হাফিজ রশিদ খান
বাংলাদেশের পাঁচ প্রধান নদীর একটি কর্ণফুলি। অন্যগুলো হলো— যমুনা, পদ্মা, মেঘনা ও পশুর নদী। এসবের পর যে-নদীগুলোর নাম উচ্চারণ করা চলে— সেগুলো হলো : তিস্তা, গড়াই, মধুমতি, রূপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, কীর্তনখোলা, বিষখালী, তিতাস ইত্যাদি। ছোটো-বড় মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি নদী রয়েছে বলে নদী-গবেষকদের অভিমত। পাহাড়-সমুদ্র, নদী ও খালে ভরা একসময়ের ‘প্রাচ্যের রানি’রূপে খ্যাত চট্টগ্রামের সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গে প্রায় ‘একদেহে লীন’ হয়ে আছে যে-নদী তার নাম এই কর্ণফুলি। এটি চট্টগ্রাম ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামেরও সবচেয়ে বড় নদী। চাকমা ভাষায় এর নাম ‘বড়গাং’ বা বড় নদী। মিজো ভাষায় ‘খাওৎলাং তুইপুই’ বা ‘পশ্চিম নদী’। মিজোরামের মমিত জেলার শৈতাগ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়ে নদীটি দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মিজোরাম থেকে এ নদীর উৎপত্তি হলেও ৩২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নদীটি ভারতীয় অংশে পড়েছে খুবই কম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কর্ণফুলির দৈর্ঘ্য ২৭৫ কিলোমিটার। যে-কারণে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর তালিকায় এটির নাম নেই। অন্যদিকে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেই এর ১৮০ কিলোমিটার অংশ রয়েছে।
পদ্মা নদীর পর এটিই বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রবহমান নদী। এর উপ বা শাখা নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে— কাওরপুই বা থেগা (ঠেগা), তুইচাং, ফায়ারুয়াং, হালদা, কাচালং, রাইখ্যং, বকখালী, চেঙ্গি, মাইনি, সাঙ্গু, ইছামতি, শিলক, বোয়ালখালী,
শ্রীমাই প্রভৃতি। এখানেই শেষ নয়। প্রকৃতপক্ষে একটি নদী তার প্রবাহ থেকে অসংখ্য ঝিরি বা ঝোরারও জন্ম দেয়। জনয়েত্রীরূপে কর্ণফুলি নদীও এ ধারায় ব্যতিক্রম নয়। মোহনা থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত এ নদী ২৪-২৫টি উপ বা শাখানদী বা ঝিরি-ঝোরার পথরেখা সৃষ্টিকারী অথবা বিভিন্ন অজানা জলধারা এসেও এর শরীরে মিশেছে। বস্তুত মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে তুইচাং ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসা তুইলিয়াংপুই নামের দুই স্রোতোধারার সঙ্গম থেকে কর্ণফুলি নদীর উৎপত্তি হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষকের অভিমত। লুসাই পাহাড়ের তুইচাং-ই কর্ণফুলির মূল স্রোতোধারা। পৃথিবীর বুকে সভ্যতার আদি পত্তন ও মানুষের বসতি গড়ে ওঠার ইতিহাস বরাবরই নদীকেন্দ্রিক।
দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন ও সমৃদ্ধিশালী সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে কোনো-না-কোনো নদীর তীরঘেঁষে। যেমন ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস নদীর তীরে সুমেরীয় সভ্যতা, সিন্ধুনদের তীরে মোয়েনজেদারো ও হরপ্পা সভ্যতা, হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতা, নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা প্রভৃতি। প্রাচীন মানুষ নদীকেন্দ্রিক নানা সুবিধাপ্রাপ্তির বাস্তবতাকে মনে রেখে তার তীরে নিবাস গড়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে যাতায়াতের সুবিধা, সুপেয় পানিপ্রাপ্তি ও জলাচারের সুবিধা, চাষাবাদের সুবিধা, খাদ্য উপাদানরূপে মৎস্য ও অন্যান্য জলজপ্রাণি আহরণের সুবিধা, পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুবিধা, পরিবহন সুবিধা ইত্যাদি খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও প্রবহমান নদী মানুষ ও তীরবর্তী লোকালয়ের বহুবিধ উপকার সাধন করে থাকে। কেবল নদী তীরবর্তী লোকজনই এর জলে তৃষ্ণা মেটায় বা গেরস্থালি নানা ধরনের কাজকর্ম সারে তা নয়, শহর-বন্দরের মানুষও নদীর জলই পান করে শোধনের মাধ্যমে। নদীর পানি সেচের মাধ্যমে মানুষ চাষাবাদের কাজেও লাগায়।
নদীর উৎপত্তি নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহ খুব বেশিদিনের কথা নয়। এই সেদিনও মানুষ নদীকে ভয় পেতো। নদী পার হওয়ার ব্যাপারটাকে অশুভ মনে করে তা থেকে বিরত থাকতো। এটির পেছনে ছিল নদীর স্রোতের প্রতি তাদের একধরণের ভীতি। সাঁতার না-জানা মানুষ ওই স্রোতের শক্তিকে সমীহ করে দূরে থাকতে পছন্দ করতো। তার ভেতরে অলৌকিক শক্তি সুপ্তাবস্থায় রয়েছে বলে বিশ্বাস করতো আর তার উদ্দেশে পুজো দিতো। এ থেকে নদী ‘দেবী’ বা ‘দেবতা’ হয়ে অবস্থান নেয় মানুষের গভীর অন্তঃকরণে। এখনও কোনো-কোনো আদিবাসী সমাজে নদীর উদ্দেশে ফুল বা মানতের বস্তু বিসর্জন দেবার রেওয়াজ আছে। কর্ণফুলি নদী ও তার শাখানদীগুলোকে কেন্দ্র করে নানা লোকাচার, যেমন— পুজো, অর্ঘ্য ইত্যাদি প্রদানের আচার রয়েছে।
কর্ণফুলি নদী নিয়ে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি খুব জনপ্রিয় লোকগল্প প্রচলিত আছে। সেই গল্প মতে, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এ নদীর নাম ছিল ‘কাইঞ্চা খাল’। লোাকমুখে প্রচলিত এই নামেই এ প্রমত্ত জলস্রোতটি বয়ে চলছিল সুদীর্ঘকাল ধরে। ভাটার কালে সে একটু শান্ত-শিষ্ট থাকে বটে, কিন্তু জোয়ারের সময় সে হয়ে ওঠে এক প্রমত্ত দৈত্যের মতো। কোনো এককালে এই জলস্রোতে এক পাহাড়ি মেয়ে স্নান করতে নেমে তার কানের ফুল স্রোতে হারিয়ে যায়। সেই থেকে এই জলধারার নতুন নাম হলো— কর্ণফুলি। এই নদী নিয়ে আরও একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হলো— অষ্টম-নবম শতাব্দীর দিকে আরব বণিকেরা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করার জন্য সেকালের আসামের কামরূপ ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকা থেকে সংগৃহীত লবঙ্গ চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসতেন। আরবি ভাষায় ‘লবঙ্গ’কে বলা হয় ‘র্কনফোল’। একদিন এক আরব বণিক এই নদী দিয়ে জাহাজভর্তি ‘র্কনফোল’ বিদেশের বাজারের উদ্দেশে নিয়ে যাবার সময় দুর্ভাগ্যবশত র্কনফোলবাহী নৌকাটি মাঝনদীতে ডুবে যায়। আর তা সারা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। ‘র্কনফোল’ বোঝাই নৌযানের ভরাডুবির পর লোকমুখে এ নদীর নতুন নাম দাঁড়ায় ‘র্কনফোলি’ আর তা থেকেই ধীরে ‘কর্ণফুলি’। এছাড়াও চট্টগ্রামি মানুষের সুখদুঃখ, হাসিকান্না, বিরহ-মিলনের অনেক কাহিনি, আবেগপূর্ণ গল্পগাথা জড়িয়ে রয়েছে এই নদীকে নিয়ে। এই নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য লোকগান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চারুকর্ম, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, আলোকচিত্রের ভাণ্ডার। এ রকম একটি বিখ্যাত গানের কয়েকটি চরণ এমন :
ছোড-ছোড ঢেউ তুলি পানিত্
লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়েরে যার গই কর্ণফুলি।
এক কুলদি শহর-বন্দর-নগর কত আছে
আরেক কুলত সবুজ রোয়ার মাথাত্ সোনালি ধান হাসে।
গাছর তলাত্ মালকাবানুর গান
গোরপ পোয়া গায় পরান খুলি\
পাহাড়ি কন্ সোন্দরী মাইয়া ঢেউঅর পানিত্ যাই
সিয়ান গরি ওডি দেখের কানর ফুল তার নাই
যেদিন কার্ন ফুল হাঁজাইয়ে
হেই দিনত্তুন নাম কর্ণফুলি\
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক গানের অন্যতম প্রাণপুরুষ গীতিকবি, সুরকার ও গায়েন প্রয়াত মলয় ঘোষদস্তিদার তাঁর এই গানে কর্ণফুলি পাড়ের জনজীবনের ছবি যেমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি এখানে কিংবদন্তির সেই স্রোতে পাহাড়ি মেয়ের কানের ফুল হারানোর গল্পও মনোরম দ্যোতনায় জুড়ে দিয়েছেন কথা ও সুরের লহরে। লোককবি সনজিত আচার্য এ নদীর কিনারেই বাড়ি— এমন এক দেহাতি নারীর মন-গভীরের কথা বলেছেন তাঁর একটি গানে। যেখানে নারীটি তার প্রেমাস্পদের সাক্ষাৎ পাচ্ছে না বলে মনের সেই দুঃখটুকু নিবেদন করছে নদীর সমীপে :
কর্ণফুলিরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে
অভাগিনীর দুঃখের কথা কবি বন্ধুরে।
সাক্ষী থাক আকাশ-বাতাস
যত তরুলতা
কার কাছে বুঝাইয়ম
আঁর মনেরি কথা
যদি ন পাই বন্ধুরে
আর হুনাইয়ম কারে\
হক্কল সমত্ আইতো-যাইতো
সাম্পান একখান বাই
এই ঘাট ঐ ঘাট ঘুইরতো বন্ধু
ভাটিয়ালি গাই
কদিন ন দেখি তারে
আঁই মন দিলাম যারে\
ইশারা দি ডাইকতো বন্ধু
আঁরে গোপনে
কানে-কানে মনর কথা
কইতাম দুইজনে
যাইতাম ঘরর বাইরে
ও তার বাঁশির সুরে\
এ তো গেল লোকসমাজের সৃজনীমার্গে আত্মনিবেদিত, আত্মভোলা লোকায়ত মন-মানসের অধিকারী সন্তানদের কর্ণফুলি-বন্দনা। এসব লোকায়ত গানের ভাণ্ডারের সমস্তকথা এই অকিঞ্চিৎকর গদ্যে ধারণ করা সহজ বিষয় নয়। যেহেতু গানের এই ভুবনটি নানা বৈচিত্র্যের প্রসবিনী হয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। মূলত আমরা এখানে নদী কর্ণফুলির একটি ছোটো স্কেচই আঁকতে চেষ্টা করছি। সৃজনের, ভাবনার চারুকাজের এই ধারা নানাভঙ্গিতে ব্যাপ্ত হয়েছে এখানকার অনুসন্ধিৎসুদের উজ্জ্বল আগ্রহে— যেখানে আলোকচিত্র, গল্প-উপন্যাস তথা কথাসাহিত্য, কাব্যকলা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও গবেষণার মতো বিষয়-আশয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে শত শত বছরের পরম্পরা বেয়ে। বাংলা সাহিত্যের খাসমহলায়ও এই নদী ও তার তীরবর্তী জনমানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি, লোকাচার, তাদের বিচিত্র বুলি বা লব্জ, তাদের আহার-বিহার, তাদের চাওয়া-পাওয়া, তাদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত সূক্ষ্মতর সব আধ্যাত্মিকতা, নারীর মনস্তত্ত্ব ইত্যাদির একটি সমৃদ্ধ ভাণ্ডার রচিত হয়েছে। এই নদী নিয়ে কবি নজরুল-এর রয়েছে বিখ্যাত গান ও কবিতা। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে দুবার কবি চট্টগ্রাম ভ্রমণে এসেছিলেন তাঁর বন্ধু সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহারও তাঁর ভগ্নি শামসুন নাহার-এর আমন্ত্রণে। অবস্থান করেছিলেন রেয়াজউদ্দিন বাজার তামাকুমণ্ডি লেনে তাঁদের ‘আজীজ মঞ্জিলে’। কর্ণফুলির বুকে ঘুরে বেড়িয়েছেন, উৎফুল্ল আড্ডায় মেতেছেন গানে ও কবিতায়। সেই নৌভ্রমণের সূত্রে রচিত হয়েছে কবিতা— ‘কর্ণফুলী’। প্রসঙ্গক্রমে দীর্ঘ কবিতাটির প্রথম স্তবক এখানে পাঠ করা যাক আপাতত :
ওগো ও কর্ণফুলী,
উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।
যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা
আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!
তুমি শুধু জল করো টলমল; নাই তব প্রয়োজন
আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।
যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর
ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে তব জল-মঞ্জীর
বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!
কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!
তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল
দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?
—বুঝি প্রিয় সব বুঝি,
তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি! …
এছাড়া কর্ণফুলির চরাঞ্চলের মানুষের জীবনসংগ্রাম ও তার প্রাত্যহিকতা নিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাস ‘সমুদ্রচর ও বিদ্রোহীরা’। বিপ্রদাস বড়ুয়া রচিত এই উপন্যাস কর্ণফুলি নদীকেন্দ্রিক জীবনধারার ওপর এক বিশ্বস্ত পর্যবেক্ষণ ও গভীর মননশীলতাকে প্রতিফলিত করে। আলাউদ্দিন আল আজাদ-এর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘কর্ণফুলী’। উপন্যাসটিতে আঞ্চলিক ও আদিবাসী ভাষাব্যবহারের কৃতিত্বের জন্যে ১৯৬২ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেসকো কর্তৃক এটি পুরস্কৃত হয়। কর্ণফুলি নদীর আশপাশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে-নিরাভরণ আদিবাসী জীবন টিকে আছে প্রকৃতি ও মানুষরূপী কিছু লোভী প্রাণীর বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে তার অসাধারণ ভাষাচিত্র এই উপন্যাস। এখানে চাকমা ও ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সাবলীল মিশ্রণের উপস্থাপন ও বিস্তার সুধীপাঠকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। উপন্যাসটিতে আলাউদ্দিন আল আজাদ লোকভাষা ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন : ‘চরিত্রকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় আমি এ-বইয়ে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করিনি। চিত্রী যেমন রং দিয়ে একটি সৃষ্টি সম্পন্ন করেন, তেমনিভাবে আমি বিভিন্ন ভাষার রং ব্যবহার করেছি মাত্র; কর্ণফুলীর জীবনধারা, সবুজ প্রকৃতি, শ্যামল পাহাড় ও সাগর সঙ্গমে বয়ে চলা প্রবাহের মতোই এই ভাষা অবিভাজ্য। শিল্পসিদ্ধির জন্য এর অবলম্বন আমার কাছে অপরিহার্যরূপে গণ্য হয়েছে।’
২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তানভীর মোকাম্মেল নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রের নাম ‘কর্ণফুলীর কান্না’ (ঞবধৎফৎড়ঢ়ং ড়ভ কধৎহধঢ়যঁষর)। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবনধারার ওপর নির্মিত এই ছবিটি সরকারি নিষেধাজ্ঞার রোষানলে পড়েছিল। পরে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের মাধ্যমে নিষ্পত্তির পর এটি জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়। পার্বত্য আদিবাসীদের দুর্দশাগ্রস্ত, কষ্টসহিষ্ণু জীবন এবং নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর নানারকমের বিপর্যকর ঘটনাকে উপজীব্য করে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্রটি দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়। এছাড়া ওহীদুল আলম-এর ‘কর্ণফুলীর মাঝি’ কাব্যগ্রন্থটিও এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য।
কর্ণফুলির শেষপ্রান্তে অর্থাৎ মোহনায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি অবস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দর নামে পরিচিত এই বন্দর শুধু বৃহত্তর চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশেরই অদ্বিতীয় বা প্রধান প্রাণপ্রবাহ বা ‘লাইফলাইন’ বলে স্বীকৃত। তা সত্ত্বেও কোনো অদৃশ্য কারণে এই নদী ও বন্দরটি সেই ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও চরম ও শোচনীয়ভাবে দখল-দূষণে বিবস্ত্র সতীর মতো লাঞ্ছিত ও অবহেলার শিকার হচ্ছে প্রতিকারহীনভাবে। একটি জরিপ জানাচ্ছে, নদীর দুপাড়ে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা এখন হাজারেরও বেশি। অন্য একটি পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, আপাতত বিগত তিন যুগে কর্ণফুলি নদী প্রস্থে ৫০৬ মিটার পর্যন্ত তার প্রশস্ততা হারিয়েছে। অর্থাৎ নদীবক্ষের সীমানা ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে।
২০২৩ সালের ২৮ অকটোবর নদীটির তলদেশে দুই টিউব বিশিষ্ট চারলেনের ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি টানেল নির্মিত হয়েছে। এটি কর্ণফুলি টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল নামে পরিচিত। এই টানেলটি শহরাঞ্চলকে নদীর অপর প্রান্তের সাথে যুক্ত করেছে। এটি বাংলাদেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গ পথ। এই টানেলের কারণে নদীর অপরপ্রান্তে শিল্পোন্নয়ন ও পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই নদী নিয়ে নির্মাণযজ্ঞের একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ না-করলে কিঞ্চিৎ অপূর্ণতা থেকে যেতে পারে। সেটি একটি কান্না ও দুঃখময় অতীতের। ১৯৬০ সালে কর্ণফুলির কাপ্তাই অংশে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে মার্কিন অর্থ সহযোগিতায়। এতে ডুবে যায় বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি ও অসংখ্য বসতঘর। চুয়ান্ন হাজার একর বা তিন শো পঞ্চাশ কিলোমিটার উর্বর জমি চিরতরে হারিয়ে যায় কৃত্রিম হ্রদটির তলদেশে। এছাড়া এক লক্ষ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী পরিণত হয় উদ্বাস্তুতে। ক্ষতিগ্রস্তদের বৃহদংশ ছিল চাকমা আদিবাসী সমাজের মানুষ। তাদের ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘বরপরং’ বা বৃহৎ অভিবাসন।
হাফিজ রশিদ খান, কবি ও প্রাবন্ধিক