রাজ কুমার শেখ : নাজ দাঁড়িয়ে ছিল কলেজের গেটের সামনে। আজও একটু আগেই বের হল কলেজ থেকে। রমি আসবে বলেছে। কিন্তু এত দেরি করছে কেন ও! নাজ একটু মনে মনে বিরক্ত হয়। কোথাও যাবার থাকলে ওর তর সয় না। কেউ সঙ্গে গেলে তার আসার দেরি হলেও বেশ রেগে যায়। কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর ভালো লাগছে না। রমিটা না –।
ও মনে মনে উচ্চারণ করে। এখন সবে দুপুর। ওর খিদেও পেয়েছে। কলেজে আসার আগে আজ ভালো করে খাওয়া হয়নি। তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে। কিছু একটা খেতে হবে। ও চলে যেতেও পারছে না। চলে গেলে রমি ওকে খুঁজে পাবে না। রমিটা ওই রকম- ই। সময় মতো আসতে পারে না। এসেই নানান ফিরিস্তি শোনাবে। বিরক্ত লাগে। না ওকে এবার বলে দেবে, তুমি আমাকে কথা দিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখবে না। আমি এ সব পছন্দ করি না। ও মাঝে মাঝে ভাবে। কিন্তু বলতে গিয়েও নাজ বলতে পারে না। রমি একটা জায়গায় কাজ করে। সেখানে ছুটি না দিলে ও কেমন করে আসবে? বেচারা! নাজ মনে মনে কথাগুলো আওড়ায়। বার বার ঘড়ি দেখছে। ওদের আজ মিনাদের বাড়ি যাওয়ার কথা। মিনা আর ও একই ক্লাসে পড়ে। ও থাকে ভাবতাতে। মিনা বেশ কদিন ধরে কলেজ আসছে না। ও কি অসুস্থ? নাজ ওকে খুব পছন্দ করে। রমিকে সঙ্গে করে যাবার কথা। কিন্তু সে বাবুর পাত্তা নেই। বহরমপুর থেকে বেশ অনেকটা পথ। বাসে যাবে ওরা। তারপর ওকে লালবাগ ফিরতে হবে। ও না ফেরা পর্যন্ত নোরিন ফুপু বসে থাকবেন। নাজকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন। চোখের আড়াল হতে দেয় না। ও ওর মাকে দেখেনি। ওরা থাকে কারবালার কাছাকাছি। কাছেই নদী। ওরা যখন মন খারাপ করে তখন ও একা নদীর কাছে গিয়ে বসে। মন ভালো হয়ে যায়। মা মা কেমন একটা গন্ধ নদীর জলে মিশে থাকে। সে গন্ধ ও গায়ে মাখে। নদীর কাছ থেকে ফিরলে সে গন্ধ বাড়ি অবধি চলে আসে ওর সঙ্গে। ওর শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে। সারারাত ওর সঙ্গে থাকে। ওর মন জুড়িয়ে যায়। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। নোরিন ফুপু ওকে সকালে ডেকে তোলে। ও মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, নাজ, তোর মা কবেই হারিয়ে গেছে। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাবি না। নাজ, আমিই তোর মা।
নাজের কেমন সব ধোঁয়াশা লাগে। ও কিছুই বুঝতে পারে না। নোরিন ফুপু ওর সামনে থেকে চলে যায়। নাজ আর কিছু বলে না। ও জানে যে তার ফুপু জানাতে চায় না ওর মায়ের কথা। নাজকে সে একটু একটু করে বড় করে তুলেছে। তার ফুপুর মনে কষ্ট দিতে চায় না ও। পড়াশোনা কলেজ নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে। ও ভুলে থাকতে চায় মায়ের কথা। এমন সময় রমি এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। মুখে হাসি।
তুমি একটা কি?
আমি?
হ্যাঁ।
কেন তোমার রাগ হয়েছে? সরি নাজ। বুঝতেই পারছো কত কিছু মেনেজ করে তবে এলাম।
ওমন কাজের গলায় দড়ি।
আরে বাবা অত রেগে গেলে হয়। চলো বাস ধরতে হবে।
রমি নাজের হাত ধরে টান দেয়।
ওরা বেলডাঙাগামী বাস ধরলো। বাসের জানালার কাছে নাজ বসে। পাসে রমি। বাস ছাড়তেই বেশ ফুরফুরে হাওয়া নাজকে এসে জড়িয়ে ধরে। ওর মনটা শান্ত হয়। বাস ছুটে চলে। বেলপুকুর, চারা বোলতলা, সারগাছি, মহুলা তারপর ভাবতা। একটু সময় লাগে মিনার বাড়ি যেতে। ভাবতাতে নেমে পায়ে হেঁটে বেশ অনেকটা পথ। কাঁচা রাস্তা। ধুলো মাড়িয়ে যেতে হবে। নাজের বেশ ভালো লাগে মিনাদের বাড়ি। এখানে শহুরের ছাপ পড়েনি এখনো। পাশেই বড় বিল। তবে এখন আর সে বিলের গভীরতা নেই। কেমন মরা মরা। মাছ ওঠে জালে। তবে খুবই কম। আগে নাকি এ বিলে বহু মাছ পাওয়া যেত। নাজ মিনার কাছে এ সব গল্প শুনেছে। সেই কবে এসেছিল ও। মিনার মা খুব আদর যতœ করেছিলেন। তখন খুব শীত ছিল। ওকে খেজুর গুড়ের পায়েস করে খাইয়ে ছিলেন। বড়োই স্বাদ। এখনো যেন মুখে লেগে আছে। তারপর রাতে গিয়ে দুজনে বসে গল্প করা। মিনা তার গ্রাম চিনিয়ে দিচ্ছে। রাতের দুধসাদা চাঁদটা তখন মাথার ওপর। দুজনের চোখে ঘুম নেই। বিলের জলে রাতচোরা পাখি। তাদের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। নাজ কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে। মিনার এখানে না এলে এ সব তার দেখা হতো না। মেটে গন্ধটা গায়ে মাখতে ইচ্ছে করছে ওর।
তুমি অত কী ভাবছো?
নাজের চমক ভেঙে যায়। একটু সময় নেয়। বাসের জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। ওর রেশমঘন চুল বাতাসে উড়ছে। রমির চোখেমুখে এসে পড়ছে চুল। বাস এগিয়ে চলে।
কিছু ভাবিনি।
তুমি তাহলে এত চুপচাপ হয়ে কেন?
নাজ ঠোঁট টিপে হাসে শুধু। মুখে কিছু বলে না।
বাসটা ওদের সময় মতোই এসে নামিয়ে দিল। মাথার ওপর সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। রমি এই প্রথম এলো এখানে। ওর কৌতূহল যেন বেড়ে গেছে। ওরা হাঁটতে থাকে। রাস্তায় তেমন লোকে নেই। বেশ চড়া রোদ এখনো। নাজের ঘাম দিচ্ছে। ও আঁচল দিয়ে বার বার ঘাম মুছছে। রমি ওর পাশাপাশি হাঁটছে। মিনাদের বাড়িটা বেশ ভেতরে। মাটির রাস্তা। রাস্তার দুধারে ধান জমি। নালা। ঝোপঝাড়। বাবলা গাছের সারি। সবুজ সবুজ গন্ধ। নাজ বুক ভরে সে গন্ধ নেয়। সোঁদা গন্ধ বাতাসে মিশে। রমি ওকে জিজ্ঞেস করে, নাজ, এখানে তুমি থাকতে পারবে?
হঠাৎ এ কথা।
না এমনি বললাম।
কেন থাকতে পারবো না। দেখছো না কত সুন্দর গ্রাম। সবুজ চারপাশে। এখানে আমার খুব ভালো লাগে। তাই তো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এলাম। তোমার বুঝি ভালো লাগছে না!
না— মানে। এখানে কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে কীভাবে?
তার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। এখান থেকে বহরমপুর কত দূর? এই তো সামান্য রাস্তা। তই বলে কি পাড়া গাঁয়ের মানুষের চিকিৎসা হয় না?
রমি আর কথা বাড়ায় না। ও হাঁটতে থাকে। নাজ যেন উড়ে উড়ে চলেছে। ওর গায়ে ফড়িং উড়ে এসে বসছে। শাড়ির আঁচল এলোমেলো। মেঠো বাতাসে ধানের গায়ে ঢেউ তুলছে। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ। রমির খুব ভালো লাগছে। ও যেতে যেতে থমকে দাঁড়াচ্ছে। বুনো ফুলের বাহার ওকে মুগ্ধ করছে। না মিনাদের গ্রাম খুব সুন্দর। ছবির মতো। বিলের জলে পানকৌড়ি, বক, সরাল, বালি হাঁস খেলা করছে। নাজ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই পরিবেশ ওকে টানে বার বার। সে কথা বলেছেও মিনাকে, মিনা, তোদের বাড়িতে কিছু দিন থাকবো।
থাক না।
জানিস তোদের ওখান কার মাঠ ঘাট আমাকে খুব টানে। সবুজ ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটতে খুব ভালো লাগে। কী মিষ্টি গন্ধ ধান ফুলের। মন ভরে যায়রে।
তু কি কবি হয়ে যাবি?
কেন?
না–। মানে যে ভাবে বর্ণনা দিচ্ছিস।
কবিতা লিখতে গেলে এলেম লাগে। আর সে এলেম আমার নাই। বুঝলি?
কেন নেই? তুই ভালো বলিস। সে গুলো গুছিয়ে লিখলেই কবিতা হয়ে যাবে।
যা। কী যে বলিস? আমি কবি হবো! দূর ও সব হবো না। তবে আমার যা ভালো লাগে তাই বলি। যা দেখছি তা মনের ভেতর এঁকে চলি। জীবনটা বড়ো অল্প সময়ের। দুচোখ ভরে সব দেখে যেতে চাই। কখন এই মায়ার জাল ছিঁড়ে চলো যাবো তা কেউ আগেভাগে জানে না।
নাজের কেমন গলা ধরে আসে।
বিলের জলে বাতাস লেগে ঢেউ উঠেছে। শীতল বাতাস এসে ওদের জড়িয়ে ধরে।
ও ষখন মিনাদের বাড়ি এসে পৌঁছালো তখন মাথার ওপর সূর্যটা হেলে গেছে পশ্চিম দিকে। মিনা ওকে হঠাৎ দেখে লাফিয়ে ওঠে।
ওরে বাবা তুই! কি কপাল আমার।
আগে বল তুই কলেজ যাস না কেন?
আরে তেমন কিছু না। মা মামার বাড়ি গেছে। তাই যেতে পারিনি।
ভাবলাম তুই অসুস্থ। চিন্তাতে পড়ে গেছিলাম।
রমি পিছনে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল।
আরে তোর সঙ্গে তো রমির পরিচয় করিয়ে দিইনি। এ রমি। আমার বন্ধু। এর কথা তোকে আগে বলেছি।
হুম। এসো এসো ভেতরে। মিনার ঘরে গিয়ে বসে। বেশ পরিপাটি করে গুছানো। ঘরে মেয়েলি গন্ধ। মিনা দক্ষিণ এর জানালা খুলে দেয়। সবুজ ধানের খেত। হুর হুর করে সবুজ গন্ধ ঢুকে গেল ঘরে। নাজ একটু নিজেকে আলগা করে দেয়। মিনা ওদের জন্য চা বসাতে গেল। রমি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। নাজের মুখটা ধরে একটু আদর করতে ওর মন করছে। কিন্তু এ সব করলে নাজ রেগে যাবে। তা ছাড়া মিনা দেখে ফেলতে পারে। মিনাদের বাড়ির উঠোন একটা ঝাকড়া আম গাছ। একটা মৌটুসী ডাকছে। নিম গাছটাতে একটা কাক বসে। রমি জানালা দিয়ে দেখতে পেল। সময় গড়িয়ে যায়। মিনা চায়ের সঙ্গে নাশতাও এনেছে। রমির বেশ খিদে পেয়েছে। সেই কোন সকালে দুটো খেয়ে বের হয়েছে। রাস্তাতে আসার সময় ওর কিছু খাওয়া হয়নি। নাজও কিছু খায়নি। মিনা ওদের খেতে দিল। রমি সপাসপ নাশতা খেতে থাকে। কারো দিকে ওর নজর নেই। নাজ চায়ে চুমক দিতে দিতে বলে, মিনা, কবে যাবি কলেজ? আমার একা ভালো লাগে না।
মা দুদিন বাদেই চলে আসবে। মা এলেই যাবো।
তোর এখানে এলে মনটা ভালো হয়ে যায়। কী দারুণ জায়গা। মেঠো পথ, ধান জমি,খাল বিল, পাখি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বসছে। মন ভালো হয়ে যায়।
আবার কাব্য করছিস।
নারে। যা সত্যি তাই বলছি। এখানে কোনো একদিন একেবারে চলে আসবো। সুন্দর পরিবেশে থাকলে সেখানে মনও সুন্দর হয়ে যায়। মানুষ মানুষ হয়।
বাহ্! তুই তো ভালো বেলেছিস। এমন করে আমি ভাবতে পারি না। রোজই মাঠঘাট দেখি। কিন্তু এমন ভাবনা মাথায় আসে না।
তুই চা খাবি না?
না। একটু আগে খেয়েছি।
আর এক কাপ খেতে পারতিস।
আজ এখানে থেকে যা। আমি একা আছি। রাতে বিল দেখতে যাবো। তারা খসা দেখবো। থাকতে তো মন করে কিন্তু ফুপুর ঘুম হারাম হয়ে যাবে। রমির সকালে ডিউটি। ও বেচারাকে ধরে নিয়ে এলাম।
তুই এ ভাবে এলি কেন? সকালের দিকে আসতে পারতিস। শুধু শুধু আমার মন খারাপ করে দিলি।
নারে একদিন আসবো। থাকবো। গল্প হবে।
এখনি বের হবি?
হুম। না গেলে গাড়ি পাবো না। বহরমপুর থেকে আবার আমাকে অটো করে অতটা পথ যেতে হবে।
আজ থাকলে ভালো হতো।
মিনা বলে কথাটা।
ওর কথা শুনে নাজ হাসতে থাকে। যেন কোথায় যেন হাজার চুড়ির ভেঙে যাওয়া শব্দ হল। আম গাছে মৌটুমীটা এখনো ডেকে চলছে। ওর যেন বিরাম নেই। বেলা শেষ হয়ে এলো। বিশ্ব চরাচর ঢেকে যাবে অন্ধকারে। হিম হিম একটা ভাব চারপাশে। নাজের মনে এখন ফাগুনের প্রমঝুম খেলা। ওর মন বুনে চলে এক গ্রাম বালকের কথা। যাকে সে কোনো দিনই দেখেনি। তার হাত ধরে চলে যাবে গাঁয়ের শেষে।
ওরা যখন বের হল তখন বেলা শেষ। মেঠো পথ দিয়ে ওরা হেঁটে চলে। আসার সময় মিনার চোখ জলে ছলছল করে উঠেছিল। নাজ মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওরও চেখে জল। কেমন একটা টান বোধ করে ও। মেঠোপথ ধরে হাঁটতে থাকে। রমি চুপ করে ওর পাশাপাশি আছে। নাজ কথার জাল বুনছে আপন খেয়ালে। বিলের জলে অন্ধকার নামছে একটু একটু করে। জলজ গন্ধ বাতাসে মিশে। বুক ভরে বাতাস নেয় নাজ। ওর টানা টানা কাজল চোখ রমির ছুঁতে খুব ইচ্ছে করছে। ওকে বুকে টেনে নিয়ে এই নির্জনে আদর করতে মন করছে। ওর মতো সুন্দরী মেয়েকে কারো জীবনে গেলে সে সুখী হবে। নাজ খুব ভালো। কোনো অহংকার নেই। সাদামাটা। মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারে। কথা বলতে পারে। রমি ওকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু ও কখনো বলেনি ওর মনের কথা। আজ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নাজ এগিয়ে চলে। রমি ওকে ধরতে পারে না। মেঠোপথে ওর হাঁটতে কষ্ট হয়। তবু সে হাঁটে। নাজ তার। শুধুই তার।
রাজ কুমার শেখ, গল্পকার