নাজমুল টিটো
(১২৯) “হৃদয় আমার প্রকাশ হল
অনন্ত আকাশে।
বেদন—বাঁশি উঠল বেজে
বাতাসে বাতাসে।”
[গীতালি—১৯]
(১৩০) “ মাটির ‘পরে আঁচল পাতি’
একলা কাটে নিশীথ রাতি,
তার বাঁশি বাজে আঁধার—মাঝে
দেখি না যে চক্ষে তারে।”
[গীতালি—১৯]
(১৩১) “মাটির ‘পরে আঁচল পাতি’
একলা কাটে নিশীথ রাতি,
তার বাঁশি বাজে আঁধার—মাঝে
দেখি না যে চক্ষে তারে।”
[গীতালি—২৭]
(
১৩২)“আমার কাজ হয়েছে সারা,
এখন প্রাণে বাঁশি বাজায় সন্ধ্যাতারা।
দেবার মতো যা ছিল মোর নাই কিছু আর হাতে,
তোমার আশীর্বাদের মালা নেব কেবল মাথে।”
[গীতালি—৬০]
(১৩৩) “কাণ্ডারী গো, ঘর যদি মোর
না থাকে আর দূরে,
ওই যদি মোর ঘরের বাঁশি
বাজে ভোরের সুরে,
শেষ বাজিয়ে দাও গো চিতে
অশ্রুজলের রাগিণীতে
পথের বাঁশিখানি তোমার
পথতরুর মূলে।”
[গীতালি—৬০]
(১৩৪) “সেথায় তরু তৃণ যত
মাটির বাঁশি হতে ওঠে
গানের মতো।
আলোক সেথা দেয় গো আনি
আকাশের আনন্দবাণী,
হৃদয়—মাঝে বেড়ায় ঘুরে
গানের সুরে।”
[গীতালি—৬৯]
(১৩৫) “ওগো আমার হৃদয়বাসী,
আজ কেন নাই তোমার হাসি।
সন্ধ্যা হল কালো মেঘে,
চাঁদের চোখে আঁধার লেগে—
বাজল না আজ প্রাণের বাঁশি।”
[গীতালি—৭২]
# বলাকা (১৯১৬) কবির গতিচেতনা বিষয়ক কাব্য। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গতির উপাসক। কবি—মনের এই গতির সুর “বলাকা” কাব্যে সুস্পষ্ট। সেই সুর কবি সঞ্চারিত করেছেন কখনো ব্যথার বাঁশি, কখনো আলোর বাঁশি, কখনোবা মধুমধ্যাহ্নের বাঁশিতে।
(১৩৬) “আছি জাগি চক্ষে চক্ষে হাসিতে হাসিতে
কত মধুমধ্যাহ্নের বাঁশিতে বাঁশিতে।”
[বলাকা—১৩]
(১৩৭)“আনন্দ—গান উঠুক তবে বাজি
এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।
অশ্রুজলের ঢেউয়ের ‘পরে আজি
পারের তরী থাকুক ভাসিতে।
Í—————————————————————————————————————
হৃদয় আমার উঠছে দুলে দুলে
অকূল জলের অট্টহাসিতে,
কে গো তুমি দাও দেখি তান তুলে
এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।
হে অজানা, অজানা সুর নব
বাজাও আমার ব্যথার বাঁশিতে,
হঠাৎ এবার উজান হাওয়ায় তব
পারের তরী থাক্—না ভাসিতে।
Í———————————————————————————————————————
বাসার আশা গিয়েছে মোর ঘুরে,
ঝাঁপ দিয়েছি আকাশ—রাশিতে;
পাগল, তোমার সৃষ্টিছাড়া সুরে
তান দিয়ো মোর ব্যথার বাঁশিতে।”
[বলাকা—২০]
(১৩৮) “বসন্ত সে আসবে যে ফাল্গুনে
দখিন হাওয়ার জোয়ার—জলে ভাসি
তাহার লাগি রইলি নে দিন গুণে,
আগে—ভাগেই বাজিয়ে দিলি বাঁশি।”
[বলাকা—২১]
(১৩৯) “সেখানেতে আবার সে কোন্ দূরে
আলোর বাঁশি বাজবে গো এই সুরে,
কোন্ মুখেতে সেই অচেনা ফুল
ফুটবে আবার হেসে।”
[বলাকা—৪৩]
# পলাতকা (১৯১৮) কাব্যগ্রন্থের পটভূমিতে দেশব্যাপী রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সমাজে নারীদের অবহেলিত অবস্থা এই দুটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। কবি এখানেও বিশ্বচরাচরে জীবনমৃত্যুর প্রবাহে তাঁর বেদনাকে বাঁশির সুরে মিশিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার প্রসন্ন প্রয়াস পেয়েছেন।
(১৪০) “বুকে যে তার বাজল বাঁশি বহুযুগের
ফাগুন—দিনের সুরে—
কোথায় অনেক দূরে
রয়েছে তার আপন চেয়ে
আরো আপন জন।”
[পলাতকা, পলাতকা]
(১৪১) “বাজল বিয়ের বাঁশি,
অনাদরের ঘর ছেড়ে হায় বিদায় হল দুষ্টুসর্বনাশী।”
[চিরদিনের দাগা, পলাতকা]
(১৪২) “এতদিনে প্রথম যেন বাজে
বিয়ের বাঁশি বিশ্ব—আকাশ—মাঝে।”
[মুক্তি, পলাতকা]
(১৪৩) “রাখাল ছেলের সঙ্গে বসে বটের ছায়ে ছেলেবেলায় বাঁশের বাঁশি বাজিয়েছিলেম গাঁয়ে।
সেই বাঁশিটির টান
ছুটির দিনে হঠাৎ কেমন আকুল করল প্রাণ। আমি ছাড়া সকল ছেলেই গেছে যে যার দেশে,
একলা থাকি “মেস্”—এ।
সকাল—সাঁঝে মাঝে মাঝে বাজাই ঘরের কোণে
মেঠো গানের সুর যা ছিল মনে।
Í————————————————————————————————————————
ওই যে ওদের কালো মেয়ে নন্দরানী
যেমনতরো ওর ভাঙা ওই জানলাখানি,
যেখানে ওর গভীর মনের নীরব কথাখানি
আপন দোসর খুঁজে পেত আলোর নীরব বাণী; তেমনি আমার বাঁশের বাঁশি আপনভোলা,
চার দিকে মোর চাপা দেয়াল,
ওই বাঁশিটি আমার জানলা খোলা।
ওইখানেতেই গুটিকয়েক তান
ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার
ঘুচিয়ে দিত অসীম ব্যবধান।
এ সংসারে অচেনাদের ছায়ার মতন আনাগোনা কেবল বাঁশির সুরের দেশে
দুই অজানার রইল জানাশোনা।
যে—কথাটা কান্না হয়ে বোবার মতন
ঘুরে বেড়ায় বুকে
উঠল ফুটে বাঁশির মুখে।
বাঁশির ধারেই একটু আলো, একটুখানি হাওয়া, যে—পাওয়াটি যায় না দেখা
স্পর্শ—অতীত একটুকু সেই পাওয়া।”
[কালো মেয়ে, পলাতকা]
(১৪৪)
“প্রাণখানি যাঁর বাঁশির মতো সীমাহীনের হাতে
সরল সুরে বাজে দিনে রাতে,
যাঁর চরণের স্পর্শে
ধুলায় ধুলায় বসুন্ধরা উঠল কেঁপে হর্ষে,
আমি যেন দেখতে পেতেম তাঁরে
দীনের বাসায়, এই পাগলের ভাঙা ঘরের দ্বারে।”
[আসল, পলাতকা]
(১৪৫) “আমার ছুটি সেজে বেড়ায়
তোমার ছুটির সাজে,
তোমার কণ্ঠে আমার ছুটির
মধুর বাঁশি বাজে।”
[ঠাকুরদাদার ছুটি, পলাতাকা]
# শিশু ভোলানাথ (১৯২২) কাব্যে শিশুর ইচ্ছা, কল্পনা এবং সাহস মূল বিষয়বস্তু। শিশুতোষ কবিতাগুলোতে স্মৃতি—বিস্মৃতির শৈশব, কাছের—দূরের কল্পনার—করুণার—অসহায়তার শৈশবের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে কবি শৈশবের প্রিয় বাঁশির সুরকে বারংবার ব্যবহার করেছেন।
(১৪৬)
“গাছে খেলা ফুল—ভরানো
ফুলে খেলা ফল—ধরানো,
ফলের খেলা অঙ্কুরে অঙ্কুরে।
স্থলের খেলা জলের কোলে,
জলের খেলা হাওয়ার দোলে,
হাওয়ার খেলা আপন বাঁশির সুরে।”
Í——————————————————————————————————————————
তোমার ধুলো তোমার আলো
আমার মনে লাগত ভালো,
শুনেছিলেম উদাস—করা বাঁশি।
বুঝেছিল সে—ফাল্গুনে
আমার সে—গান শুনে শুনে
তোমারও গান আমি ভালোবাসি।”
[শিশুর জীবন, শিশু ভোলানাথ]
(১৪৭)
“দুপুরবেলায় চিল ডেকে যায়;
হঠাৎ হাওয়া আসি
বাঁশ—বাগানে বাজায় যেন
সাপ—খেলাবার বাঁশি।”
[মুর্খু, শিশু ভোলানাথ]
(১৪৮)
“পাতায় পাতায় পায়ের ধ্বনি,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডাকাডাকি,
হাওয়ায় হাওয়ায় যাওয়ার বাঁশি
কেবল বাজে থাকি থাকি।”
[দূর, শিশু ভোলানাথ]
# পূরবী (১৯২৫) “বলাকা পর্ব”—এর একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। পূরবী’ গ্রন্থে সংকলিত কবিতায় মানসিক বিচ্ছিন্নতার মাঝেও নিজস্ব জগতের গাঢ় অধ্যবসায়ের প্রকাশ ঘটেছে। সাথে জাগতিক রূপ ও দৈন্যতার থেকে আত্মার রহস্য খুঁজতে চেয়েছেন কবি এবং মানবিক দুর্বলতার বাইরে গিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে চেয়েছেন।
অনুজ ও স্নেহভাজন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকাল প্রয়াণে বিশ্বকবি তাঁর স্মরণে ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ শিরোনামে নাতিদীর্ঘ কবিতায় ছন্দের জাদুঘর সম্পর্কে যে নির্মেদ ও নিরাবেগ মূল্যায়ন করেছেন তা বাংলা কাব্যাঙ্গনে চিরকালের জন্য স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকলো। যেই বাঁশিখানি হাতে লয়ে সত্যেন্দ্রনাথের আবির্ভাব তারও বহু আগে থেকে এই বংশী হাতে লয়ে কবিগুরুরও পথচলা শুরু। জীবন চলার এই বন্ধুর পথে আনন্দ—বেদনায়, বিরহ—মিলনে কিংবা নানা দুর্যোগে এই বাঁশি দেখায় কবিকে পথের দিশা এবং হয়ে ওঠে তাঁর মর্ত্য সাধনায় মূর্ত ও বিমূর্ত প্রতীক।
পূরবী কাব্যের ৭৮—টি কবিতার মধ্যে ২৩টি কবিতায় কবি অত্যন্ত সচেতন ও প্রাসঙ্গিকভাবে পুনঃ পুনঃ বাঁশির ব্যবহার করেছেন।
(১৪৯)
“ধরণীতে প্রাণের খেলায়
সংসারের যাত্রাপথে এসেছি তোমার বহু আগে,
সুখে দুঃখে চলেছি আপন মনে; তুমি অনুরাগে এসেছিলে আমার পশ্চাতে, বাঁশিখানি লয়ে হাতে ‘মুক্ত মনে, দীপ্ত তেজে, ভারতীর বরমাল্য মাথে। ‘আজ তুমি গেলে আগে; ধরিত্রীর রাত্রি আর দিন তোমা হতে গেল খসি, সর্ব আবরণ করি লীন চিরন্তন হলে তুমি, মর্ত কবি, মুহূতের্র মাঝে।”
[সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পূরবী]
(১৫০)
“ওরে, এতক্ষণে বুঝি তারা—ঝরা নির্ঝরের গ্রোতঃপথে পথ খুঁজি খুঁজি গেছে সাত—ভাই চম্পা; কেতকীর রেণুতে রেণুতে ছেয়েছে যাত্রার পথ; দিগবধূর বেণুতে বেণুতে বেজেছে ছুটির গান; ভাঁটার নদীর ঢেউগুলি মুক্তির কল্লোলে মাতে, নৃত্যবেগে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি
উচ্ছলিয়া বলে, ‘চলো, চলো।’ Í——————————————
Í————————————————————————————————
ওরা ডেকে বলে, ‘কবি,
সে তীর্থে কি তুমি সঙ্গে যাবে, যেথা অস্তগামী রবি সন্ধ্যামেঘে রচে বেদী নক্ষত্রের বন্দনাসভায়,
যেথা তার সর্বশেষ রশ্মিটির রক্তিম জবায়
সাজায় অন্তিম অর্ঘ্য; যেথায় নিঃশব্দ বেণু—’পরে সংগীত স্তম্ভিত থাকে মরণের নিস্তব্ধ অধরে।”
[যাত্রা, পূরবী]
(১৫১)।
“একদা সে দিনগুলি তোমার পিঙ্গল জটাজালে শ্বেত রক্ত নীল পীত নানা পুষ্পে বিচিত্র সাজালে,
গেছ কি পাসরি।
দস্যু তারা হেসে হেসে
হে ভিক্ষুক, নিল শেষে
তোমার ডম্বরু শিঙা, হাতে দিল মঞ্জিরা বাঁশরি।”
[তপোভঙ্গ, পূরবী]
(১৫২)
“কেন যে আজি উঠিল বাজি আকাশ—কাঁদা বাঁশি
জানিস তাহা না কি?
রঙিন যত মেঘের মতো কী যায় মনে ভাসি
কেন যে থাকি থাকি?”
[আগমনী, পূরবী]
(১৫৩)
“কালগ্রোতে এ অকূলে আলোচ্ছায়া দুলে দুলে
চলে নিত্য অজানার টানে।
বাঁশি কেন রহি রহি সে আহ্বান আনে বহি
আজি এই উল্লাসের গানে?
চঞ্চলেরে শুনাইছে স্তব্ধতার ভাষা,
যার রাত্রি—নীড়ে আসে যত শঙ্কা আশা।
বাঁশি কেন প্রশ্ন করে, ‘বিশ্ব কোন্ অনন্তের পানে
চলে নিত্য অজানার টানে।”
[উৎসবের দিন, পূরবী]
(১৫৪) “দেখো তো, সখী দিয়েছে ও কি
সুখের কাঁদা, দুখের হাসি,
দুরাশাভরা চাহনি।
দিয়েছে কি না ভোরের বীণা,
দিয়েছে কি সে রাতের বাঁশি
গহন—গান—গাহনি।”
[গানের সাজি, পূরবী]
(১৫৫)
“বর্ষাশেষের গগন—কোনায়—কোনায়
সন্ধ্যামেঘের পুঞ্জ সোনায় সোনায়
নির্জন ক্ষণে কখন অন্যমনায়
ছুঁয়ে গেছ থেকে থেকে—
কখনো হাসিতে কখনো বাঁশিতে
গিয়েছিলে ডেকে ডেকে।
Í——————————————————————————————————————————
এতদিন হেথা ছিনু আমি পরবাসী,
হারিয়ে ফেলেছি সেদিনের সেই বাঁশি,
আজ সন্ধ্যায় প্রাণ ওঠে নিশ্বাসি
গানহারা উদাসীন।
কেন অবেলায় ডেকেছ খেলায়,
সারা হয়ে এল দিন।”
[লীলাসঙ্গিনী, পূরবী]
(১৫৬)
“তোমার হোমাগ্নি—মাঝে
আমার সত্যের আছে ছবি,
তারে নমো নম।
তমিগ্র সুপ্তির কূলে
যে বংশী বাজাও, আদিকবি,
ধ্বংস করি তম,
সে বংশী আমারই চিত্ত,
রন্ধে্র তারই উঠিছে গুঞ্জরি—
মেঘে মেঘে বর্ণচ্ছটা,
কুঞ্জে কুঞ্জে মাধবীমঞ্জরী,
নির্ঝরে কল্লোল।
তাহারি ছন্দের ভঙ্গে
সর্ব অঙ্গে উঠিছে সঞ্চরি
জীবনহিল্লোল।
Í———————————————————————
হে রবি, প্রাঙ্গণে তব
শরতের সোনার বাঁশিতে
জাগিল মূর্ছনা।
আলোতে শিশিরে বিশ্ব
দিকে দিকে অশ্রম্নতে হাসিতে
চঞ্চল উন্মনা।”
[সাবিত্রী, পূরবী]
(১৫৭)
“স্বর্গসুখে ক্লান্ত কোন্ দেবতার বাঁশির পূরবী
শূন্যতলে ধরে এই ছবি।
ক্ষণকাল পরে যাবে ঘুচে,
উদাসীন রজনীর কালো কেশে সব দেবে মুছে।
Í————————————————————————————————
দুঃখে সুখে বর্ণে বর্ণে লিখা
চিহ্নহীনপদচারী কালের প্রান্তরে মরীচিকা।
তার পরে দিন যায়, অস্তে যায় রবি;
যুগে যুগে মুছে যায় লক্ষ লক্ষ রাগরক্ত ছবি।
তুই হেথা কবি,
এ বিশ্বের মৃত্যুর নিশ্বাস
আপন বাঁশিতে ভরি গানে তারে বাঁচাইতে চাস।”
[ছবি, পূরবী]
(১৫৮)
“তোমার খেলায় আমার খেলা মিলিয়ে দেব তবে নিশীথিনীর স্তব্ধ সভায় তারার মহোৎসবে,
তোমার বীণার ধ্বনির সাথে আমার বাঁশির রবে
পূর্ণ হবে রাতি।
তোমার আলোয় আমার আলো
মিলিয়ে খেলা হবে,
নয় আরতির বাতি।”
[খেলা, পূরবী]
(১৫৯)
“সেদিন আমার রক্তে শুনা যাবে দিবসরাত্রির
নৃত্যের নূপুর।
নক্ষত্র বাজাবে বক্ষে বংশীধ্বনি আকাশযাত্রীর
আলোকবেণুর।”
[মুক্তি, পূরবী]
(১৬০) “এ মোর যাত্রীর বাঁশি
ঝঞ্ঝার উদ্দাম হাসি
নিয়ে গাঁথে সুর—
বলে, সে, ‘বাসনা—অন্ধ,
নিশ্চল শৃঙ্খলবদ্ধ
দূর, দূর, দূর।”
[ঝড়, পূরবী]
(১৬১)
“মনের মাঝে কে কয় ফিরে ফিরে—
বাঁশির সুরে ভরিয়া দাও গোধূলি—আলোটিরে।
সাঁঝের হাওয়া করুণ হোক দিনের অবসানে
পাড়ি দেবার গানে।
Í———————————————————————————————————————————————
দিনের শেষে যে ফুল পড়ে ঝরে
তাহারি শেষ নিশ্বাসে কি বাঁশিটি নেব ভরে?
অথবা বসে বাঁধিব সুর যে তারা ওঠে রাতে
তাহারি মহিমাতে।”
[অবসান, পূরবী]
(১৬২)
“এমনি করে পথে পথে অনেক হল খোঁজা, এমনি
করে হাটে হাটে জমল অনেক বোঝা—
ইমনে আজ বাঁশি বাজে, মন যে কেমন করে
আকাশে মোর আপন তারার তরে।”
[তারা, পূরবী]
(১৬৩)
“সেই ভালো, প্রতি যুগ আনে না আপন অবসান, সম্পূর্ণ করে না তার গান;
অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস রেখে দিয়ে যায় সে বাতাসে। তাই যবে পরযুগে বাঁশির উচ্ছ্বাসে।
বেজে ওঠে গানখানি
তার মাঝে সুদূরের বাণী।”
[অতীত কাল, পূরবী]
(১৬৪)“বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায় তোমার ছবি দূরে
মিলাইবে গোধূলির বাঁশরির সর্বশেষ সুরে।”
[শেষ বসন্ত, পূরবী]
(১৬৫)“সন্ধ্যাতারা দিগন্তের কোণে
শিরীষ পাতার ফাঁকে কান পেতে শোনে
যেন কার পদধ্বনি দক্ষিণ—বাতাসে।
ঝরাপাতা—বিছানো সে ঘাসে
বাঁশরি বাজাই আমি কুসুমসুগন্ধি অবকাশে।”
[চাবি, পূরবী]
(১৬৬)“যেথায় তাহার গোপন সোনার রেণু
সেথা বাজে তার বেণু;
বলে— এসো, এসো, লও খুঁজে লও মোরে,
মধুসঞ্চয় দিয়ো না ব্যর্থ করে,
এসো এ বক্ষোমাঝে,
কবে হবে দিন আঁধারে বিলীন সাঁঝে।”
[প্রভাতী, পূরবী]
(১৬৭)“আসিবে সে, আছি সেই আশাতে।
শোন নি কি, দুজনাকে
নাম ধরে ওই ডাকে
নিশিদিন আকাশের ভাষাতে।
সুর বুকে আসে ভাসি,
পথ চেনাবার বাঁশি
বাজে কোন্ ওপারের বাসাতে।
ফুল ফোটে বনতলে,
ইশারায় মোরে বলে
‘আসিবে সে’; আছি সেই আশাতে।”
[অদেখা, পূরবী]
(১৬৮)
“দূর প্রবাসে সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে এনু,
হঠাৎ যেন বাজল কোথায় ফুলের বুকের বেণু।
আঁতি—পাঁতি খুঁজে শেষে বুঝি ব্যাপারখানা,
বাগানে সেই জুঁই ফুটেছে চিরদিনের জানা।
Í—————————————————————————————————————————————
জানি তুমি বলবে আমায়, ‘থামো একটুখানি,
বেণুবীণার লগ্ন এ নয়, শিকল ঝঝমানি।
শুনে আমি রাগব মনে, কোরো না সেই ভয়—
সময় আমার আছে বলেই এখন সময় নয়।
Í——————————————————————————————————————————————
অসীম কালের যেন দীর্ঘশ্বাস বহেছিস তুই
ও আমার জুঁই!
বক্ষে এনেছিস কার
যুগ—যুগান্তের ভার,
ব্যর্থ পথ—চাওয়া—
বারে বারে দ্বারে এসে
কোন্ নীরবের দেশে
ফিরে ফিরে যাওয়া।
তোর মাঝে কেঁদে বাজে চিরপ্রত্যাশার কোন বাঁশি
‘আমি ভালোবাসি।’
[চিঠি, পূরবী]
(১৬৯)
“সেখানে কোন্ রাজপুত্তুর চিরদিনের দেশে। তোমার লাগি সাজতে গেছে প্রতিদিনের বেশে। সেখানে সে বাজায় বাঁশি রূপকথারই ছায়ে, সেই রাগিণীর তালে তোমার নাচন লাগে গায়ে।”
[বিরহিণী, পূরবী]
(১৭০)
“গুঞ্জরিয়া অসমাপ্ত সুর, শালের মঞ্জরী যত
কী যেন শুনিতে চাহে ব্যগ্রতায় করি শির নত,
ছায়াতে তিনিও সাথে ফেরেন নিঃশব্দ পদচারে
বাঁশির উত্তর তাঁর আমার বাঁশিতে শুনিবারে।”
[সৃষ্টিকর্তা, পূরবী]
নাজমুল টিটো, প্রাবন্ধিক ও গবেষক