পূর্ববাংলা থেকে বাংলাদেশ
সুফিয়া শীলা
ইতিহাসের রক্তাক্ত পথে
নগ্ন পায়ে দেহের সকল উত্তাপ ঢেলে,
দুর্বিপাকের ঘূর্ণিঝড় করে ছিন্নভিন্ন
মাড়িয়ে হাজারও শ্বাপদের বেড়াজাল– উঠে দাঁড়িয়েছে
আমার স্বদেশ।
বীরদর্পে, মাথা উঁচু করে
লক্ষ শহিদের বিসর্জিত প্রাণের ধুলোমাখা পথে
উপাখ্যানের অহঙ্কারী মহানায়ক হয়ে।
সেই পথের বাঁকে বাঁকে প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছে
পূর্ব-প্রজন্মের বীরত্বগাথা, আভিজাত্য আর অর্জন;
মিলানো হিসেবের ঝকঝকে অঙ্কের খাতা।
‘স্বাধীনতা’– হৃৎপিণ্ডের মুক্ত জলাধারে–
ফুটে থাকা শাপলার শুভ্র আঁচল আর
সোনালি দোয়েলের শিস।
বঙ্গভঙ্গ থেকে দেশবিভাগ–
কালের অগ্নিগর্ভ থেকে উঠে এসেছিলো সব সৈনিক যোদ্ধারা,
অকাতরে বিলিয়ে প্রাণ ফিরে গেছে অরুণ-রাঙা ভোরে।
বায়ান্ন-র একুশ ফেব্রুয়ারি–
ঢাকার রাজপথে খইফোটা বুলেটের রক্তগ্রোতে
ভেসে গেলো বিজাতীয় ভাষার দাগ,
নির্ভীক যোদ্ধাদের রক্তচ্ছাপে সগৌরবে উঠে দাঁড়ায়
মাতৃভাষার ক্ষত-বিক্ষত অক্ষর, শব্দ আর ইতিহাসের পদাবলি।
চুয়ান্ন-তে পূর্ববাংলার প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন,
জেগে ওঠে পূর্ব প্রজন্মের কিংবদন্তিরা;
একুশ দফায় যুক্তফ্রন্ট-এর বিজয় গাথা,
শুরু হলো স্বাধীনতার জয়যাত্রা,
জোটের জঠরেই স্পন্দিত হয়েছিল বাংলাদেশ।
ছাপ্পান্ন-তে সংবিধানের নামে এক কালো অধ্যায় হলো রচিত,
বাঙালি নিধনের আরেক নতুন দিক হলো সূচিত;
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন–
দমন নিপীড়নের সর্বগ্রাসী হাতিয়ারের নগ্ন ঝনঝন।
বাষট্টি-র শিক্ষা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ,
শাসন-শোষণ আর শিক্ষা সংকোচনের জঙ্গমতা–
হয়ে গেলো লাশের মিছিল;
শবযাত্রায় শরিক এবার ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা
আর বাবুল,
শিক্ষা নীতি করতে বাতিল করলো মরণ কবুল।
ছেষট্টি-র ছয় দফা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু,
হয়ে গেলো স্বাধীন বাস্তুভিটার দৃশ্যমান কাঠামো নির্মাণ;
গণ-আন্দোলনে আবারও সারিবদ্ধ লাশ,
এগারো সন্তানের শব কাঁধে স্বদর্পে হেঁটে গেলো স্বদেশ;
পেছনে ফিরবার মতো নপুংসক নয়– এই জাতি।
ঊনসত্তর-এর গণ-অভ্যুত্থান,
ছাত্র-জনতার আক্রোশ হয়ে উঠলো মৃত্যুর বজ্রবাণ;
আসাদের রক্তাক্ত শার্ট অঙ্কিত হয়ে গেছে
আকাশের শুকতারায়,
অদৃষ্টের অধ্যাদেশ তখন হয়ে গেছে লেখা শুরু;
বঙ্গবন্ধু বন্দি হলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়।
সময় হলো নিশাবসানের।
সরে যেতে শুরু করলো দুইশত চব্বিশ বছরের
অমাবস্যার নিকষ দেয়াল;
দূরে– বহু দূরে দিগন্তরেখায় উঁকি দিলো ঈপ্সিত আরক্ত ভোর।
একাত্তর- এলো মুক্তির মহাকাব্যের সাঁজোয়া বহর হয়ে,
সাত মার্চ– মঞ্চে উঠে এলেন বাংলাদেশের রূপকার;
দিয়ে গেলেন মুক্তিমন্ত্র,
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
–অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় সেই মুক্তিমন্ত্র
শিরা উপশিরা আর ধমনীর পথ বেয়ে নিমিষেই
পৌঁছে গেলো বাঙালিদের নিউরণ কোষে।
আগ্নেয়গিরির ম্যাগমা তখনও হয়নি লাভা,
পঁচিশ মার্চ– এর কালরাত!
বিদীর্ণ মানচিত্রের হৃৎপিণ্ডে শুরু হলো রক্তপাত,
শুরু হলো স্বাধীনতার অগ্ন্যুৎপাত।
ছাব্বিশ মার্চ– সেই উত্তপ্ত লাভা বয়ে চললো
ছাপ্পান্ন বছর বর্গমাইল জুড়ে।
থেমে গেলো মহাকাল,
তিরিশ লক্ষ শহিদ আর দুই লক্ষ বীরাঙ্গনার বিনিময়ে
সেই আরক্ত ভোরে ছিন্ন করে পরাধীনতার সকল শৃঙ্খল;
ষোল ডিসেম্বর– মধ্য আকাশের উঠলো কাক্সিক্ষত
বিজয়ের সূর্য,
আমাদের স্বাধীন বাস্তুভিটা– বাংলাদেশ
আমাদের স্বাধীন মানচিত্র– বাংলাদেশ।