অমল বড়ুয়া :
আদিযুগে কাব্যভাষাই ছিল সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মত বাংলাসাহিত্যেরও গোড়াপত্তন কবিতা দিয়েই। বাংলা সাহিত্যের বয়স দেড়-হাজার বছরের অধিক। আর এই প্রাচীন বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ হল কাব্য। চর্যাপদের কাব্যসমূহে প্রাচীনবাংলার সমাজজীবনের ছবি চিত্রিত হয়েছে। চর্যাপদের পদ্যসমূহ সাহিত্যগুণেও অনন্য। বাংলা ‘কবিতা’র উৎপত্তি হয়েছিলো মূলত পালি এবং প্রাকৃত-সংস্কৃতি থেকে। প্রাচীনযুগে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-শতকে বঙ্গদেশ মৌর্যাধিকারে আসার পর থেকে আর্যভাষা এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং এর প্রায় সহস্রাব্দ পরে প্রাকৃতভাষা থেকে বাংলাভাষার উৎপত্তি হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১) কর্তৃক ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের পদগুলির রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। এতে বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মতত্ত্ব ও সাধন-ভজনমূলক ৪৭টি পদ আছে এবং সেগুলি সুনির্ধারিত তাল, রাগ ও সুরে গীত হওয়ার উপযোগী। ব্যঞ্জনাময় শব্দ-ব্যবহার, উপমা-রূপকাদি অলঙ্কারের প্রয়োগ, প্রাকৃতিক বর্ণনা, সমাজচিত্র ইত্যাদি বিবেচনায় পদগুলির সাহিত্যিক ও ভাষা নিদর্শনগত মূল্য অপরিসীম। চর্যাপদ বাংলাভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য-ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। চর্যাপদের রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। চর্যাপদের ২৪ জন পদকর্তা হচ্ছেন লুই পা, কুক্কুরীপা, বিরুআপা, গু-রীপা, চাটিলপা, ভুসুক পা, কাহ্নপাদ, কাম্বলাম্বরপা, ডোম্বীপা, শান্তিপা, মহিত্তাপা, বীণাপা, সরহপা, শবর পা, আজদেবপা, ঢেণ্ঢণপা, দারিকপা, ভাদেপা, তাড়কপা, কঙ্কণপা , জঅনন্দিপা, ধামপা, তান্তীপা, লাড়ীডোম্বীপা।
চর্যাপদের পরে প্রবাদ, বচন, ছড়া, ডাক ও খনার বচন ইত্যাদি কিছু কিছু কাব্যনিদর্শন থাকলেও চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো রচনা পাওয়া যায় না। তাই এ সময়টাকে (১২০১-১৩৫০) কেউ কেউ ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করেন। ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতির সংস্পর্শে এবং মুসলিম শাসকদের ভিন্নতর রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তখন এক নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছিল। সে সময় বাংলাভাষা ও সাহিত্য ছিল সৃজ্যমান অবস্থায় এবং চর্যার বঙ্গীয়-বৈশিষ্ট্যময় অপভ্রংশভাষা আরও বেশি মাত্রায় বাংলা হয়ে ওঠে। এ যুগের প্রাপ্ত নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৩শ-১৪শ শতকের রামাই পন্ডিতের গাথাজাতীয় রচনা শূন্যপুরাণ। এতে বৌদ্ধদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, মুসলমানদের জাজপুর প্রবেশ ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনা সম্বলিত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ শীর্ষক একটি কবিতা আছে। এছাড়া আছে অপভ্রংশভাষায় রচিত প্রাকৃত পৈঙ্গল নামক একটি গীতিকবিতার সংকলন, যার ছন্দ ও ভাষা প্রাকৃত বা আদি পর্যায়ের বাংলা। হলায়ুধ মিশ্র রচিত সেখশুভোদয়া (আনু. ১২০৩) নামক সংস্কৃত গ্রন্থেও একটি বাংলা গান পাওয়া গেছে। এরূপ পীর-মাহাত্ম্যসূচক ছড়া বা আর্যা, প্রেমসঙ্গীত এবং খনার বচন শ্রেণির দু-একটি বাংলা শ্লোকই এ সময়কার প্রধান রচনা।
২.
আদি-মধ্যযুগ সাধারণভাবে খ্রিস্টীয় ১৩শ-১৪শ শতক পর্যন্ত কাল বাংলাসাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত। এ সময়ের বাংলাসাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে: বৈষ্ণবসাহিত্য, মঙ্গলসাহিত্য এবং অনুবাদসাহিত্য। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগ বলা হয়। বড়– চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যকে বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের প্রথম সাহিত্য নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়। বড়ু চন্ডীদাস (১৪শ শতক) এ সময়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি, যিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়বিষয়ক নাটগীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর আগে কবি জয়দেব সংস্কৃতভাষায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূলক যে গীতিসাহিত্যের প্রবর্তন করেন, চন্ডীদাস সেই ধারাকেই বিকশিত করে তোলেন। বাংলাসাহিত্য মধ্যযুগে প্রবেশ করে বড়– চ-ীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের মাধ্যমে। মধ্যযুগে বাংলা-কবিতার সমৃদ্ধি ঘটে বিচিত্রধারায়। নাথসাহিত্য, ধর্মমঙ্গল, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব-পদাবলী, জীবনীকাব্য, অনুবাদকাব্য, রোমান্সমূলক প্রণয়কথা (কারো কারো মতে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান) প্রভৃতি বিষয়ভাবনা ও রূপবৈচিত্র্যে বাংলা-কবিতার বিকাশ ও উত্তরণে ভূমিকা পালন করেছে। মালাধর বসু সংস্কৃত শ্রীমদ্ভাগবত অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক উপাখ্যান শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এই-কাব্যের জন্য গৌড়েশ্বর তাঁকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি ‘মঙ্গল’ বা ‘বিজয়’ জাতীয় পাঁচালি বা আখ্যানকাব্য হিসেবে পরিচিত; তাই এর অন্য নাম গোবিন্দমঙ্গল বা গোবিন্দবিজয়। এই পাঁচালিকাব্য বাংলার অনুবাদ শাখারও একটি প্রাচীনতম নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন। এ-যুগেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি অনুবাদকাব্যের রচনা শুরু হয়। এ-ব্যাপারে মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ-সময় বাংলাসাহিত্যের বিকাশে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-৩২) এবং সেনাপতি পরাগল খাঁর উৎসাহ ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ব্রজবুলি-ভাষায় বাঙালিদের পদ-রচনার শুরুও এ সময়েই। এ-সময় কবি কঙ্ক সত্যপীরের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় সর্বপ্রথম বিদ্যাসুন্দর কাহিনি রচনা করেন (আনু. ১৫০২)। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবও এ সময়। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত বাংলাভাষায় প্রচার করলে বাংলাসাহিত্যের নতুন দিক উন্মোচিত হয় এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেরও ভিত্তি স্থাপিত হয়।
মধ্য-মধ্যযুগের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যধারা হচ্ছে পদাবলি। এর শুরু চৈতন্যপূর্বযুগেই। রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক এ সাহিত্য ভাব, ভাষা ও ছন্দে অতুলনীয়। এতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মার আত্মীয়রূপে কল্পিত; তাঁর ও ভক্তের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। পরে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এবং চৈতন্যদেবের প্রেমসাধনাকে অবলম্বন করেই বিস্তার লাভ করে মধ্যযুগের পদাবলি বা গীতিকাব্যের ধারা। চৈতন্যদেবের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা পদাবলি সাহিত্য বিশেষভাবে পরিপুষ্ট হয়। অনেকের মতে বাংলাসাহিত্যের প্রকৃত জাগরণ ঘটে এই পদাবলি রচনার মধ্য দিয়েই। কতিপয় মুসলমানসহ অগণিত কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদ রচনা করে বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন,- চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, লোচনদাস, গোবিন্দদাস, কবি বল্লভ রায়শেখর, বলরাম দাস, নরোত্তম দাস, নরহরি দাস, রাধামোহন ঠাকুর প্রমুখ। মিথিলার বিদ্যাপতি ছিলেন চৈতন্যপূর্ব কবি। মৈথিল-ভাষায় রচিত তাঁর পদগুলি পদাবলি সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ। চ-ীদাস ও বিদ্যাপতি পদাবলি সাহিত্যের দুই সেরা কবি। বৈষ্ণবপদাবলি ধারার কবিরা হলেন বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, দ্বিজ চ-ীদাস, দীন চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস। মঙ্গলকাব্য বাংলার নিজস্ব উপাদানে রচিত লৌকিক দেবমাহাত্ম্যমূলক কাহিনিকাব্য। পাঁচালি কিংবা পালার আকারে চৈতন্যপূর্ব যুগেই এগুলি রচিত হয়। মধ্যযুগের কাব্যধারা মনসামঙ্গলের কবিগণ, চ-ীমঙ্গলের কবিগণ, ধর্মমঙ্গলের কবিগণ, কালিকামঙ্গলের কবিগণ নানাভাবে বাংলা-কবিতায় অবদান রেখেছেন। মঙ্গলকাব্যের বিখ্যাত কবিগণ হচ্ছেন কানাহরি দত্ত, নারায়ন দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রীশ্যাম প-িত, ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর, ক্ষেমানন্দ, কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ মাধব, আদি রূপরাম, মানিক রাম, ময়ূর ভট্ট, খেলারাম, রূপরাম, সীতারাম দাস, শ্যামপ-িত, দ্বিজ বংশী দাস, দ্বিজ প্রভারাম। বিদ্যাসুন্দরের পাঁচালিকাব্য অনেকটা রূপক বা আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত। বিদ্যাসুন্দর কাহিনির উৎস কাশ্মীরী পন্ডিত বিহ্লনের (১২শ শতক) চৌরপঞ্চাশৎ বলে অনুমান করা হয়। আঠারো শতকে মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র। তাঁর মাধ্যমে একটা যুগের পরিণতি ঘটেছে। তাঁর প্রধান রচনা অন্নদামঙ্গল আটটি পালায় তিন-খন্ডে বিভক্ত: শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ও মানসিংহ-অন্নপূর্ণামঙ্গল।
মুসলমানরা বাংলাভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। বাংলাসাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান কাহিনিকাব্য বা রোম্যান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধসাহিত্য ছিল মানুষ ও প্রকৃতি প্রধান। হিন্দু রচিত বাংলাসাহিত্যে দেবদেবীরা প্রধান এবং মানুষ অপ্রধান। আবার মুসলিমদের রচিত সাহিত্যে মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। মুসলমান কবিরা কাহিনিকাব্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়মূলক সাহিত্যও রচনা করেছেন; এমনকি চৌতিশা, জ্যোতিষ ও সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্যও তাঁরা রচনা করেছেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে মধ্যযুগের মুসলমান রচিত কাব্যগুলিকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়: কাহিনিকাব্য, ধর্মীয়কাব্য, সংস্কৃতিবিষয়ককাব্য, শোকগাথা, জ্যোতিষশাস্ত্রীয়কাব্য এবং সঙ্গীতশাস্ত্রীয়কাব্য। বাংলাসাহিত্যে মধ্যযুগে মুসলমান রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্যধারা হচ্ছে রোমান্সমূঔশ কাব্য। ইউসুফ-জুলেখা- শাহ মুহম্মদ সগীর, পদ্মাবতী- আলাওল, মধুমালতী- মুহাম্মদ কবীর, সতীময়না-লোরচন্দ্রানী- দৌলত কাজীর, লায়লী-মজনু- দৌলত উজির বাহরাম খা। জীবনীকাব্য, শাক্তপদাবলি, দোভাষী পুঁথি-সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন: বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, রামপ্রসাদ, দাশু রায়, সৈয়দ হামজা, ফকির গরীবুল্লাহ প্রমুখ।
আরাকানে বাংলাসাহিত্য মধ্যযুগের অন্তিমপর্বে বঙ্গদেশের সীমান্তবর্তী স্বাধীন ও অর্ধস্বাধীন রাজাদের রাজসভায় বাংলাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য চর্চা হয়। উত্তরবঙ্গের কামতা-কামরূপের (কোচ-রাজবংশের) রাজসভা, পূর্ববঙ্গের ত্রিপুরা ও আরাকানের (রোসাঙ্গ) রাজসভা এবং পশ্চিমবঙ্গে মল্লভূম-ধলভূমের রাজসভায় বাংলাভাষায় বিবিধ কাব্যধারার সৃষ্টি হয়। এর-মধ্যে আরাকানি ধারা বিশিষ্ট। ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়ার পর থেকে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে আরাকানি রাজগণ বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই বাংলাভাষা ও সাহিত্য উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এর পশ্চাতে সেখানকার বাংলাভাষী সভাসদ ও বিদ্বজ্জনদেরও অবদান ছিল। আরাকান রাজসভাতেই বাংলাভাষার প্রথম মানবীয় প্রণয়কাব্য রচিত হয়। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে তাই আরাকান রাজসভার নাম সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। আরাকান রাজসভার উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় যাঁরা কাব্যচর্চা করেন তাঁদের মধ্যে দৌলত কাজী (আনু. ১৬০০-১৬৩৮) প্রাচীনতম। তাঁর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী প্রথম মানবীয় প্রণয়কাব্য। তিনি এ-কাব্যের রচনা শুরু করেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি; শেষ করেন আলাওল (আনু. ১৬০৭-১৬৮০)। এর মূলকাহিনি আওধী (গোহারি) ভাষায় উত্তর ভারতে প্রচলিত ছিল। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। এতে কবির অসাধারণ কবিত্বশক্তি ও সৌন্দর্যবোধ ফুটে উঠেছে। বৈষ্ণব-পদাবলির ঢঙে তিনি নববর্ষার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা বাংলা ‘বারমাস্যার’ একঘেয়েমির ক্ষেত্রে এক অপূর্ব ব্যতিক্রম। লোকগাথা আঠারো শতকের অন্যতম সাহিত্যধারা। এর প্রধান বিষয় প্রণয়কাহিনি। অধিকাংশ লোকগাথাই ছিল অলিখিত, লোকমুখে প্রচলিত; ফলে সেগুলির ভাব, ভাষা ও উপমায় প্রক্ষেপণ ঘটেছে। উনিশ শতক পর্যন্ত গাথাগুলির প্রায় সবটিতেই নারীর প্রধান ভূমিকা ছিল। এ-ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মৈমনসিংহ-গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকা। গীতিকাগুলির কাল-নির্ণয় দুরূহ। প্রথমটি দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ও দ্বিতীয়টি চন্দ্রকুমার দে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। এগুলিতে পল্লীর লোকজীবন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় বাংলাসাহিত্য শুধু পদ্যেই রচিত হতো।
৩.
উনিশ শতক হচ্ছে বাঙালির নবজাগরণের যুগ। এ-সময় বাঙালি-প্রতিভার সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে এবং জাতি হিসেবে বাঙালির অভ্যুদয়ের সর্ববিধ প্রচেষ্টারও সূত্রপাত ঘটে। এ-যুগেই একটি শক্তিশালী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয়। মধ্য ও আধুনিকযুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন যুগসন্ধি ক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রা ভেঙে প্রবেশ করেন মুক্ত ছন্দে। রচনা করেন সনেট। লাভ করেন আধুনিক কবিতার জনকের খ্যাতি। ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতিকবি ছিলেন ভোরের পাখি নামে খ্যাত বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)। মহিরুহ বৃক্ষের ন্যায় বাংলাসাহিত্যে প্রবেশ করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। উনবিংশ শতকের শুরুতে বাংলায় আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগের সূচনা করেন মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)। উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম কবি হিসেবে কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), কবি জসিম উদ্দিনের (১৯০৩-১৯৭৬) অবদানও অবিস্মরণীয়।
বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপিয়ান শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রভাবে বাঙালি জীবনে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০), হিন্দু কলেজ (১৮১৭), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭) প্রভৃতি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এদেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় প্রথম আধুনিক জীবনের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সর্বাঙ্গীন আধুনিক কবি। বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের হাতে আধুনিক বাংলা-কবিতা আন্তর্জাতিক মান স্পর্শে সক্ষম হয়। কবিতার বিষয় ও রূপ-রীতি উদ্ভাবনে বাঙালি কবিরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা-কবিতা বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে খ্যাতির অনন্য আসনে উপনীত হয়েছে ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। এর-মাধ্যমে বাংলা-কবিতা বিশ্বসাহিত্যের অংশ হয়ে গেল। আনন্দের বিষয় হচ্ছে ১৯৭১ সালে নোবেল কমিটির কাছে বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। তাঁর নামটি প্রস্তাব করেছিলেন কৃষ্ণ কৃপালিনি। সে বছর তারাশঙ্কর নোবেল পাননি, পেয়েছিলেন চিলির কবি পাবলো নেরুদা।
বাংলা-কবিতার এক স্বতন্ত্রধারা বাংলাদেশের কবিতা। অভিন্ন ভাষায় রচিত হলেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে বাংলাদেশের কবিতা পশ্চিম-বাংলার কবিতা থেকে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কবিতা নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষার জন্য রক্তদানের অভিজ্ঞতায় আমাদের কবিতায় যে চেতনা জন্ম নেয় পৃথিবীর কোনো দেশের সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ থেকে এই সমাজ ও তার কবিতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের কবিতায় স্বতন্ত্র ভিত্তি রচিত হয় চল্লিশের দশকে। এ-সময়ে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৬), আবুল হোসেন (১৯২১-), সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আবুল হোসেনের ‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৫), সৈয়দ আলী আহসানের ‘চাহার দরবেশ’ (১৯৪৫), আহসান হাবীরের ‘রাত্রিশেষ’ (১৯৪৭) কাব্যে উপকরণ, জীবন জিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-ভাবনায় যুগান্তকারী বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। এ-সময়ের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, আজীজুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী উল্লেখযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের জীবনচেতনার রূপায়ণে এ-পর্যায়ের কবিতা এক নতুনমাত্রা যোগ করে। ষাটের দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পাশ্চাত্য কবিতার ধ্যান-ধারণার সঙ্গে ব্যক্তি মানসের নিভৃতচারিতা ও রাজনীতি সচেতনতা এঁদের কবিতার স্বভাবধর্ম।
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ-সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ কবির আবির্ভাবে বাংলাদেশের কবিতায় নতুন প্রাণবন্যা সূচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কবিতা যাঁদের সাধনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আবিদ আজাদ, সানাউল হক খান, সাজ্জাদ কাদির, সিকদার আমিনুল হক, আল মুজাহিদী, মাহবুব হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুলাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাংলা কবিতার ইতিহাস হাজার বছরের। এই বাংলা কবিতাই বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসীনে অধিষ্ঠিত করেছে। বাংলাসাহিত্যকে পরিণত করেছে বিশ্বসাহিত্যের অগ্রজ ও উর্বর সাহিত্যধারা হিসেবে। বাংলা কবিতার এই ঋদ্ধ ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের হাত ধরে আরও শাণিত, প্রাণিত ও অনন্য হোক এই প্রত্যাশা রইল।
অমল বড়ুয়া, প্রাবন্ধিক, গবেষক