মুহম্মদ র ই শামীম:
চলে আসার সময় কোনো আড়াল থেকে হলেও শ্রুতিকে দেখার পলাশের খুব ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে তো করবেই। একজন মানুষকে শুধু একনজর দেখার জন্য তা না হলে কেউ কি এগারো হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসে? শ্রুতির এত আকর্ষণ শক্তি! এক পলক দেখা, কন্ঠ শোনে মন ভালো হয়ে যাওয়ার এই ব্যাকুলতা ওর জন্য তো শুধু আজকের নয়। দীর্ঘ বারো বছর যাবত শ্রুতিকে না দেখার অসুখে ভুগছে পলাশ। অন্য কোনো অসুখ তার নেই যে ডাক্তার কবিরাজ তাবিজ-কবজে ভালো হবে। এই অসুখের কথা অবশ্য পলাশ নিজে ছাড়া আর কেউই জানে না। জানে শুধু তার অন্তরস্ত হৃদয়।
কী আছে মেয়েটার মধ্যে! এ প্রশ্নের উত্তর বহু বছর সে খুঁজেছে। পায়নি। ঘন কোমর দোলানো কাজল কালো চুল, সিমসাম দেহবল্লরী, গায়ের রং তেমন আহামরি নয়। তবে খুব ইমপ্রেসিভ চেহারা। শাড়ি পরলে ওকে এত সুন্দর লাগে যে পলাশ ওর মতো কোনো সুন্দরী মেয়ের দেখা আজও পায়নি। শ্রুতিই বারবার তাকে তাড়িত করে ফিরেছে। সেজন্য আর বিয়েও করা হয়নি পলাশের। পলাশ মাঝে মাঝেই ভাবে, এতদিনে শ্রুতি হয়তো বিয়ে করে পুরোপুরি সংসারী হয়ে গেছে। অথচ ওর সঙ্গে পরিচয়ের কারণেই তার অগোছালো জীবনটা আরো এলোমেলো হয়ে গেছে।
অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই শ্রুতির সঙ্গে পলাশের পরিচয় হয়। শ্রুতি আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে একা একাই খেলার এক ফাঁকে ঘুরছিল ক্যাম্পাসে। পলাশ তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তার শখ ছিল ছবি তোলার। দূর থেকেই ক্যামেরার লেন্সে পলাশ দেখতে পাচ্ছিল শ্রুতি-কে। ক্যামেরায় চোখ রেখেই পলাশ ভাবছিল এই মেয়েটা প্রকৃতির সাথে অসাধারণভাবে মানিয়েছে। যদি ছবি তোলা যেত! ক্যামেরায় এরকম অসাধারণ ছবি এর আগে পলাশ তুলেনি। এদিকে শ্রুতিরও পলাশকে দেখতে পেয়ে মনে মনে এত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে ছবি তোলার খুব লোভ হচ্ছিল।
শ্রুতি পলাশকে কাছাকাছি পেয়ে বলেই ফেলল,- আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিবেন? পলাশ মাথা নেড়ে মুচকি হেসে ছবি তুলতে শুরু করল। এথেকেই দুজনের পরিচয়। শ্রুতি অবশ্য ১৫-২০ দিন পরই তার তোলা প্রিন্ট করা কিছু ছবি ডাকে পেয়েছিল। ধন্যবাদ জানিয়ে শ্রুতিও পলাশকে চিঠি দিয়েছিল। এরপর মাঝেমধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হতো। প্রায়শই সাক্ষাতের জন্য শ্রুতি চলে আসতো ক্যাম্পাসে। পলাশের সাক্ষাৎ অনেক সময়ই মিলত না। শ্রুতি তবু ছুটে আসতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। একা একাই ঘুরে বেড়াত। তার প্রতি, পলাশের আগ্রহ-অনুভূতি শ্রুতি বুঝে উঠতে পারত না। বছর না ঘুরতেই শ্রুতি চলে যায় লন্ডনে পড়াশোনা করতে। লন্ডন চলে যাওয়ার পর ঢাকার বাসার ঠিকানায় শ্রুতি পলাশের শেষ চিঠিটি পেয়েছিল। সেখানেও তার তোলা আরো কিছু ছবি ছিল যা পলাশ আগে দেয়নি। কেন দেয়নি তা আজও শ্রুতির কাছে অজানা। সেই ছবির প্যাকেট শ্রুতির মা পরদিনই লন্ডনে তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। ছবিগুলো দেখে সে নিজের রূপ লাবণ্যের জন্য যেন গর্ববোধ করতে থাকে। ভাবে সে কি আসলেই এত সুন্দরী ? নিজের অজান্তেই শ্রুতি বলে ওঠে, না না এই রূপ শুধু পলাশের ক্যামেরার-ই কারসাজি।
শ্রুতির সঙ্গে দীর্ঘ এক যুগ পর দেখা করতে আজ ময়মনসিংহ এসেছে পলাশ। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আবারও শ্রুতি-পলাশের যোগাযোগ হয়। সত্যিই তো পৃথিবীটা ছোট। সেই হারিয়ে যাওয়া পলাশ আসবে তার চেম্বারে দেখা হবে, এই ভাবনায় পুরোরাত নির্ঘুম কেটেছে শ্রুতির। সে অপেক্ষা করছে কখন সকাল হবে। অফিসেই আসবে পলাশ। শ্রুতি এখন সিনিয়র সহকারী জজ। সে অফিসে গিয়ে বলে রেখেছে তার গেস্ট আসবে; আজ বেশি মামলা শুনবে না পেশকারকে বলে রেখেছে । বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে শ্রুতি । এত আবেগ কেন কাজ করছে এই বয়সে ? পলাশ কি জানে আজও সে—। ওর জন্যই তো সে আজও একাকীত্বে ভুগছে? শ্রুতি ভাবে,পলাশ এতদিনে হয়তো বিয়ে-শাদি করে সংসারী হয়েছে। পলাশ কি সত্যিই কোনদিন আমাকে বুঝতে পারেনি ? আমি তাকে চাই ,তাকে কতটুকু চাই। আমি তো আজও প্রাণ ভরে শুধু তাকেই ভালোবাসি। শ্রুতি এজলাস ছেড়ে এসে বারবার জীবনটাকে পেছনে ফিরে নতুন করে রিওয়াইনড করে যাচ্ছিল। এসব চিন্তা বারবার আসায় নিজের মধ্যে এক ধরনের লজ্জাবোধ করতে থাকে। পলাশ ছেলেটা এমন কেন! সে কি সত্যিই তাকে ভালবাসেনি ? নাকি এ সম্পর্ক শুধুই এক তরফা? অথচ ওকে খুঁজে খুঁজে একযুগ কেটে গেল তার। ওর তোলা ছবিগুলো দেখে মনে হয় কারো জন্য বুকের ভেতর ভালোলাগা না থাকলে শুধু ক্যামেরায় কি এত সুন্দর ছবি তোলা সম্ভব ? ক্যামেরা তো মানুষের মন এবং চোখের সমন্বয়েই ছবি তুলে। না হলে জীবনে কেন আর কোনো ছেলেকে কেন আর পলাশের মত ভালো লাগেনি।
পলাশ চীফ জুডিশিয়াল আদালত চত্বরে চলে এসেছে সকাল দশটায়। শ্রুতির ওখানে যাওয়ার কথা দুপুরে। শ্রুতি এজলাস থেকে এ সময় নেমে থাকে। দুপুর একটার পর তার এপয়েন্টমেন্ট। পলাশেরও সময় কাটছে না। ছাত্র জীবনে ছবি তোলার নেশাটা এখন আর নেই। তবুও বহু বছর পর কানাডা থেকে দেশে এসে দুদিন যাবত দামি আইফোনে ছবি না তুলে থাকতে পারছে না পলাশ। ছবি তোলার আগের নেশাটা যেন পেয়ে বসে। ময়মনসিংহের জিরো পয়েন্টের পাশেই কাচারিঘাটে নদের পাড়ে গতকাল অনেক ছবি তুলেছে পলাশ।
পাশেই ব্রহ্মপুত্র নদের কূল গেষেই ময়মনসিংহ আদালত চত্বর। হঠাৎ ছোট এক শিশুর করুণ চিৎকার তার কানে আসে। আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব, বারবার কান্নার সঙ্গে এই শব্দ ভেসে আসছিল। পলাশ সামনে তাকিয়ে দেখে কিছু মানুষের জটলা। ক্যানভাসারদের ওষুধ বিক্রির সময় চারপাশে মানুষজন গোল করে যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে দৃশ্যটা সেরকম।। সে আগ্রহ নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। মানুষের ভিড় ডিঙ্গিয়ে সে দেখে একটি ছয়-সাত বছরের শিশু তার মাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে, মা বারবার তার হাত রাগান্বিত হয়ে সরিয়ে দি”্ছ।ে শিশুটি মাকে ধরার জন্য ছটফট করছে আর আদালত চত্ত্বর কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলছে, আমি মায়ের কাছে যাব। কিন্তু মায়ের মন কিছুতেই গলছে না। চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন নানা মন্তব্য করছে। পলাশ ঘটনা কী, জানতে চাইলেই একজন বলে উঠলো-এই শিশুটির বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। একজন বলে উঠলো- বাচ্চাডা মায়ের কাছে থাকতে চাচ্ছে, কী পাষাণী মহিলা মাইয়াডারে নিতে চাইছে না। শিশুটির বাবা দূরে দাঁড়িয়ে করুণ দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষের মতো তাকিয়ে আছে। যেন তার কিছুই করার নেই। বাবার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। একজন বয়স্ক নারী বলে উঠলো, বাচ্চাডারে নিলে তো এই মাইয়ার আর বিয়ে অইব না এই জন্যই পাষাণীডা ওরে নিতে চাইছে না!
পলাশের পুরো ঘটনা বুঝতে বাকি রইল না। সে জানে শিশুটির করুণ এই কান্নার আওয়াজ কত নিষ্ঠুর কত ভয়াবহ। এই জন্যই শিশুটি বারবার তার মায়ের হাত ধরে একটু অবলম্বন খোঁজার চেষ্টা করছিল। ছোট্ট শিশুটি কি এই বয়সেই তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা বুঝতে পেরেছিল ? বাবা-মায়ের বন্ধন ছিঁড়ে একটি শিশুর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কত নিষ্ঠুর,কত কঠিন তা পলাশের চেয়ে আর কে বেশি জানে ? পলাশ মনে মনে বলে সকল গর্ভধারিণীই মা নয়। গর্ভে ধারণ করলেই সকলেই মা হতে পারে না। পলাশ নিজের অজান্তেই শৈশবে ফিরে যায়। সেই দিনগুলোর কথা তার মনে পড়ে। একদিন এই শিশুটির মতোই মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেও এভাবেই মায়ের হাত পা বারবার ধরে মায়ের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে পারেনি। ব্যর্থ হয়েছিল। একমাত্র বাবাও পলাশকে ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে চলে যায়, তখন তার বয়স তের-চৌদ্দ। পলাশের মন ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। তার চোখ কখন যে ভিজে ওঠে টের পায়নি। সে অতীত থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। এ অবস্থায় কি করে শ্রুতির সঙ্গে কি দেখা করা সম্ভব ? সে যখনই শ্রুতির কাছাকাছি এসেছে তখনই জীবনের চেনা-অচেনা সংকটগুলো মনের গহীনে ভেষে ওঠেছে।পলাশ দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়ে যায়।
এজলাস থেকে নেমেই শ্রুতি নিজ কক্ষে এসে দুজনের প্রথম দিনটির কথা ভাবতে থাকে। জানালার ফাঁক দিয়ে কোর্ট চত্বরে মানুষের ভিড় করে রাখা একটি জটলা তারও নজরে পড়ে। দূর থেকে শিশু-বাচ্চার কান্নার করুণ ক্ষীণ আওয়াজ তার কানে এসে পৌঁছে। এসব কান্না, এসব ঘটনা আদালত চত্বরে নতুন নয়। তবে আজ কেন জানি শ্রুতির মনটাও এই কান্নার আওয়াজে বিষণœ হয়ে পড়ে।
পলাশ চলে যায় কাচারি ঘাটে; ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ছোট্ট চায়ের টং দোকানে গিয়ে বসে। নদের দিকে তাকিয়ে বারবার সে ভাবতে থাকে, সে কী করবে এখন। সে কি ফিরে যাবে নাকি শ্রুতির সঙ্গে দেখা করবে? দেখা করে নিজের কষ্টগুলোকে নিজেই আবার জীবন্ত করবে ? সে কি পারবে তার অস্থির-উচাটন জীবনের কষ্টগুলো শ্রুতির সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে? তা কী করে সম্ভব, শ্রুতি এখন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা,হয়ত অন্যের স্ত্রী। যার কণ্ঠ শুনে তার মনের কষ্টগুলো যেন শীতল হয়ে যেত। যাকে এক নজর দেখতে পেলে বুকের মধ্যে বেচেঁ থাকার ইচ্ছে জেগে ওঠত। সে যেন নতুন প্রাণ,নতুন বসন্তের ছোঁয়ায় জাগিয়ে দিত পলাশকে। কিন্তু বারো বছর পর শ্রুতিকে নিয়ে ্এসব চিন্তার কি কোনো মানে হয়? দোষ তো তার-ই, সে তো কোনদিন শ্রুতিকে ভালোবাসার কথা জানায় নি। আবার স্বগোক্তি করে পলাশ নিজেকেই বলে ভালোবাসা কি বলেকয়ে প্রকাশের বিষয় ? সামনে তাকিয়ে দেখে শুকিয়ে যাওয়া মরা ব্রহ্মপুত্র নদে নতুন করে জোয়ার আসতে শুরু করেছে। ওপারে তাকিয়ে দেখে চৈত্রের জরাজীর্ণ গাছপালা বৈশাখে নতুনভাবে পল্লবীত হয়ে সেজে ওঠছে। সে ভাবে মানুষ, প্রকৃতি ও নদীর মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কত মিল। সবাই বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। পলাশ পূব আকাশের দিকে তাকায়, দেখে আকাশ কত নীল! সে চিন্তা করে নীল কি আসলেই বেদনার রং? পলাশের মনে হতে থাকে, তার মত সকল পলাশের না দেখার অসুখ নিয়ে আকাশ যেন নীল হয়ে আছে।
মুহম্মদ র ই শামীম, কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার