গৌতম বিশ্বাস
ফোন রেখে ড্রইংরুমের সোফায় সবেই পিঠটাকে এলিয়ে দিয়েছি আর অমনি মায়ের গলা,” কার ফোন রে খোকা?”
সারাদিন কতোই তো ফোন আসে। মা সাধারণত জিজ্ঞেস করে না কার ফোন। কিন্তু এখন করলো। তার মানে পাশের ঘর থেকে কিছু কথা নিশ্চয়ই কানে গেছে তার। টি ভি তে খবরের চ্যানেল চলছে। সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। বললাম,” নিশি কাকার।”
একটু যেন চমকে উঠলো মা, ” নিশি! কতদিন পরে ফোন করলো।”
” হ্যাঁ মা, তা কয়েক বছর তো হবেই।”
” তা কি বললো সে?”
” আমায় যেতে বললো।”
” কেন? এত বছর পরে হঠাৎ কেন যেতে বললো?”
” তা তো জানি না।”
” কিছু বলেনি?”
” না। শুধু বললো কি নাকি দরকার। অবশ্যই যেন যাই।”
আমার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকালো মা,” তা তুই কী বললি?”
” বলিনি তেমন কিছু। তবে ভাবছি যাবো। এত করে বলছে। স্কুল ও কাল থেকে দিন তিনেক ছুটি। এই সুযোগে যাই একবার ঘুরেই আসি। কতদিন গ্রামটাকে দেখি না। সেই মাঠ,আকাশ, পুকুর, ধানখেত। চেনাজানা কত মানুষ। আমার সঙ্গে যাবে নাকি?”
” আমি? না রে খোকা। এই শরীরে অত ধকল নিতে পারবো না। কম দূরের পথ তো আর নয়। তুই বরং বৌমা আর দাদুভাইকে নিয়ে যা। গ্রামটাকে কোনওদিন দ্যাখেনি ওরা। গেলে দেখবি খুব ভালো লাগবে ওদের।”
আমি হাসলাম। বললাম, ” ওরা কী যেতে চাইবে?”
একটু যেন অবাক হল মা, “কেন চাইবে না? শহরের এই ইট কাঠের বদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে কার না ইচ্ছে হয়।”
একটা দীর্ঘশ্বাস আচমকাই আমার বুক চিরে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলা। সেই গ্রাম,মাঠ,পুকুর,সন্ধে নামা, জোনাক জ্বলা রাত, ঝিঁঝিঁর ডাক।
ক্ষণিকের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। মা ডাকলো,” খোকা — ”
” উঁ?”
” কি হল খোকা? কিছু ভাবছিস?”
” আচ্ছা মা — ”
” উঁ?”
” আমাদের সেই গ্রামের কথা তোমার মনে আছে? সেই ফসলে ভরা মাঠ। সবুজ গাছপালা। নীল আকাশ।”
” আছে তো।”
” জানো তো মা,আমি যখন একটু একা থাকি তখনই কেন যেন গ্রামের কথাটা মনে পড়ে যায় আমার। হঠাৎ হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার সেই ছোটবেলা। সেই সুন্দর দিনগুলো। সেই মাঠ,আকাশ,ধানখেত — ”
আজকাল মায়ের চোখে পাওয়ারের খুব সমস্যা। ভোরবেলা উঠে আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মোটা ফ্রেমের চশমাটা পরেই থাকতে হয় তাকে। আমার কথায় চোখ দু’টো ঈষৎ ঝাপসা হয়ে এলো বুঝি তার। হাত দিয়ে চশমাটা খুলতে খুলতে মা বলল, “ওসব কি আর ভোলা যায় খোকা? না রে। জীবনটা অতবড়ো বেঈমান নয় যে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে। তাছাড়া এমন কিছু স্মৃতি মানুষের থাকে যাকে ইচ্ছে হলেও ভোলা যায় না। আমি বুঝতে পারছি খোকা।”
” কি?”
” গ্রামটাকে আজও খুব ভালোবাসিস তুই। তাই বলি সুযোগ যখন এসেছে,যা। গিয়ে ঘুরেই আয়।”
খুব বেশি কথা আর না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল মা। আমি পিঠটাকে ফের একবার এলিয়ে দিলাম সোফায়। আপনা থেকে বন্ধ হয়ে এলো চোখ দু’টো। আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম ফেলে আসা আমার সেই ছোটবেলায়।
শহর থেকে অনেকখানি দূরে বলে তখনও শহরের এতটুকু ছোঁয়া লাগেনি তার গায়ে। পাখির ডাকেই সেখানে সন্ধে হয় তখন। আবার পাখির ডাকেই ভোর। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বৃত্তাকার গ্রামটার ভেতরের বড়ো রাস্তাতেই সবে ইট পড়েছে। বাকি সবটাই মাটির। চোত—বোশেখের দিনে একটু হাওয়া দিলেই তাতে ধুলো ওড়ে। আর বর্ষায় হাটু ডোবা কাদা। আম,জাম,তাল,কাঁঠাল,নারকেলের পাশাপাশি বুনো ঝোপ, লতানো আগাছায় গ্রামটা একেবারে সবুজে সবুজ। গ্রামের দক্ষিণে ফাঁকা মাঠ। সারি সারি ফসলের খেত। সকাল—সন্ধে সেখানে কৃষকের গান। রাখালের বাঁশির সুর।
আমার ঠাকুর্দা — যাকে আমি ‘ দাদু ‘ বলে ডাকতাম, সেই মানুষটি ছিল গাঁয়ের একজন সম্ভ্রান্ত চাষি। মুনিশ লাগিয়ে চাষ করার পাশাপাশি নিজে হাতেও করতো অনেককিছু। দক্ষিণের মাঠে বাইশ বিঘে জমি ছিল আমাদের। সারা বছর ফসল ফলতো সেখানে। দাদুর হাত ধরে কত বার সেই মাঠে গেছি আমি। আবার পাড়ার ছেলেদের সাথেও। তখন হয়তো বিকেল। দিনান্তের শেষ আলো ছড়িয়ে থাকা মাঠটায় দিন শেষের ইশারা। দ্রুত রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশ। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে শালিক, ফিঙে—আরও কত সব পাখি। কোনও কোনওদিন পুরো মাঠটার কোথাও না থেমে উড়ে যেত দুধেল ডানার বকের ঝাঁক। দূরের পথ পাড়ি দিত মাছরাঙা,পানকৌড়িরাও। আল দিয়ে আমায় হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে খেত চেনাতো দাদু। বলতো,” এসবই তোর জমি দাদুভাই। আজকে আমি যেমন এখানে চাষ করি,ফসল ফলাই,একদিন তোকেও করতে হবে এ সব। এখন থেকেই তাই নিজের জমিগুলো চিনে নে।”
শুধু কী খেত? হাতে ধরে ফসলও চেনাতো আমায়। ধান, পাট, তিল, ধনে, কালোজিরে, মটর, মুসুর, সরষে— আরও কত কী। কোনও গাছের পাতা ছিঁড়ে আমার নাকের কাছে ধরে এক একদিন বলতো,” জোরে জোরে শ্বাস টান তো দাদুভাই। ”
বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে দাদুর দিকে তাকাতাম আমি। দাদু জিজ্ঞেস করতো,” কোনও গন্ধ পাচ্ছিস?”
মাথা নাড়তাম,” হুঁ।”
দাদু জিজ্ঞেস করতো, ” কেমন গন্ধ বল দেখি?”
হরেক ফসল। হরেক রকম ঘ্রাণ। কোনওটার গন্ধে বুক ভরে যেত। চোখেমুখে স্পষ্ট ভেসে উঠতো একটা খুশির আভাষ। আরও আরও জোরে শ্বাস টানতাম আমি।আবার কোনওটার গন্ধ ভালো লাগতো না। একবার শ্বাস টেনেই পাতাটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলতাম,” ইস, কি বিচ্ছিরি গন্ধ।”
পারলে আমার মুখে হাত চাপা দিত দাদু। বলতো,” ছিঃ দাদু,অমন কথা বলতে নেই। ফসল হল মা লক্ষ্মী। তাকে কেউ অমন করে বলে?”
মা লক্ষ্মীর ব্যাপারটা ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামে নন্দীবাড়িতে ধুমধাম করে দূর্গাপূজো হত। সেই পুজো শেষ হতে না হতেই এসে যেত লক্ষ্মীপূজো। প্রত্যেক বাড়িতে পুজো হত। পুজো হত আমাদের বাড়িতেও। মা,ঠাকুমা দু’জনেই সারাদিন উপোস থেকে পুজোর সবকিছু গোছাতো। সন্ধেবেলায় শাঁখ—উলুর আওয়াজ আর ঠাকুর মশাইয়ের মন্ত্রপাঠে সারা গ্রামে সে এক অন্যরকম পরিবেশ। ধুপ—ধুনোর গন্ধে বাতাস মাখামাখি। দল বেঁধে প্রসাদ খেতে বেরোতো গাঁয়ের মানুষ। সুর করে লক্ষ্মী ঠাকুরের পাঁচালী পড়তো ঠাকুমা। শুনতে না চাইলেও শোনা হয়ে যেত কত কথা। জানা হয়ে যেত কত জিনিস।
দাদুর মুখে মা লক্ষ্মীর কথা শুনে ভেতরে ভেতরে চুপসে যেতাম আমি। একটা ভয় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতো আষ্টেপৃষ্ঠে। মনে হত,’ ইস, কেন যে এমন করে বলতে গেলাম। ঠাকুর যদি এবার পাপ দেয়?’
দাদু বলতো,” শোন দাদুভাই, এইসব ফসল আছে বলেই মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে আছে। না হলে পৃথিবীটা কবেই শেষ হয়ে যেত। তাছাড়া আমরা হলাম মাটির মানুষ। ফসল আমাদের জীবন। আমাদের বেঁচে থাকা। মাটি,ফসল — এ গুলোকে ভালোবাসতে না পারলে যে হবে না রে দাদুভাই।”
আমি ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতাম দাদুর দিকে।দাদু বলতো,” বুঝতে পারিসনি না? এতটুকু বয়সে না বোঝারই কথা। তবুও বলছি দাদুভাই, মাটি হল আমাদের মা। ফসল আমাদের জীবন। বেঁচে থাকতে গেলে এদের ভালো না বেসে যে উপায় নেই।”
এমন করে আরও কত কথাই না বলতো দাদু।
একদিন ঠিক এমন করেই বলছিলো দাদু। তখন শেষ ফাল্গুনের বিকেল। শরীর জুড়োনো দক্ষিণের হাওয়ার মাঠ জুড়ে দাপাদাপি। শীতের ফসল উঠে গেছে। আবার গরমের ফসল বোনা হয়নি। বেশিরভাগ খেত শূন্য বুকে চাষ পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। সে সব খেত গোরু ছাগলের অবাধ বিচরণ ভূমি। দাদুর হাত ধরে আলপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি।হঠাৎ দেখি হন হন করে কোথায় যেন যাচ্ছে নিশিকাকা। নিশিকাকা আমার রসময় দাদুর ছেলে। আমার দাদুর আপন ভাই রসময় দাদু। রসময় দাদু যেমন ভালোবাসতো আমায়,নিশিকাকাও তেমনি। নিশিকাকাও কতদিন মাঠ দেখাতে নিয়ে গেছে আমায়। নিশিকাকা ই আমায় চিনতে শিখিয়েছে কোনটা শালিক পাখি। কোনটা দোয়েল, ফিঙে, টুনটুনি। মাছরাঙা, পানকৌড়িও নিশিকাকার কাছ থেকেই চেনা আমার।
তো নিশিকাকাকে অমন করে হাঁটতে দেখে দাদু জিজ্ঞেস করেছিল,” এমন হনহনিয়ে কোথায় চললি রে নিশি?”
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল নিশিকাকা। বলেছিল,” যাই, একটু নদীর দিক থেকে ঘুরে আসি।”
” নদী! ” ওই বয়সেও নদীর কথা শুনে যেন চমকে উঠেছিলাম,” কোথায় নদী?”
নিশিকাকা আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল,” কেন?তুই জানিস না? এই মাঠটা তো ওই নদীতে গিয়েই শেষ হয়েছে। তারপরেই তো ওই গ্রাম।”
একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমি তাকিয়েছিলাম ওই অনেকখানি দূরে গিয়ে মাঠটা যেখানে গ্রামের সাথে মিশেছে,সেখানে।নদী কেমন দেখতে হয় তখনও জানি না। কেবল কারও কারও মুখে শুনেছি নদীর কথা। আমাদের তালপুকুরের থেকেও নাকি অনেক লম্বা। আর অনেক জল। দুই পাড় আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে নেমে গেছে জলের কাছে। সেখানে কলমী,কচুরিপানার জঙ্গল। বেগুনি রঙের ফুল। কত মৌমাছি, ফড়িং,মালপোকা।
হঠাৎই আমি বলে উঠেছিলাম,” আমি যাবো।”
নিশিকাকা জিজ্ঞেস করেছিল,” কোথায়?”
আমি ততক্ষণে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছি।সেই অস্থিরতা নিয়েই বলেছিলাম,” নদী দেখতে।” তারপর দাদুর দিকে ফিরে বলেছিলাম,” চলো না দাদু আমরা নদী দেখে আসি।”
দাদু বলেছিল,” যাই বললেই কী যাওয়া যায়। আমার কী আর সেই বয়স আছে? এই এতখানি পথ — ”
একটু ধীর পায়ে আমাদের কাছে এগিয়ে এসেছিল নিশিকাকা। বলেছিল,” অসুবিধা না থাকলে আমিই না হয় ওকে নিয়ে যাই জ্যাঠা।”
কি যেন একটা ভেবেছিল দাদু। তারপর বলেছিল,” আচ্ছা,যা। তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।”
নিশিকাকা বলেছিল,” সে তুমি ভেবো না জ্যাঠা। এই তো এটুকু পথ। মাঠটা পেরোলেই তো নদী। সন্ধের আগেই ঠিক ফিরে আসবো।”
দাদু বলেছিল,” দেখিস। দেরি হলে ওরা আবার — ”
সেদিন সারাটা বিকেল নিশিকাকার সঙ্গে ছিলাম আমি।শুধু বিকেলই বা বলি কেন, বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে। সন্ধ্যে উতরে
রাতটাও নেমে গিয়েছিল। কত কথা সেদিন বলেছিল নিশিকাকা। আমায় নদী চিনিয়েছিল। সেইসঙ্গে চিনিয়েছিল জীবন। নদীর দিকে দেখাতে দেখাতে বলেছিল,” এই যে যেমন নদী দেখছিস,আমাদের জীবনটাও ঠিক এমন। নদীর মতই সেও কেবলই বয়ে যায়। কারও জন্যেই থেমে থাকে না কখনও।”
আমি ‘ হা ‘ করে তাকিয়েছিলাম নিশিকাকার দিকে। নিশিকাকা আরও বলেছিল,” নদীতে যেমন একবার যে জল বয়ে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না,তেমনি যে দিনটা চলে যায় সেও আর ফিরে আসে না।”
জীবন সম্পর্কে আরও অনেক কথাই বলেছিল নিশিকাকা। সব কথার অর্থ বোঝার মত বয়স তখন আমার নয়। আজ এই বড়োবেলায় এসে কতক বুঝেছি। আবার বুঝিও নি কত। এতদিন পরে এসে ফের একবার মনে পড়ছে সেইসব দিন। সেইসব কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই নদী,মাঠ,রাতের আকাশ, গাছপালা। কেমন আছে আমার সেই গ্রাম? কেমন আছে নিশিকাকা?
গ্রামটার অনেককিছুই পাল্টে গেছে। আবার পাল্টায়নি অনেককিছুই। যেমন পাল্টায়নি নিশিকাকার বাড়িটা। তেমনি রাস্তা থেকে ঈষৎ ভেতরের দিকে সরে গিয়ে ফালি উঠোন। উঠোনের পাশে ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। ঘরের ওপর হিমসাগর আমের ছায়া। তবে আগের চেয়ে অনেকটাই বেশি নির্জন যেন। এ বাড়িতে কেবল অসংখ্য পাখির কিচির মিচির আর গাছের পাতা নাড়িয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ বাদ দিলে বাকি সবটাই যেন এক নৈঃশব্দে মোড়া।
কিন্তু এ কি হাল হয়েছে নিশিকাকার? সেই আমার দেখে যাওয়া যৌবনের অবশিষ্ট কোথায়? সারা শরীরে ঝুলে পড়া চামড়ার আচ্ছাদনে ঢাকা হাড়ের কাঠামো চামড়া ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বিশ্রী ভাবে। দু’টো ঘোলাটে চোখে ধূসর দৃষ্টি। এক মাথা সাদা হয়ে যাওয়া চুল। সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়া শরীর জুড়ে অকাল বার্ধক্যের হিংগ্র ছায়া।
আমায় দেখে ভীষণ খুশি নিশিকাকা। আমার গায়ে,মাথায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল,” কত বড়ো হয়ে গেছিস। আমি তো ভাবতেই পারিনি। আমার চোখে তো কেবল তোর ছোটবেলাটাই আছে। কতদিন পরে তোকে দেখলাম বল তো?”
শেষের কথাটায় যেন মিশে আছে একটা অভিমান। কিংবা কষ্ট। সে তো থাকারই কথা। নিশিকাকা কত ভালোবাসতো আমায়। কত কোলে কাঁধে নিয়ে বেড়াতো। কত সন্ধে, বিকেল কেটেছে কাকার সঙ্গে।
” কী ভাবছিস শুভ?”
একটু যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম কোথায়। চমকে উঠলাম নিশিকাকার কথায়।
নিশিকাকা যেন বুঝলো কিছু একটা। আর তাই বুঝি জিজ্ঞেস করলো,” কি হল শুভ?”
আমি বললাম,” সত্যিই তো কাকা,কতদিন পরে এলাম। অথচ কি মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে এই যেন সেদিনের কথা। এই সেদিনই যেন এই দাওয়ায় বসে মুড়ি নারকোল খেলাম। আমার হাত ধরে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেলে তুমি। ডুমুর গাছে টুনটুনির বাসা দেখালে। সবেই ডিম ফুটে দু’টো বাচ্চা হয়েছে তাতে। আমাদের দেখেই মা টুনটুনিটা পালিয়ে গেল। ভয় পেয়ে ‘ চিঁ চিঁ ‘ করে বাচ্চা দু’টোর কি ডাকাডাকি।”
নিশিকাকার ঠোঁটের কোনে হালকা খুশির ঝিলিক, ” বাঃ,তোর তো বেশ মনে আছে ”
” হ্যাঁ কাকা,আরও কত কি মনে আছে। তুমি সেদিন নদী দেখাতে নিয়ে গেলে আমায়। তখন বিকেল।কে একটা লোক নৌকোয় বসে জাল ফেলছিলো। আমি নৌকোয় উঠতে চাইলাম। তুমি লোকটাকে বলে — ”
আমার কথায় একটু একটু করে নিশিকাকাও যেন ফিরে যাচ্ছে তার অতীতে। চোখেমুখে ভেসে উঠছে একটা খুশি। ফেলে আসা যৌবনের ছোঁয়া অনুভব করছে ভেতরে। আমাকে শেষ করতে না দিয়ে তাই বলল,” সবই তো দেখি মনে আছে তোর।”
আমি বললাম,” হ্যাঁ কাকা,সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল। মাঝ মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা চিনিয়েছিল আমায়। আমি তো সেদিনই প্রথম চিনে নিয়েছিলাম কোনটা কালপুরুষ। কোনটা সপ্তর্ষিমণ্ডল। কোনটা ধ্রুবতারা।”
হঠাৎই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিশিকাকার বুক চিরে। বাইরের দিকে তাকিয়ে কি একটা ভাবলো। তারপর বলল,” কেন যে এখানকার সবকিছু বেঁচে দিয়ে শহরে চলে গেল অনাদী দা। চাকরি তো এখানেও করতে পারতো। জ্যাঠা বেঁচে থাকলে কিছুতেই যেতে দিত না। না গেলে কত ভালো হত বল তো?”
এখন বিকেল। আর সে বিকেল শেষ হয়ে আসছে একটু দ্রুতই। মাঝ আশ্বিনের দিন শেষের রোদ এখন পুরোটাই প্রায় ছায়ার দখলে। নিশিকাকার উঠোনের পুরোটা জুড়েই ছায়া। চারপাশে বড়ো বড়ো সব আম—কাঁঠালের গাছ। সেইসব গাছের ডাল গুলো ঝুলে পড়েছে উঠোনের ওপর। এখানে ওখানে লতানো আগাছার জঙ্গল। একা মানুষ নিশিকাকা। তার ওপর
বয়স বেড়েছে। কতই বা আর দেখে রাখা সম্ভব।
কাছেপিঠে কোথাও ঢাকের আওয়াজ। পুজো আসছে। মাত্রই আর দিন কতক বাকি। কতদিন যে এমন করে ঢাকের আওয়াজ শোনা হয় না।
নিশিকাকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” আচ্ছা কাকা,নন্দী বাড়িতে এখনও কি পুজো হয়?”
নিশিকাকা বলল,” হয় তো।”
” এখনও কি তুমি যাও আগের মত?”
আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কাকা। তারপর বলল,” নারে,এখন আর আগের মত যাওয়া হয় না। বয়স বেড়েছে তো। অত হাঁটাচলা করতে পারি না। তবে পুজো এলেই মনটা কেমন করে ওঠে। পেছনের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। তোকে কত কোলে কাঁধে নিয়ে পুজো দেখাতে গেছি। তোর মনে আছে শুভ?”
” আছে তো। সব মনে আছে কাকা।”
” এখন একা থাকি তো। অবশ্য ঠিক একা নয়। সরলার মা আছে। দুইবেলা রান্না করে দেয়। বাড়িঘর ঝেড়ে পুছে রাখে। সারাদিন তার সঙ্গেই যা একটু কথা হয় আমার। বাকি সময় একদমই একা। তখন তোর কথা মনে পড়ে। অতীতের কথা মনে পড়ে। চলে যাওয়া দিনগুলো যেন ফিরে আসে আবার। রাতে একদমই ঘুমোতে দেয় না ওরা।”
” তাই বুঝি আমায় আসতে বললে?”
” না রে,আরও একটা দরকার আছে।”
” কী দরকার?”
” বলবো। সব বলবো তোকে। তা হ্যাঁ রে শুভ — ”
” বলো।”
” এই গ্রামে তোর ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? এই গ্রাম,এই মাঠ,আকাশ,গাছপালা। ”
” কি করে আসবো বল তো? আমার চাকরি তো সেই শহরে। একবার যদি যেতে, দেখতে কত দূরের পথ। তাছাড়া আমার ছেলে, ওর মা— ওরা আজন্ম শহুরে মানুষ। গ্রামে এসে দু’দিনের বেশি তিনদিন তো থাকতেই পারবে না।”
ফের একটা দীর্ঘশ্বাস নিশিকাকার বুক চিরে বেরিয়ে এলো। আমার মনে হল শ্বাস নয়,যেন একটা কষ্ট। এত কীসের কষ্ট নিশিকাকার? আচ্ছা এতই যদি কষ্ট,তাহলে বিয়ে করলো না কেন মানুষটা? তাহলে তো আর এই বয়সে এসে এমন নিঃসঙ্গ থাকতে হত না।
দিনের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। নিশিকাকার বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ঝাঁপসা একটা অস্পষ্টতা। দিন শেষের ইশারা নিয়ে সন্ধ্যা আসছে। ঢাকের আওয়াজ আরও স্পষ্ট।
হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলাম,” তোমার কি শরীর খারাপ কাকা? কিছু হয়েছে?”
নিশিকাকা বাইরের দিকে তাকালো। ঝাঁপসা একটা অস্পষ্টতা ঘিরে আসা উঠোন জুড়ে দিন শেষের ছবি। সেই ছবি দেখতে দেখতে নিশিকাকা বলল,” একটা জীবন কত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, না রে?”
কাকার কথার মানেটা খুঁজতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। মাথার মধ্যে কেমন যেন জট পাকিয়ে এলো সবকিছু। আচমকাই জিজ্ঞেস করে ফেললাম,” তুমি বিয়ে করলে না কেন নিশিকাকা?”
হঠাৎই যেন চমকে উঠলো নিশিকাকা,” বিয়ে!”
বললাম,” হ্যাঁ,বিয়ে। একটা বিয়ে করলে কত ভালো হত বল তো? ছেলে—মেয়ে, নাতি—নাতনি নিয়ে আজ ভরপুর একটা সংসার থাকতো তোমার। এখন তোমার শরীরের যা হাল তাতে এই বাড়িঘর, বিষয়সম্পত্তি — কে খাবে বলো তো এ সব?তাছাড়া তুমি নিজেও তো আর দেখে শুনে রাখতে পারো না।”
আমার মুখের দিকে তাকালো কাকা। খুঁটিয়ে দেখলো কিছু। তারপর বলল, ” সে জন্যেই তো তোকে ডেকেছি রে শুভ।”
” মানে?”
” মানে এই বিষয় আশয়ের ভার আমি আর বইতে পারছি না রে।”
” তাই তো বলছি,যদি বিয়ে করতে,যদি একটা ছেলে থাকতো,তাকেই তো দিয়ে যেতে পারতে সব। কে তোমায় মাথার দিব্যি দিয়েছিল বল তো এভাবে বিয়ে না করে থাকতে?”
এক অন্যরকম চোখে আমার দিকে তাকালো নিশিকাকা,”বিয়ে হয় তো আমি করিনি। কিন্তু কে বললো আমার ছেলে নেই?”
এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না একদম। অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,” এ সব কী বলছো কাকা? এ কথার মানে কী?”
ফের দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিশিকাকা। একবার আকাশের দিকে তাকালো। একবার আমার দিকে। তারপর বললো,” ঠিকই বলছি রে শুভ। আমার একটা ছেলে আছে। কিন্তু কোনওদিন তার পরিচয়টা কাউকে দিতেও পারিনি। এমনকি তাকেও বলতে পারিনি কোনওদিন যে আমিই তার বাবা। অথচ আমার
এই চোখের সামনেই সে খেলে বেড়িয়েছে। এই কোলে কাঁধে চড়েছে। তবুও — ”
কথাটা শেষ না করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো নিশিকাকা।হয়তো ইচ্ছে করেই হারিয়ে গেল অতীতের মাঝে। এদিকে আমার মাথার মধ্যে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে আসছে। খেই হারিয়ে ফেলছি কেবল। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি আমি। চারিদিকে নিকষ আঁধার। আলোহীন প্রান্তর জুড়ে এক হিং¯্র নৈঃশব্দ্য। আমি ডুবে যাচ্ছি সেই আঁধার ঘেরা নৈঃশব্দে।
ডুবতে ডুবতে হঠাৎই ‘ভুস্ ‘ করে জেগে উঠলাম আমি। মুখেও কথা ফুটলো আমার। বললাম,” এইসব বিষয় আশয় তো একপ্রকার তারই। তাহলে তাকেই দিয়ে যাও না।”
” দেবো বলেই তো তোকে ডেকেছি রে শুভ।”
চমকে উঠলাম,” মানে?”
বাইরের দিক থেকে চোখ ফেরালো কাকা। তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর হঠাৎই আমাকে চমকে দিয়ে বললো,” যদি বলি তুই সেই ছেলে — ”
আচমকা বুঝি বজ্রপাত হল ঘরের ভেতর। মেঝেটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে ভীষণ ভাবে দুলে উঠলো। চেয়ার থেকে ছিটকে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিতে পারলেও দুই চোখে চেপে বসলো এক আঠালো আঁধার। সেই আঁধার একসময় জড়িয়ে ধরতে লাগলো আমার সর্বাঙ্গ। অন্ধকার এক গোলকধাঁধার পথে হারিয়ে যেতে যেতে বেঁচে ওঠার তীব্র আকাক্সক্ষায় হাত—পা ছুঁড়তে লাগলাম আমি। কিছু একটা বলতে গিয়ে দেখলাম মুখ থেকে সমস্ত কথারা হারিয়ে গেছে। অগত্যা নিশিকাকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল।
আশ্বিনের আকাশ জুড়ে তখন সন্ধ্যা নামছে।।
গৌতম বিশ্বাস, গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত