অনুবাদ: আলম খোরশেদ
১৯৭১ এর স্মৃতি ছিল দুঃখের, তবে তার প্রাপ্তি ছিল দারুণ!
২৬শে মার্চ আমরা বোমা বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ভয় পেয়ে গিয়ে আমি মাকে ডাকি। তিনিও ভয় পেয়ে বাবাকে ডেকে তোলেন। তিনি আমাদেরকে শান্তিতে ঘুমাতে বলেন। তিনি বলেন, গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তবুও আমাদের চোখগুলো ভয়ে চকচক করে ওঠে, যখন অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিলাম।
২৭শে মার্চ আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম লোকজন ছোট্ট বাক্সপ্যাঁটরা আর খাবার নিয়ে পায়ে হেঁেট গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে, যেহেতু তারা ভেবেছিল শহরে থাকা আর নিরাপদ নয়। রাতের বেলায় সবকিছুই শান্ত ও শান্তিপূর্ণ মনে হয়েছিল। আমরা কেবল বিছানায় উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ মেশিনগানের আওয়াজ শুনতে পাই। আমার বাবা বেরিয়ে আসেন। তিনি আমাদের ছাদের ওপর দিয়ে লাল হলুদ রঙের আলো ছুটে যেতে দেখে ভয় পেয়ে যান। বাবা আমাদের সবাইকে ডেকে পেছনের দেয়াল ও আমার কাজিনের বাড়ির মাঝখানের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন।
অবশ্য ২৯শে মার্চের দিনটা আমরা শান্তিতে কাটাই। দুপুর তিনটায় সাতটা ট্রাক আমাদের বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে মালপত্র নিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে গেল। আমার বাবা সেটা দূর থেকে দেখেন। একজন সৈনিক বাড়ির দিকে হেঁটে যাওয়া এক লোককে থামায়। কোনো প্রশ্ন না করেই সে তাকে ডানে বাঁয়ে থাপড়াতে থাকে। আরেকজন সৈনিক আমাদের
দেয়ালের ওপর দিয়ে নিচু হয়ে আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, ”আপনি কী?”
আমার বাবা জবাব দেন, ”আমি খ্রিস্টান।”
”ভেতরে যান।” সৈনিকটি হুকুম দেয়।
আমরা এখানে আরও দুই কি তিনদিন থাকি। এরপর আমার বাবা সিদ্ধান্ত নেন, পেছনের পাহাড়ে অবস্থানরত সৈন্যদের এত কাছে এখানে থাকাটা অসম্ভব, তাই আমরা আরেকটু দূরে সরে যাই। প্রভুর সাহায্যে, সৈন্যদের নাকের ডগা দিয়েই আমরা নিরাপদে আরেকটি দোতলা বাড়িতে চলে যাই, সেখানে আরও দুতিনটা পরিবারের সঙ্গে আমরা মাস তিনেক থাকি। এই সময়টাতে আমরা যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে যাই সেসব ছিল অসহনীয়: বাতি ছিল না, দোকানপাট বন্ধ, পানিও নাই; আমরা কাছের একটা কুয়ো থেকে পানি টেনে আনতাম, তারপর তা শোধন করে পান করতাম। পানির স্বল্পতার জন্য আমরা বেলা তিনটা কি চারটার দিকে ¯œান করতাম। এই সময়টাতে কোনো রেডিয়োর খবরও শোনা যেত না। আমরা লোকের মুখ থেকে যে-খবরগুলো পেতাম সেগুলো খুবই সত্যি ছিল: তরুণীদের তুলে নিয়ে যাওয়া, লুটপাট, খুন, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এই সবই ঘটছিল তখন। এই সময়টাতে বাঙালিদের জন্য আমার প্রাণ কাঁদছিল। কী হবে আমাদের?
আমি বিজয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজের কথা ভেবেছিলাম। আমি একটা কিশোরী মেয়ে? কী হবে আমার? এরকম কিছু ঘটার চেয়ে মরে যাওয়াইতো ভালো। তারপর আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি এবং বলি, ”আপনিই আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আপনিই জানেন কী সবচেয়ে ভালো। আপনিই আমাদের একমাত্র আশ্রয় ও প্রশ্রয়।” এই প্রার্থনা আমাকে অনেক সান্ত¦না দিয়েছিল।
তারপর দেশের অবস্থা অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসে। সরকারি আদেশে স্কুল ও অফিস আদালত খোলে। আমার স্কুলও আবার খুলেছিল, কিন্তু আমি আর যাইনি, কেননা আমার বাবা ভেবেছিলেন, কিশোরী মেয়েদের বাড়ি থেকে বার হওয়া ঠিক হবে না।
দিনে দিনে অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আমি জিনি লর্কাবি ও লিন সিলর্ভানেইল আন্টিদের সঙ্গে থাকতে যাই। আমি অক্টোবর মাসে স্কুলে যোগ দিই, আমি ভাবি আমার পড়াশোনার আর দেরি করা উচিত না, যেহেতু এটাই আমাদের জাতির মেরুদ-।
এই সময়টাতে মুক্তিযোদ্ধারাও শত্রুদেরকে দান ছেড়ে দেয়নি, যদিও তারা তখন অস্ত্র ও গোলাবারুদের দিক থেকে অতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। একদিন স্কুল থেকে আসার পথে একটা মোড় ঘোরার পরই দেখি লোকজন ছোটাছুটি করছে এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আমরা আন্দাজ করতে চেষ্টা করি ব্যাপারটা কী এবং ড্রাইভারের কাছে তা জানতে চাই। তিনি বলেন, ”একটা বোমা ফুটেছে।” আমরা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে আরেকটা পথ ধরার সময় আমি দেখতে পাই, একটা তরুণ ছেলে ফুটপাথে শুয়ে আছে এবং তার সারা শরীরে রক্ত।
মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। তারা তাদের কাজে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শেষপর্যন্ত যুদ্ধ করার ব্যাপারে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। এত শাস্তিভোগের পরও আমাদের তরুণ যোদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল।
তারপর ডিসেম্বরের ৪ তারিখ সকাল সাতটার দিকে আমরা প্লেনের আওয়াজ পাই, যাকে প্রথমে বজ্রপাতের আওয়াজ বলে মনে হচ্ছিল। দিনটা যেহেতু মেঘলা ছিল সেহেতু আমি ভেবেছিলাম বজ্রপাতই বুঝি হচ্ছে। জিনি আন্টি বলেন, প্লেনগুলো বন্দরের দিকে বোমা নিক্ষেপ করছে। প্রভুর কাছে প্রার্থনা করা ও নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। কার্ফ্যু জারি করা হয়েছিল, এবং নয়টা নাগাদ বোমাবর্ষণ থামে। ú্রকৃতি কাজ করে যাচ্ছিল সুচারুভাবেই: জোরালো পশ্চিমা বাতাস বইছিল এবং সূর্য ওঠার পর মেঘলা ভাবটাও কেটে গেল। শহরটা শান্ত, সুনসান ছিল; শুধু রাস্তায় কিছু সৈন্যের উপস্থিতি ছাড়া। আমি চিন্তায় হারিয়ে যাই; আমি খুব একা ও নিঃসঙ্গ বোধ করি।
দুপুরে কার্ফ্যু তুলে নেওয়া হয়েছিল। মি. মিনিখ আসেন তখন এবং তাঁরা ভাবেন আমাদের এই বাসা ছেড়ে তাঁদের ওখানে চলে যাওয়া উচিত। আরও আটটা মেয়ে ছিল আমাদের সঙ্গে। এই দিনগুলোতে প্রত্যেকদিন বিকেল তিনটায় ঠিক চায়ের সময় বোমা ফেলছিল বিমানগুলো। হয় চায়ের ঠিক আগে অথবা ঠিক পরপর প্লেনগুলো আসত। কেউ বাইরে থাকলে, দৌড়ে ঘরে চলে আসত এবং সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়ত।
রাতের বোমাবর্ষণ ছিল অনেক লম্বা সময় ধরে, সেটা খুব মারাত্মক ছিল। বাড়িঘর কাঁপত, আমরা জানালার কাচের ঝনঝন শব্দ শুনতে পেতাম। আতঙ্ক পেয়ে বসে আমাকে। আমার মুখ থেকে আর কিছুুই বোরোয় না প্রভুর নাম ছাড়া, ”প্রভু, আমাদেরকে রক্ষা করো।”
আমাদের প্রতিদিনের খাবার ছিল ভাত, তরকারি আর টিনের মাছ। আমরা এটা খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তবে সেটা একেবারে অভুক্ত থাকার চেয়ে ভালো ছিল। যারা এই খাবারগুলো পাঠিয়েছিল তাদেরকে ধন্যবাদ।
১৬ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় একজন প্রতিবেশী জিনি আন্টির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। সবার মনোযোগ একটা সুঁইয়ের আগায় নিবদ্ধ ছিল, যখন তিনি তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। তিনি যখন ফিরে আসলেন, তখন আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ঘটনা কী। তিনি বলেন, ”পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে।”
আমাদের হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারিনি আমরা, কেননা শত্রুসৈন্যরা তখনও চট্টগ্রামে রয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের কাছ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।
তারপর সন্ধ্যা সাতটায় দুটো রেডিয়োতে, একটা মিনিখ আঙ্কল ও অন্যটা জিনি আন্টির, আমরা খবরের পর খবর শুনি! ভারত থেকে ইথারে ভেসে আসা বক্তৃতা। হ্যাঁ, পাকিস্তানি সৈন্যরা সত্যি আত্মসমর্পণ করেছে। মিনিখ আঙ্কেল একটা বাংলাদেশের পতাকা জোগাড় করেন এবং সেটা আমাদের ডাইনিং টেবিলে রাখেন। আমাদের চট্টগ্রামে বিজয়ের প্রথম উদ্যাপন হয় এই বাড়িতেই।
তারপর ১৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্যরা চট্টগ্রাম প্রবেশ করে। এটা একটা আগ্নেয়গিরির মতো ছিল, যা ফেটে পড়বার জন্য যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশে দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় ছিল! সব জায়গাতেই বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল আর লোকেরা চিৎকার করে বলছিল, ’জয় বাংলা!’ — নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর এই প্রথমবারের মতো, সাত কোটি মানুষের এক ও অভিন্ন আত্মার ভাষা হয়ে উঠেছিল যেন তা।
এটা দুঃখের সময় ছিল, ছিল আত্মত্যাগের মৌসুম; এটা একটা সত্যিকার সংগ্রামের কালপর্ব ছিল। সোনালি বাংলাদেশ ফকফক করছিল পূর্ণিমা রাতের তারার মতো, নৃশংসতা ও শত্রুতার শেষে ঝড় থেমে-যাওয়া শান্তির মতো। সাতকোটি মানুষের জীবন যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল- আর কোনো ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে হবে না তাদেরকে।
আমরা সাহসী ও শক্তিশালী, অগুনিত তরুণ প্রাণের মৃত্যুর জন্য শোক করি, যারা দাসত্বের পরিবর্তে বুলেটকে বেছে নিয়েছিল। গান ও কবিতায় ঘেরা শান্তির ময়দান থেকে বাংলার তরুণদের টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আধুনিক রণাঙ্গনের চৌহদ্দিতে। কিন্তু তারা দ্রুতই সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। সোনালি মাতৃভূমির সেইসব সন্তানের প্রতি আমাদের গভীরতর শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি যারা স্বৈরাচার, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
আমরা এখন সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষারত।
(উৎস: কর্মব্যপদেশে বাংলাদেশে: একাত্তরের যে-গল্প ছাপেনি কোনো সংবাদপত্র, জিনি লর্কাবি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, সেপ্টেম্বর, ২০২২)
আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক,গবেষক ও অনুবাদক