হানিফ ওয়াহিদ :
রফিক সাহেব ছাতা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, মিতুর মা, আমি একটু রাহেলার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। মিতু কই?
রফিক সাহেবের স্ত্রী পেয়ারা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, মিতু স্কুলে গেছে। গত সপ্তাহেও তো রাহেলার বাড়ি থেকে ঘুরে এলেন, আবার যাবেন যে? বাইরে কী গরম দেখেছেন?
রফিক সাহেব কাঁচুমাচু মুখে বললেন, কী করবো বলো, বোনটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করতেছে।
এই বোনের প্রতি আপনার অনেক টান। আপনার তো আরেকটা বোন আছে। কই, বছরে একবারও তো তার বাড়ি যাবার কথা মনে আনেন না।
রফিক সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। শুধু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
রাহেলা আর ববিতা যখন ছোট তখন রফিক সাহেবের মা বাবা একদিন শহরে এক আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মারা যান। রফিক সাহেব তখন সদ্য বিয়ে করেছেন।
বোন দুটো তখন স্কুলে পড়ে। বাবা মার অভাব ওদেরকে বুঝতে দেন নাই। দুই বোনকে কলেজে লেখাপড়া করিয়েছেন তিনি। তার অবস্থা ততোটা স্বচ্ছল নয়। বাজারে একটা ছোট মুদির দোকান আছে। সেটা দিয়েই সংসার চলে। মা বাবা মারা যাওয়ার পর রফিক সাহেব বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। বোনদুটো ছিল তার চোখের মনি। পেয়ারা বেগমও নিজের মেয়ের মতো করে বোন দুটোকে আগলে রেখেছেন। ওদেরকে কোনো অভাব বুঝতে দেন নাই।
রাহেলা আহামরি সুন্দরী নয়। চেহারা মোটামুটি। গায়ের রং ময়লা বলা যায়। তার বিয়ে হয়েছে গরীব ৃষকের ঘরে। ববিতা নায়িকা ববিতার মতোই সুন্দরী। সে বড়লোক জামাই পেয়েছে। রাহেলার বিয়েতে রফিক সাহেব যা খরচ করেছেন, ববিতার বিয়েতে খরচ করেছেন তার ডাবল।
শত হলেও বড় ঘরে বোনের বিয়ে হচ্ছে। বোনদের সুখই যে তার সুখ।
রাহেলার এক ছেলে এক মেয়ে। মামা অন্তপ্রান। ওদের ওখানে গেলেই মামাকে জড়িয়ে ধরে। এটাওটা আবদার করে। কবিতারও দুই মেয়ে।
রাহেলার শ্বশুরবাড়ির কাছে এসে একটা মুদির দোকানের সামনে গেলেন রফিক সাহেব। ভাগ্নে ভাগ্নির জন্য দুটো চিপস এবং দুই টাকা দামের চারটা চকলেট কিনলেন। তিনি গরীব মানুষ। এরচেয়ে বেশি আর কী কিনবেন? বোনদের বিয়ে দেওয়ার সময় চড়াসুদে ঋণ করেছিলেন, এখনো পুরোপুরি শোধ দিতে পারেন নাই।
মামাকে দেখে বাচ্চারা জড়িয়ে ধরল। চিপস আর চকলেট পেয়ে বেশ খুশি হলো। রাহেলা ভাইয়ের পায়ে সালাম করে বলল, এতো রোদ মাথায় নিয়ে কেন আসতে গেলেন ভাইজান? বিকেলে রোদ পড়লে না হয় আসতেন।
রফিক সাহেব জবাব না দিয়ে ভাগ্নে ভাগ্নিকে জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগলেন। রাহেলা দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ের জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে এনে লজ্জিত গলায় বলল, ভাইজান, ঘরে তো ফ্রিজ নাই, ঠান্ডা পানি দিতে পারি নাই।
রফিক সাহেব হাসতে হাসতে সেই শরবত এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেললেন। রাহেলার চোখে পানি এসে গেল। সে মনে মনে বলল, আমার ভাইটা এতো ভালো কেন? হে আল্লাহ! আমার ভাইকে কোনোদিন কষ্ট দিও না।
রাহেলা দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। ভাইয়ের জন্য রান্না করতে হবে।
রফিক সাহেব হাতমুখ ধুয়ে জোহর নামাজ পড়ে খেতে বসেছেন। আয়োজন সামান্য। পাট শাক ভাজি, আম দিয়ে ডাল আর বেগুন ভর্তা।
রফিক সাহেব তৃপ্তি নিয়ে খেতে বসলেন। রাহেলা পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আয়োজন সামান্য কিন্তু লোকটা কী মজা করেই না খাচ্ছে! রাহেলার চোখে আবারও পানি এসে গেল। আহা! সে দরিদ্র মানুষ। এরচেয়ে ভালো কিছু দেওয়ার সামর্থ্য যে তার নাই!
ভাই যতক্ষণ খেল, রাহেলা ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে এটা ওটা তুলে দিল। সামান্য আয়োজন, দিবেনই বা কী। খাওয়া শেষ হলে নিজে দোকানে গিয়ে ভাইয়ের জন্য একটা খিলি পান নিয়ে এলো। সে পানও সে তৃপ্তি নিয়ে খেলো।
পরে রাহেলা ফ্রেস হয়ে নিজে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ভাইয়ের পায়ের কাছে এসে বসলো। বাচ্চারা তখন মামার কাছে গল্প শুনছে। রাহেলাও মুগ্ধ হয়ে ভাইয়ের গল্প শুনতে লাগল। গল্প শুনতে শুনতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেল।
রাহেলা ভাইকে কিছু বলার জন্য উসখুস করতে লাগল। বিষয়টা রফিক সাহেবের চোখ এড়ালো না। তিনি বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বলবি?
রাহেলা কাচুমাচু গলায় বলল, একটা কথা বলতে চাইছিলাম ভাইজান।
কী বলবি বল, সংকোচ করছিস কেন?
না মানে ভাইজান, দুইদিন আগে ববিতা ফোন করেছিল।
কী বলল ববিতা?
আপনি নাকি এক বছরের বেশি হয় ওদের বাড়ি যান নাই। ববিতার ধারণা, আপনি ববিতাকে পছন্দ করেন না। আপনার সব ভালোবাসা নাকি শুধু আমার জন্য।
রফিক সাহেব জবাব দিলেন না। উদাস হয়ে একদিকে কাত হয়ে রইলেন। রাহেলা বলল, ভাইজান, ববিতা আপনাকে বেশ পছন্দ করে। ফোন দিয়েই আপনার কথা জিগ্যেস করে।
কোনো কারনে কি আপনি তার উপর বিরক্ত?
না রে, বিরক্ত হবো কেন? আমার চোখে তোরা দু’জন সমান। দেখি, আগামী সপ্তাহে একবার ওকে দেখতে যাবো।
ভাইয়ের কথা শুনে বোন বেশ খুশি হলো।
ফিরে আসার সময় রাহেলা ভাইকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো। মিতুর জন্য নিজেদের গাছের কয়েকটা পেয়ারা ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। বাচ্চারাও সাথে এলো মামাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য।
এর এক সপ্তাহ পর তিনি আবার রওনা হলেন ছোটবোনকে দেখতে। মিতুকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল আছে বলে মিতু বাবার সাথে যেতে রাজি হয় নাই। তাছাড়া সে নিজেও ছোট ফুফুদের বাড়ি যেতে পছন্দ করে না। তার সব আবদার বড় ফুফুর কাছে।
পেয়ারা বেগম স্বামীর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন। এতোদিন পর লোকটা ছোটবোনকে দেখতে যাচ্ছে। খালি হাতে গেলে হবে? সাথে তিনি নিজেদের গাছের কয়েকটা পেঁপে একটা ব্যাগে ভরে দিলেন। সাথে দিলেন হাতে বানানো পাটিসাপটা পিঠা। বড়লোকের বাড়ি যাচ্ছেন, অল্প জিনিসে হয়?
রফিক সাহেব মিষ্টির দোকান থেকে এক কেজি মিষ্টি এবং এক হাঁড়ি দই কিনলেন। সাথে নিলেন কয়েকটা চকলেট।
প্রচন্ড রোদ। বোনের বাড়ি যেতে যেতে তিনি নেয়ে ঘেমে গেলেন।
তিনি বাড়িতে ঢুকেই ববিতা ববিতা বলে ডাকতে লাগলেন। ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে বোন অন্যরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর মিষ্টি আর দইয়ের প্যাকেট দেখে বিরক্ত গলায় বলল, এগুলো কী আনছেন ভাইজান? ওরা কি এসব সস্তা জিনিস খায়? ওদের বাবা দামী দামী মিষ্টি কিনে আনে, সেগুলোই তো ফ্রিজে পড়ে থাকে। আর পেঁপে আনছেন কেন? এগুলো কোনো খাবার জিনিস হলো?
রফিক সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, আমি আসবো শুনে রাত জেগে তোর ভাবি পিঠা বানিয়ে দিল,,,
আপনার আক্কেলটা কী বলেন তো ভাইজান? আমাদের এখানে পিঠার দোকান আছে। এখানে কত ভালো ভালো পিঠা বিক্রি করে, মুখে দিলেই গলে যায়। ভাবির হাতে বানানো শক্ত পিঠা বাচ্চারা খেতে পারবে? এখন আর হাতে বানানো পিঠা কেউ খায়? আর আপনি এসব কী জামাকাপড় পরে এসেছেন? এই বাসায় আমার একটা ইজ্জত আছে না?
রফিক সাহেব বোনের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলেন। মনে হল, জিনিসগুলো লুকাতে পারলে বাঁচেন। তিনি পকেট থেকে আর চকলেট বের করতে সাহস পেলেন না। শুধু ম্লান হাসলেন।
তিনি কাঁচুমাচু বললেন, আমার ভাগ্নিরা কই?
ওরা হোমওয়ার্ক করতেছে, আপনি বসেন। এতো ঘামতেছেন কেন? রিকশায় আসেন নাই, নাকি হেঁটে এসেছেন?
ওদের একটু ডাকো। কবে থেকে ওদের দেখি না।
এসেছেন যখন দেখবেন। অস্থির হওয়ার কিছু নাই। আপনি আরাম করে সোফায় বসেন।
রফিক সাহেব অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসতে বসতে বললেন, আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারো ববিতা?
দাঁড়ান পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলেই সে ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর কাজের মেয়ে এক গ্লাস ফ্রিজের ঠান্ডা পানি দিয়ে গেল। তিনি পানি খেয়ে চুপচাপ বসে রইলেন।
অনেকক্ষণ পর পড়া শেষ করে দুই ভাগ্নি মামার কাছে এলো। তিনি পকেট থেকে চকলেট বের করতে সাহস পেলেন না। নিশ্চয় এরা দামী দামী চকলেট খায়। গরীব মামার আনা চকলেট কী ওদের মুখে ঢুকবে? বাচ্চারা মামার সাথে দুই একটা কথা বলেই মোবাইল নিয়ে গেইম খেলতে বসে গেল।
রফিক সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একা একাই চুপচাপ বসে রইলেন। বোন অবশ্য এরমধ্যে দুই একবার এসে ভাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে গেল। জানিয়ে গেল, সে রান্নায় ব্যস্ত।
খেতে বসে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। কী নাই সেখানে? তার পছন্দের সব খাবার রান্না করা হয়েছে। বড় ইলিশ, গরুর কালা ভুনা, মুরগির রোস্ট, রুইমাছ ভাজা, চিংড়ি মাছের দোপেয়াজা। সাথে ধোঁয়া উঠা পোলাও। মিতুকে সাথে আনতে পারলে ভালো হতো। কতদিন হয় মেয়েটা এতো ভালো খাবার খায় নাই।
কাজের মেয়ে বেড়ে দিচ্ছিল। তিনি অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ববিতা কই?
মেয়েটা রোবটের গলায় বলল, ম্যাডাম গোসল করতেছে। আপনি খেতে বসেন।
আমার ভাগ্নিরা কই?
ওরা পরে খাইবো। আপনি খাইয়া ফালান।
বড়ো খাবার টেবিলে খাবারের অভাব নাই। বহুদিন হয় এসব ভালো খাবার তিনি খান নাই। তবুও তার কেন যেনো কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। তার একা একা খেতে ভালো লাগছে না। তিনি মন খারাপ করে বসে রইলেন। কাজের মেয়ে বিরক্ত গলায় বলল, আপনি খাইতেছেন না কেন? খাবার তো ঠান্ডা হইয়া যাইতেছে।
অগত্যা তিনি খেতে শুরু করলেন ।
খাবারের শেষ পর্যায়ে এসে ববিতা বলল, ভাইজান, ঠিকমতো খান না কেন? সবই তো পড়ে রইল। কাজের মেয়েরা রেঁধেছে। রান্না ভালো হয় নাই?
রফিক সাহেব একটা হাসি দিয়ে বললেন, খাবার খুব ভালো হয়েছে। মজা করে খাইতেছি তো। মনে মনে বললেন, বোন রে, এতো এতো দামী খাবার রান্না না করে যদি আলুভর্তা আর ডাইল রান্না করে আমার পাশে বসে তুই খাওয়াতি, বিশ্বাস কর বোন, আমি এরচেয়ে হাজার গুণ বেশি খুশি হতাম। আমি আসলেই যে তুই দামী খাবারের আয়োজন করিস, সেজন্যই ইচ্ছে থাকলেও লজ্জায় তোর বাড়ি আসতে পারি না। যেদিন থেকে আমাকে ডাইল ভাত রান্না করে খাওয়াবি, বিশ্বাস কর বোন, আমি প্রতি সপ্তাহে তোকে দেখতে আসবো। শুধু দামী খাবার খাইয়ে ভাইয়ের মন জয় করবি, এটা তুই ভাবলি কী করে!
খাওয়া শেষ হলে রফিক সাহেব ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলেন। নরম সোফায় বসে তার চোখ বুজে এলো। ববিতা এসে জানিয়ে গেল, বিকেলে একটু না ঘুমিয়ে নিলে তার ভালো লাগে না। তার কিছু লাগলে যেন কাজের মেয়েকে জানায়।
রফিক সাহেব মাথা কাত করে সম্মতি জানালেন।
তার খুবই ইচ্ছে ছিল খাওয়াদাওয়ার পর বোনের সাথে একটু গল্প করবেন। এতোদিন পর এসেছেন। তিনি মন খারাপ করে বসে রইলেন।
আশা করেছিলেন ভাগ্নিরা এসে মামাকে সঙ্গ দিবে। ওরা কেউ এলো না। মায়ের কড়া নির্দেশ আছে, দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিতে।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিকেলে যখন ফেরত আসছেন, বোন তখন গভীর ঘুমে। ভাগ্নিরা টিচারের কাছে পড়তে বসেছে।
স্বামীকে এতো তাড়াতাড়ি ফেরত আসতে দেখে পেয়ারা বেগম বেশ অবাক হলেন। লোকটার তো এতো তাড়াতাড়ি ফেরত আসার কথা না। মিতুও বাবার আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বড়লোক ফুফু বাড়ির গল্প শুনতে চায় সে।
পেয়ারা বেগম অস্থির গলায় বললেন, কী গো, এতোদিন পর বোনের বাড়ি বেড়াতে গেলেন, এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে? ওরা যতœআত্তি ভালো করে নাই?
রফিক সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, নিজের ভাইকে যতœ করে না, এমন বোন কি দুনিয়ায় আছে? ভালোই যতœ করেছে। এতো যতœ করেছে যে আমার সহ্য হচ্ছিল না। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম। বলেই তিনি অন্যদিকে মুখ লুকালেন।
তার চোখে তখন পানি।
হানিফ ওয়াহিদ, কথাসাহিত্যিক