ১৯১৮ সালের ৬ জুন ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রচনার উদ্ধৃতি ও সেটির অনুবাদ তাঁর কৌতূহলী মনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটায়। এছাড়াও কাশীরাম দাশের মহাভারত, কৃত্তিবাস ওঝা’র রামায়ণ, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কালকেতু উপাখ্যান, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি’র অনুবাদ ইত্যাদি বাংলা ভাষা-সাহিত্য বিষয়ে সচেতন একজন ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।

জে ডি এন্ডার্সন রচিত চিটাগাং প্রোভার্বস্ চট্টগ্রামের প্রবাদবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। এই পথিকৃতের মর্যাদা ছাড়াও এ-গ্রন্থ ধারণ করে রচয়িতার চট্টগ্রামের ভৌগোলিক-সামাজিক বিষয়ক মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিও। গ্রন্থটির ভূমিকাটিও অত্যন্ত মূল্যবান। একথা নিঃসন্দেহে সত্য, ভারতবর্ষে চাকুরিরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিংবা ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের অনেকেই নিজেদের স্মরণীয় করে রেখেছেন তাঁদের রচিত নানামাত্রিক পুস্তক রচনার মাধ্যমে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে সেসব কথা এসে পড়ে অনিবার্যভাবেই। এমন অনেক গবেষণার সাক্ষাতও আমরা পাই যেগুলো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা বা উদ্যোগের ফলে সাধিত হয় নি বরং সেসবের পেছনে ছিল রুচিসম্পন্ন-মার্জিত ও মানবিকতার বোধে উদ্দীপ্ত ব্যক্তিদের একান্ত নিজস্ব সচেতনা। আমরা ইতঃপূর্বে বলেছি এন্ডার্সনের এ-গ্রন্থকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘সুন্দর গ্রন্থ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন এবং সেটিকে তিনি কেবল চট্টগ্রামের নয় ‘বঙ্গসাহিত্য ভা-ারে’র সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে গেছেন। অর্থাৎ গ্রন্থটি এ-ধরনের গবেষণার একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত। গ্রন্থকার-সম্পাদকের ভূমিকা পাঠ করলেই আমরা এ-গ্রন্থের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করতে পারি। এন্ডার্সন গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেছেন এক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরী ক্যাপ্টেন গার্ডনকে। ১৮৯৬ সালে আসামি প্রবাদবিষয়ক গার্ডনের গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় শিলং থেকে। তিনিও এন্ডার্সনের মতো একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আসামের গোয়ালপাড়ার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন ক্যাপ্টেন গার্ডন। এ-প্রসঙ্গে ১৮৬৯ সালে কলকাতার সাপ্তাহিক ইংলিশম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবাদমালার কথাও বলা যায়। সেখানে নির্বাচন করবার পরেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ২৩৫৮টি প্রবাদ স্থান পায় যেটি ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের কাজের গুরুত্বকে প্রমাণ করে। তাঁদের প্রবাদবিষয়ক এসব গবেষণা ও রচনা নিঃসন্দেহে তাঁদের সৃজনশীল মনমানসিকতারই বহিপ্রকাশ। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত পূর্ববর্তী গ্রন্থেই এন্ডার্সনের হাতমকশো হওয়ার দৃষ্টান্ত আমরা পাই। এ শর্ট লিস্ট অব ওয়র্ডস্ অব দ্য হিল টিপেরা ল্যাংগুয়েজ নামক গ্রন্থটিতে এন্ডার্সনের ভারতীয় জনজীবনের প্রতি আকর্ষণের দিকটি উন্মোচিত হয় এবং তাঁর সে-আকর্ষণ যে কেবলই উপর-উপর গোছের ছিল না তার প্রমাণ পরেও পাওয়া যায় যখন ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর এ কালেকশন অব কাছাড়ি ফোক-টেলস্। এ-গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন আরেক বিখ্যাত গবেষক রেভারেন্ড এস. এন্ডল। সে-ভূমিকায় কৃত এন্ডলের মন্তব্যে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য উঠে আসে। বিশেষ করে বোডো ভাষা সম্পর্কিত তাঁর মূল্যায়নটি ঐতিহাসিক-সামাজিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতেও গুরুত্ববহ। কেন তিনি একাজকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন তা আমরা গ্রন্থে প্রদত্ত এন্ডার্সনের মন্তব্য থেকে জানতে পারবো। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর মন্তব্যের খানিকটা নির্যাস থেকেও তাঁর কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে পারা যায়। তাঁর দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত অঞ্চলটির রয়েছে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় যেখানে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং ইসলাম এই তিন ধর্মের চমৎকার সমন্বয় সাধিত হয়েছে যা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। এখানে রয়েছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় সব লোককাহিনী। এসব গবেষণার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ অবকাশ এবং ধৈর্য যা এন্ডার্সনের জীবনে তত সুলভ না হলেও নিজেকে তিনি নিয়োজিত রেখেছিলেন দীর্ঘকাল। তিনি যে উচ্চপদস্থ ছিলেন তা তাঁর জীবনেতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে। সেই পদস্থতায় তিনি পৌঁছেছিলেন তাঁর নিরলস ও একাগ্র কর্মগুণেই। কক্সবাজারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখবো সেখানেও এতদঞ্চলে কর্মরত জে ডি এন্ডার্সনের প্রশাসনিক কাজের স্বীকৃতি বিদ্যমান। কক্সবাজার জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম ‘এন্ডার্সন রোড’ চট্টগ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সনের নামেই করা হয়েছিল। কর্মজীবনের শেষ পাঁচ বছর তিনি চট্টগ্রামেই কাটিয়েছিলেন।

চট্টগ্রামের প্রবাদবিষয়ক এন্ডার্সনের গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া ৩৫২টি প্রবাদের ধারাবাহিক প্রকাশনা প্রসঙ্গে আরও কিছু বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। বিষয় চট্টগ্রাম হলেও ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের এসব গবেষণা থেকে উপকৃত হয়েছিল সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপট। উইলিয়ম জোন্স প্রতিষ্ঠিত রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি এবং এর প্রকাশনা-জার্নালের অবদান স্মরণ করলে আমরা দেখবো ভারতবর্ষের বহুমাত্রিক দিকগুলো তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সূক্ষ্মভাবে এবং ইতিবাচক গবেষণার মধ্য দিয়ে সেসব কাজকে রেখে গেছেন মানসসম্পদরূপে। সেসব কাজের অনস্বীকার্য গুরুত্ব আমরা স্মরণই করি না, বর্তমানের গবেষণার ক্ষেত্রেও সেসবের তথ্য-জ্ঞানকে আমরা কাজে লাগাই। ১৮৬৫ সালের ঘটনাকেও আমরা আজও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। আজ থেকে প্রায় পৌণে দুইশ’ বছর পূর্বেই ভারতবর্ষের লোকগবেষণার এক অনন্য কর্মকা-ের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উপস্থিত। ১৮৬৫ সালের ১৯ জুন রেভারেন্ড জেমস লং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণাকর্ম উপস্থিত করেছিলেন রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তাঁর পঠিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘ফাইভ হানড্রেড কোয়েশ্চনস্ অন দ্য সোশ্যাল কনডিশন অব দ্য নেটিভস্ অব বেঙ্গল’। এটি পরে ১৮৬৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য জার্নাল অব দ্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন এ্যান্ড আয়ারল্যান্ড (নিউ সিরিজ)’-এর দ্বিতীয় খ-ের প্রথমাংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ৫২২ পৃষ্ঠার জার্নালটির ৪৪ থেকে ৮৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত জেমস লং-এর প্রবন্ধ।

লক্ষণীয় বিষয়, রেভারেন্ড জেমস লংকে আমরা এন্ডার্সন এবং অন্যদের করা এ-ধরনের গবেষণাকর্মের পূর্বসূরী হিসেবে চিহ্নিত করি কিন্তু জেমস লং ঠিকই তাঁর অনুপ্রেরণাদাতার ঋণ স্বীকারে কার্পণ্য করেন নি। তাঁর পূর্বে হ্যাক্সথাউসেন ককেশাস অঞ্চল সম্পর্কে যে-গবেষণা করেন লং সেটির উল্লেখ করেন। হ্যাক্সথাউসেনের কাজটি ছিল ককেশাস অঞ্চলের সাধারণ নি¤œজীবী মানুষদের সমাজজীবন সম্পর্কিত। তিনি যে খুব নিরাপদে কাজটা করতে পেরেছিলেন তা নয়। জারশাসিত রাশিয়াতে নিজের গবেষণার কাজে থাকতে গিয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বিভিন্ন বাধা, সন্দেহ ও বিরুদ্ধতার মোকাবেলা করতে হয় তাঁকে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জার্মান ফন হ্যাক্সথাউসেনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল জার্মান ও বিশ^সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব গ্রিম-ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে। অগাস্ট ফ্রাঞ্জ লুদভিগ মারিয়া, ব্যারন ফন হ্যাক্সথাউসেন-আবেনবুর্গ (১৭৯২-১৮৬৬) ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক, লোকগানের সংগ্রাহক। ১৮৪৩ সালে রাশিয়া ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে তাঁর গবেষণাকর্মগুলোর মুদ্রিত রূপ প্রকাশিত হয়। গ্রিম-ভ্রাতৃদ্বয়ের অন্যতম জ্যাকব ছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রে তাঁর সহপাঠী। অনেকের ধারণা তিনি যে লোকগান, গাথা, কিংবদন্তি, রূপকথার গল্প এসব নিয়ে গবেষণা করেন তার অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন গ্রিম ভাইদের নিকটেই। পূর্বসূরীর ঋণ স্বীকার করে রেভারেন্ড লং জানান, ভারতবর্ষে স্থানীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক প্রসারের প্রেক্ষাপটে লোকসাহিত্য সম্পর্কিত কাজের গুরুত্ব দেখা দিয়েছে। লং ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন যে একটা প্রচলিত সমাজ ও জীবনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্কৃতির যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে লোকমানসের পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ কতটা গুরুত্ববহ হতে পারে। লং আরও লক্ষ করেন, যে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং পরিবর্তমানতার বৃত্তান্ত সেসব যে সবসময় পুস্তকেই পাওয়া যাবে তা নয়। এর জন্যে প্রয়োজন সামাজিক লোকমানসের স্মৃতি এবং ঐতিহ্য’র দ্বারস্থ হওয়া। সে কারণেই রেভারেন্ড জেমস লং কলকাতার বিদ্বজ্জনদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যেটির সভাপতি হ’ন তিনি স্বয়ং। সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল ভারতীয় জনগোষ্ঠির নিজেদের সামাজিক জীবনের বিবিধ বিষয় সম্পর্কিত গবেষণা সম্পাদন করা।

১৮৭৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রেভারেন্ড জেমস লং রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটিতে আরেকটি প্রবন্ধ পাঠ করেন যেটির শিরোনাম ‘ওরিয়েন্টাল প্রোভার্বস্ ইন দেয়ার রিলেশন্স টু ফোকলোর, হিস্ট্রি, সোসিওলজি; উইথ সাজেশন্স ফর দেয়ার কালেকশন, ইন্টারপ্রিটেশন, পাবলিকেশন’। প্রবন্ধটিতে লং এগারো বছর পূর্বে (১৮৬৬ সালে) পঠিত প্রবন্ধটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, পূর্ববর্তী প্রবন্ধটির সূত্রে লোকবিষয়ক গবেষণায় যথেষ্ট সাড়া পড়েছিল। বস্তুত লং বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করলেও লোকসাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণায় বিশেষভাবে নিয়োজিত ছিলেন। এ-প্রবন্ধটিও ১৮৭৫ সালে লন্ডন থেকে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের সপ্তম খ-ের দ্বিতীয়াংশে প্রকাশ পায়। জার্নালটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৯৩, লং-এর প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয় ৩৩৯ থেকে ৩৫২ পৃষ্ঠা পর্যস্ত। এবারে জেমস ড্রমন্ড এন্ডার্সন রচিত চিটাগাং প্রোভার্বস্ গ্রন্থের ভূমিকাটি লক্ষ করা যাকÑ ‘প্রিফেস’ শিরোনামাঙ্কিত ভূমিকাটি নি¤œরূপ:

This little book is an imitation of Captain Gurton’s æAssamese Proverbs”, and is

intended, as the title page shows, to afford as the examples of the local dialects

of Chittagong, an unwritten speech of much interest. The collection does not

pretend to approach completeness as a storehouse of Chittagong rustic wisdom,

any additional proverbs will be gladly received by Baboo Raj Chandra Datta,

Magistrate’s Office Chittagong, by whom the majority of these Proverbs were

gathered together.

I trust someone may be induced to take in hand the local folk stories, which on

this border land of Hinduism, Buddhism and Islam are probably unusually

interesting. The task requires more leisure and patience than I have been able

to devote to it.

  1. D. A.

 

এন্ডার্সন রচিত গ্রন্থটির সর্বমোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৯০ এবং এতে মুদ্রিত হয়েছে সর্বমোট ৩৫২টি প্রবাদ। এগুলোর ইংরেজি অনুবাদও একই সঙ্গে দিয়েছেন গ্রন্থকার। আবার প্রয়োজনে ইংরেজিতে দিয়েছেন ব্যাখ্যা। তাছাড়া কোনো-কোনো প্রবাদের ক্ষেত্রে একই প্রবাদের অন্যভাষী বা অন্যজাতীয় উৎস থাকলে সেসবেরও উল্লেখ করা হয়েছে। উপর্যুক্ত ভূমিকা থেকে আমরা জানলাম চট্টগ্রাম জেলার ম্যজিস্ট্রেট অফিসের কর্মচারি জনৈক রাজচন্দ্র দত্তই প্রবাদগুলোর সংগ্রহে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। এন্ডার্সন কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করেছেন। এটিও অনুমান অসঙ্গত নয়, একা রাজচন্দ্রের পক্ষেও সবগুলো প্রবাদ সংগ্রহ সম্ভব ছিল না হয়তো। তিনিও প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা আদিষ্ট কাজটিকে সুসম্পন্ন করবার জন্য নিয়োগ করেছিলেন লোকবল। সেসব ইতিহাস আমাদের পক্ষে আজ আর জানা সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে কোনো গবেষক এ-বিষয়ে আরও আলোকপাত করতে সক্ষম হলে নিঃসন্দেহে তা হবে চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনসূত্র। এবারে আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রবাদগুলো লক্ষ করবো যেগুলো প্রথম প্রকাশিত হয় আজ থেকে একশ’ সাতাশ বছর আগে এবং যেগুলোর শেকড় নিহিত ছিল আরও প্রাচীন কালে। লং তাঁর গবেষণায় বলেছেন, ভারতবর্ষের অনেক প্রবাদের বয়স হাজার বছর। কখনও কখনও সেসবের ইতিহাস পাওয়া যায় না কিন্তু জনমানসের স্মৃতিতে গাথায় কবিতায় কিংবদন্তিতে সেগুলোর শেকড় নিহিত রয়েছে।

 

(১) দুধ দেওন্যা গাইয়ে লাথি দেয়নও ভালা।

“If a cow gives milk, never mind if it kicks you.” i. e., Do not criticize a benefactor,

do not look a gibt horse in the mouth.

 

(২) আরলা চৈর্লে মধ্যের দোকান।

Common rice in the shop’s midst.” – An upstart among his betters.

(৩) খাডি দিতে ন পার পৈররে নিন্দা।

He who cannot (afford to) dig a ditch criticizes another’s tank.” i. e., Presumption.

(৪) বাপে আজায় নাই চাষ্

ধান দাইতে কুড়াল লৈ যাস ॥

His father and grandfather never ploughed (are you surprised that) he goes to reap

with an axe?” Satirises pervenus.

(৫) (হল্দিয়া পাইক্) সাজ্দে মাজ্দে ধেচুয়া রাজা।

It is well known that while the golden oriole was dressing for its coa wiseronation, the black dhechua went and got crowned king. i. e., Procastination is the thief of time. Also, fine feathers do not make fine birds. There is an allution to a local parable.

 

 

(৬) মা গুনে পোয়া ভুঁই গুনে রোয়া ॥

A mother’s merits make the son, as on the soil’s qualities depend the crop.”

Tis a wise mother that has a wise child.

 

(৭)  ভালা ঠাকুরের চাকরি, তিন জন মৈল হা করি ॥

A nice billet my master has!

Three (of the family) have died gaping (with starvation).” Used of unprofitable

undertakings : Employment on poor pay & c. Said by the dependants of a poor or

resourceless man.

 

(৮) কিলাই ভুঁইচাল ধাবান্ ।

He beats so hard that the earth quakes.” Used, quite seriously, as a threat; not sarcasm.

 

(৯) মৈর্ষ পিডত্ চড়িলে যম নয়।

Riding a buffalo does n’t make you the God of death.”

Yama is represented in the Hindoo scriptures as mounted on a buffalo. Satirises presumption.

 

(১০) চোররে কয় চুরি র্ক, গিরস্থরে কয় হজাগ্ থাক্।

Double dealing – He tells the thief to steal, but warns the householder to be on the

look out.

(ক্রমশ)

 

ড. মহীবুল আজিজ, কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

 

 

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয় না

শোয়েব নাঈম শব্দের মধ্যেই থাকে জীবনের আসল দর্শন। শব্দের কারণেই মানুষ হয় নির্বাসিত। এখন মঙ্গলের অমরতায় ঘামছে গ্রীষ্মের বৈশাখ মাস। মঙ্গল এই শব্দবোধে যতটা কল্যাণ

চীনের মতো আমাদেরও ভাবা উচিত

আমির হোসেন চীনে ফেসবুক, ই’নস্টাগ্রা’ম, ইউটিউব, গুগল, গুগল ম্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপ, এমনকি ক্রোম ব্রাউজারও ব্যান! শুরুতে শুনে বিরক্ত লাগলেও এখন বুঝতে পারছি- ওরা আসলে অনেক আগেই

গল্পশূন্য জীবনের ইতিকথা

আন্দরকিল্লা ডেক্স : আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন, শ্রমিক ছিলেন। থাকতেন মাটির কাঁচা ঘরে। অর্থাভাবে-অন্নাভাবে কখনও-সখনও উপোসও করতেন। পরতেন মলিন পোশাকপরিচ্ছদ। আমাদের বাবারা চাইলেন আমরাও যেন

সংস্কার চাই : চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন

নিখিল রঞ্জন দাশ সম্প্রতি চট্টগ্রাম এম.এ. আজিজ স্টেডিয়ামকে আগামী ২৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারশনকে দেয়া হবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজনে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের ৬০

চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তুলল মৈত্রেয়ীর জীবনে “মির্চা, মির্চা আই হ্যাভ টোল্ড মাই মাদার দ্যাট ইউ হ্যাভ কিসড মাই ফোরহেড'”

নহন্যতে উপন্যাসে মৈত্রেয়ী দেবীর এই উক্তি টি অবশ্যই পাঠকদের মনে আছে? মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেম কি শুধুই প্রেম ছিল নাকি সেই সাথে কিছু