এখন সময়:বিকাল ৩:৪২- আজ: মঙ্গলবার-২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৩:৪২- আজ: মঙ্গলবার
২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম

হোসাইন আনোয়ার

চট্টগ্রাম এর জন্ম চেৎ-ত-গৌঙ্গ থেকে। যার বাংলা অর্থ হলো ‘যুদ্ধ করা অনুচিত।’ এই চে-ত-গৌঙ্গা থেকে চেত্তগৌং, চাটিগ্রাম, চাঁটগা, সবশেষে চট্টগ্রাম। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় চট্টগ্রাম কখনওই কারো কাছেই মাথা নত করেনি। সকল আন্দোলন, সকল সংগ্রাম এই চট্টগ্রাম থেকেই শুরু হয়েছে। প্রথম ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রথম পুস্তিকা ‘‘ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাঙলা না উর্দ্দু।”রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী সম্বলিত এই পুস্তিকাটি প্রকাশের উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রামের অধ্যাপক আবুল কাসেম (পরে অধ্যক্ষ আবুল কাসেম নামে পরিচিত)। তমুদ্দুন মজলিশ ঢাকা থেকে পুস্তিকাটি প্রকাশ করে। পুস্তিকায় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, তৎকালীন ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল মনসুর আহমদ এবং অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখা স্থান পায়। বইটির মুখবন্ধে অধ্যাপক আবুল কাসেম লিখেছেন বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা ও অফিসাদির ভাষা।

প্রতিবাদ মিছিলে প্রথম চট্টগ্রাম: পাকিস্তান হবার পরপরই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বরূপ উম্মোচন করে। হালদা নদীর কাছে মাদারসার টেকে পাকিস্তানের ১ম গণহত্যাটি সংগঠিত হয় এই চট্টগ্রামের বুকে। টেকটি কাটলে স্থানীয় কৃষকদের উপকার হয়, কিন্তু পাকিস্তান সরকার ওটা কিছুতেই কাটতে দেবে না।

 

কৃষকরা একদিন জোর করে কাটতে গেলে পাকিস্তান সরকার গুলি চালায়। আটজন কৃষকের রক্তে রঞ্জিত হয় জনপদ,অগণিত কৃষক গুলিবিদ্ধ হয়। হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম শহরে যে মিছিল বের হয়, সেটিও পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল। অগণিত মানুষ সেদিনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলো। এমনকি তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতারাও সেদিনের মিছিলের অংশগ্রহণ  করেছিলেন। ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের দায়ে স্থানীয় দৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের সম্পাদক প্রকাশক জনাব আবদুস সালামকে অর্থদণ্ডও ভোগ করতে হয়। ততদিনে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়ে গেছে এবং চট্টগ্রামে এম,এ,আজিজ,জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ মুসলিম লীগ কর্মীরা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া শুরু করেছেন।

ভাষা আন্দোলনে প্রথম চট্টগ্রাম: ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন ও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে চট্টগ্রামে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতারা এক গোপন বৈঠকের আয়োজন করেন। ঐ বৈঠকে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অনেক নেতাসহ সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকেও ডাকা হয়। বৈঠকে ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে ব্যাপক আলোচনার পর তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা রফিউদ্দীন সিদ্দিকীকে আহবায়ক এবং মাহবুব-আলম চৌধুরী ও রেল শ্রমিক নেতা মাহবুবল হককে যুগ্ম আহবায়ক করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এই সংগ্রাম কমিটি লালদিঘী ময়দানে জনসভা করবে। সেই সময়ে এ,কে খান ও নূর আহমদ চেয়ারম্যান ছিলেন পাকিস্তান গণ পরিষদ সদস্য। তখন রেল শ্রমিক নেতা মাাহবুবুল হক ও মোসলেম উদ্দিন। সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করতেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষা সংক্রান্ত তার সেই কুখ্যাত ঘোষণা ‘টৎফঁ ংযধষষ নব, রিষষ নব ্ সঁংঃ নব ঃযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ.” ঘোষণাটি দিলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে চট্টগ্রাম। এই ঘোষাণার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম লালদিঘী ময়দানে আরও একটি জনসভা আহবান করা হয়। এই জনসভা সফল করার জন্য ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রচারে নামেন মাহবুবল-উল-আলম চৌধুরী, শহীদ সাবের এবং গোপাল বিশ্বাস। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর গুণ্ডারা উক্ত জনসভায় বাধা প্রদানের কারণে জনসভাটি অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।

এদিকে শহরে ভাষা আন্দোলন বাধাপ্রাপ্ত হলে তা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রামের সকল স্কুল- কলেজের ছাত্র সমাজ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ধর্মঘট পালন করে। হাজার হাজার ছাত্র সেদিন মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তার বেরিয়ে পরে। এই সময়ে পাকিস্তান তমুদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাসেম, রফিকুল্লাহ চৌধুরী এবং আজিজুর রহমান ভাষা আন্দোলনের প্রতি একটা ইতিবাচক ভূমিকায় ছিলেন। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র (পরে এ্যাডভোকেট) ফরমান উল্লাহ খান, অধ্যক্ষ মোঃ ইসহাক, মোঃ সোলায়মান, ডাঃ মাকসুদ, সিএমপি মোঃ ফরিদ, এজহারুল হক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র মাইনুল-হাসান সিদ্দিকী প্রমুখ ছিলেন অন্যতম।

১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান চট্টগ্রাম সফরে এলে. ফরমান উল্লাহ ও মোহাম্মদ ইসহাক শিক্ষামন্ত্রীকে আরবি হরফে বাংলা চালু করার প্রতিবাদে একটা স্মারকলিপি প্রদান করেন। ফলে এই দুজন নেতা চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন এবং ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে মাইনুল হাসান গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লে নির্ধারিত সময়ে তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হন।

১৯৫০ সালে সারা দেশে যখন দাঙ্গার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে তখন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মীরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জে.এম.সেন হল প্রাঙ্গণে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। সমাবেশে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর রফি উদ্দিন সিদ্দিকী, আবদুল হক দোভাষ, অধ্যক্ষ আবু হেনা, যোগেশ সিংহ,আবুল ফজল, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, শওকত ওসমান প্রমুখের নেতৃত্বে এক দীর্ঘ শান্তিমিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের পর খুরশীদ মহলের উপর তলায় আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওখানেই রফিকউদ্দিন সিদ্দিকীকে সভাপতি, মাহবুবল-উল-আলম চৌধুরীকে সম্পাদক এবং চৌধুরী হারুন-অর-রশীদ ও গোপাল বিশ্বাসকে যুগ্ম-সম্পাদক করে একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির দু হাজারের অধিক কর্মী ইউনিফর্মে সজ্জিত হয়ে ড্রাম বাজিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী গান গেয়ে প্রতিদিন সারা শহর প্রদক্ষিণ করতো। গানের নেতৃত্বে থাকতেন মরহুম সাদেক নবী।

এই প্রগতিশীল চেতনার পথ ধরেই ৫০ এর শেষের দিকে প্রান্তিক নব নাট্যসংঘের জন্ম হলো। ঐ বছরই বিশ্বশান্তি পরিষদের শাখা স্থাপিত হলো চট্টগ্রামে। সভাপতি আবদুল হক দোভাষ, সম্পাদক হলেন মাহবুবুল-আলম-চৌধুরী। প্রান্তিক নব্য নাট্য সংঘ ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সারা দেশে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং ৫২-এর মূল ভাষা আন্দোলনের পূর্ব ইতিহাসে এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব পালন করে।

চট্টগ্রামের কম্যুনিস্ট পার্টি তখন সংস্কৃতি বৈঠকের নামের আড়ালে নিজেদের সংগঠিত করেছিলো। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আবার রাষ্ট্রভাষা উর্দ্দু ঘোষণা দিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচী হিসাবে ৫২সালের ২১ ফেব্রুয়ারী সারা দেশজুড়ে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। ৪ ফেব্রুয়ারী আন্দরকিল্লাস্থ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে  প্রথম সর্বদলীয় সভা আহবান করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম.এ.আজিজকে আহবায়ক করা হয়। স্থির হয় আওয়ামী লীগ অফিসেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর থাকবে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা দুআনা একআনা করে চাঁদা তুলে পার্টি অফিসে জমা দিত। সেই পয়সা দিয়ে বাংলা-ইংরেজী ও উর্দ্দুতে পোস্টার লেখা হলো। এবং মাইকিংও করা হতো এই পয়সা দিয়েই। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে প্রচার কাজের জন্য প্রথম বের হন সাংবাদিক ওবায়দুল হক এবং চকবাজারের সাালেহ আহমদ প্রতিদিন সন্ধ্যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে পথসভা হতো,রাতে কর্মীরা পোষ্টার লাগাতো।

তখন তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ছিলেন প্রকৌশলী আজিজুর রহমান। তারাও পৃথকভাবে প্রচারকর্মে অংশ নিতেন। জনমত গঠনে তাদেরও ভূমিকা কম ছিল না। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন চৌধুরী হারুন-অর-রশীদ। যুব বিগ্রেডের কৃষ্ণ গোপাল সেন, তমুদ্দুন মজলিসের রফিকুল্লাহ চৌধুরী, শ্রমিক নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী,ডা. সৈয়দুর রহমান চৌধুরী,আবদুল্লাহ আল হারুন,গাজী ফরিদ, আবদুল হালিম প্রমুখ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

মহিলাদের মধ্যে ছিলেন আরতী দত্ত, মনি ইমাম, ননীবালা বড়ুয়া, রওশন আরা রহমান, ফাতেমা সালামরা প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো ছিলো। যেমন মাদার বাড়ি ক্লাব, নন্দনকানন শক্তি সংঘ, দেওয়ান বাজার অগ্রণী সংঘ প্রভৃতি। সংগ্রাম পরিষদের সর্বশেষ প্রস্তুতি সভা চলাকালীন সময়ে মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়লে হারুন-অর-রশীদ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

২১শে ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। গাড়ি-ঘোড়া,অফিস-আদালত,কল-কারখানা এমনকি রেল চলাচল পর্যন্ত বন্ধ ছিলো। ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিলের পর মিছিল বেরুতে থাকে। সবগুলো মিছিলের গন্তব্যস্থল ছিল পুরনো ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট। একটি মিছিল আসে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা আসেন আবুল ফজলের নেতৃত্বে। রেল শ্রমিকেরা রেল ষ্টেশন থেকে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে সমবেত হন চট্টগ্রাম কলেজ,মেডিক্যাল কলেজ ও বিভিন্ন স্কুলের ছাত্ররাও জঙ্গী মিছিল নিয়ে সমবেত হতে থাকে ওয়াজিউল্লাহ ইনষ্টিটিউটে। এখান থেকে এম.এ.আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে লালদিঘীর দিকে অগ্রসর হন। লালদিঘীতে বিশাল এক সমাবেশে ২২ ফেব্রুয়ারী হরতাল পালনের আহবান জানানো হয় এবং বিকেলে লালদিঘীতে জনসভার কর্মসূচী দেয়া হয়।

এদিকে অসুস্থ মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি জানানো হলে প্রচণ্ড জ্বরের মধ্যেও তিনি উত্তেজনায় ছটফট করছিলেন।

কারণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহবায়ক হিসাবে মূল সংগঠক ছিলেন তিনিই। চট্টগ্রাম ২১ ফেব্রুয়ারীর কর্মসূচীকে কার্যকর করার জন্য দিনরাত সমানে পরিশ্রম করছিলেন যার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এরই মধ্যে ঢাকায় গুলি বর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের খবর তাঁকে উত্তেজিত করে তোলে। জ্বরের মধ্যেই তিনি কবিতা লেখার জন্য কাগজ কলম হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি লিখতে পারেননি তাঁর হাত কাঁপছিল। আবেগে উত্তালে তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন- কবিতার এক একটি চরণ আর তা লিখে যাচ্ছিলেন তাঁরই একজন কর্মচারী ননী ধর। ছাত্র ফেডারেশনের একজন সদস্য মার্কসবাদী, রাজনীতির একজন নিবেদিত কর্মী। যিনি কাজ করতেন খুরশীদ মহলে। খুরশীদ মহল ছিল লালদিঘির পশ্চিমে একটি সিনেমা হল(বর্তমানে এটি একটি বাণিজ্য বিপনি,নাম মহল মার্কেট)। মাহবুব-উল-আলম বলছিলেন আর ননী ধর লিখছেন-

 

কাঁদতে আসিনি

ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি

– মাহবুব-উল-আলম-চৌধুরী

 

ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশী

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে-রমনার রৌদ্র দগ্ধ কৃষ্ণ চূড়ার গাছের তলায়

ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য-বাংলার জন্য।

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে

একটি দেশের মহান সাংস্কৃতিক মর্যাদার জন্য

আলাওলের ঐতিহ্য

কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের

সাহিত্য ও কবিতার জন্য-

যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে

পলাশপুরের মকবুল আহমদের

পুঁথির জন্য-

রমেশ শীলের গাঁথার জন্য

জসীম উদ্দীনের ‘সোজন বাদীয়ার ঘাটের’ জন্য।

যারা প্রাণ দিয়েছে

ভাটিয়ালি,বাউল, কীর্ত্তন, গজল

নজরুলের ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি

আমার দেশের মাটি।’

এ দুটি লাইনের জন্য

দেশের মাটির জন্য

রমনার মাঠের সেই মাটিতে

কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো

চল্লিশটি তাজা প্রাণ, আর

অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে

আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত। (অসমাপ্ত)

 

কবিতাটি শেষ হওয়ার পর মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে দেখতে আসেন খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। একুশের প্রথম কবিতার প্রথম শ্রোতা তিনিই। তার কিছুক্ষণ পর আসেন তৎকালীন চলচ্চিত্র মাসিক উদয়ন পত্রিকার সম্পাদক রহুল আমিন নিজামী, তখনই কবিতাটি মুদ্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুদ্রণের ভার পড়ে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের উপর। যে প্রেসটি এই দুঃসাহসিক কর্মটি সম্পন্ন করেছিলো সেই প্রেসটি হচ্ছে, আন্দরকিল্লায় অবস্থিত এবং মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস।

 

কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের তৎকালীন ম্যানেজার ছিলেন দবির আহমদ চৌধুরী। গভীর রাতে পুলিশ হানা দেয় কোহিনূর প্রেসে। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রেসের কর্মচারীরা কবিতাটি লুকিয়ে ফেলে। তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ যখন খালি হাতে ফিরে যায় কর্মচারীরা পুনরায় শুরু করেন তাঁদের কাজ। দুপুরের মধ্যেই মুদ্রিত ও বাঁধাই হয়ে প্রকাশিত হয়-‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ কবিতাটি।

 

৫২’র ২২শে ফেব্রুয়ারী লালদিঘীর ময়দানে বিশাল জনসভায় কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুন-অর-রশীদ। তাৎক্ষণিকভাবে সরকার কর্তৃক কবিতাটি নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করা হয়। কবিতাটি পাঠের পর লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী,পাঠক চৌধুরী হারুন-অর-রশীদ,কবিতাটি মুদ্রণের জন্য কাগজ সরবাহকারী কামাল উদ্দীন আহমদের নামে হুলিয়া জারী করা হয়। হারুন-অর-রশীদকে এবং পাণ্ডলিপি দেখাতে অসমর্থ হওয়ার কারণে মুদ্রাকর দবির আহমদ চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং দবির আহমদ চৌধুরীকে ছয় মাস জেলও খাটতে হয়েছিল।

 

অমর একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা ভাষা সৈনিক ও বরেণ্য কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। গত ২৩ডিসেম্বর রোববার দুপুর দেড়টায় রাজধানীর উত্তরায় ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

 

সহায়ক গ্রন্থ:(১) হাজার বছরের চট্টগ্রাম (দৈনিক আজাদী ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা), (২) প্রসঙ্গ একুশের প্রথম কবিতা (চৌধুরী জহুরুল হক)

 

হোসাইন আনোয়ার, প্রাবন্ধিক, কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

লাহোর প্রস্তাব বিকৃতির কারণে একাত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে

হোসাইন আনোয়ার ২৩ মার্চ ১৯৪০। পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে ২৩ মার্চের ইতিহাস। একটি ভুল ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালিত হয় সমগ্র পাকিস্তানে।

ইফতার পার্টি নয়, সেদিন যেন তারার হাট বসেছিল পিটস্টপে

রুহু রুহেল সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিচয় সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে সামনের পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। সাম্য সুন্দর স্বদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন বিবিধ মত ও পথকে

নভোচারী সুনিতা মহাকাশে ফুল ফোটায় পৃথিবীতে নারীর পায়ে শেকল পরায় কে?

প্রদীপ খাস্তগীর চমৎকার একটি সফল মহাকাশ সফর শেষ হয়েছে গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে। গত বছরের ৬ জুন মাত্র ৮ দিনের

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: দর্শনের বিজ্ঞান

রাজেশ কান্তি দাশ দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। বস্তুবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন বস্তু থেকে জাগতিক সব কিছুর উৎপত্তি। গ্রীক দার্শনিক

মানুষ ও মঙ্গল মানব

সরকার হুমায়ুন দুজন মহাকাশচারী- একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেলেন। তারা নিরাপদে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। সেখানে তাদেরকে অতিথি হিসেবে মঙ্গলবাসীরা সাদরে