এখন সময়:রাত ৯:০৮- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:০৮- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

দুপুর রঙের বৃষ্টি (পর্ব-১৬)

রাজকুমার শেখ

খুব হতাশ হয়ে ফিরে আসে নাজ। সঙ্গে মিনা আসে। ওকে একা ছেড়ে দেয় না মিনা। রমি চলে যায় ওদের ফরাসডাঙাতে। নাজরা ওখানেই অটো ধরে।  বেলা মরে এসেছিল। দূরে আমবাগানে একটা বিকেলের দোয়েল ডাকছিল। ওই ডাকে কেমন এক মায়া ছিল। নাজকে আরও বেশি হতাশ করে দেয়। ও যা চেয়েছিল তা যেন নিমিষে শেষ হয়ে গেল। ওর মায়ের কোনোই খোঁজ সে পেল না। এমন কেন হল ওর ভাগ্যতে? ও এ কথার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তার কি ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দেওয়া হবে? ও নিজেই জানে না।  ওর চলার পথটা কেমন আঁকা বাঁকা। চলতে কষ্ট হচ্ছে।  নোরিন ফুপু কি জানেন সব? কিন্তু কেন তাকে অন্ধকারে রেখেছেন?  না এবার জিগ্যেস করতে হবে।  ওকে জানতেই হবে।

রমি চলে যাবার সময় বলে যায়, কলেজে কাল না গেলে ও এখানে আসবে। এক সঙ্গে ঘুরবে। হাজারদুয়ারী মাঠে গিয়ে বসবে। কথা হবে। মিনা চলে আসে। কাল ওরা কলেজে যাবে না। মিনা নাজের সঙ্গে থেকে যায়।

নাজ বাড়ি ফিরে এসে একটু জিরিয়ে নেয়। মিনা ফেস হয়ে এসে বসে ওর শোবার ঘরে। দুজনেই চুপ করে আছে। জানালা গলিয়ে বাতাস আসছে। মনটা একটি শান্ত হলে নাজ বলে, মিনা, কোথাও কিছু গরমিল আছে। ফুপু সবই জানেন। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। হয়তো কেউ নিষেধ করেছে। আমার সঙ্গে কি চায় উনি?

একটানা কথা বলে নাজ একটু থামে। তারপর আবার বলতে শু করে, আমি আর এ সব নিতে পারছি না। মন খুলে কিছু করতেও পারছি না। কি করি বলতো?

তুই এত উতলা হচ্ছিস কেন? সব বের করবো আমরা। তুই পড়াতে মন দে। সামনে ফাইনাল ইয়ার। এম করলে পাস করতে পারবি না।

মিনা বলে কথাটা।

এমন সময় কিছু হালকা খাবার আনেন নোরিন ফুপু। সঙ্গে চা। একমুখ হেসে বলেন, মিনাবেটি, কেমন আছো?

আমি ভালো। আপনি কেমন আছেন?

আরে বেটি, এ বয়সে আর কি ভালো থাকা যাই! নাজকে নিয়ে চিন্তায় আছি। ওর বিয়েটা দিতে পারলে হয়। তারপর চোখটা যেন শান্তিতে বন্ধ করতে পারি। নাও এটুকুনি মুখে দাও।

আচ্ছা ফুপু, নাজের মা বাবার কি খবর? উনাদের কোনো কথা শুনতে পাইনা।

নোরিন ফুপু এ কথা শুনে কেমন একটু কেঁপে ওঠেন। একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। মুখে কিছু বলেন না। তারপর একটু সময় নিয়ে বলেন, সে একদিন বলবো। আমাকে বলতেই হবে। তবে সে সময় আসুক। নাজ সব জানবে। তবে সে এক লম্বা কাহিনি। ছোট্ট নাজকে বুকে পিঠে করে মানুষ করেছি। ওর মনে দুঃখ দিতে পারবো না। এ সবই ওর। ওর মায়ের যা কিছু সব।

এখন কি বলা যাবে না?

মিনা জিগেস করে।

না-। ওর পড়াটা শেষ হোক। ভালো ছেলে দেখে একটা বিয়ে দেব।

নাজ চুপচাপ। ওর মুখে কোনো কথা নেই।  কেমন নির্বাক দৃষ্টি। তবে ভেতরে ওর ঝড় বয়ছে। যে ঝড়ে সব উপড়ে দেবে। মিনা আর কথা বাড়ায় না। নোরিন ফুপু চলে যান। নাজ ওকে খেতে বলে। মিনা ওকে বলে, আগে তুই কিছু মুখে দে দেনি। কখন কি খেয়ছিস। আরে বাবা অত ভেঙে পড়লে হবে না। জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা আসবে। তাই বলে কি নিজে থেকে থেমে থাকলে হবে? মোকাবিলা করতে হবে। চল ওঠ। খা।

নাজ ওর সঙ্গে খায়। জানালা দিয়ে মতিঝিল মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। কেমন একটা গা সিরসির করা বাতাস ঘরে ঢুকছে। আমবাগানে পাখিদের কলরব। সব পাখি ঘরে ফিরে এসেছে। আজ সন্ধেটা কেমন এক হিম হিম ভাব। নাজ ওকে বলে, আজ রাতে তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো। নোরিন ফুপু যেন জানতে না পারে। রাত হলেই বেরিয়ে পড়বো।

কোথায় যাবি?

মিনা জিগ্যেস করে।

আছে একটা জায়গা। একা তুই রাতে যেতে পারবি না। ভীষণ নির্জন। আমি গেছিলাম। ওখানে কখনো কখনো ফুপু যান। কখন যান তা বলতে পারবো না। ওই বাড়ির সাথে ফুপুর কোনো যোগাযোগ আগে থেকেই আছে মনে হয়। তা না হলে কেন যাবেন? কী- ই বা আছে সেখান? আমার মনে অন্য কথা বলছে মিনা। আমি ঠিক সব টেনে বের করবো।

মিনা চুপ করে বসে ওর কথা শুনছে। ও বেশ অবাক হয়ে গেল। কেমন এক রহস্যঘেরা। ওর গাটা হঠাৎ ঝমঝম করে ওঠে।  কিন্তু সে কথা নাজকে বলে না। যদি অন্য রকম ভাবে নেয়। এমনি তে ওর মন ভালো নেই।  চিন্তায় আছে। হাসিখুশি নাজ কেমন এক ভাবনায় তলিয়ে গেছে। ওকে ফেরানো দরকার। তা না হলে ও পরীক্ষা দিতে পারবে না। ওর মাথায় এখন মায়ের ভাবনা। এত কিছুর মধ্যে ও কি এগোতে পারবে? মিনা ভাবতে থাকে। ও খাওয়া ভুলে যায়। ও বন্ধুকে ছেড়ে আসতেও পারে না। চিঠিগুলো আরও বেশি করে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। কারো নাম উল্লেখ নেই। কে বা কাকে সম্পত্তি দিতে চান! তাও বুঝে উঠতে পারছে না। সব যেন ভাসা ভাসা। ধোঁয়াশা। মিনাকে বেশ চিন্তিত দেখায়। ও নাজকে মুখে কিছু বলে না। ঠিক আছে আজ রাতে যাওয়া যাক। কি আছে সেখানে দেখা দরকার?

 

বেশ রাত হয়ে গেছে। মিনা কেমন এক উদ্বেগে আছে। নাজ পাশের ঘরে থেকে চাবির গোছা নিয়ে এলো। ওরা চুপটি করে বের হয়। যাতে ওর ফুপু না জেগে যান। ওরা রাস্তাতে এসে পড়লো। আম ডালে একটা পেঁচা ওদের দেখে ভয়ে উড়ে পালালো। মিনা বেশ ভয় পেয়ে গেছে। ঘন আমবাগান। অন্ধকার চারপাশে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। ওরা চুপচাপ  হেঁটে চলেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। দূরে কোথায় একটা শিয়াল ডাকছে। হিমহিম রাত। আসার সময় নাজ একটা মোমবাতিও নিয়ে আসে সঙ্গে।  রাস্তায় শুকনো পাতা পড়ে। তাতে পা পড়ে মুচুর মুচুর শব্দ হচ্ছে।  মিনা এক একবার পিছন ফিরে দেখছে। কেউ বুঝি তাদের পিছনে আসছে কি না। এমন অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি। নাজের কথামতো ও এগিয়ে চলেছে।  রাত কত হল কে জানে। যদি কিছু ঘটে তাহলে কেউ জানতে পারবে না। মিনার কেমন ভয় হয়। ও নাজকে ধরে। নাজ ফিসফিস করে বলে, কি হল? ভয় নেই। এখানে কেউ আসবে না।

আর কত দূর?

মিনা জিগ্যেস করে।

চলে এসেছি। আর একটু।

ওরা একসময় একটা ফালি মতো রাস্তায় বাঁক নিল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা গেট খুলে ঢুকে পড়ে। আম বাগান। তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা। চারপাশে জঙ্গল। কিছু দেখা যায় না। কোথায় থেকে একটা বুনো ফুলের গন্ধ বাতাসে মিশে ভেসে আসছে। এখানে ঘন আম বাগান। তার মধ্যে দিয়ে নাজ চলেছে। মিনা ওর পিছনে আসছে। ওর বেশ ভয় ভয় করছে। এমন নির্জনে সে কখনো যায়নি। এখানে ভূতের  আত্মা থাকতে পারে। এমনিতেই এই ঐতিহাসিক শহরে কত  কিছুরই  ভয়।  কত কিছু ঘটেছে সে সময়। মসনদ দখলের কথা সবারই জানা। এখনো এ শহর জুড়ে কত রহস্য যে লুকিয়ে আছে তার ঠিক নেই। এই তো নাজ তার জন্মদাতাকে জানে না। সে এখনো খুঁজে চলেছে। ও যেখানে যাচ্ছে সেখানে হয়তো কোনো কিছু ও খুঁজে পেতে পারে।

 

এক সময় একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। অনেক পুরনো বাড়ি। এই রকম আম বাগানের মধ্যে এমন বাড়ি আছে তা কেউ বাইরে থেকে ভাবতে পারবে না। তবে এটা যে এক সময় খুব চাকচিক্য ছিল তা দেখেই বোঝা যায়। নাজ আগে মোমবাতিটা  জ্বালালো। কারুকার্য করা দরজা। বাইরে একটা বড়ো তালা লাগানো। নাজ চাবি দিয়ে তালা খোলে। দরজা খুলতেই কেমন একটা গন্ধ বেরিয়ে এলো। নাজ মিনাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। মিনা মনে করলো, যেন কোনো নবাবী মহল। ওরা এগিয়ে যায়। তারপর দেখছে নাচ মহল। যেন এখনি কোনো নবাব এখানে ছিলেন। দামি আসবাব। মেঝেতে দামি কার্পেট। বালিশ। কাচের মোমবাতি দানি। পানের পিকদানি। মাথার উপর বিরাট ঝাড়বাতি। লন্ঠন। গোলাপজলদানি। যেন কোনো বাঈজি এখনি ঠুমরী  গাইতে গাইতে উঠে গেছে। যেন মনে হল এখনি নবাব আসবেন আসরে। সব একই অবস্থাতে রাখা। এখানে কে থাকতো কে জানে। এখানে নোরিন ফুপু কেন আসেন মাঝে মাঝে?  তাঁর দখলেই আছে এ বাড়ি। কবেকার শুকনো ফুলের মালা। গোলাপজল রাখা। এখনো কিছুটা থেকে গেছে। দেয়ালে দেয়ালে গানের সুর  লেগে আছে। সারেঙ্গিটা একপাশে শোয়ানো। তবলা। হারমোনিয়াম সব পড়ে আছে। শুধু নেই সে গানেওয়ালী। নবাবী গন্ধ আর নেই। তবু যেন আছে এ সবের মধ্যে। নাজ অবাক হয়ে দেখছিল। ইতিহাস কি শুকিয়ে যায় এই ফুলের মতো? নবাবের কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু সত্যতা কতখানি? নাজ ভাবছে। যে মানুষগুলো বাংলাকে সাজিয়ে ছিলেন। প্রজাকে সুখে রেখে ছিলেন। বাংলার মানুষ সোনার থালায় ভাত খেত আর মাটির ঘরে বাস করতো। এই সুখ নষ্ট করেছিল চতুর ইংরেজ।  নবাবের ৭০ হাজার সেনা কাজ হারিয়ে ছিল। নবাবের রাজদরবার থেকে সকলকে তাড়ানো হল। তারাও কাজ হারালো। এ সবের মূলে ছিল ইংরেজ।  সমস্ত ধনদৌলত লুট হল। ফাঁকা হয়ে গেল রাজকোষ।  সবের মূলে ইংরেজ।

একজন খাঁটি নবাবকে জীবন দিতে হল। হয়তো পলাশী এখনো কাঁদে।

নাজ আরও গভীরে গিয়ে ভাবতে থাকে। তার দরজা খুলে যাচ্ছে। সে যেন সব দেখতে পাচ্ছে। এমন সময় মিনা ওকে ডাকে, নাজ, কি ভাবছিস অত? চল একটু ওপরটা দেখি। এই মহলের রাজরানিটা কে?

বুঝতে পারছি না।

নাজ বলে কথাটা। তবে ফুপুর সঙ্গে এ মহলের কিছু না কিছু যোগাযোগ আছে।

থাকতে পারে।

মিনা বলে কথাটা।

ওরা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে। পাশাপাশি বেশ অনেকগুলো ঘর। নাজ একটা দরজা খুলে ঢোকে। আলগা ছিল ঘরটা। ঘরটাতে কেমন একটা গন্ধ। অনেক দিন বন্ধ থাকার ফলে হয়তো। বড়ো একটা পালঙ্ক। খুব সুন্দর একটা চাদর পাতা। মনে হচ্ছে কেউ যেন শুয়েছিল। এখনি বাইরে গেছে। বিছানায় যেন তার গায়ের উষ্ণতা লেগে।  মোমবাতির আলোতে যতটুকু দেখা যায়। তাতেই ওরা অবাক হচ্ছে। নাজ এগিয়ে যায় খাটের কাছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে। ওর মনটা কেমন করে ওঠে।  বড়ো উতলা হয়ে পড়ে। তার তো এমন হবার কথা না। তবে কেন সে এখানে এসে দুর্বল হয়ে পড়ছে? না তাকে শক্ত হতে হবে। নাজ সরে আসে। মোমবাতি দিয়ে দেখছে দেয়ালে একটা বড়ো পেন্টিং। একটি সুন্দরী মেয়ের আঁকা ছবি। নাজের চোখ আটকে যায়। তবে কি এ মহলের রানি? হতে পারে। এর আগে যেদিন এসেছিল ও সেদিনও এ সব লক্ষ করেনি। আজ সব ও দেখবে। নাজ ছবিটা দেখে অবাক হয়ে। ছবিটা যেন কিছু বলছে। কি মায়াবী মুখ। যেন ছবি থেকে বেরিয়ে এসে কথা বলবে। মিনাও অবাক হয়ে দেখছে। হঠাৎ একটা কিসের শব্দ। দুজনেই চমকে ওঠে। মিনা নাজের হাত চেপে ধরে। কেউ যেন সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। নাজ শব্দটা বুঝবার চেষ্টা করে। কিন্তু শব্দটা থেমে গেল। দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। কোনো কথা বলে না। ওরা দরজার আড়ালে চলে যায়। যদি আবার শব্দটা শোনা যায়। রাত কত হল কে জানে। একটা পেঁচা মহলের পাশের গাছে বসে ডাকছে। নিঝুম রাত। মিনার গা সিরসির করছে। মোমবাতি শেষ হয়ে আসছে। ওদের এবার ফিরতে হবে। নাজ আবার ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

 

রাজ কুমার শেখ, গল্পকার, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে