আলম খোরশেদ
আজ আমি একটি গ্রন্থের কথা বলতে এসেছি। এর নাম, আমার পিতা নয় পিতার অধিক। এই পিতা কোনো ব্যক্তিবিশেষের জনক নন, তিনি খোদ আমাদের জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর, এর লেখকও নন কোনো যেনতেন সৌখিন সাহিত্যিক কিংবা মৌসুমি মুজিব-প্রেমিক। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি প্রায় কৈশোরকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে একদিকে যেমন রাজপথে নেমেছিলেন বিক্ষুব্ধ চরণে, অন্যদিকে তেমনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর শাণিত কলমখানি, যার অবিরল দ্রোহোচ্চারণ আজও সুতীব্র আবেগে, সবেগে বহমান। তিনি আর কেউ নন, কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মিনার মনসুর। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল অবধি রচিত তাঁর অসংখ্য রচনা থেকে মোট একত্রিশটি নিবন্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সুনন্দ গ্রন্থখানি, যার প্রথম ভাগে রয়েছে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও বাংলাদেশকে নিয়ে রচিত ষোলোটি আবেগমথিত, রাজনৈতিক প্রবন্ধ এবং দ্বিতীয়াংশে দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ও প্রেরণাসঞ্চারী ব্যক্তিবর্গের প্রতি শ্রর্দ্ধাঘ্য ও স্মৃতিচারণামূলক পনেরোটি ব্যক্তিগত গদ্য।
সন্দেহ নেই, বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম-শতবর্ষে তাঁর প্রতি এক অনন্য ও অনুপম শ্রদ্ধার্ঘ্য এই বই, কিন্তু পাশাপাশি এটি আমাদের ইতিহাসের এক অমূল্য আকরগ্রন্থও বটে। কেননা ১৯৭৫ এর রক্তাক্ত আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নির্মম ও নৃশংসভাবে– ইতিহাসে যে-বর্বরতার কোনো তুলনা পাওয়া ভার– হত্যা করার অব্যবহিত পরের অধ্যায়টুকু সম্পর্কে, বিশেষত এহেন ন্যাক্কারজনক, কাপুরুষোচিত, অমানবিক পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে সংঘটিত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঘটনাবলি বিষয়ে, সম্যক অবহিত নই আমরা অদ্যাবধি। এই গ্রন্থের বেশ কয়েকটি রচনা, যেমন নাম-নিবন্ধ ‘আমার পিতা নয় পিতার অধিক’, বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ‘একুশ বছরের যত মুখ ও মুখোশ’, ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’, ‘রাসেলের মৃত্যু আমার জীবন বদলে দিয়েছিল’ ইত্যাদি এই শূন্যতাটুকু পূরণ করে, ইতিহাসের অনালোকিত এই অধ্যায়টিতে আলো ফেলতে সক্ষম হয় প্রগাঢ় ঔজ্জ্বল্যে। আমরা জানতে পারি, ঢাকার বাইরে, অন্তত চট্টগ্রামে এই জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিবাদ হয়েছিল বেশ জোরালোভাবেই, এবং তা সংঘটিত হয়েছিল কয়েকজন সদ্যতরুণের নেতৃত্বে, আলোচ্য গ্রন্থের লেখক ছিলেন যাদের মধ্যে অন্যতম।
এর পেছনে প্রধান প্রণোদনাটুকু হয়তো ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর দুর্মর ভালোবাসা, রাসেলের মতো একটি অপাপবিদ্ধ কিশোরের এমন অপমৃত্যুজনিত শোক এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর প্রায় গোটা পরিবারটির এমন রাতারাতি পৃথিবীর বুক থেকে নির্মূল হয়ে যাওয়ার গভীর বেদনাময় অভিঘাত। তবে এটাই সব ছিল না, কেননা মিনার মনসুর সব দিক থেকেই ছিলেন সময়ের থেকে অগ্রসর এক তরুণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, রাজনীতিসচেতন একজন স্বাপ্নিক মানুষ, যার চোখেমুখে তখন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। তাঁর এই সাম্যের স্বপ্ন আর এই সংগ্রামী চৈতন্যই তাঁকে অদ্যাবধি যুক্ত রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির অধিকতর প্রগতিশীল ধারাটির সঙ্গে। অনেক প্রলোভন আর অনেক ভীতিপ্রদ ষড়যন্ত্রের মুখেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সেই উত্তোলিত, অভয়-আঙুলখানিকে ছেড়ে দেননি, বরং সেই হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁর অপর অস্ত্র, শাণিত ও শক্তিমত্ত কলমখানি। সেই কলম-নিঃসৃত সোনালি শস্যের সৌরভ আর প্রগাঢ় পুষ্টিতেই পূর্ণ হয়েছে এই গ্রন্থের ত্রিশোর্ধ্ব রচনার আত্মা ও শরীর। দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
“কেবল বুটের বিকট শব্দ-কণ্টকিত সেই হিমরাত্রির কথা কি কারো মনে আছে? যখন ঘাতকের বুটে বিদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের বুক, যখন যুগপৎ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতা মুখ থুবড়ে পড়েছিল রক্তার্জিত বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর, যখন মানুষের বর্বরতা দেখে বাংলার শ্যামল নিসর্গ মূক হয়ে গিয়েছিল বর্ণনাতীত এক বিস্ময়ে-বেদনায়-শোকে? আর পঁচাত্তর পরবর্তী ভয়াল নৈঃশব্দ্যপীড়িত সেই বছরগুলোর কথা- যখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের ন্যূনতম সাহস-সততাটুকুও খুইয়ে বসেছিলাম আমরা? বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে পুষ্ট অনেক রথী-মহারথীর কাছেও যখন বঙ্গবন্ধু এক নিষিদ্ধ, উচ্চারণ-অযোগ্য নাম? কারো মনে আছে কি বাংলার সেই আধুনিক চারণকবির কথা? ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’- রবীন্দ্রনাথের এই অভয়মন্ত্র বুকে ধারণ করে রবীন্দ্রনাথের মতোই দীর্ঘদেহী, শ্মশ্রæমÐিত, অকুতোভয় যে-কবি বলেছিলেন, ‘আমি আজ শেখ মুজিবের কথা বলতে এসেছি’- সেই কবির কথা? মনে আছে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই তরুণদের কথা, যারা সামরিক একনায়কের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে প্রকাশ করেছিল এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় নামের সেই দুঃসাহসী সংকলন? আর চট্টগ্রামের কৈশোর-উত্তীর্ণ সেই দুই তরুণ- যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এপিটাফ, শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ, এবং আবার যুদ্ধে যাবো-র মতো তীব্র প্রতিবাদী সংকলন প্রকাশ করেছিল এবং স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়ে যার একটি কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল সেই সময়ে- তাকে মনে আছে কি কারো?” (একুশ বছরের যত মুখ ও মুখোশ)
না, মনে ছিল না অনেকেরই, এমনই বিস্মৃতি-প্রবণ জাতি আমরা। আর তাই তো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এমন একটি গ্রন্থের, যা আমাদের মনে করিয়ে দেবে ইতিহাসের এইসব উপেক্ষিত অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ, যা এই প্রজন্মের সদস্যদের একাধারে শিক্ষিত, সচেতন ও উজ্জীবিত করবে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজগুলোকে সম্পূর্ণ করার ব্রতগ্রহণে। আরেকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক:
“চূড়ান্ত বিচারে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বলতে যে-সামগ্রিক ধারণাটি আমরা পাই তা হচ্ছে, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে দারিদ্র্য ও সকল প্রকার বৈষম্যমুক্ত একটি ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অতএব, যিনি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন না, যিনি নারী-পুরুষের সমঅধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন এবং যিনি দরিদ্রদের স্বার্থবিরোধী কাজ করেন, তিনি কখনোই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হতে পারেন না। এটাই হলো মূল কথা এবং এই কথাটা সহজভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরাটাই হলো বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারীদের প্রাথমিক কর্তব্য। আর চূড়ান্ত কর্তব্য হচ্ছে সেই স্বপ্নের যথাযথ বাস্তবায়নে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিবেদিত করা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এবং নব্য মোশতাকচক্রকে প্রতিহত করার এটাই সর্বোত্তম পন্থা। একমাত্র পন্থাও বইকি।” (বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম পন্থা কী)
বস্তুত, গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি লেখাতেই তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই সত্য ও স্বপ্নের কাছেই উপনীত হন বারবার। তাঁর মাথা আকাশ স্পর্শ করলেও পা ছিল মাটিতে নামক নিবন্ধেও তাই দেখি তিনি ঐতিহাসিক সালাহউদ্দীন আহমেদের মুখ দিয়ে এই কথাটিই বলছেন, ‘প্রতিকৃতিতে ফুলের মালা দিয়ে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোনো অর্থ নেই, যদি আমরা তাঁর আদর্শগুলো মনে না রাখি, যদি তাঁর স্বপ্ন-আদর্শ থেকে সরে যাই।’ সত্যি বলতে কি, বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন-আদর্শকে বুকে ধারণ করে, তার আশু বাস্তবায়নের কথাটিই মিনার মনসুর তাঁর ভাষায়, ‘সহজ কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে’ বারবার করে বলে গেছেন এই বইয়ের পাতায় পাতায়। সমকাল ও উত্তরপ্রজন্ম তাঁর কথা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে অবধান করবেন, এই প্রত্যাশা তো আমরা করতেই পারি।
নামগুলো যেন তারার মতো উপশিরোনামাঙ্কিত গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশটি মূলত বাংলার নক্ষত্রপ্রতিম কয়েকজন মহান মানবের প্রতি লেখকের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শংসাবচনের হার্দ্য সংকলন। এঁদের মধ্যে আছেন তাঁর সক্রিয় রাজনীতি-জীবনের অভিভাবকতুল্য ক‘জন: আবদুর রাজ্জাক, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, নুরুল ইসলাম, মোনায়েম সরকার প্রমুখ; রয়েছেন তাঁর সাহিত্যিক ও সাংবাদিকজীবনের প্রেরণার উৎস রণেশ দাশগুপ্ত, বেগম সুফিয়া কামাল, অন্নদাশঙ্কর রায়, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, বজলুর রহমানের মতো বাতিঘরতুল্য মহাপ্রাণেরা। আর অবধারিতভাবে আছেন তাঁর আজীবনের প্রেরণার পাত্র ও সাধনার ধন ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই লেখাগুলো এবং প্রথমার্ধের বঙ্গবন্ধুবিষয়ক অধিকাংশ রচনাই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সাংবাদিকজীবনের দুই প্রধান ঠিকানা দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। এর বাইরে কিছু লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তর, মাসিক সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকায় এবং রাইজিংবিডি.কম ও পূর্বপশ্চিম.কম নামক দুটি অন্তর্জাল সংবাদ-বাতায়নে। লেখাগুলোর প্রকাশকালের মধ্যে দীর্ঘ বাইশ বছরের ব্যবধান থাকার কারণে প্রচুর পুনরাবৃত্তি ও ক্ষেত্রবিশেষে সালতারিখের অসংগতি লক্ষ করা গেছে। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে লেখক, গ্রন্থের এই দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূরীকরণের উদ্যোগ নেবেন। আর প্রকাশকের উদ্দেশে বলি, এই বইয়ে বাংলাদেশের অপরাপর অনেক গ্রন্থের তুলনায় মুদ্রণপ্রমাদ অনেক কম হলেও, তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পেরেছে সে কথা বলা যাবে না। এছাড়া পুস্তক সম্পাদনার কিছু ত্রæটিও চোখে পড়েছে এই আলোচকের। যেমন গ্রন্থের মূল শিরোনামের সঙ্গে একটি উপশিরোনাম থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল, যা থেকে পাঠক প্রথমেই এই গ্রন্থের প্রকৃতি ও পরিচয় বিষয়ে একটি ধারণা পেয়ে যেতে পারে। গ্রন্থের প্রধমার্ধের লেখাগুলোকে কালানুক্রমিকভাবে সাজানোর একটা চেষ্টা ছিল, কিন্তু এক পর্যায়ে এসে সেটাকে আর রক্ষিত হতে দেখা যায়নি, আর দ্বিতীয় অংশে তো তার বালাই-ই ছিল না। এছাড়া, অনেক লেখার প্রথম প্রকাশস্থল ও প্রকাশতারিখ অনুপস্থিত ছিল, যা গ্রন্থটির সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠার পথে বিঘœ সৃষ্টি করে। আশা করি, প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে এই আপাত তুচ্ছ কিন্তু পুস্তকের সর্বাঙ্গীন সৌন্দর্য ও সম্পাদনার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে সদয় দৃষ্টিপাত করবেন।
সবশেষে বলি, সুকান্ত-কথিত যে ‘আঠারো’র শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এই গ্রন্থের রচয়িতা তাঁর প্রথম যৌবনেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং সত্য, সুন্দর ও সাম্যের জয়গান গাইতে, এই গ্রন্থ পাঠ করে প্রত্যাশা জেগেছে যেন সেই ‘আঠারো’ই নেমে আসে এদেশের বুকে পুনরায়, এই অভাগা দেশটিকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে দেখা সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তোলার মহান অভিপ্রায়ে। শুভ পাঠ!

ভাষার যতো মান অপমান
অজয় দাশগুপ্ত : বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমাদের মাতৃভাষার নাম বাংলা ভাষা। আপনি আশ্চর্য হবেন জেনে প্রবাসের বাঙালিরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের সন্তানদের বাংলা শেখায়। এ