ড. আবু নোমান
উৎস বা সূত্র যতটা স্বচ্ছ যৌক্তিক ও প্রায়োগিক হয় ইতিহাস তত বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এ কারণেই ইতিহাস রচনায় উৎসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা প্রাচীন একটি জনপদ, আদি নাম বঙ্গ। প্রাচীনকালে বাংলা কোনো একক নামে পরিচিত না হয়ে একাধিক জনপদে বিভক্ত ছিল। কালে কালে বাংলার অবস্থান ও আয়তনের পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাস রচনায় তথ্য বা উৎসের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বিষয়। আধুনিক ঐতিহাসিকগণের অনেকেই বিভিন্ন উৎস ও সূত্র থেকে তত্ত্ব ও তথ্য যাচাই বাছাই করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় অগ্রবর্তী হয়েছেন। যে সকল সূত্রের ভিত্তিতে ইতিহাস রচিত হয় মূলত যেগুলোই ইতিহাসের উৎস। ইতিহাস রচনার উৎসের একটি প্রাথমিক বা মূল উৎস এবং এবং অন্যটি মাধ্যমিক বা গৌণ উৎস। সমসাময়িক সাহিত্য ও রচনাবলি, দলিল ও ফরমান, মুদ্রা ও শিলালিপি এবং স্থাপত্য ও শিল্পকর্ম প্রভৃতি প্রাথমিক বা মূল উৎস হিসেবে বিবেচ্য। প্রাথমিক উৎসের এসব সূত্র যাচাই-বাছাই ও বিচার বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে যে সব বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়ে থাকে সেগুলো মাধ্যমিক বা গৌণ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তুলনামূলক আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনা করা যতটা সহজ প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনা করা ততটা সহজ নয়। প্রাচীন লিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য ভাস্কর্য, সাহিত্য, পর্যটকদের বিবরণ ইত্যাদি সূত্র থেকে তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহপূর্বক ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস রচনার চেষ্টা করেছেন।
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়- প্রাচীন বাংলার স্বচ্ছ ইতিহাস রচনায় তাম্র-শিলালিপি মুদ্রা ও প্রত্ন-ভাস্কর্য কতটা প্রভাব রাখে বা দরকারি।
প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাসের উৎস হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান অর্থ অতীত বা প্রাচীন মানুষের সৃষ্ট, ব্যবহৃত বা প্রভাবিত দ্রব্যাদির চিহ্ন বা ধ্বংসাবশেষ। যেমন প্রাচীন লিপি, মুদ্রা, স্থাপনা ও অন্যান্য চারু ও কারু শিল্পের নিদর্শন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ সকল নিদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। প্রাচীন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ মাধ্যম গুলোই অন্যতম এবং প্রধান উপাদান। এক্ষেত্রে লিপিমালাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে যুগে যুগে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। প্রাচীন মানুষ শিলাগাত্র, তামার পাত বা স্তম্ভের গায়ে লিপি উৎকীর্ণ করতো। শিলাগাত্রের উৎকীর্ণ লিপিকে শিলালিপি এবং তামার পাতে উৎকীর্ণ লিপি-কে তাম্রলিপি বা তাম্রশাসন বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও ইট ও পোড়ামাটির উপরেও লিপি আবি®কৃত হয়েছে। এ সমস্ত লিপিমালা থেকে অজানা ইতিহাসতথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। লিপিতে সাধারণত লিপি জারিকারীর নাম, পদবী, ও পরিচয় উৎকীর্ণ থাকতো, এমনকি বাংলায় প্রাপ্ত বহু লিপিতে রাজা ও তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রশস্তিগাঁথা উৎকীর্ণ পাওয়া যেতো। এ সকল প্রশস্তিগাঁথা থেকে বাংলার বহু রাজার বংশলতিকা উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে।
অনেক লিপিতে দেখা যায়, রাজা বা তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছাড়াও তাঁদের গৌরবময় কাজের বিবরণ, কীর্তিকলাপ, বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শক্তি-সাহস, শৌর্যবীর্য ও কৃতিত্ব সম্পর্কে তথ্যমালা উৎকীর্ণ থাকে। এ সকল তথ্য থেকে অন্যান্য প্রাপ্ত তথ্যের যৌক্তিকতা বিচার করা সম্ভব হয়। ফলে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এ সকল প্রাপ্ত তথ্য ইতিহাসে রচনার উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্ত এ ধরণের তথ্যে শিলালিপি জারিকারী অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে অতিরঞ্জিত তথ্যের সমাবেশ করে থাকতে পারেন। যৌক্তিকতা বিচার করে প্রাপ্ত তথ্য থেকে অতিরঞ্জিত বিষয় বাদ দিয়ে ইতিহাস রচনা করা সুকঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
প্রাপ্ত অনেক লিপিতে সন তারিখ উৎকীর্ণ দেখা যেতো। এ ধরণের তারিখ-সন উৎকীর্ণ থাকলে তা থেকে সহজেই তথ্য সংগ্রহ করে নেয়া সম্ভব ছিল। প্রাচীন বাংলায় প্রাপ্ত এ ধরণের সনগুলোর মধ্যে গুপ্তাব্দ, শকাব্দ প্রভৃতি অব্দ দেখা যায়। গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্র গুপ্ত। তাঁর ক্ষমতায় আরোহণের সময়কাল থেকে গুপ্তাব্দ গণনা হয়ে থাকে। তিনি ৩২০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
রাজা কনিস্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় থেকে শকাব্দ গণনা শুরু হয়। তবে, এ যাবতকাল পর্যন্ত বাংলায় প্রাপ্ত শিলালিপির অধিকাংশেই বিভিন্ন রাজার রাজত্বের সময়কাল অর্থাৎ রাজা কত সাল থেকে কত সাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া গেছে। এ তথ্য থেকে কোন রাজা কত বছর রাজত্ব করেছেন সে সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়।
শিলালিপির লিখার ধরণ থেকেও খুব সহজেই লিখার সময়কাল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অক্ষরের লেখ্যরূপের বিবর্তনধারা পর্যবেক্ষণ করে শিলালিপির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
জমি ক্রয়-বিক্রয়, জমির দাম ইত্যাদি বিষয়ক দলিল মূলত তামার ফলকেই উৎকীর্ণ হতো। এ সব তাম্রলিপিকে তাম্রশাসন বলা হয়ে থাকে। তাম্রশাসন মূলত ভূমিদান সম্পর্কিত দলিল। দানপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল। এ ধরণের দলিল যাতে সহজে নষ্ট হয়ে না যায় বা হারিয়ে না যায় সে কারণেই তাম্রফলকে উৎকীর্ণ করা হতো। এ সমস্ত তাম্রশাসনে সমকালীন শাসকের নাম, রাজবংশ, সময়কাল কর্মচারী এবং রাজ্যের প্রশাসনিক একক ইত্যাদি লিপিমালা উৎকীর্ণ থাকতো। ফলে রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা, প্রশাসনের স্তরবিন্যাস ইত্যাদি সহজেই উদঘাটন করা সম্ভব। এ এছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের তথা জনগণের কল্যাণে রাজা বা রাজদরবারের ভূমিকা, রাজদরবারের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পর্ক-সম্পৃক্ততা সম্পর্কেও অবগত হওয়া যায়।
তাম্রশাসনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য থেকে অবগত হওয়া যায় সে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত শাসিত অঞ্চল ধনাহদহ, বৈগ্রাম ও দমোদরপুরে প্রাদেশিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিত। দমোদরপুর তাম্রশাসন থেকে আরো জানা যায় সে, পুণ্ডবর্ধনভুক্তির শাসন পরিষদে শিল্প-বাণিজ্যের শীর্ষে রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গুনাইগড় তাম্রশাসনসমূহ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় গুপ্ত শাসনের বিভিন্ন তথ্য অবগত হওয়া যায়। মহাজয় বৈন্যগুপ্ত নামক এক রাজকর্মচারী ত্রিপুরা জেলায় ভূমি দান করেছিলেন। ধারণা করা যায় যে, এ কারণে তাকে দ্বাদশ দিত্য উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল আমল বিখ্যাত। পাল যুগের ইতিহাস রচনায় তাম্রশাসন এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস মাধ্যম। ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন থেকেই রাজা শশাঙ্কপরবর্তী বাংলার বিশৃঙ্খল অবস্থা ‘মাৎস্যন্যায়’ সংঘটিত হওয়ার তথ্য অবগত হওয়া যায়। মাৎস্যন্যায়ের প্রেক্ষিতে রাজা গোপাল ক্ষমতায় আরোহণ করেন। এ তাম্রশাসন থেকে ধর্মপালের সময় ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব এবং কনৌজের রাজনৈতিক অবস্থা অবগত হওয়া যায়। মুঙ্গের তাম্রশাসন থেকে দেবপালের সামরিক দক্ষতা, যোগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় জানা যায়। নালন্দা তাম্রশাসন থেকে জনগণের কল্যাণে দেবপালের কার্যাবলি কী ছিল তা জানা যায়। বানগড় তাম্রশাসন থেকে প্রথম মহিপালের রাজ্য সম্পর্কে জানা যায়। এখান থেকেই দ্বিতীয় দফা পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস উঠে আসে। ত্রৈলোক্যচন্দ্র কর্তৃক সমতট বিজয়ের কথা সর্বপ্রথম জানা যায় শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন থেকে। বাংলায় চন্দ্রবংশ শাসনের ইতিহাস এই তাম্রশাসন মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়। শ্রী চন্দ্রের শাসনকালের ছয়টি তাম্রশাসন আবি®কৃত হয়েছে। এগুলো থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শ্রী চন্দ্রের পরাক্রমশালী শাসনের ইতিহাস জানা যায়। বর্ম রাজবংশের ইতিহাস অবগত হওয়া যায় বেলাব তাম্রশাসন থেকে। জাতবর্মার পর তার পুত্র হরিবর্মার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায় ভুবনেশ্বর শিলালিপি বা তাম্রশাসন থেকে। বল্লাল সেনের নৌহাটি তাম্রশাসন এবং বিজয় সেনের দেওপাড়া শিলালিপি থেকে সেন রাজাদের বাসস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। বিজয় সেনের বেরাকপুর তাম্রশাসন থেকে তাঁর সামরিক শক্তিমত্তার বিবরণ পাওয়া যায়। লক্ষণ সেনের মাধাইনগর তাম্রশাসন থেকে লক্ষণ সেনের রাজত্বকাল সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।
প্রাচীন বাংলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন লিপি থেকে প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ও ধারাপ্রবাহ অবগত হওয়া যায়। বগুড়ার মহাস্থানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মিলিপি থেকে বাংলার মৌর্য শাসনের ইতিহাস অবগত হওয়া যায়। বাকুড়িয়া নিকটস্থ সুসুনিয়ার পর্বতগাত্রে ক্ষোদিত পুস্করণাধিপ সিংহবর্মা ও তাঁর পুত্র চন্দ্রবর্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। দিল্লীর কুতুবমিনার সংলগ্ন কুয়াতুল ইসলাম মসজিদ প্রাঙ্গনে অবস্থিত লৌহ স্তম্ভগাত্রে ক্ষোদিত লিপি থেকে সমসাময়িক বাংলার ইতিহাস অবগত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই লিপি থেকেই বাংলায় গুপ্ত শাসনের ইতিহাস অবগত হওয়া যায়। বাংলার গুপ্ত শাসনের ইতিহাস সম্পর্কে এলাহাবাদ স্তম্ভ লিপিতেও তথ্য পাওয়া যায়।
পাল রাজাদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে দৈব্যদেবের কমৌলি তাম্রলিপি এবং মহিপালের বাণগড় তাম্রলিপি থেকে। লিপি থেকে রাজার রাজ্য বিস্তৃতির ইতিহাসও অবগত হওয়া যায়। নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রলিপি থেকে কান্যকুব্জে ধর্মপালের রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অবগত হওয়া যায়। ধর্মপাল সম্পর্কে দেবপালের মুঙ্গের তাম্রলিপি থেকেও বেশ কিছু তথ্য অবগত হওয়া যায়। ধর্মপালের কৃতিত্ব ও রাজত্বকাল সম্পর্কে দেবপালের বাদাল স্তম্ভলিপিতে তথ্য রয়েছে।
বাংলার খড়গ বংশের রাজত্বকাল সম্পর্কে ঢাকার আশরাফপুরে প্রাপ্ত দুটি লিপি এবং কুমিল্লার দেউলবাড়িতে প্রাপ্ত একটি লিপি। খড়হচন্দ্রের ময়নামতি তাম্রলিপি থেকে শ্রী চন্দ্র কর্তৃক গৌড়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা ও বিজয়ের তথ্য অবগত হওয়া যায়।
এ সমস্ত লিপি থেকে উপরোক্ত তথ্যসমূহই শুধু পাওয়া যায় না, ধারণা পাওয়া যায় আরো তথ্যের; যেমন- লিপির প্রাপ্তিস্থান বিশ্লেষণ করে রাজ্য বিস্তৃতির ধারণা; লিপিতে স্বদেশের বাইরের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ও রাজার ধারণা; পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর মধ্যে আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ধারণা।
তাম্রশাসন থেকে প্রাচীন বাংলার ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। কৃষি, ভূমি, বাস্তুভিটা, তৃণ ভূমি, বনভূমি, জলাভূমি, উপর ভূমি, নদী, নদীর গতিপথ ইত্যাদি ভৌগোলিক তথ্যে পূর্ণ থাকে তাম্রশাসনগুলো। এছাড়া কৃষি ফসল ও পণ্যের তথ্য ও এসব তাম্রশাসনে পাওয়া যায়। তাম্রশাসন মূলত ভূমিদান ও জমি ক্রয়-বিক্রয়ের পাকা দলিল। সুতরাং ভূমির প্রকৃতি, পরিমাপ এবং মূল্য সম্পর্কিত তথ্য ও এসব দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে। এ সকল তাম্রশাসনে ক্রেতা বিক্রেতার নাম ও পেশার নাম উল্লেখ থাকতো। এ তথ্য থেকে সমসাময়িক মানুষের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কিত তথ্যও অবগত হওয়া যায়। সমসাময়িক সময়ের বাংলার মানুষের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক বৈশিষ্ট্যের তথ্য অবগত হওয়া যায়। তাম্রশাসনগুলোতে রাজা বা প্রণয়নকারী অফিসের সিল সংযুক্ত থাকতো। এ সব সিলে রাজার বা অফিসের ধর্মীয় প্রতীক উৎকীর্ণ থাকতো। এ সমস্ত তাম্রশাসনে রাজার উপাস্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বহু লিপি উৎকীর্ণ হয়েছে। হিন্দু মঠ, মন্দির, জৈন বিহার ও বৌদ্ধ বিহারের নানাবিধ ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পুরনো স্থাপনা সংস্কারের জন্য ভূমিদান করা হয়েছে। ফলে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনেক তথ্য অবগত হওয়া যায়। হিন্দু রাজা কর্তৃক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে অথবা বৌদ্ধ রাজা কর্তৃক হিন্দু প্রতিষ্ঠান বা ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করে পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও উদারতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এভাবে লিপিতে শাসক ও শাসিতের ধর্মীয় মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। লিপিতে নানা ধর্ম ও শ্রেণি পেশার মানুষের তথ্য থাকায় সমাজের অবকাঠামোর ধারণা লাভ করা যায়। লিপির মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত বহু উৎসব অনুষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। এ সব তথ্য প্রাচীন বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পূণর্গঠনে সহায়ক।
দৈব ক্ষমতায় বিশ্বাস প্রাচীন বাংলার রাজাগণও করতেন। বহু লিপিতে এ ধরণের বিষয় অবগত হওয়া যায়। সেন রাজগণ নিজেদের চন্দ্রবংশ বলে দাবি করতেন। এ দাবির পেছনে উদ্দেশ্য ছিল জনগণের ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা লাভ। কারণ সাধারণ জনগণ চন্দ্র বংশকে দেবতার বংশ বলে মনে করতো এবং নিজেদের দেবতা হিসেবে শ্রদ্ধা পাওয়ার সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যেই সেন রাজগণ চন্দ্র বংশের উত্তরাধীকার হিসেবে প্রচারণা চালাতেন।
প্রাচীন বাংলায় ব্রাহ্মণ সমাজ অতি উচ্চ পর্যায়ের একটি শ্রেণি। তাই দেখা গেছে প্রাচীন বাংলার লিপিগুলোয় বিশেষত অধিকাংশ তাম্রশাসনেই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। ব্রাহ্মণদের বংশ পরিচয় ও তাঁদের পাণ্ডিত্যের বিবরণ এসব লিপিতে পাওয়া যায়। সমাজের সম্মানিত ও উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে তাঁদের পূজা-অর্চনা, বসবাস, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ এবং অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশের রাজা ও সচ্ছল প্রজাসাধারণ ভূমি দান করেছেন। ব্রাহ্মণগণ সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সে সময়ে শিক্ষা বিস্তারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। লিপি থেকে পাওয়া যায় যে, ভিক্ষুগণ বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থাবলি ছাড়াও ব্যাকরণ ও অন্যান্য শাস্ত্র চর্চা করতেন। পাল-সেন-চন্দ্র রাজগণের তাম্রশাসনে সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার বিশেষত কাব্য চর্চার প্রতিফলন আছে। সংস্কৃত ভাষায় বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও পণ্ডিতবর্গ দক্ষ ছিলেন।
প্রাচীন বাংলার ভাষা ও অক্ষর শৈলীর বিবর্তন ও ধরণ সম্পর্কে জানা যায়। মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি বাংলার প্রাচীনতম শিলালিপি। এই লিপির ভাষা প্রাকৃত এবং অক্ষর ব্রাহ্মী। এই শিলালিপিটি মৌর্য আমলের একমাত্র লিপিতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা বাংলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশিষ্ট প্রাচীন বাংলার ইতিহাস গবেষক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পশ্চিম বাংলায় প্রাপ্ত ব্রাহ্মী খরোষ্ঠী লিপির ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতবর্ষ থেকে আদি ঐতিহাসিক যুগে খরোষ্ঠী অক্ষরের ঐতিহ্যবাহী মানুষ বসতি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন। ফলে বাংলার ব্রাহ্মী অক্ষরের সঙ্গে উত্তর পশ্চিম ভারতীয় খরোষ্ঠী অক্ষরের সমন্বয়ে মিল তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও লিপি থেকে স্থাপত্য- ভাস্কর্য ও মূর্তিকলার বহু তথ্য পাওয়া যায়। প্রস্তর ও ধাতবশিল্পের অগ্রগতি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
লিপি অনেক বেশি স্থায়ী এবং দীর্ঘদিন অক্ষত থাকে। প্রাচীন বাংলায় প্রচুর লিপি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে যা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় প্রভূত সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে লিপিই প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার একক বৃহত্তম উপাদান। এতে উৎকীর্ণ তথ্য পরিবর্তন করা দুঃসাধ্য। ফলে অনেক সত্য ও নির্ভরযোগ্যও বটে। তাই প্রাচীন বাংলার ইতিহাস মূলত লিপির উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল মুদ্রা যে কোনো দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। মুদ্রা শব্দের ইংরেজি কয়েন। কয়েন (ঈড়রহ) শব্দটি ল্যাটিন কিউনিয়স (ঈঁহবঁং) শব্দ হতে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ প্রাথমিক পর্যায়ে মুদ্রা তৈরির ছাঁচ এবং তার থেকে ছাঁচে তৈরি মুদ্রার ওপর এই শব্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। অপর একটি ল্যাটিন শব্দ পিকুনিয়া (চবপঁহরধ)। শব্দটি কয়েন শব্দের সমার্থক শব্দ। মুদ্রার সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায় যে, স্বর্ণ, রৌপ্য বা এরূপ মূল্যবান ধাতবের এমন এক খণ্ডকে বোঝায় যার আকৃতি ও পরিমাপ সুনির্দিষ্ট এবং যাতে প্রশাসন ক্ষমতা কর্তৃক বিশুদ্ধতা নিরূপণের উদ্দেশ্যে কোনো বিশেষ প্রতিকৃতি নমুনা, প্রতীকচিহ্ন বা লিপি ব্যবহৃত হয়। মুদ্রা অতীতের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ক তথ্য ও বিবরণী তথা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মুদ্রার প্রচলন কবে থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইতিহাসের জনক হিরোডাটাসের মতে লিডীয় জাতি এশিয়া মাইনরে সর্বপ্রথম স্বর্ণ ও রৌপ্যের মুদ্রা প্রবর্তন করে। জুলিয়াস পোলক্স একই মত পোষণ করেন। স্ট্রাবো ও এলিয়ানের মতে, আরগোজের শাসক ফিডোন এ্যাজিনো দ্বীপে রৌপ্যমুদ্রা প্রবর্তন করেন। উভয় মতেই বলা হয়েছে মুদ্রার প্রবর্তন হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে। মানব সমাজে লেনদেন এবং বিনিময়ের মাধ্যমে যে ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতি হয়েছে তাকে দুটি সময়কালে বিন্যস্ত করা যেতে পারে- মুদ্রা পূর্ব সমাজ ও মুদ্রা উত্তর সমাজ। মুদ্রার গুরুত্ব বুঝাতেই সমাজের প্রকারভেদের ক্ষেত্রে মুদ্রাকে বিভক্তির মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মুদ্রায় বিভিন্ন প্রাণী ও জীবের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ লক্ষ্য করা যায়। এ ধারা প্রাচীনকাল হতে আধুনিক যুগেও লক্ষ্যণীয়। প্রাচীনকালে বিশেষ করে গ্রিসবাসী বিভিন্ন দেবতার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী প্রতীকচিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
মধ্যযুগে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ম বিশ্বাস নির্দেশ করতে প্রতীক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু রাজাদের মুদ্রায় তাঁদের ধর্মবিশ্বাসভিত্তিক প্রতীকচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। রাজপুত ও চৌহান বংশীয় রাজাদের মুদ্রায় শিবের বাহন ষাঁড়ের প্রতিকৃতি অংকিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলিম সুলতানগণের মুদ্রায় ও এ ধরণের রীতি লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে অবশ্য এ রীতি বহাল থাকেনি।
মুদ্রা প্রস্তুত হয়ে থাকে সাধারণত ইলেক্ট্রাম (স্বর্ণ ও রৌপ্যের স্বাভাবিক সংমিশ্রণ), স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা ও ব্রোঞ্জ এর মাধ্যমে। এ গুলো ছাড়াও প্রয়োজনবোধে সীসা, লোহা, নিকেল এবং এলুমিনিয়াম ধাতবে মুদ্রা প্রস্তুত হতো। এশিয়ার দেশগুলোতে স্বর্ণ দ্বারা মুদ্রা প্রস্তুত হতো। আকিমিনীয় শাসকদের মুদ্রা, ভারতীয় উপমহাদেশের কুশাত্রাদের মুদ্রা এবং দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজবংশের মুদ্রা স্বর্ণ দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। উমাইয়া-আব্বাসীয় আমলে মুদ্রা প্রস্তুতিতে স্বর্ণ ব্যবহৃত হতো। এছাড়া ইউরোপের দ্বিতীয় ফিলিপ, তৃতীয় আলেকজান্ডার রোমান এবং বাইজান্টানীয় সম্রাটগণের মুদ্রা স্বর্ণ দ্বারা নির্মাণের তথ্য জানা যায়।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমান রিপাবলিকে মুদ্রা হিসেবে রৌপ্য ধাতুর ব্যবহার দেখা যায়। উমাইয়া-আব্বাসীয় এবং পরবর্তী মুসলিম শাসকদের মুদ্রায় ধাতব হিসেবে স্বর্ণের সাথে সাথে রৌপ্যের ব্যবহারও দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশেও মুসলিম শাসকদের মুদ্রা রৌপ্য দ্বারা প্রস্তুত হতো।
সময়ে সময়ে মুদ্রার সাময়িক অভাব মেটানোর জন্য বিশেষ করে যুদ্ধোত্তরকালে সীসা, নিকেল, লৌহ এবং এলুমিনিয়াম ধাতবে মুদ্রা নির্মাণ করা হতো। এবং এ ধরনের মুদ্রা অবশ্য সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি।
গ্রহণযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুদ্রায় উৎকীর্ণ তথ্য ও উপকরণ অত্যন্ত মুল্যবান ও সমাদৃত। প্রত্নতাত্মিক যে সমস্ত উপকরণ ও তত্ত্ব-তথ্য ইতিহাসের রচনায় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত, তন্মধ্যে মুদ্রা অন্যতম। এর ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব ইতিহাস রচনার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে।
প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত নগর ও শহর খননের ফলে যে সব পুরাতন সামগ্রী বা ধ্বংসস্তুপ আবি®কৃত হয়, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে এদের মধ্যে মুদ্রাই বেশি কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ। লিখিত উৎস যেখানে ইতিহাস পূনর্গঠনে কার্যকর ও যৌক্তিক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় সেখানে মুদ্রা ও শিলালিপি ইতিহাসের নতুন পাঠ পুনর্গঠনে অত্যন্ত শক্তিশালী এক উপাদান। ইতিহাস রচনার এক নীরব উপাদান হিসেবে যুগ যুগ ধরে মুদ্রা ইতিহাস রচয়িতা ও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। মুদ্রায় উৎকীর্ণ উপাদান একটি রাজবংশের শুধুমাত্র রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহের তথ্যই উপস্থাপন করে না, বরং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও ধর্মীয় বিশ্বাসের তথ্যও পরিবেশন করে থাকে। মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপি, প্রতীক চিহ্ন ও প্রতিকৃতির বিশ্লেষণ করে দেশ ও জাতির ইতিহাসকে তথ্যসমৃদ্ধ ও ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব।
ইতিহাস কেবলমাত্র অতীত ঘটনার বিবরণমাত্র নয়। সমাজ, জীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর বিচার বিশ্লেষণ ইতিহাসের কাঙিত বিষয় বস্তু হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। প্রাথমিক ও মৌলিক উৎস হিসেবে মুদ্রা ইতিহাসের যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক ও সত্যের কাছাকাছি তথ্যের সন্ধান দিতে এবং নতুন ব্যাখ্যার পথ উন্মুক্ত করতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ফলে মুদ্রা ইতিহাসের গতিধারায় নতুন ব্যাখ্যার পথ অর্গলমুক্ত করে ইতিহাস রচনাকে তথ্যভিত্তিক করে তোলে।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় মুদ্রা এক গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য উপাদান। জানা যায়, প্রাচীন বাংলার শাসকবৃন্দ মুদ্রা জারি করেছিলেন। মৌর্য, কুশান ও গুপ্ত ঔপনিবেশিক যুগে এ ধরনের ধাতব মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়। ধাতব মুদ্রা ছাড়াও গুপ্তোত্তরকালের বাংলার রাজাগণের অনেক মুদ্রা বাংলায় আবি®কৃত হয়েছে। মৌর্যপূর্ব যুগের মুদ্রাও এদেশে পাওয়া গেছে। তবে এ ধরণের মুদ্রা বাংলার ইতিহাস রচনায় তেমন গুরুত্ববহ নয়। কারণ, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত এ মুদ্রাগুলো লিপিবিহীন। ফলে সময়কাল ধারণাপ্রসূত। তবে মুদ্রাগুলোর ছাপ অংকিত রয়েছে এবং ঢালাইকৃত। এ সমস্ত মুদ্রা থেকে প্রমাণিত হয় যে মৌর্য ও মৌর্যপূর্বকালে বাংলা ভূখণ্ড ব্যবসা বাণিজ্যে ছিল সমৃদ্ধ।
সবচেয়ে বেশি মুদ্রা আবি®কৃত হয়েছে গুপ্তযুগের। এ সময়কালে স্বর্ণমুদ্রা বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতির পরিচয় বহণ করে। গুপ্ত পরবর্তী যুগে বাংলায় যে মুদ্রা নির্মাণ করা হতো তা গুপ্তদের অনুকরণেই। বগুড়ার মহাস্থান ও নরসিংদি জেলার উয়ারি বটেশ্বর, কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার প্রভৃতি স্থান থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা বাংলায় সর্বভৌম রাজশক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারতা এবং কারুশিল্পের নৈপূণ্যের পরিচয় প্রমাণ করে।
প্রাচীন বাংলায় প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পুরান। পুরান ছিল রৌপ্য মুদ্রা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পুরান আবি®কৃত হয়েছে। পুরান মৌর্য যুগের মুদ্রা হিসেবে ধারণা করা হয়। মহাস্থানগড়ে কনিস্কের মূর্তি (ঝপঁষঢ়ঃঁৎব) অংকিত মুদ্রা আবি®কৃত হয়েছে। সমগ্র বাংলার বিভিন্ন স্থানে গুপ্ত সম্রাটদের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা বিপুল সংখ্যায় পাওয়া গেছে। এছাড়াও রাজা শশাঙ্কের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে বাংলার অনেক অঞ্চলে। পাল যুগের মুদ্রা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। পাহাড়পুরে তিনটি তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে একটি মুদ্রার একদিকে একটি বৃক্ষ এবং অপরদিকে তিনটি মাছ উৎকীর্ণ। অনেকে ধারণা করেছেন, এগুলো পাল যুগের প্রথমদিকের মুদ্রা। বিগ্রহ পালের মুদ্রা হিসেবে ধারণাকৃত কিছু মুদ্রা আবি®কৃত হয়েছে। এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে শ্রীবিগ্র। এগুলো তামা ও রুপার মুদ্রা। সেন যুগের মুদ্রা এ পর্যন্ত আবি®কৃত হয়নি। গুপ্তোত্তরকালের স্বর্ণমুদ্রা গুলোতে ধীরে ধীরে খাদের পরিমাণ বেশি দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়। ক্রমান্বয়ে এ সময়ের মুদ্রা গুলোতে শিল্পসৌন্দর্য তুলনামূলকভাবে পূর্বের চেয়ে কম। স্বর্ণমুদ্রার এই বিবর্তন ধারা পর্যবেক্ষণ করে রাজার তুলনামূলক বা আপেক্ষিক কাল নির্ণয় করা সম্ভব। স্বর্ণমুদ্রার মানের এই যে ক্রমাবনতি, তা থেকে ধারণা করা যায় যে, এই সময় থেকে শিল্প-বাণিজ্যের ক্রমাবনতিও সাধিত হয়েছিল। ইতিহাসে পাল রাজাদের যে আধিপত্য তাতে এ সময়ের দু-একটি মাত্র মুদ্রার প্রাপ্তি ঐতিহাসিকদের বিস্মিত করে। চন্দ্র-বর্ম ও সেন যুগের কোনো মুদ্রার হদিস না থাকা বা আবিষ্কার না হওয়া রীতিমত হৈ চৈ এর মত শোনালেও কিছু কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে যে, এ সময়ের অর্থনীতি ছিল অনেকটাই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, এ সময়ের আর্থ-সামাজিক শিল্প-বাণিজ্যনির্ভর কাঠামো হলে নিশ্চিত রূপেই মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবস্থা অনেকটা ব্যাপকতা লাভ করতো। সেক্ষেত্রে মুদ্রা আবি®কৃত না হওয়াটা অনেক স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সামন্ততান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল এ সময়ের সেন শাসিত প্রাচীন বাংলায়।
বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মুদ্রায় পরিবেশিত উপকরণ অত্যন্ত মূল্যবান। ইতিহাসের ধারণাকে শক্ত মজবুত ভিত্তির উপরে স্থাপন করতে মুদ্রায় পরিবেশিত তথ্য অনেক কার্যকর সূত্র। প্রত্মতাত্ত্বিক সে সব উপকরণ ও মাল-মশলা ইতিহাস সৃষ্টির পরিমণ্ডল প্রসারিত করে তার মধ্যে মুদ্রার অবস্থান অনেক উর্ধে। প্রাথমিক ও মৌলিক উৎস হিসেবে মুদ্রা ইতিহাসের এক সুবিস্তৃত জ্ঞানকোষে নতুন তথ্যের সন্ধান দিতে এবং নব নব ব্যাখ্যার পথ উন্মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুদ্রা ইতিহাসের গতিধারায় ব্যাখ্যার পথ খুলে দিয়ে ইতিহাস রচনাকে তথ্যভিত্তিক করে তোলে। সুতরাং ইতিহাস রচনায় মুদ্রা অত্যন্ত শক্তিশালী উৎস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রাচীন স্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। প্রাচীন বাংলায় প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্ব সহজপ্রাপ্য নয়। এক্ষেত্রে প্রত্মতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ বললেও বলা যেতে পারে। স্থাপনা সমাজের সভ্যতার একটি অন্যতম নিদর্শন বা উপাদান। সমাজের আভিজাত্য ও উচ্চবিত্ততার মাপকাঠি নির্ণয়ের একটি মাধ্যম হচ্ছে সমকালীন সমাজের স্থাপনা। স্থাপনা একটি সমাজের রুচিশীলতা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং সভ্যতার অন্যতম মাপকাঠি। বাংলার বহু স্থানে প্রাচীনকালের
স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ আবি®কৃত হয়েছে। এ সকল স্থাপনার মধ্যে দুর্গ-বিহার, মন্দির ও স্তুপ অন্তর্ভুক্ত। এ সব স্থাপনার মধ্যে বাংলার ইতিহাস রচনায় এ সকল স্থাপনা অত্যন্ত কার্যকর উৎস হিসেবে বিবেচ্য।
মহাস্থানগড়, বানগড়, চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুকের নাম প্রাচীন বাংলার দুর্গ সমূহের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। দুর্গনগরী হিসেবে এই সমস্ত স্থানগুলো চিহ্নিত হয়েছিল। এসব নগর ছিল শিল্প, বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্র। প্রাচীনকালে মহাস্থানগড় পরিচিত ছিল পুণ্ড্রনগর হিসেবে। বানগড় প্রাচীনকালে পরিচিত ছিল কোটিবর্ষ হিসেবে। তমলুক প্রাচীনকালে পরিচিত ছিল তাম্রলিপ্তি হিসেবে। এ সমস্ত দুর্গনগরগুলা খনন করে প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক বহু নিদর্শন আবি®কৃত হয়েছে। এ সকল প্রাচীন নিদর্শনের আলোকে প্রাচীন বাংলার নাগরিক জীবনের অনেক অজানা তথ্য উদঘাটন করে ইতিহাস রচনা করা সম্ভব।
পাহাড়পুর বিহার শালবন বিহার সহ বাংলার বহুস্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে কতকগুলো বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ স্তুপ এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন আবি®কৃত হয়েছে। খননকৃত নিদর্শন নিরীক্ষণ করে ঐতিহাসিক বহু তথ্য সন্নিবেশন করে ইতিহাস রচনা সম্ভব। বৌদ্ধ বিহারে ভিক্ষুগণ বসবাস করতেন, পূজা-অর্চনা করতেন। এবং জ্ঞান আহরণ ও বিতরণে নিয়োজিত থাকতেন। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ও ভিক্ষু জীবন এবং শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ স্তুপে জনগণের ধর্মীয় মনোভারের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। আবি®কৃত স্থাপনাগুলো প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশিল্পের বাস্তব নিদর্শন। এসব নিদর্শন বাঙালির স্থাপত্যশিল্পে নৈপুণ্যের প্রমাণ দেয়। ভারতবর্ষের বৃহত্তর বৌদ্ধবিহারগুলোর মধ্যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ছিল বৃহত্তম। এই বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দির একটি ক্রুশাকৃতির উপাসনা কমপ্লেক্স। এর প্রতিটি প্রধান দিকেই একটি করে মণ্ডপযুক্ত গর্ভগৃহ রয়েছে। এ ধরণের মন্দির স্থাপত্য সৃষ্টির উৎসভূমি বাংলা। ময়নামতির ক্রুশাকৃতির মন্দিরগুলোতেই এ ধরণের স্থাপত্য শৈলির উৎসসমূহের খোঁজ পাওয়া যায়।
প্রাচীন বাংলার স্থাপনা নির্মাণের প্রধান উপকরণ ছিল ইট। কোনো কোনো দুর্গ, প্রাকার মাটির তৈরি, বেশির ভাগই ছিল ইটনির্মিত। পাহাড়পুর ও ময়নামতির কোনো কোনো স্থাপনায় প্রাচীনগাত্র পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলঙ্কৃত। এ সব ফলকে সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ফলে বাংলার প্রাচীন স্থাপনা বাংলার প্রাচীন ইতিহাস রচনাকে অনেকটাই সহজ করেছে।
তবে একথা সত্য, প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের এই অন্যতম উৎস স্থাপনা অনেকটাই অনাবি®কৃত। আবি®কৃত হলে ইতিহাস রচনা যেমন অনেকটা সহজ ও স্বচ্ছ্ব হয়ে যেতো, আবিষ্কারের অভাবে তা অন্ধকারে বস্তু খোঁজার মতই ধারণাপ্রসূত। এক্ষেত্রে একথা বলা যায় যে, বাঙালি সমাজের এই প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানার প্রচেষ্টা অনেকটাই অপ্রতুল। বাঙালির প্রাচীন ইতিহাস রয়ে গেছে লুক্কায়িত। অন্ধকারে থেকে গেছে বাংলার গভীর পলিমাটি, নতুন গড়ে ওঠা বসতি এবং পরিত্যক্ত ও জঙ্গলময় ভূমির নিচে বহু প্রাচীন জনপদের চিহ্ন। অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে সে যুগের মানুষের ব্যবহৃত উপকরণসমূহ।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের উপকরণ অনাবিষ্কারের পেছনের কারণ অনেক কারণই রয়েছে। যেমন বাংলার আবহাওয়া জলবায়ুপ্রবণ। এ কারণে এ অঞ্চলে সাধারণত: কোনো বস্তুই বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ফলে, প্রাচীন বাংলার সমাজ যতই উন্নত ও সভ্য হোক না কেন জলবায়ুপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানে সমকালীন কোনো নিদর্শন অক্ষত থাকেনি। এবং এটি ইতিহাস রচনার জন্য যথেষ্ট উৎস হিসেবে পরিগণিত হয় না।
বাংলায় পাথর একেবারেই অপর্যাপ্ত। পাথর ইতিহাসের উৎস সংরক্ষণে তথা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংরক্ষণে খুবই কার্যকর একটি উপকরণ। প্রাচীন বাংলায় পাথর সহজলভ্য না হওয়ায় এ দেশের প্রাচীন মানুষ বেত, বাঁশ, কাঠ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তাঁদের আবাস নির্মাণ করেছিলেন। অথচ পাথর দিয়ে তাঁদের বাড়িঘর নির্মিত হলে তা থেকে তৎকালীন মানুষের রুচি, অভ্যাস, নিদর্শনের অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু খড়কুটো, কাঠ, বাঁশ বেত এ দেশের আবহাওয়ায় সহজেই পচনশীল, বিধায় তা থেকে ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। আর এ ধরণের উপকরণ সে সময়ে ব্যবহৃত হতো সেটিও প্রমাণিত নয়; অনুধাবনযোগ্য। বাংলায় প্রাচীনকালে প্রস্তর বা ধাতুনির্মিত অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক লক্ষ্যণীয় নয়। এ দেশের নদীনালা প্রচুর। প্রাচীনকালে তা ছিল আরো বেশি খরস্রোতা ও বৃহৎ। নদ-নদীগুলোর ছিল ব্যাপক গতিপরিবর্তনশীলতা। নদীর গতি পরিবর্তনে কত যে জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়েছে তা বর্তমানকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে অতীতকে ভাবলেও সহজেই অনুধাবন করা যায়। ফলে একদিকে জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়েছে, গড়ে উঠেছে নতুন ভিন্ন ভিন্ন জনপদ। সভ্যতার চিহ্ন নিদর্শন হারিয়ে গেছে কখনো আগ্রাসী নদীর গতি পরিবর্তনে, কখনো নদীবাহিত পলিমাটির আস্তরনে চাপা পড়ে। ফলে এ সকল চিহ্ন নিদর্শন লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেছে। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে কতকগুলো বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ স্তুপ এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন আবি®কৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে পাহাড়পুর বিহার ও শালবন বিহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধবিহারে ভিক্ষুগণ বসবাস করেন, পূজা অর্চনা করেন এবং জ্ঞান আহরণ ও শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত থাকেন। ফলে বৌদ্ধ ধর্ম ও ভিক্ষু জীবন এবং শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। হিন্দু বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ স্তুপে জনগণের ধর্মীয় মনোভাবের প্রতিফলন ফুটে ওঠে। সুতরাং প্রাচীন বাংলায় প্রাপ্ত স্থাপনা ইতিহাস রচনায় উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।
স্থাপনা সকালীন যুগের শিল্পনৈপূণ্যের অবস্থা এবং মানুষের রুচি নির্দেশ করে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ছিল প্রাচীন বাংলার তথা ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম। এই বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দির একটি ক্রুশাকৃতির উপাসনা কমপ্লেক্স যার প্রতিটি প্রধান দিকেই একটি করে মণ্ডপযুক্ত গর্ভগৃহ রয়েছে। এ ধরণের স্থাপনা সে সময়ে বাংলাতেই শুধু পরিলক্ষিত হয়েছে। ময়নামতির ক্রুশাকৃতির মন্দিরগুলোতেই এ ধরণের স্থাপত্যশৈলীর উৎসসূত্রের নিদর্শন দেখা যায়।
স্থাপনার উপকরণ প্রাচীন বাংলার মানুষের সামর্থ ইট, কাঠ পাথর ইত্যাদির সহজলভ্যতা, পোড়ামাটির উপকরণে কারুকার্যতায় সমকালীন সময়ের মানুষের সৌন্দর্যপ্রিয়তাসহ সময়ের ছবি এ সময়ের মানুষকেও বিমুগ্ধ ও আকর্ষিত করে। ইট ছিল স্থাপনা নির্মাণের প্রধান উপকরণ। তবে কিছু কিছু দূর্গ-প্রাকার মাটির তৈরিও ছিল। পাহাড়পুর ও ময়নামতির অধিকাংশ স্থাপনায় প্রাচীরগাত্র পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। এ ধরণের ফলকে সমকালীন সমাজ-সংস্কৃত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের চিত্র রয়েছে। ফলে স্থাপনা উৎস হতে প্রাচীন বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সমকালীন মানুষের সামাজিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন বাংলার লেখক ও ঐতিহাসিকদের রচনা থেকে সমকালীন স্থাপত্যের যে চিত্র কল্পনায় ফুটে ওঠে, এ যাবত প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে তা কোনোক্রমেই যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় না। ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ এবং প্রাচীন শিলালিপি ও তাম্রশাসনের বিষয় আলোচনা করলে দেখা যায় যে, হিন্দুযুগে বাংলায় বিচিত্র কারুকার্যখচিত হর্ম্যমালা ও মন্দির এবং স্তুপ ও বিহারের অবস্থান ছিল। প্রাচীন সভ্যতার এ নিদর্শনগুলো সমকালীন লেখকরা উচ্ছ্বসিতভাবে প্রশংসা করেছেন। এ ধরণের স্থাপত্যগুলোকে গগণস্পর্শী, ভূ-ভুষণ, কুল-পর্বত-সদৃশ, সূর্যের গতিরোধকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীতেও সন্ধ্যাকর নন্দী বরেন্দ্রভূমিতে প্রাংশু প্রাসাদ, মহাবিহার এবং অনেক কাঞ্চন-খচিত হর্ম্য ও মন্দির দেখেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
বর্তমান সময়ে প্রাপ্ত যে ধ্বংসাবশেষ তা থেকে উপরোক্ত বর্ণনার নিদর্শনযুক্ত কোনো স্থাপনার নজীর অবগত হওয়া যায় না। এ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, বাংলার স্থাপনার অনেক নিদর্শনই হারিয়ে গেছে, অবলুপ্ত হয়েছে। এ যাবত প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে ইতিহাস রচনার যে পাদপীট নির্মিত হয়েছে তা অনেকটাই অপূর্ণাঙ্গ কঙ্কালসার মাত্র। কালের বিবর্তনে হয়তো এ সমস্ত উৎস স্থাপনার নিদর্শন আবি®কৃত হবে; ফলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনার পথ অনেকটাই সহজ হয়ে উঠবে।
যা মনকে হরণ করে তা-ই মনোহর। চারু অর্থ-মনোহর। চারু অর্থ সুন্দর, শোভণ, সুদর্শন, কমনীয়। চিত্রাঙ্কনাদি সুকুমার শিল্প, ললিত কলা (ঋরহব অৎঃং)। কারু অর্থ শিল্পী; শিল্পকার, নির্মাতা; কর্তা, শিল্পকর্ম; কাঠধাতু ইত্যাদির কারিগরি শিল্প (ঈৎধভঃং), নকশা ইত্যাদি। প্রাচীন বাংলায় চারুকারু শিল্প হিসেবে চিত্রকলা; ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প, ধাতব শিল্প ইত্যাদি নিদর্শন উল্লেখযোগ্য। এ সকল নিদর্শনের মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করা যায়। প্রাচীন বাংলায় চারু ও কারু শিল্পের যে নিদর্শন তা সকালীন সমাজের উত্তবিত্ত শ্রেণির মানুষের এবং শাসক শ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ও রুচির পরিচায়ক। চারু ও কারু শিল্পে সে সময়ের এক শ্রেণির মানুষের সামাজিক তথ্য ফুটে ওঠে। এ ছাড়াও চারু ও কারুকলার বহু নিদর্শন হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়বস্তুকে চিত্রিত করে।
প্রাচীনকাল হতে বাংলায় চিত্রাঙ্কনের চর্চা থাকলেও পাল যুগের পূর্বেকার কোনো চিত্র এখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত। ফা হিয়েন তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারে অবস্থানকালে বৌদ্ধমূর্তির ছবি আঁকতেন বলে জানা যায়। সাধারণত মন্দির ও বৌদ্ধবিহার প্রভৃতির প্রাচীরগাত্র চিত্রদ্বারা শোভিত করা হতো বলে পরবর্তীকালের শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসনে বর্ণনা পাওয়া যায়। সুতরাং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীনকাল হতেই চারুকারু শিল্প পরিচিত ছিল এ কথা অনুমান করা যায়। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল আমলে লিখিত কয়েকটি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে অঙ্কিত বজ্রযান-তন্দ্রযান-মতোক্ত দেবদেবীর ছবি আবি®কৃত হয়েছে। পাল আমলের এই চিত্রগুলোই প্রাচীন বাংলার চারুকারু শিল্প আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু। এই চিত্রগুলো ছিল রেখার সাহায্যে অঙ্কিত।
ভাস্কর্যশিল্প মূলত দেবদেবীর প্রতিমার-ই নিদর্শন। তিব্বতীয় লামা তারানাথের বর্ণনায় রয়েছে, ধীমান ও তার পুত্র বিৎপালো প্রস্তুর ও ধাতব মূর্তি গঠনে এবং চিত্রাঙ্কনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের একটি স্বতন্ত্র শিল্পী সম্প্রদায়গোষ্ঠী ছিল। বিজয় সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে এই এই শিল্পী সম্প্রদায়গোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে। তাঁরা ভাস্কর্য নির্মাণে বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
প্রস্তর ও ধাতুর সাহায্যে ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে তৎকালে অর্থশালী শ্রেণি কিংবা শাসকরাই ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন। শিল্পীগণ উচ্চবিত্ত শ্রেণির ব্যয় নির্বাহে তাঁদের নির্দেশন মোতাবেক এই সমস্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন। শিল্পীগণ তাঁদের এই শিল্পী পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সুতরাং এ কথা বলা যুক্তিসঙ্গত যে, উচ্চ শ্রেণির মনোরঞ্জনে ও প্রয়োজনের অনুকূলে হলেও যে, উচ্চবিত্ত শ্রেণির নির্দেশ মোতাবেক মূর্তি-ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে যে সময়ের শিল্পীগণ নিজেদের স্বাধীন মতামত ও সুকুমারবৃত্তিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত করেছেন। সাধারণত: এই শিল্পীগণ তাঁদের সৃষ্টিকর্মে উচ্চবিত্ত শ্রেণির সৌন্দর্যবোধ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের আবেগের প্রতিফলন-ই ঘটাতেন। ধনী, অভিজাত ও উচ্চবিত্ত মানুষের অনুগ্রহে, আগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপুষ্ট এইসব শিল্পীর শিল্প রচনা সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের মনোরঞ্জন ও প্রয়োজনের অনুকূলে হলেও শিল্পীদের দক্ষতা ও সচেতনতায় সমকালীন সমাজের মানুষের রুচিবোধ, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার প্রভৃতির একটি সার্বিক সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে।
ড. আবু নোমান, অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ রাজশাহী