জাকিয়া শিমু
রমজান আলী দু’হাঁটুর চিপায় মাথা গুঁজে উঠোনের এককোণে জলচৌকির ওপর বসে আছে। তাকে দেখতে বহুদিনধরে ভোগা, বিপর্যস্ত-সান্নিপাতিকরোগীর মতো লাগছে। নির্ঘুমচোখের চারিধারে শ্বেতভাল্লুকের চোখের মতো ঘন কালিরেখা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, চোখের মণিদুটো মদ্যপের মতো রাঙা।
এখন বর্ষাকাল। গতক’দিনে আকাশে মোষেরপালের মতো যতো মেঘ জমা ছিল, সারারাত ধরে তা ঝরে এখন এইসকালের আকাশ ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। যদিও বাতাসে জলের ভেজাগন্ধ ছড়ানো। হেমন্তকালের মতো হালকা শীতল হাওয়া বইছে-,আষাঢ়ী কুটকুটে গরমটা একদম কেটে গেছে। এমন একটা স্নিগ্ধ পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে রমজান আলী, আদুল গায়ে বিবশ হয়ে বসে আছে। তার মাথার উপরের কদমগাছটায় আকাশের তারার মতো হাজারে বিজারে কদম ফুল ফোটে আছে। হাওয়ার দাপটে ফুলের রেণু ঝুরঝুরিয়ে ঝরে পড়ছে, বাতাসে তার সৌরভ ম ম করছে। কিন্তু তার মন কোনো কিছুতেই বসছে না- অতিরিক্ত বিক্ষিপ্ত, উথালপাথাল অবস্থা যাকে বলে।
মনের ভার তার শরীরে ভর করেছে- কপালে মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা- ডানপাশের রগটা ঘুড়ির সুতোর মতো টান টান হয়ে আছে, মনেহচ্ছে যেন যেকোনো সময় ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ! মাথায় চাপকলের শীতল পানিও ঢালা হয়েছে কিন্তু তাপমাত্রা নামছে তো না-ই বরং ছাইচাপা আগুনের ন্যায় অবিরত বাড়ছে।
রমজান আলীর প্রথম স্ত্রী, রাহেলা বেগমের ঘরে প্রায় পাঁচ বছর পরে সন্তান আসল, তাও আবার পুত্র সন্তান। যদিও রাহেলা বেগমের খুব শখ ছিল একটা মেয়ে সন্তানের। কী বা করার আছে! মানুষের সব আশা কী আর পূর্ণ হয় ! তারপরও সে যারপরনাই খুশি, মোটের ওপর বন্ধ্যা রটনা ঘুচল তো! শুধু কী তাই! কথাটা মনে পড়তেই রাহেলা বেগম হেসে ওঠেন,- নিজ মনে হাসেন; এই হাসির উৎস, রমজান আলী গত দুবছর ধরে টের পাচ্ছেন যদিও গাঁয়ের সকল লোক সবেমাত্র জানল!
ছেলেটার আজ এক সপ্তাহ পূর্ণ হল। দেখতে ধবধবে পরিষ্কার, নাক চোখ খাড়াখাড়া। সাতদিন বয়সের বাচ্চাকে মনে হচ্ছে যেন দু’তিন মাস বয়সের বাচ্চা- বড়সড়-টনটনে। গ্রামসুদ্ধ লোকের ঢল নেমেছে- রাহেলা বেগমের বাড়িতে। বাচ্চার আকিকা উপলক্ষে ঘরবাড়ি ভর্তি আতœীয়স্বজন। সন্তানের মা মানত করেছিল, তার কোলে সন্তান এলে শুধু তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী নয়, চার গাঁয়ের লোক জানিয়ে মহা হূলস্থুল বাঁধিয়ে সে বাহ্য-লৌকিকতা করবে, যাতে বংশপরম্পরায় এঘটনার ধকল বয়ে নিয়ে যায়। কথামতো আয়োজন চলছে- জোড়া খাসি এবং সাইজ মতো পাঁচ পাঁচটা গরু কেনা হয়ে গেছে। মোহনগঞ্জ হাট হতে দিনাজপুরের একনম্বর চিনিগুঁড়া চালের বেশকটা উপরি-বস্তাও দাওয়ায় স্তূপ করে রাখা আছে যাতে কমতি না পড়ে। স্থানীয় গোয়াল ডেকে, আশেপাশের গৃহস্থবাড়ি থেকে বাজারদরের চেয়ে সের প্রতি বেশি টাকায় খাঁটিদুধ কিনে, দই পাতার কাজও গতরাতে শেষ করা হয়। নানান পদের মিষ্টিতে ঘর ভর্তি। আয়োজনের শেষমুহূর্তে তার মনে হলো- মাছের কথা। এমন আয়োজনে মাছ থাকবে না, তা মানা যায় না। লোক পাঠিয়ে পদ্মাপাড় থেকে তরতাজা ঢাউস সাইজের বেশকটা মাছও আনা হল। এমন বিশাল সাইজের মাছ এ গাঁয়ের লোক আগে কখনও দেখেনি। মুরব্বিদের একটা হক আছে- এমনকথা মনে পড়ল তাও অনুষ্ঠানের দিন সকালবেলায়। তড়িঘড়ি করে শহরে লোক পাঠানো হল শাড়ি-লুঙ্গি আনতে। এআয়োজনের শতভাগ নিখুঁত হওয়া চাই, কোন ফাঁকফোকর চলবে না।
রমজান আলী শোবারঘরের খাটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার গা খালি, লুঙ্গিটা হাঁটুঅবধি বিস্রস্ত হয়ে আছে। নেশাখোরের গাঁজায় দম নেওয়ার মতো করে শরীরের সমস্ত জোর ব্যয়ে যেন প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়া দম ফিরে পেটে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বুকের পাঁজর কামারের হাপরের মতো দ্রুত উঠানামা করছে। গত দু’বছরে তার শরীরের ওজন একটু বেশিমাত্রায় ক্ষয়েছে যেন, হাতের আঙুলগুলো তার দিবাসাক্ষ্য- শুকিয়ে শীর্ণ শনের মতো দেখতে। কোটরাগত চোখে মড়ামানুষের চাহনি। এমন একটা খুশির দিনে রমজান আলী অসুস্থ হলে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ডা. ডাকা হয় কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ ব্যতীত শারীরিক তেমন কোন কঠিন সমস্যা পাওয়া যায় না। ‘মনের শরীরের ব্যথা সারানোর দাওয়াই কী ডা.’র দেওয়ার সাধ্য আছে ! আচানক এমনটাই রাহেলা বেগমের মন বলে উঠল।
আজকের দিনটি রাহেলা বেগমের জন্যে বড়ো আনন্দের দিন। বাড়ি ভর্তি মানুষ। অনুষ্ঠানে ঘাটতি পুরাতে সে নিজে ঘুরে ঘুরে তার তদারকি করছে। তার বুকের ওমে সাতদিনের সন্তানটি দুহাতে আগলে ধরা। সবাই খুব কৌতূহলী চোখে বাচ্চাটি দেখছে। সে পুরোবাড়ি সন্তান নিয়ে চক্কর দেয়, যাতে কেউ অদেখা না থেকে যায়।
রমজান আলী বিছানায় হাতপা বিড়ালের মতো গুঁটিয়ে শুয়ে আছে। মনের-রোগ শরীরটাকে কাহিল করে তুলেছে। বিছানা বরাবর জানালার কপাট খোলা, চোখ রাখতে বাইরের মহাযজ্ঞ চোখে পড়ে, সেদিকে সে সাপের মতো অপলক-শীতলদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। সহসা রাহেলা বেগম সন্তান কোলে নির্ভারে ঘুরে বেড়ানো অবস্থায় তার দৃষ্টিফ্রেমে ঢুকে পড়ে। এমন পবিত্রদৃশ্য দেখে সে ভীষণভাবে চমকে উঠে। এমন নয় যে- সন্তানের মুখ সে এই প্রথম দেখল- গত দশদিনে বেশ ক’বার, বলতে গেলে রাহেলা বেগম জোর করে তাকে দেখতে বাধ্য করেছে। যেমন, সে বিবসবদনে বাইর বাড়ির পিটুলি গাছটার তলে (তার খুব পছন্দের জায়গা- সেখানে দিনরাত সবসময় বেতের মোড়া পাতা থাকে, দক্ষিণ দিকটা খোলা- গাছের পাতা না-নড়ার মতো তপ্ত গরমেও কোথা থেকে যেন চোরাই হাওয়া এসে গা শীতল করে) বসে আছে, দেখা গেল রাহেলা বেগম চুপিসারে বিড়াল পায়ে সেখানে এসে হাজির হয়। কিছু বুঝার আগেই সন্তান তার কোলের ওপর বসিয়ে দিয়ে, খিলখিলিয়ে হেসে উঠে, ও-হাসির ব্যখ্যা দেওয়া কঠিন- বুকের পাঁজর দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্টের। রমজান আলী তখন ভয় আতঙ্কে চমকে উঠে, অবুঝ শিশুটাকে তার আজরাইলের মতো ভয় করে !
এখনো, এতদূর থেকে শিশুটাকে দেখে সে শঙ্কিত হল, মুহূর্তে গায়ের লোমগুলো সূর্যের আলোতে দূর্বাঘাস যেমন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে যায় তেমন করে খাড়া হয়ে গেল। ঠিক এসময়ে সে বিড়বিড়িয়ে অশ্রুত কিছু যেন একটা বলে উঠল। তার দেহের সমস্ত শিরা উপশিরা বেঁয়ে একটা অশুভ ভাবনা দ্রুত ছুটে যেয়ে মাথার খোঁড়লে আটকে গেল। এরপর খুন’ শব্দটা মাথার ভেতর চিড় মারতে থাকল। এবং একটা খুনের নেশায় আসক্ত হল- যেমন করে সে প্রতি রাতে বাংলা মদ, তাড়ি খেয়ে মত্ত হয়, তেমন করে। মনটা দৃঢ়ভাবে যেন বলে উঠল-খুনটা তাকে করতেই হবে – ভাবনাটা মনে হতে হতে মুহূর্তে আবার শরীর মন দুটোই থরথরিয়ে কেঁপে উঠল এবং মনোবল শূন্য হয়ে মিইয়ে গেল। এরপর তার কণ্ঠ থেকে লড়াইয়ে হেরে যাওয়া পশুর মতো গোঙানির আওয়াজ শোনা গেল। কৌশলী রমজান আলী গাঁয়ের সহজ সরল মেয়ে রাহেলা বেগমের ফাঁদে পোক্তভাবে আটকে গেছে- গর্তে-পড়া হাতির মতো বেকায়দায় পড়েছে। রমজান আলী কড়া অনুতাপের সাথে তার ফেলে আসা জীবনের পেছনের দিকে তাকাল, অনেকটা সময় পেছনে-
একসময়ে তার সংসার এখনকার মতো জৌলুসাবৃত ছিল না- এটা সত্যকথা তবে তীব্র শীতে গরীবের বিছানার খড়ের ওমের মতো যে- সুখ, সে রকম-সুখের কমতি ছিল না এতটুকু। মা বাবা আর দু’বোনের একমাত্র ভাই রমজান আলীকে নিয়ে গৃহস্থ সংসার। নিজেদের জমিজমা ছিল না, বাপের সাথে অন্যের জমি বর্গাচাষ করে সংসার চলত। রাহেলা বেগম তার লতায় পাতায় জড়ানো আতœীয় এবং প্রতিবেশী। তাদের অবস্থা গ্রাম আন্দাজে মন্দ নয়। তবে সে দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, এমনকথা বললে বিকোবে না। কানা খোঁড়ারও উঠতি বয়সকালের একটা সৌন্দর্য থাকে, সে অবশ্য ওই পর্যায়ের নয়, তার শরীরের তেমন কোন খুঁত নেই। তো বয়সকালের-রূপটা সবে তখন ফুটতে শুরু করেছে, রমযান আলী তার প্রেমে পড়ে যায়- তা সে-প্রেম তার বিষয়আশয়ের নাকি সৌন্দর্যের শুরুতে বলা তা মুশকিল! এরপর উভয় পরিবারের অমতে বিয়ে হয় !
শুরুটা সেই থেকে অর্থাৎ রাহেলার অধঃপাতের পথ চলা। বিয়ের আগে কল্পনায় আঁকা স্বপ্নগুলো আকাশের তারার মতো একটা একটা করে খসে ক্ষয়ে উধাও হয়ে যায়। তার উপস্থিতি নানানভাবে সংসারে সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। সে এ-সংসারে ঢুকতে রমজান আলীর মা-বোন হাত গুঁটিয়ে বসে থাকে। একসময় তারা নারিকেল পাতায় পাটি বুনত, নকশীকাঁথা সেলাই করত এবং এ-ওর বাড়ি বাড়তি কাজ করে উপরি আয় করত এবং সবমিলিয়ে সংসার মোটের ওপর চলে যেত। রমজান আলীর বাবার শরীরও নাকি আগের মতো চলে না। সেও ফন্দি আঁটে, একবেলা ক্ষেতে যায়, তো ও-বেলা ঘরে শুয়ে হাপিতাশ করে। সংসার প্রায় অচল হয়ে পড়ে। রমজান আলী একা খেটে কুলাতে পারে না। এদিকে রাত দিন এক হাতে সংসারের কাজ করে রাহেলা।
সেসময়ে গাঁয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার হিড়িক পড়ে। গাঁয়ের লোকের সম্পদ বলতে, আছেই বা কী! বেশির ভাগের পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ভিটেমাটিটুকু। অনেকে তা বিক্রি কিংবা বন্ধক রেখে ভিসা পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। রমজান আলীর বিদেশ যাওয়ার বড় শখ, টাকার অভাবে কপাল খুলছে না’- এমন আক্ষেপ তার বাসর রাতে প্রকাশ ঘটেছে। রাহেলা অবশ্য ধাক্কাটা সেদিন বুঝতে পেরেও পাশ কাটিয়ে গেছে। সে অবশ্য হাঁটুগেঁড়ে বসে থাকার পাত্র নয়,বিয়ের বছর না ঘুরতে রাহেলাকে বাপের সম্পত্তির অংশ বিক্রি করাতে বাধ্য করে। এরপর সে বদলে যায়- কামকাজ বাদ দিয়ে বউয়ের টাকায় সংসার এবং ফুর্তি করে বেড়ায়। মদ তাড়ি খেয়ে (যদিও এটা তার বহুকালের অভ্যাস), গভীর রাতে বাড়ি ফিরে। বিদেশের নাম ভুলেও এ বাড়ির কেউ মুখে আনে না। রমজান আলী বংশের একমাত্র চেরাগদাতা, ভবিষ্যৎ বংশরক্ষার মালিক এমন প্রভুকে মরুদেশে পাঠিয়ে জানে মারার মতো বোকা তার পরিবার নয়। সে নিজেও বেঁকিয়ে বসে। একবেলা নুন পান্তার যার জোগাড় ছিল না, সেই তার হাতে এখন প্রচুর টাকা, এত টাকা এক সাথে বাপের জীবনে সে দেখছে কী না সন্দেহ- এসব ছেড়ে ছুড়ে বিদেশের মাটিতে পচে মরার কোনো মানে হয় না। সে উল্টোরথে পা ফেলে, রাহেলাকে বিদেশ যেতে জোর করে।
মরুদেশে মেয়েদের চাহিদা বেশি আর অল্পবয়সী হলে তো কথাই নাই। কিন্তু রাহেলা এপ্রস্তাবে রাজি হয় না। রমজান আলী ফরমাস জারি করে- বিদেশ যেতে রাজি না হলে তাকে তালাক দিয়ে বেশি টাকায় যৌতুক নিয়ে সে দেশে ব্যবসা শুরু করবে। বাবা-মা নেই। নিজের অংশ বিক্রি করায় ভাইদের সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। পায়ের তলের শেষ মাটিটুকু সে ট্র্যাপে পড়ে হাতছাড়া করেছে। রাহেলা দিককূল খোঁজে পায় না। শেষে, নিদেন পক্ষে সংসারটা বাঁচাতে হলেও সে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে মনস্থির করে।
রাহেলাসহ আরও সাতজন মেয়ে তীব্র গরমের মধ্যে আবুধাবী এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এদের বয়স পনের থেকে কুড়ির মধ্যে- একান্ত বাচ্চা বয়স। তাদের পরনে ভারি কালো কুচকুচে বোরকা। এরা এ-কাপড়ে অনভ্যস্ত, মাথা থেকে ঘোমটা সরে গিয়ে অগোছালো চুলেরগাছি ঘর্মাক্ত কপালে লেপটে আছে। কেউবা বোরকার হাতা টেনে কনুই অবধি তুলে রেখেছে- হাতগুলো নবীন, সবেমাত্র কচি দূর্বাঘাসের মতো লোম গজাতে শুরু করেছে, মুখখোলা-সতেজ, ভিরু চেহারার ভেতর হরিণশাবকের মতো উৎসুকচোখগুলো অদেখা পৃথিবীটার দিকে মুমূর্ষু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোনদিকে এদের দিশা নেই। মনটা ছটফট করছে দেশের জন্যে, প্রিয়জনের জন্যে এদিকে অচেনা ধূসর বর্ণহীন এই মরুভূমিকে মনে হচ্ছে যেন ভিন্ন এক গ্রহে তারা ভুল করে চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এদের যার যার মালিক এসে বাসাবাড়িতে নিয়ে যাবে। দেশি দালাল করিম মিয়া, মক্তবের মৌলভির মতো এ দেশিয় চালচলন আদবকায়দা বিষয়ে ভারী বয়ান দিচ্ছে কিন্তু তাদের কান বধির, ভয় আতঙ্কে এরা এ-ওর দিকে অনড় সজলচোখে তাকিয়ে আছে- বর্ষার বাড়তিজলে টইটুম্বুর দিঘির মতো চোখগুলো-একটু টোকাতেই যেন ঝুরঝুরিয়ে ঝরে পড়বে !
মেয়েগুলো এয়ারপোর্ট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরা যদিও কেউ কারো পূর্ব পরিচিত ছিল না কিন্তু একই দুঃখনদী সবাই সাঁতরে বেরানো সূত্রে এবং গত দু’দিনে সহযাত্রী থাকায় চিরআপন হয়ে গেছে। কাজের জায়গা ভিন্ন হলেও নিশ্চিত একই পরিশ্রুতিতে রয়েছে- অচিন দুর্ভেদ্য ভাষা, ঘরদোরের চিত্র ভিন্ন এমনকি মানুষগুলোর চায় চেহারাও ভিন্ন।
রাহেলার মালিকের পরিবারে দু’জন মহিলা এবং চারজন ছেলে। ছেলেদের দু’জনের বয়স ছোট হলেও বাকি দুজন দেখতে যথেষ্ট বড়। তাদের সম্পর্ক আঁচ করা দুরূহ, তবে মালিকের পেতল রঙের সাপের মতো ঠা-া চোখজোড়ার সাথে ছেলেগুলোর বিস্তর সাদৃশ্য রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাহেলা ধরে নেয় এরা মালিকের ছেলে। এয়ারপোর্টে মালিকের দিকে তাকাতে সে এতকে উঠে, ভেতর ভেতর ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও তা গোপন করেছে- ও দৃষ্টি বড়ো নোংরা মনে হচ্ছিল ওর। জগতের সকল মানুষ ভিন্ন জাতগোত্রের হলেও তাদের হাসি এবং চোখের ভাষা বোধহয় একই হয়, চাইলেও কেউ গোপন করতে পারে না- ভাষা না জেনেও ঠাস করে তার চরিত্র বলে দেওয়া যায়। মহিলাদের মধ্যে একজন মালিকের বউ এবং বয়স্কজন মা কিংবা শাশুড়ি হবে হয়তো। রাহেলাকে মালিকের বউ তার ঘরের কাজ বুঝিয়ে দেয়।
বিষণœকালে প্রিয়জন মনে শান্তি জোগায়, মনকে প্রবোধ দেয়, তা হউক সে ধারে কাছে নেই। কল্পনায় তাকে পাশে বসিয়ে মনের শরীরকে উজাড় করে খোলে ধরতে মন চায়- তাতে স্থিত হওয়া সহজ হয়। রাহেলা সারাদিনের ধকল শেষে প্রায় মধ্যরাতে রান্নাঘরের শেষদিকের কোণাঘেঁষা সারভেন্ট রুমের বিছানায় শুয়ে ছটফট করে। শরীর প্রচ- ক্লান্ত হলেও ঘুম আসে না। মনটায় প্রচ- অষোয়স্থি ভর করেছে। আপনজন বলতে বাবাই খুব কাছের ছিলেন। বাবা তো নেই-ই, মা-ও সেই কবে দুনিয়া ছেড়েছে। ভাইরা যে যার সংসারে। বাকি থাকে- রমজান আলী! নামটা মনে পড়তে ভেতর থেকে একটা ধাক্কা খেল সে! নিজেকে খুব হীন মনে হল। প্রচ- ঝড়ের চোটে গাছের আলগা-পাতারা যেমন উড়ে ঘুরে কোন নোংরা উচ্ছিষ্টে যেয়ে পড়ে, নিজেকে পরিচয়-মানহীন সেই ঝরা পাতার মতোই মনে হল! রমজান আলী তার আপন মানুষটা হতে পারত, তাইতো কথা ছিল! এমনটা ভাবতে বৈশাখী ঝড়ের রাতে অন্ধকার আকাশে বিজলিবাতি যেমন বিক্ষিপ্তভাবে জ্বলে উঠতে থাকে মনটা তদ্রƒপ অস্থির হল।
এ সময়ে রান্নাঘরের ওপাশ থেকে শিয়ালের ছপছপ পায়ে চলার আওয়াজের মতো কারো পায়ের শব্দ কানে এল। তার অল্পক্ষণ পর কে যেন তার দরজায় পর পর ক’টা টোকা দেয়। সে কান উঁচিয়ে থাকে-এতরাতে এদিকে কারো আসার কথা নয়। গত দু’দিনে এমন ঘটনা ঘটেনি। নিচতলায় সে রাতে একাই থাকে আর বাবুর্চি মনসুর, রাতের পর্ব শেষে নিজবাড়ি চলে যায়।
এই ফাঁকে এবার দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ আসলে সে ভয়ে ধমড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে সোজা দরজা খোলে দেয়। ঘরে সবুজ ড্রিম লাইটের মৃদু আলো জ্বলছিল। ওটুকু আবছায়া আলোতে রাহেলার চোখে পড়ে- মালিকের ক্ষুধার্ত ধূর্ত শিয়ালের মতো চকচকে চোখদুটোতে। সে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার শরীরে এমন হারে কাঁপন ধরে যে, দাঁতের দু’পাটির ঘর্ষণে ঢকঢক আওয়াজ স্পষ্ট হয়ে কানে বাজে। পাহাড়ের মতো লম্বাচওড়া মানুষটা,জোব্বা পাগড়ির খোলস ছেড়ে, খুব সাবলীলভাবে প্রাত্যহিক আর দশটা কাজের মতো কাজ সারতে যেন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাহেলা টুঁ শব্দটি করতে সুযোগ পায় না। ওটুকু শরীরের ওপর এমন অসুরের মতো শক্তি নিয়ে পশুটা চেপে বসলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। রাহেলার মনে পড়ে- ভাদ্রমাসে গাঁয়ের মর্দ কুকুরগুলোর লালাযুক্ত জিহবা ঈষৎ ঝুলে থাকত, এরা বেজায় উন্মাদ হয়ে মনের খায়েশ মেটাতে গ্রামের আপ্রান্ত ওপ্রান্ত মাদি কুকুরের খোঁজে ছুটে বেড়াত। তার শরীর অসার হয়, চোখদুটো অনড় এবং বিস্মিত হয়ে সেই কুকুরের মতো অবিকল তার মালিকের চেহারায় সে তাকিয়ে রয়।
রাতের ঘটনার পর বাকি রাত রাহেলা নগ্ন শরীরে কোনমতে চাদরে শরীরটা ঢেকে লুলা, মাজাভাঙ্গা পশুর মতো উপুর হয়ে পড়েছিল। রাতের শেষে ভোর হয়েছে এরপর অনেকটা বেলা গড়িয়েছে এসবই সে ঘোরের মধ্যে টের পেয়েছে। রান্নাঘরে বাবুর্চি মনসুরের হাঁড়িপাতিলের টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার কাজের সময় হয়েছে এখন কাজে হাত না লাগালে কঠিন শাস্তি অবধারিত জেনে শরীর নিংড়ে শেষ শক্তিটুকু সম্বল করে উঠে দাঁড়াতে মাথাটা প্রচ-ভাবে চক্কর দিয়ে উঠে এবং চোখের দৃষ্টি ঝাপসা যায়। সে অন্ধের মতো হাত হাতড়ে বিছানার এককোণে বসে পড়ে।
রমজান আলীকে যে করেই হোক আজকের মধ্যে বিস্তারিত জানাতে হবে, মনে মনে বলে উঠে সে। নিজের দেশ হলে রাতেই সে পালাত। রাস্তাঘাট জানা নেই, ভাষা সে তো অজানা। কোন পরিচিত নেই তার,তার সাথের মেয়েগুলো কোথায় কে আছে, কে জানে! মরুভূমির মতো শো শো শূন্যতাবোধ হচ্ছে। সে সময় তার নাম ধরে কেউ একজন হাঁক দেয়,বোধহয় বুড়ি। ইশারা ইঙ্গিত ছাড়া কারো সাথে কথা বলার জো নেই। বুড়ি খুব খিটখিটে, রাহেলা তার কথা বুঝতে না পারলে সে হাতের কাছে যা পায় ছুড়ে মারে তাকে। এ বাসায় একমাত্র মনসুর বাবুর্চির সাথে আড়ালে আবডালে যা একটু কথা হয়। রাহেলা একসময় হিন্দি মুভির পাগল ছিল। গাঁয়ের বিভিন্ন বাড়িতে সারারাত ধরে ভিসিআর ভাড়া করে এনে হিন্দি ছবি দেখা হত। রাহেলা রাত জেগে তখন মুভি দেখত। সেই সুবাদে চালিয়ে নেওয়ার মতো এ ভাষাটা সে রপ্ত করেছে। বাবুর্চির সাথে সে হিন্দিতে কথা বলে। বাবুর্চি মনসুর, এ বাড়ির অবস্থা জানে। রাহেলার জন্যে তার মায়া হয়, হয়তো নিজের বোন কিংবা মেয়ের কথা মনে পড়ে। তার ফোন দিয়ে গোপনে রাহেলা রমজান আলিকে ফোন দেয়। তাদের গাঁয়ের বাজারে ফোনের দোকানে ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা আছে। সে অঝোরে আষাঢ়ী বৃষ্টির মতো কাঁদে, ওপাশে রমজান আলী হাসে, দাঁত কেলিয়ে দেহ দুলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। যেন রাহেলা রঙ্গ করছে। রাহেলা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কোনো প্রকার অনুরোধ মিনতির কমতি রাখে না। বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল ভিটের অংশটা বিক্রি করে টাকা এনে দেওয়ায় প্রতিজ্ঞাও সে করে কিন্তু কোন অজুহাতেই রমযান আলীকে টলানো যায় না। বরং রমযান আলীর রাগ ধরে- অতিসাধারণ বিষয়ে সে তার কান্নার কারণ বুঝে উঠতে পারে না। রমজান আলী নিয়মিত মাগিপাড়ায় যায়, মেয়েদের নিয়ে রাতভর ফুর্তি করে, কই কাউকে সে রাহেলার মতো কাঁদতে দেখেনি। তাছাড়া সব জেনে শুনেই তো সে তাকে পাঠিয়েছে! তবে দালালের সাথে আলাপের কিছু কথা সে গোপন রেখেছে, মেয়ে মানুষের সব কথা আগে ভাগে শোনা শাস্ত্রে নিষেধ আছে তবে আজ ফোনে সেসব খোলাসা করেই রাহেলাকে বলল।
রাহেলা রমজান আলীর কথায় বিশ্বাস করতে পারে না, ভ্রম মনে হয়, সে বিমূঢ় হয়ে ধপাস করে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ঘরের মেঝেতে বসে- এতটাই বিস্মিত হয়! এ সময় বুড়ির ঘর থেকে শিয়ালের মতো কর্কশ কণ্ঠে রাহেলার আবারও ডাক পড়ে। ওর কাজ সকাল সকাল ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা। রাহেলা বহুকষ্টে ভগ্ন শরীরের ভেতর মৃত মনটাকে কোনোমতে গুঁজে নিয়ে ওপরের তালায় পা বাড়ায়। বিশাল বাড়ি-অনেকগুলো কামরা, কে কোথায় থাকে এখনো সে ঠিকঠাক মতো চিনে উঠতে পারেনি। সকালবেলায় এমনকী রাত পর্যন্ত বাড়িটা পোড়োবাড়ির মতো পড়ে থাকে। দিনে বুড়ি ছাড়া কাউকে বাড়ি দেখা যায় না। বেলা প্রায় দুপুর, তাকে দ্রুত কাজে হাত লাগাতে হবে কিন্তু শরীর নড়বড়ে জংধরা কব্জার মতো হয়ে আছে- যেন একটু ঠেস লাগলে ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়বে। তারপরও বহু কষ্টে একে একে বেশ ক’টা ঘরেরকাজ শেষ করে আনে সে।
একটা বেশ বড় কামরা, কার, কে জানে! ঘরটায় ঢুকতে ভেতরটা উগড়ে সব বেরিয়ে আসতে চাইল যেন, এমন একটা ঝাঁঝাল এঁটো গন্ধ। নানান রঙের বোতল, কাগজ, আধখাওয়া সিগারেট, বোতলের ঢাকনা, কলমের খাপ এরকম কতো কী যে ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। রাহেলা নিরাশ হয়ে সেসবের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ বেশ সমর্থ হাতে তাকে ঝাপটে ধরে- সাপ যেমন ছু মেরে খপ করে ব্যাঙকে ধরে ভক্ষণ করার আগে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তেমন করে খানিকক্ষণ অনড় হয়ে রইল। রাহেলা সহায়শক্তিহীন প্রতিমার মতো শিকারের বাহুতে বন্দি থেকে পাথরচোখে স্পষ্ট যেন পরবর্তী ঘটনা দেখতে পেল এবং হুবহু মিলেও গেল। মালিকের ছেলে, ক্ষুধার্ত পশুর কায়দায় ওকে বিছানায় চিতকরে ফেলে দিল। রাহেলার দেহটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতো বিছানায় লেপটে থাকলেও চোখ দুটোতে বার বার করে ফিরে আসছিল- ভাদ্রমাসের সেই লালায়িত কুকুরের ছবি।
শুরুটা সেদিন হলেও একবার কিংবা একদিন নয়, বাবা এবং ছেলেদের এমন অসহনীয়, পাশবিক অত্যাচার চলে প্রতিদিন। ওদিকে রাহেলা বেশ্যা হয়ে গেছে- এমনতরো রসালো খবর গাঁয়ের প্রতিটি কোণায় নিজ দায়িত্বে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য রমজান আলীর তাতে কোন দোষ নেই; এসবকথা লোহার সিন্দুকে সোনাদানা গচ্ছিত রাখার আদলে সে নিজমনে ধরে রেখেছিল যদিও রাহেলা কাজ না করে দেশে ফিরে এলে তার কুকীর্তি লোক সমাজে জানিয়ে তাকে হেয় করার হুমকি সে দিয়েছিল আদতে সে এখনো ছড়ায়নি। রাহেলার আলাভোলা বড় ভাইটা এসব কথা চাউর করেছে। বোকাসোকা মানুষ; দিন দুনিয়ার বাও বুঝতে পারে নি, এতিম বোনটার এমন কান্না সহ্য করা সম্ভব ছিল না ! সে রমজান আলীর হাতেপায়ে ধরে, বোনটাকে ফিরিয়ে আনতে। রমজান আলী তাকে বাড়ি থেকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। এরপর সে গাঁয়ের মাতাব্বরদের কাছে সাহায্য চায়, তাতেও কাজ হয় না। তারা গাঁয়ের সম্মান রাখতে ঘটনা চেপে যেতে বলে। সে বড় কষ্ট পায়। বাধ্য হয়ে থানায় বড় সাহেবের কাছে ধর্না দেয়। বড়সাহেব পানখাওয়া দাঁতে খিলখিলিয়ে হাসে। বোনটাকে নিয়ে অসভ্য নোংরা ইঙ্গিত করে। কষ্ট সইতে না পেরে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসে বুক চাপড়ে কাঁদে। লোক জড়ো হয়, যারা এই ঘটনা জানত না তারাও এ সুযোগে জেনে যায়।
এমন সংবাদ চাউর হতে- রমজান আলীর ঘরে দ্বিতীয় বউ আসে। ছেলেকে ঘরমুখো করতে মা নিজ তাগিদে ছেলেকে বিয়ে দেন, গাঁয়ের লোকও তাতে সায় দেয়। বড়বউ দু’হাতে টাকা কামায়- পুণ্যদেশের সেই মালিক বেতনের পাঁচগুণ বখশিস দেয়। ছেলেটার হাতে নগদের অভাব নাই, অস্থানে টাকা উড়ায়, এসব থেকে দূরে সরাতে ঘর সংসারের বিকল্প নাই। তাছাড়া রাহেলার মতো নাপাকি বউকে নিয়ে সংসার নাজায়েজের কাজ। বংশরক্ষার বলেও কথা থেকে যায়, অমন পেটের সন্তান দিয়ে বংশরক্ষা ঠিক হবে না,মহাপাপের কাজ। এসব ভেবেচিন্তে সতী মেয়েকে দ্বিতীয় বউ করে ঘরে তোলা হয়। রমজান আলীর ঘরদোরের চেহারাসুরতও রাতারাতি বদলে যায়- বাঁশের চালার ঘরে উঠে ইটকাঠের ঘর। এরই মধ্যে ধানী জমিও কয়েক কানি কেনা হয়ে গেছে।
রাহেলা দু’বছর পর মাস দুয়েকের ছুটিতে দেশে আসে। এ দু’বছরে চেনাজানা সবকিছু বেশ বদলে গেছে। তার নিজের ঘরে সতীনের বাস। রমজান আলী আর তার একা নেই, যদিও ভাগ হয়ে শুধু কাগজপত্রে এখনো তার রয়ে গেছে। সতীনের ঘরে ফুটফুটে সন্তান এসেছে, উঠোনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পায়ে গুড়গুড়িয়ে হাঁটে। রাহেলা মুগ্ধ হয়ে সেদৃশ্য দেখে, খুশিতে তার চোখে জল ভরে ওঠে। ওর সারা জীবনের এমন একটা স্বপ্নই তো ছিল- সন্তান এবং পরিবার। রাহেলা সতিনকে ছোট বোনের মতো মেনে নিয়ে একত্রে সংসার করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে। নিজ গর্ভের একটা সন্তানের বড় আশ তার, সেই তীব্র আকাক্সক্ষা তাকে সবকিছু মেনে নিয়ে ভিখারির মতো রমজান আলীর পায়ের কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। রমজান আলী রাহেলার মনোবাসনা বুঝতে পারে কিন্তু ধূর্ত খেকশেয়ালের মতো সে ধরা দেয় না, তাকে এড়িয়ে চলে। রাহেলা অচ্ছুত, নষ্টা-ভ্রষ্টা মেয়ে মানুষ। তাকে চৌদ্দপুরুষ ছিঁড়েছিঁড়ে খেয়েছে। তার পেটে শুধু অবৈধ সন্তান আসবে, যেমন বহুবার এসেছে, পৃথিবীর আলো হাওয়ায় বাঁচার অধিকার তাদের নেই, ভাগাড় তাদের আসল ঠিকানা। এমন মেয়ে মানুষের সাথে বিছানা ভাগ করা যায় না। বার বার পেট-খসানো রাহেলার থলিতে বাচ্চা পয়দা করলে সে বাচ্চা হালাল হবে না। রাহেলাদের মা হতে নেই, পরিস্ফুট একটা সন্তান পৃথিবীতে আনার অধিকার তাদের নেই। রমজান আলীর পরিবার, সমাজ, দেশ তাকে ধিক্কার জানাবে- এমন সন্তান সমাজে অপাঙ্ক্তেয়।
দু’মাস কেটে, ছুটি ফুরিয়ে যায়। রাহেলা সেই নরকে আর ফিরতে চায় না। রমজান আলীর হাতপা ধরে কান্নাকাটি করে। কিন্তু তার শত অনুনয়, বুক বিদীর্ণ করা আহাজারি রমজান আলীকে স্পর্শ করতে পারে না।
বরং সে হিরকখ-ের মতো দুরূহ-কঠোর হয়ে তাকে জানায়–স্বেচ্ছায় সে ফিরে না গেলে তালাকনামা ধরিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করা হবে। রাহেলার গত দুবছরের গতরখাটা টাকার সবটাই স্বামীর অধিকারে, নিজের হাতে কানাকড়িও নেই যদিও রাহেলা খুব করে বলে কয়ে দু’কানি ধানী জমি শুধু নিজের নামে করেছিল, ওইটুকুই একমাত্র নিজের সম্বল। এরপর রাহেলা চুপ হয়ে যায়-তীব্র ঝড়ের পরে প্রকৃতি যেমন শান্ত স্নিগ্ধ শীতল হয়ে যায় সেরকম। গাঁয়ের লোক অবশ্য জানল ভিন্নকথা- রাহেলা বেশ্যা,সে কখনো মা হতে পারবে না, মরু দেশের শেখেরা তার মা হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছে। সে নিজ গরজে সেখানে যেতে উদগ্রীব হয়ে আছে। গাঁয়ে তাকে নিয়ে রি রি পড়ে গেল। এতদিন লোকের মুখে আড়ালে ফিসফাস শব্দে এসব রটনা শোনা গেলেও এবারের অভিযোগ হাওয়া বাতাসে উড়ে নয়, রমজান আলী এবং তার পরিবার রাহেলার সম্মুখে ছড়াতে লাগল। রাহেলা প্রতিবাদহীন থাকায় অভিযোগ আরও পাকাপোক্ত হয়। এরপর রাহেলা প্রচ- একটা অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা এবং গোপন একটা জেদ চেপে নিয়ে মরুদেশের উদ্দেশ্যে উড়াল জাহাজে চেপে বসল। আরও দু’বছর পরে- রাহেলা, মরুদেশের ভ্রুণ, স্বজ্ঞানে নিজের জঠরে বয়ে নিয়ে স্বগর্বে দেশে ফিরে আসে। এবার অবশ্য রাহেলা চোখে পড়ার মতো স্বার্থপর হয়েছে -নিজের নামে বাড়ি, জমি, হাতে নগদ এসবের পুরো পাঁচটা পূর্ণ করেছে এবং পেটে শেখদের সন্তানের কথা নিজমুখে জনে জনে বলে বেড়াচ্ছে। রমজান আলী, নিজের ভুলে ফাঁদে-পড়া বাঘের মতো মর্মাহত হয়। তার চোখের সামনে রাহেলার তলপেট ফুলে ফেঁপে সুডৌল হয় এবং এরপর শাদা ধবধবে সুঠাম একটা ভিনদেশি সন্তানের জন্ম হয়। এতকিছুর পরও রমজান আলী এবার তালাকের কথা ভাবতে পারে না। কারণ তার বৃহদাকার সংসারটা আজও নিদেনপক্ষে টিকে আছে রাহেলা বেগমের করুণা-দাক্ষিণ্যে।
জাকিয়া শিমু, গল্পকার
ফ্লোরিডা, উত্তর আমেরিকা