আ.ম.ম. মামুন :
সূচেতনা, তুমি এক দূরতম দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।
আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্র ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুসিয়াসের মতো আমাদের প্রাণ
মুক ক’রে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে-এ পথেই পৃথিবীর ক্রম মুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল:
প্রায় এতদূর ভালো মানব সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাত
গড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।
মাটি-পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি
না-এলেই ভালো হতো অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হলো হবে মানুষের যা হবার নয়Ñ
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
[সুচেতনা, বনলতা সেন]
‘সকলেই কবি নয়’ কেউ কেউ কবি’ আমার মতো কেউ নাই আর’ কিংবা ‘আমি আমারি মুদ্রাদোষে হয়েছি সবার থেকে আলাদা’Ñএরকম আরও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত স্পষ্ট বাক্যোচ্চারণ করে যিনি বাংলা কাব্যলোকে আবির্ভূত হয়েছেন, তিনি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। জীবনানন্দ দাশের কাব্যচর্চার সূচনাপর্ব ছিলো তাঁর কর্মজীবনের মতোই অমসৃণ। সমকালে আর কোন কবিকে এতোটা অবহেলা, অবমূল্যায়ন ও নির্দয় সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি। এক সজনীকান্তই কবির জীবনকে কেবল ক্ষতবিক্ষতই করেননি, দুর্বিসহ করে তুলেছিলেন। আবার অন্যদিকে কবির মৃত্যুর পর আরো স্পষ্ট করে বললে, বিশ শতকের শেষ পর্বে এসে বাংলা কবিতার জনপ্রিয়তম কবিও সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ।
জীবনানন্দ দাশের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেব বসুকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, তার কবিতা ‘চিত্ররূপময়’ এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ সন্দেহ নেই এই ‘লক্ষ্যভেদী’ মন্তব্যের ভেতর জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়েছে। সমসাময়িক বুদ্ধদেব বসু, যিনি জীবনানন্দের ‘অভিনব কাব্য ভাষার’ বড় সমর্থক, যিনি তিন তিনটি প্রবন্ধ (জীবনানন্দ দাশ: ধূসর পান্ডুলিপি, জীবনানন্দ দাশ: বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে) লিখে পাঠককে অনেকটা বাধ্য করেছিলেন জীবনানন্দ পাঠে, তিনি তার ‘নির্জনতম কবি’ বলেই ক্ষান্ত হননি, আরও যোগ করে বলেছেন, ‘তাঁর কবিতা, চিত্রবহুল; তাঁর চিত্র বর্ণবহুল; তার বর্ণ বর্ণনাবহুল।’-দীপ্তি ত্রিপাঠী তো, এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি বলে জীবনানন্দের কাব্য মূল্যায়নে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরী করে দিয়েছিলেন, এক রকম সিল মেরে দিয়েছিলেন।
যাঁকে নিয়ে এতো কথা, যার কবিতা প্রসঙ্গে এতো এতো বিশ্লেষণ সেই নিজের নির্জনে ডুবে থাকা, মিতবাক কবি তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় মোক্ষম জবাবটাই দিয়েছেন।
‘‘……..প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্যÑ কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়।’
একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, জীবনানন্দ দাশের কবিতা আমাদের সামনে এমন এক জগৎ ও জীবনকে উন্মোচন করে যা বড়োই রহস্যময়, নেতি ও অস্তির আলো ও আঁধারের এবং আশা ও হতাশার দোলাচলে দোদল্যমান।
একটি প্রকৃত কবিতা পুরোপুরি বুঝে ওঠা প্রায় অসম্ভব। প্রকৃত কবিতার প্রাণ অফুরান। কবিতায় আনন্দ লাভটাই সার। তবুও আধুনিক জীবনকে ধারণ করতে গিয়ে আধুনিক কবিতাও হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য, জটিল ও রহস্যময়। একটি কবিতা বুঝে ওঠার জন্য জরুরিÑকবিতার মুদ্রিত কাব্যে কী বলা হয়েছে তা নয়, কী বুঝোনো হয়েছে তা বুঝে ওঠা। কবিতার বর্ণিত অর্থ-আর নিহিতার্থে দুস্তর ব্যবধান। তবু সে কবিতার কবি যদি জীবনানন্দ দাশ তাহলে সে ব্যবধান যোজন যোজন। তাই জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তে গেলে পাঠককে একটু নড়েচড়ে বসতে হয়। বাড়তি আয়োজন করতে হয়। প্রতিষ্ঠিত বোধ ও বিশ্বাসে পুরোপুরি কাজ হয়না। জীবনানন্দ গবেষক গাজী আজিজুর রহমান যথার্থ বলেছেনÑ
“ জীবনানন্দের কাব্যভুবনে প্রবেশের আগে পাঠককে একটা প্রস্তুতিকাল অতিক্রম করতে হয়। প্রস্তুতিটা প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো মতো, বাতাসের বেগ নির্ণয় করে ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। দমকা হাওয়ার মতো হুট করে তার প্রকোষ্টে ঢুকে পড়লে নিভে যাবে লণ্ঠন। তখন নিশি পাওয়া অন্ধকারের প্রবঞ্চনা ভোগ করতে হয় পাঠককে। …. তার পৃথিবীর অতিথি হতে গেলে অনেক কুয়াশা ভেঙে কাদা কাঁটা মাড়িয়ে জলের পর জলের ঘোল পেরিয়ে প্রান্তর পাহাড়, অতিক্রম করে, রক্ত ঝরিয়ে তবেই প্রবেশ করতে হয় তাঁর আলো-অন্ধকার কাব্যমন্দিরে। জীবনানন্দের জলে ডুব দিতে গেলে প্রথমে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামতে হয় পা জলে। তারপর হাঁটুজল, তারপর বুকজল, গলাজলে। নাকজলে ডোবার আগেই সমাপ্ত করতে হয় জল ¯œানের বিভূতি। তাঁর কবিতার ঘোরানো সিঁড়ি, পেচানো পথ, নানা বাঁকের বীষ্পায়ন বহুমাত্রিক, ইন্দ্রিয়ানুভব কাছকে দূর, দূরকে কাছে ঝরবে যে প্রতিবচন তা যতনা সহজ ও সুন্দর, দূরহ প্রতীতিই তার প্রকরণিক অবভাস। বাঁশের শুকনো ঝরা পাতা ঘুরে ঘুরে যেমন বিদ্ধ করে বায়ু, ব্যাধের অদৃশ্য শর কোমল হরিণকে, তেমনি জীবনানন্দের কবিতা বিদ্ধ করে পাঠকের হৃদয় মন বোধকে। এভাবে বাংলা ভাষার আর কোন কবির কবিতা অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী হয়নি।
[কবিদের কবি, পৃষ্ঠা-৭]
আমরা এখন, জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতাÑ‘সুচেতনা’ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো।
‘সুচেতনা’ কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) কাব্যগ্রন্থ ভুক্ত একটি কবিতা। জীবনানন্দ দাশের মধ্য পর্যায়ে লিখিত এটি তাঁর একটি ‘প্রতিভূ-কবিতা’। ‘যার প্রকরণ ও প্রসঙ্গে জীবনানন্দীয় চারিত্র্য খচিত হয়ে আছে।’ এই কবিতায় সুচেতনা সম্বোধনে কবি তাঁর প্রার্থিতা, আরাধ্য এক চেতনানিহিত বিশ্বাসকে মুদ্রিত করেছেন। সুচেতনা শব্দটি উচ্চারণে এবং সু উপসর্গযোগে সুচেতনা শব্দের পর যুক্ত কমা সুচেতনাকে একজন নারী বলেই বোধ হয়। সম্বোধনসহ প্রথম স্তবকে প্রেমের একটু অনুরণন দোলা দিয়ে উঠতে দেখে পাঠকের কাছে এটিকে নিতান্ত প্রেমের কবিতা বলে মনে হতে পারে। তবে ঐ মনে হতে পারা পর্যন্তইÑ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য নারী যেমন ব্যক্তি নারীতে সীমাবদ্ধ না থেকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উত্তীর্ণ- সুচেতনাও তার ব্যতিক্রম নয়। ব্যক্তির জটিল দুর্গম অন্তর্লোক থেকে বিশ্বময় অস্থির সময় ও সংকট কবিতার মর্মবাণী হয়ে উঠেছে। [সুচেতনা, তুমি এক …….আমার হৃদয়]
কবিতার প্রথম স্তবকে ‘সুচেতনা’ সম্বোধনের মৃদু ধাক্কাটা সামলে উঠলে বুঝা যাবে ‘সুচেতনা’ মানে শুভ চেতনা, শুভবোধ, জাগ্রত চেতনা। এই শুভবোধ শূন্য হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। পৃথিবী ঠিকঠাক চলে না। কিন্তু সে সুচেতনা আজ ‘দূরতর দ্বীপ’ যার সাথে যুক্ত হয়েছে বিকেলের নক্ষত্র, মানে ঝাপসা আলো, কেননা সূর্য তখনো পুরোপুরি অপসৃত হয়নি। সেই দূরতর নির্জন দ্বীপে মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু কবি হতাশ, হতোদ্যম নন। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কবি যখন বলেনÑ
‘এই পৃথিবীর রণ রক্ত
সত্য;’ তবু শেষে সত্য নয়।
মানুষ কেবল যুদ্ধ বিগ্রহ, রক্ত নিয়ে প্রতিশোধস্পৃহ হয়ে থাকবে না, কেবল সফলতার পেছনে দৌড়াবে না। তাকে দাঁড়াতে হয়, জিরোতে হয়। শেষ পর্যন্ত মানুষ শান্তি চায়, ভালোবাসা চায়। কোলকাতা একদিন আধুনিকতার ছোঁয়ায় তিলোত্তমা কল্লোলিনী হবে কিন্তু কবির মন আলোকময় নগরী ছেড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে দূরতর দ্বীপে সুচেতনার কাছে।
দ্বিতীয় স্তবকে [আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে……মানুষ তবু ঋণী পৃথিবীর কাছে] প্রথম স্তবকের প্রেমের আভাস কেটে গিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে সময় চেতনা। জীবনানন্দ দাশের কবিতা বুঝতে হলে সময়কে বুঝতে হবে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেনÑ‘মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি; গ্রহণ করেছি।’ [কবিতা কথা]
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সময় বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। অন্যত্র কবি নিজেই বলছেনÑ‘কবির পক্ষে সমাজকে বুঝা দরকার। কবিতার অস্থির ভেতর থাকবে ইতিহাস চেতনা। মর্মের ভেতর থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ জীবনানন্দ দাশ জীবনজুড়ে সময়ের সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তাই কবিতা সেই সময়েরই দলিল। সুচেতনার তৃতীয় স্তবকে এসে প্রত্যেক্ষ করছেন মানুষ কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। আত্মপ্রতিষ্ঠায় উন্মত্ত হয়ে স্বার্থদ্বন্দ্বে জড়িয়ে ভাই বন্ধু প্রিয়জনের রক্তে রঞ্জিত করছে হাত। বাস্তবতার রূঢ় রৌদ্রে পরিভ্রমণ করে কবি বুঝেছেন পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন। অসুখ পূর্বেও ছিলো। কিন্তু ‘গভীরতর’ শব্দটি বুঝিয়ে দিচ্ছে বর্তমানে তার তীব্রতা কত বেশি। তবুও কবির অভিমত ‘মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে’। কেননা হাজার প্রতিকূলতা, অপূর্ণতা সত্ত্বেও পৃথিবীকেই আঁকড়ে থাকতে হবে, এটি বর্জনযোগ্য নয়। সুচেতনা কবিতায় মুদ্রিত ‘সময় চেতনা’ মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত নয়। এখানে সময় চেতনা নিকট অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের নির্দেশক।’ আমাদের নিশ্চয় মনে পড়ছে, বলনতা সেন প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৪২-এ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত শেষ না হতেই আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ মানুষের ভাবনার অতীত ছিলো। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটলো। বিশ্বজুড়ে ধ্বংস, অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব বিক্ষোভÑইতিহাসের এই নির্মমতা কবিকে বিক্ষুব্ধ করেছে কিন্তু হতোদ্যম করতে পারেনি।
[কেবলি জাহাজ এসে………….রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান]৬
তৃতীয় স্তবকে কবি যখন বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলেনÑ
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে/দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়/সেই শস্য অগণন মানুষের শব/শব্দ থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় তখন চারিদিকে বাণিজ্যের রমরমা চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়ে বন্দরে খালাস হয়। পৃথিবী ভেসে যায় বিলাস ব্যাসনে। কিন্তু সভ্যতার নেপথ্যের কারিগরÑকৃষক, মুটে মজুর- চিরদিনই রয়ে যায় পাদপ্রদীপের বাইরে। বঞ্চিত হয় প্রাপ্য ন্যায্য হিস্যা থেকে। শ্রমজীবী মানুষের শবের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষ নিষ্ঠুর নৃত্যরত। সভ্যতার নায়ক এই প্রান্তিকজনেরাই হয় সর্বস্বান্ত, হতাশ, অনাহুত। কবি একরাশ হতাশা আর দু:খ নিয়ে প্রত্যক্ষ করেন এই অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়ায় না। আমাদের আদিপিতা বুদ্ধ, সুদূর চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসও রয়ে যান নীরব, মূক। আর দেশীয় বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীলরা তো মুখে কুলুপ আঁটেন। কিন্তু এসবই শেষ কথা নয়। তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান। চলমানতাই শেষ কথা। পৃথিবীকে সচল রেখে মানবমুক্তি সম্ভব। একদিকে শস্য জীবনের প্রতীক, অন্যদিকে শব-মৃত্যুর, স্থবিরতার। আবার স্বর্গের বিস্ময় বলে বাঁচার আশাকে জাগিয়ে রেখেছেন। জীবনের ক্ষণিক ও স্থায়িত্ব দুটোই মুদ্রিত এ স্তবকে।
চতুর্থ স্তবকে [সুচেতনা এই পথে আলো জ্বেলে….অন্তিম প্রভাতে] এসে কবির বিশ্বাস ও আশাবাদ আরো উজ্জ্বল বাঙময় হয়ে উঠেছে। এই পথে আলো জ্বেলে সুচেতনা-শুভবোধ আসবে। তবে সেটি দ্রুত সময়ে নয় আরও বহু শতাব্দী পর, বহু মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। ক্লান্তিহীন নাবিক যেমন সমাজ বদলের জন্য কর্মে বৃত হয়ে আছেন, তেমনি কবিও ক্লান্তিহীন এ পথের পথিক। এই মানবিক পৃথিবীর মুক্তি হঠাৎ কোনো বিপ্লব বিক্ষোভে অসম্ভব। সেটি সম্ভব হবে মানুষের অব্যাহত কর্মচাঞ্চল্যের এক দীর্ঘ সুদূরপ্রসারী প্রকল্পে।
‘আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।’
এখানেই কবিতাটির লক্ষ্যভেদী স্বরূপ ও নিহিতার্থ স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে।
একটি সুস্থ স্বাভাবিক মানব সমাজ গড়ে দেবার জন্য সুচেতনার আহ্বান করেছেন কবি। আর সেটি আসবে ‘ক্লান্ত অথচ ক্লান্তিহীন’ ‘অর্থাৎ দায়বদ্ধ প্রতিশ্রুতিবান মনীষীদের হাতেই ফুটবে সভ্যতার আলোক। তবে দ্রুততম সময়ে নয় ঢের দেরিতে। কেননা, পৃথিবীতে কোন ধ্বংসকারীরা বাস করে না, ধীরে সুস্থে গড়ে তোলার মানুষও বাস করে। ‘ক্লান্ত অথচ ক্লান্তিহীন’Ñএই বিরোধাভাস সৃষ্টি করে কবি নাবিকের অন্ত পথ চলার সূক্ষ্ম প্রবণতাকে বুঝিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের এই নাবিকচিত্ততা বহুমাত্রিক বাঞ্জনায় মুদ্রিত হয়েছে।
পঞ্চম ও শেষ স্তবকে [মাটি মানুষের টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি…..শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়] কবি মানুষের একঘেঁয়ে জীবনের হতাশা-আফসোস, পৃথিবীতে কোন কারণে আসা, না আসলে শ্রেয়, সব ছাপিয়ে আশাবাদকে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এই পৃথিবীতে এসে যে লাভ হয়েছে কবি তখনই বুঝেছেন, এখন তার দৃষ্টিজুড়ে প্রতিভাত হয়েছে ‘শিশিরসিক্ত সমুজ্জ্বল ভোর।’
শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সুর্যোদয়Ñএই দুই চিরন্তনের সাথে যুক্ত রাত্রির অন্ধকার ও দিনের আলো।’ অর্থাৎ রাত্রির পরই ভোর। অন্ধকারের পর আলো। লক্ষ যদি সূর্য না হয় তবে অন্ধকার অতিক্রম করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো কবি চিরন্তন অন্ধকারের পরই কবি অবলোকন করেছেন অনন্ত সুর্যোদয়। এখানেই জীবনানন্দ দাশ তার চিরকালের দোদল্যমানতা কাটিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে স্থিত হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তিমিরের কবি নন, তিমির হননের কবি। তাঁর কবিতার অন্ধকারের বহুমাত্রিক ব্যবহার সত্ত্বেও আমরা যদি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ কবি তাহলে দেখতে পাবেন তাঁর বর্ণিত অন্ধকার নিচ্ছিদ্র, জমাট নয়, সেখানে তারারাও জ্বলে। সাতটি তারার তিমির।
সুচেতনা ‘-জীবনানন্দ দাশের একটি প্রতিভু-কবিতা যার প্রকরণ ও প্রসঙ্গে জীবনানন্দীয় চারিত্র্যখচিত হয়ে আছে।’ চেতনা শব্দের পূর্বে ‘সু’ উপসর্গ যুক্ত করে সুচেতনাকে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় মুদ্রিত করেছেন। ‘তুমি’ সম্বোধনে সুচেতনাকে নারীর আভাস দিয়ে পরক্ষণেই ‘দূরতর দ্বীপ’ বলে চেতন-অচেতনের রহস্য জাল বিস্তার করে পাঠকের ভাবনাকে বিস্তৃত করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছেন। সুচেতনা শুভবোধ হয়েও বনলতা সেন, সবিতা, সুরঞ্জনার মতো কুহক তৈরী করেছে।
সুন্দরতম শব্দের সুন্দরতম বাণীবিন্যাসÑকবিতার এ সংজ্ঞা অসম্পূর্ণ হলেও কবিতার শব্দ যে অপরিহার্য এটা নি:সন্দেহে বলা যায়। শব্দই একজন কবির চৈতন্যকে চিহ্নিত করে। জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় এমন শব্দ, শব্দচিত্র শব্দরীতি চালু করেছেন তার শব্দ সড়ক ধরেই উভয়কালের কবিরা কাব্যপথে অগ্রসর হয়েছেন। অভিনব সব শব্দের অবিকল্প প্রয়োগ তার কবিতাকে আলাদা মাত্রা ও মর্যাদা দিয়েছে। সুচেতনাতেও তার ঝিলিক চোখ এড়ায় না। কয়েকটি উদাহরণÑরূঢ়রৌদ্র, দূরতর দ্বীপ, রক্তক্লান্ত, শিশির শরীর, ঢের দূর আবার বুদ্ধ ও কনফুসিয়াস শব্দদ্বয় সুপ্রাচীনকালে নিয়ে যায় পাঠককে।
‘তবু’ নামক অধ্যায়টি জীবনানন্দ দাশের জটিল রহস্যঘেরা কবিতার দ্বারোন্মোচনে চাবিশব্দ হিসেবে কাজ করেছে। ‘সুচেতনা’ কবিতায়ও ‘তবু’ কবিতাটি জটিলসব গ্রন্থি একে একে খুলে দিয়েছে যেনÑ
১. তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়
২. পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন
মানুষ তবুও ঋণী মানুষেরই কাছে।
৩. এ পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য, তবু শেষ সত্য নয়
৪. তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
জীবনানন্দ দাশ কবিতার মাধ্যমে যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তা সম্পূর্ণ চোখে দেখার মতো। রবীন্দ্রনাথ যেটাকে বলেছেনÑ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ বুদ্ধদেব বসু বলেছেনÑ‘তাঁর কাজ বর্ণনাবহুল, তাঁর বর্ণনা চিত্রবহুল এবং চিত্র বর্ণবহুল।’ বর্ণনাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার বাহন উপমা।
আমার যে উজ্জ্বল উপস্থিতি তার কবিতায় দেখি, বাংলা কবিতায় আর কারো কবিতায় তা দুর্লক্ষ। তিনি নিজেই একবার বলেছেনÑ‘উপমাই কবিত্ব।’ তাঁর কোনো কোনো উপমাকে বুদ্ধদেব বসু ‘এক একটি ছোট কবিতা’ কবিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার উপমা উজ্জ্বল জটিল ও দূরগন্ধবহ। সুচেতনা কবিতায় উপমা, অনুগ্রাস, যমক, চিত্রকল্পের চমৎকার প্রয়োগ কবিতাটিকে অসাধারণ করে তুলেছে।
কয়েকটি নমুনাÑ
উপমা: ১. আমাদের পিতা ব্দ্ধু কনফুসিয়াসের মতো
আমাদের প্রাণ মূক করে রাখে;
২. পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
অনুপ্রাস: ১. আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তহীন নাবিকের মতো
২. শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে
যমক: এ পথে আলো জ্বেলেÑএ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।
চিত্রকল্প: কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনিত হয়।
ছন্দ : সুচেতনা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত ৪+১০
সুচেতনা/তুমি এক দূরতর দ্বীপ ১০
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে ৪+১০
সেইখানে/দারুচিনি বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে। ৬
সুচেতনা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। উল্লিখিত ৪টি পঙক্তি বিশ্লেষণ করলে দেখি পূর্ণ পর্ব ১০ মাত্রার, অপূর্ণ পূর্ণ ৬ মাত্রার এবং অতি পর্ব ৪ মাত্রার। প্রথম ও তৃতীয় পঙক্তি ২ পর্বের মাত্রা ৪+১০. দ্বিতীয় পঙক্তি ১ পর্বের মাত্রা ১০ এবং চতুর্থ পঙক্তিতে ৬ মাত্রার অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। কবিতার গতি মন্থর।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বৈপরীত্যভাব, ভাবের বৈপরিত্য, ভাষা ও অলংকারের বৈপরীত্য এবং চিন্তা চেতনার বৈপরীত্য আমাদের যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত করে! কী করে জটিল নাস্তি অন্ধকার পেরিয়ে আলো ও অস্তির রাজপথে দাঁড়ায় তার কয়েকটি উদাহরণÑ
১. আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে,
২. মাটি ও পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি
না এলেই ভালো হতো অনুভব করে
এসে যে গভীরতর লাভ হলো সে-সব বুঝেছি।
৩. দেখেছি যা হলো হবে মানুষের যা হবার নয়
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
এই বিবোধাভাসে দোটানায় তমসাজয়ী আলোকে জীবনানন্দ দাশের কাব্য ও জীবন দর্শন প্রকাশিত হয়েছে।
‘সুচেতনা’ সম্বোধনে কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রার্থিত আরাধ্য এক চেতনানিহিত বিশ্বাসকে শিল্পিত করেছেন। কবির বিশ্বাস মতে, সুচেতনা দূর দীপসদৃশ একটি ধারণা, যা পৃথিবীর নির্জনতায় যুদ্ধে বিগ্রহে রক্তে নি:শোষিত হতে পারে না। চেতনাগত এই সত্তা বর্তমান পৃথিবীর গভীরতর ব্যধিকে অতিক্রম করে সুস্থ ইহলৌকিক পৃথিবীর মানুষকে জীবন্ময় করে রাখে। জীবন মুক্তির এই চেতনাকে সত্যই পৃথিবীর ক্রমমুক্তির আলোককে প্রজ্জ্বলিত রাখবে, মানবসমাজের অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করবে। শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সুর্যোদয়কে প্রকাশ করবে।
শাশ্বত রাত্রির যদি হয় বর্তমান সময় তাহলে সুচেতনা হচ্ছে অনন্ত সূর্যোদয়।
তথ্যসূত্র :
১. কবিতার কথা : জীবনানন্দ দাশ, সিগনেট প্রেস, পঞ্চম সংষ্করণ, ১৩৯২
২. কালের পুতুল : বুদ্ধদেব বসু, নিউএজ পাবলিশার্স, প্রা:লি. দ্বিতীয় সংষ্করণ, ১৯৮৪
৩.অনুষ্টুপ : জীবনানন্দ বিশেষ সংখ্যা: সম্পাদক দেবীপ্রাসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়,
কোলকাতা, ১৯৯৯
৪. জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা : আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত:
নলেজ হোম, ১৯৮৬
৫. জীবনানন্দ দাশ : আবদুল মান্নান সৈয়দ : বাংলা একাডেমী, ঢাকা : ১৯৮৮
৬. শুদ্ধতম কবি : আবদুল মান্নান সৈয়দ : নলেজ হোম, ঢাকা, ১৯৭৭
৭. কবিদের কবি, গাজী আজিজুর রহমান : বাংলা একাডেমী : ২০১০
আ. ন. ম মামুন, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ