সৌভিক চৌধুরী
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি
এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে
আমি তাদের ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি
(কাঁদতে আসিনি , ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি)
ঐতিহাসিক এই কবিতার কিছু অংশ দিয়ে আমরা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে (১৯২৭-২০০৭) চিনতে পারি। মর্মস্পর্শী এবং প্রতিবাদী এই কবিতা সময়কে নাড়া দিয়েছিলো, কাঁপিয়ে তুলেছিলো স্বৈরাচারের ভিত। তাঁর এই কবিতা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য ঐতিহাসিক আখ্যান হয়ে আছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, ‘দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয় না সকল সাহিত্য কর্মের। এই কবিতাটির তা হয়েছিলো। বাজেয়াপ্ত হলেও হাতে হাতে কবিতাটি পূর্ব বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো। একুশের প্রথম কবিতা তিনি যে লিখলেন, তা হয়তো এক আকস্মিক ঐতিহাসিক ঘটনা কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কবিতা তাঁকে লিখতেই হতো, তাঁর জীবনাচরণ ও সাহিত্যচর্চার ধারায় যা ছিল অনিবার্য । নিতান্ত অল্প বয়সে রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে তিনি মিলিয়েছিলেন একই স্রোতে’।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী মূলত কবি। তাঁর কবিত্বের আসল পরিচয় নিহিত ছিলো একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতায়। এর মাধ্যমে তিনি জীবনব্যাপী ইতিহাসখ্যাত কবি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর কবিত্বশক্তি প্রকাশিত হয়েছিলো অসংখ্য কবিতার মাধ্যমে। জীবদ্দশায় তাঁর ৭ টি এবং মৃত্যুর পর ৩ টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিলো। এ ছাড়া লিখেছিলেন ৩ টি নাটক, ৪ টি প্রবন্ধের বই এবং ১ টি উপন্যাস। মানবতার জন্য সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম , মানুষের সমঅধিকারের সংগ্রাম, এসব যেন সর্বদা সক্রিয় থাকে, এ প্রার্থনা তিনি সবসময় করতেন। বলতেন, ‘মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রেম প্রীতি, ভালোবাসা সবকিছুই বিলীন হয়ে যাবে। তাই মানুষের জন্য আমার যুদ্ধ অনন্তকাল ধরে চলবে।’ তাইতো তিনি ‘আবার এসেছি’ কবিতার মাধ্যমে ফিরে এসেছেন মানুষের মাঝে । প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ নিয়ে তিনি দুঃখী মানুষের সাথে , বেদনাহত মানুষের সাথে সমব্যথী হয়েছেন । ‘
এখনো দাঁড়াতে পারি
লক্ষ জনের সামনে ,
নির্ভয়ে বলতে পারি
বন্ধুরা , আমি এসেছি
নিদ্রা ভেঙে আমি আবার এসেছি ।বন্ধুরা আর কান্না নয়
ফাঁসির দাবীও নয়
এখন সরাসরি যুদ্ধ
নির্যাতনের কঠিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার যুদ্ধ । ‘
‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি ‘ নামে যে প্রথম কাব্যগ্রন্থটি বেরিয়েছিল তাতে ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দেশাত্মবোধক সংগ্রামী চেতনার বেশ কিছু কবিতা প্ত্রস্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের সৃষ্টিকর্ম কবির মনকে দোলায়িত করেছিলো বিভিন্ন দ্যোতনায় । তাঁদের দর্শন মানবজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পাথেয় হয়েছিলো, যা যুগ যুগ ধরে চলমান।১৯৫০ এ লেখা ‘নজরুলের উদ্দেশে ‘ কবিতায় তিনি লিখেন ‘ কী ভীষণ পণ তুমি করিয়াছ ওগো মৌনব্রতী / কোন মহাবাণী শোনাবার তরে / মনে মনে চলিতেছে আগ্নেয় প্রস্তুতি / পিঙ্গল পালক পুটে দিকে দিকে আকাশ বিহারী শঙ্খচিল। বহু দুঃখ বেদনায় জীবনের বৈচিত্র্য আজ হয়েছে শিথিল। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি ‘কবিতা তাঁকে নিয়ে গেছে চেতনার প্রচন্ড গভীরে ‘জীবনে প্রথম আমি তিলোত্তমা মানসীকে করেছি রচনা / তুমি তাই মিশে আছো জীবনের যন্ত্রণাকে ঘিরে / হৃদয়ের মর্মমূলে, আমাদের চেতনার প্রচন্ড গভীরে। ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতার বিষয় মুখ্যত স্বদেশ, গৌণত প্রেম। প্রেমের কবিতা কখনো কখনো স্বদেশের কবিতা হয়ে ওঠে, স্বদেশ বিষয়ক কবিতা প্রায়ই সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের কবিতায় পরিণত হয়। একই গ্রন্থের ‘প্রিয়তমাষু’ কবিতায় তিনি বলছেন ‘ কামনা করিনি কভু উষ্ণবক্ষ প্রেয়সীর গাঢ় আলিঙ্গন / কাঁঠালিচাপার গন্ধ মুক্তপক্ষ পাখিদের গান/ আমি বুঝি চাই নাই প্রিয়ার চুলের ছায়া বুকের বিশ্রাম/ প্রতিদিন ঘরে এসে কর্মশেষ মুহূর্তের দাম।‘ কবি দুরন্ত সৈনিক হতে চেয়েছেন, আরণ্যক পথ অতিক্রম করার জন্য নতুন সূর্যের প্রতীক্ষায় আছেন তিনি । ‘ আমি এক দুরন্ত সৈনিক ‘কবিতাটি সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষায় কবির এগিয়ে চলার প্রত্যয়, যেখানে তিনি লিখেন ‘কাল রাত্রির কন্টকাচ্ছন্ন দুর্গম পথের অন্ধকার ঢেকে ঢেকে এগিয়ে চলেছি/ চরণ চিহ্ন এঁকে এঁকে সর্ব শরীরে লালক্ষত আঁকা দুর্জয় নির্ভীক পীড়িত মানবতার স্বপ্নে বিভোর আমি এক দুরন্ত সৈনিক।
‘সূর্যাস্তের রক্তরাগ’ কবিতা গ্রন্থের একটি দীর্ঘ কবিতার কথা বলতে পারি, যার শিরোনাম ‘যেখানে আমি লড়াই করছি‘ । জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাঙালীর সংগ্রামের ইতিহাসের এক অপূর্ব কাহিনি বলেছেন তিনি। দীর্ঘ সংগ্রামের ইতি টানার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের অস্ত্রকে ফুল হয়ে প্রকাশিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ৫২‘র ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যুদয়ের কথা, সব ইতিহাসই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে এ কবিতায়। কবিতাটির কিছু অংশ তুলে ধরা যায় এখানে,
আমি বিশাল জন সমুদ্রে এসে গেলাম
মানুষের প্রতিটি মাথা আমার কাছে
মনে হলো এক একটি ফুল
আমি মানুষের কথা বললাম
উদ্বাস্তুর কথা বললাম
আমি তেতাল্লিশের আঁকা শিল্পী জয়নুল আবেদিনের
মহা মন্বন্তরের ছবিগুলো তুলে আনলাম
আমি জানি যুদ্ধ একদিন শেষ হবে
বিজয়ের শেষে কবরে শ্মশানে
আবার ফুল ফুটবে
মানুষ আবার ফুলের দিকে তাকাবে
যুদ্ধের প্রতিটি অস্ত্র হয়ে উঠবে
এক একটি ফুল ।
সাহসের প্রতি কবির আগ্রহ চিরদিনের। সাহসকে তিনি নিজের জীবনের সঙ্গী করেছিলেন। কিন্তু এই সাহসহীনতা কবিকে কতটুকু ভোগায় তার বর্ণনা তিনি নিজেই দিয়েছেন ‘সাহস ফুরিয়ে গেলে’ কবিতায়। প্রতিবাদী কবি জীবনের পরতে পরতে সাহসী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেছেন। কখনো তাঁর মনে হয়েছে সাহসের অভাব জীবনকে মলিন করে দেয়। কবি তাই বলতে চেয়েছেন , নিস্প্রভ জীবন থেকে ফিরে আসার জন্য সাহসের বিকল্প নেই। ‘সাহস ফুরিয়ে গেলে জীবনের থেকে কি থাকে আর বলো / দেহ প্রেম ভালবাসা অপ্রেমে অস্থির হয়ে / ঝরে পড়ে একে একে / সাহস ফুরিয়ে গেলে / যৌবনের সকল বিদ্রোহ / সূর্যাস্ত হয়ে পড়ে বিবর্ণ মলিন। ‘তাই সাহসকে জীবনের সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হয়।
ছোট কাগজ ‘সীমান্ত’ সম্পাদনাকালে তিনি আলমগীর, মোহাম্মদ শাহেদউদ্দিন, প্রাথমিকা প্রামাণিক, সবুজ চৌধুরী ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত এই ‘সীমান্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বেশিরভাগ কবিতায় স্বদেশভাবনা ও সংগ্রামী চেতনা ফুটে উঠেছে। নির্যাতিত মানুষের বেদনা আর দেশত্যাগের করুণ দৃশ্য তাঁর কবিতায় প্রতিভাত। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ কবিতার কথা বলা যায়। ভিটেমাটি বিহীন নিষ্পেষিত মানুষের আর্তি , দেশত্যাগের অনাকক্সিক্ষত অবস্থার কথা কবিতায় এসেছে। এ যেন এক বঞ্চনার বয়ান। স্বৈরাচারী শাসকের নিষ্পেষণে লাঙ্গল ও জমির ফসল কিংবা খেলার পুতুল ফেলে উদ্বাস্তু হওয়ার করুণ দৃশ্য দেখা যায়।
এই ভিটে মাটি তোমাদের তরে রেখে গেলাম
রেখে গেলাম, ছোট ছোট অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন
অনেক দীর্ঘশ্বাস।
বড় আদরের লাঙ্গলটিরেও রেখে গেলাম
কাস্তে খানাও তোমাদের হাতে দিয়ে গেলাম
এই লাঙ্গল, কাস্তে ,বলদ জোড়া
তোমাদের হাতে দিয়ে গেলাম, দিয়ে গেলাম।
তেমনি এক বিচ্ছেদের বেদনা ফুটে ওঠে ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতায়। ২৫ শে বৈশাখের রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিনে বন্ধুদের মিলন মেলার সুখস্মৃতি কবি উল্লেখ করেছেন এই কবিতায়। কিন্তু বিদেশি শয়তানদের প্রভাবে একসময় সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বন্ধুদের এই বিচ্ছিন্নতা কবি মেনে নিতে পারেন নি। মেনে নিতে পারেননি বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ। প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে কবি তাই আবারো বন্ধুদের কাছে ফিরে যেতে চান।
গত বছর ঠিক এমনি দিনে
এইখানে আমরা পচিশে বৈশাখের
আয়োজন করেছিলাম
বিদেশী শয়তানের অপ কৌশলে
হিন্দু মুসলমানের যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল
আমার ও তোমার মনে, বাঙালীর মনে
সেই প্রশ্নের সমাধি রচনা করেছিলাম
এইখানে আবার আমরা
পঁচিশে বৈশাখের আয়োজন করব
আবার গান গাইব, জীর্ণ যা কিছু মলিন
পুরানোর সাথে হউক তা বিলীন, আবার বাঁশী বাজাবো,
মঞ্চ সাজাবো, উৎসব মুখর করে তুলব নতুন বাংলাকে।
প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ প্রতিটি কবিরই থাকে। এক্ষেত্রে কবির অন্তরে প্রকৃতির অনুভবের কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি ‘সূর্যের ভোর’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা ‘সবুজ মাটির টানে’ কবিতাটিতে। মাটিকে তিনি সবুজ অনুভবে কাছে টেনেছেন। তাঁর প্রিয় ফুল ম্যাগনোলিয়া , যার পরশে তিনি প্রেমিক হয়ে ওঠেন। সমস্ত ফুলের মায়াবী ছোঁয়ায় তিনি যেন এক স্বর্গের ছোঁয়া পান।
আমাদেরকেও আরো হাজার হাজার
ফুলের চারা লাগাতে হবে
আরো বেশি করে লাগাতে হবে
যেন তার আলোতে
পৃথিবী আলোকিত হয়ে ওঠে,
মানুষ স্বর্গের সন্ধান পায়
তারা খুনের বদলে যেন
ফুলের দিকে তাকায়।
বিপ্লবী আদর্শে উজ্জীবিত কবি মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপোষহীন। তিনি জনতার লড়াইকে ছোট করে দেখেননি কখনো। মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই করে যায়, এ লড়াই তো কবির নিজস্ব লড়াই। তাই তো তিনি একাত্ম হয়েছেন তাদের সাথে । কবির একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আমি যদি চলে যাই, বন্ধ করো না লড়াই’
আমি যদি চলে যাই ,
বন্ধ করো না লড়াই
মনে করো ,
আমি তোমাদের সাথে আছি,
তোমাদের সাথে মরি বাঁচি
তোমাদের সাথে আকাশে মাটিতে
শত্রু ঘাঁটিতে যুদ্ধ চালাই।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী এমন একটি সময়ে কাব্য সাধনায় এসেছেন, যখন এই বাংলার জনগণ মুক্তির জন্য সংগ্রামী যুদ্ধে অবতীর্ণ। তাঁর সমকালীন সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন প্রতিবাদী চেতনায়। তিনি তাঁর সেই সময়ের মুহূর্তগুলো কবিতায় মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁর কবিতা সংগ্রাম, প্রতিরোধ, দেশপ্রেম আর প্রেমের যুগল সম্মিলন। তার রচিত প্রতিটি কবিতাই কথা বলে মানুষ, সংগ্রাম আর মুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে। কবিতা দিয়ে মানুষের দাবিকে যে উচ্চকিত করা যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন। কবি পৃথিবীর সৌন্দর্যে মোহিত। পৃথিবীর মাটি, সমুদ্র, পাহাড়, ফুল, বৃক্ষ তাঁকে টানে। তাঁকে টানে তাঁর প্রথম প্রেয়সী। সবকিছু ফেলে কবিকে প্রস্থান করতে হবে, কিন্তু তিনি কাউকে অশ্রুবিন্দু ফেলতে বারণ করেছেন। কারণ তাঁর কাছে মনে হয়েছে তাঁর কথা মনে করে এই পৃথিবীর সৌন্দর্যকে যেন আমরা অস্বীকার না করি। কবি তাঁর প্রেয়সীর কথা, তাঁর প্রথম প্রেমের পঞ্চশিখা, হৃদয়ের গভীর টানে তিনি যাকে সাথী করেছিলেন, তার হৃদয়মথিত কবিতা ‘পঞ্চশিখা’ ফিরে দেখা কৈশোরের নিবিড় ভাবনা। কবির প্রেমের অনুভব কখনো বিলীন হয়নি। তিনি তাই অনুভব করেন তাঁর প্রথম প্রেয়সীর কথা। বেদনাভরা হৃদয়ে প্রকাশ করেন তাঁর পংক্তিমালা, ‘সবি আছে মনের গভীরে / শুধু তুমি নেই/ তুমি আছ দূর আকাশে / চাঁদের আলোয় মিশে, নিঃশেষে / চলে গেছ তুমি / এখন আকাশ জুড়ে আলোয় ভরা / তোমার নামটি লিখা / হে আমার প্রেয়সী / চিরকালের বন্ধু / প্রিয় পঞ্চশিখা।’
এখানেই শেষ নয়, তাঁর বোধ এবং চেতনার অনেকটাই উৎসারিত হয়েছিলো ভালোবাসার জগতকে নিয়ে। তাঁর প্রেমিক হৃদয় আকাক্সক্ষার সমুদ্রে ডুবে যায় কোনো এক প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। কবিতার মধ্যে নীরবে কবি স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন তাঁর প্রথম প্রেয়সী ‘শিখার’ ভাবনায়। ‘রক্তকমল’ ‘কবিতায় তিনি শিখাকে খুঁজে বেড়ান আনন্দময়তার আবরনে।’ তবু তোমাকে কাছে না পেলে/হৃদয়ের স্মৃতিময় রক্তকমল / মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে / মনে হয় কোথাও সে আছে / তোমার মধ্যে খুঁজতে থাকি তাকে/ তুমি এলে বেদনায় আনন্দময় হয়ে ওঠে/ তারই খোঁজে। শিখার খোঁজে। ‘আকাশের সব তারা’ কবিতার ছত্রে তিনি তেমনি দেখেন শিখাকে,তারার মালা গেঁথে, আকাশের সব তারাকে নিজের কাছে এনে কবি যেন উদ্বেলিত অশ্রুসজল হয়ে প্রতীক্ষা করছেন।
যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছি
আকাশের সব তারা
ঘরে এনে রেখেছি
তোমাকে দেব বলে
তারার মালা গেঁথেছি
কেন তুমি
আমার সে মালা
পা দিয়ে মাড়ালে
কেন পিছন ফিরে তাকালে
অকারণে আমাকে কাঁদালে ।
কবি হৃদয় প্রেমের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ । অনুভূতিপ্রবণ কবি তাঁর প্রেয়সীর প্রশ্রয়ে দিতে পারেন প্রেমের সংলাপ কিংবা দূর করতে পারেন অন্ধকার কিংবা প্রেমের অসুখ। ‘তোমার প্রশ্রয় পেলে ‘কবিতায় তেমনি এক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে ,
তোমার প্রশ্রয় পেলে
আমিও হতে পারি এক রাশ রজনীগন্ধা
এক গুচ্ছ রঙিন গোলাপ।
তোমার নিভৃত বুকের ছায়ায় স্থান পেলে
আমি অনায়াসে হতে পারি
পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কোন প্রেমের সংলাপ।
কবি জীবনসায়াহ্নে তাঁর বিপ্লবী চেতনা থেকে সরে এসে প্রেমের কবিতা লেখার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। মৃত্যুর পর ২০০৮ সালে কবিতার যে বই বেরিয়েছিলো ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে’ তাতে এই অনুভূতির প্রতিফলন দেখা যায়। কবিরা প্রেমিক হয়ে ওঠেন। এ প্রেমিক হওয়ার পেছনে আবেগ কাজ করে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী শুধুমাত্র একজন বিপ্লবী কবিই ছিলেন না, তিনি আবেগের ঝর্নাধারায় স্নাত হয়ে প্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন। কবি হৃদয় প্রেমের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ। অনুভূতিপ্রবণ কবি তাঁর প্রেয়সীর প্রশ্রয়ে দিতে পারেন প্রেমের সংলাপ কিংবা দূর করতে পারেন অন্ধকার কিংবা প্রেমের অসুখ। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে’ কিছু প্রেমের কবিতায় সিক্ত হয়েছে। গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় বেদনা কিংবা আকুতির ব্যাপারগুলো ফুটে উঠেছে । বেশ কিছু কবিতা যেমন ‘আকাশের সব তারা’, ‘আমি কবি হয়ে উঠি, তোমার আসার আশায়, তোমার চুলের অবাধ্যতা, এগুলোতে রয়েছে প্রেয়সীর জন্য প্রতীক্ষা, নিবিড় আকুলতা, ভালোবাসার কথা বলার জন্যে ব্যাকুলতা । অত্যন্ত আবেগী ‘তোমার আসার আশায়’ কবিতাটিতে প্রেমিকার প্রস্থানে কবি ব্যথিত চিত্তে তার আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন।
কবির চলে যাওয়া কখনো নিরর্থক হয় না। কবি মনে করেন, সবকিছুই যেন তার নিয়মমতো চলে। ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে’ কাব্য গ্রন্থের ‘শুধু আমি থাকবো না’ কবিতায় তিনি তাঁর বেদনার কথা ব্যক্ত করেছেন। বসন্ত যেভাবে আসার কথা ছিলো সে তো আসবেই, যে ফুল ফোঁটার কথা ছিলো সে ফুটবেই, শ্রাবণের ধারাও নিয়মমতো চলে আসবে, শুধু কবিই থাকবেন না। কবি মালা গেঁথে কারো প্রতীক্ষায় থাকবেন না। একজন বিপ্লবী কবিরও চেতনায় রয়েছে প্রেম আর প্রতীক্ষা। ইহজগতে তিনি পরলোক সম্মন্ধে সজাগ, না থাকার বেদনায় ক্লিষ্ট। তিনি যা বুঝিয়ে গেছেন, তাঁর ভেতরে এসব কষ্ট থেকে তিনি মুক্তি পেতে চেয়েছেন। তিনি বলছেন ‘আমি চলে গেলে / শীতের গোলাপে বিন্দু বিন্দু শিশির জমবে/ আমি চলে গেলে / জুঁইয়ের লতায় অসংখ্য জুঁই ভোরে ঝরবে নরম গন্ধ ঢেউয়ে / শুধু আমি থাকবো না / তার মালা গেঁথে / তোমার জন্য প্রতীক্ষায়।‘
গ্রন্থের পরিশেষে দশটি গুচ্ছ কবিতার প্রতিটিই যেন জীবন্ত ভালোবাসার কথা বলে। অত্যন্ত সহজ, সরল ভাষায় কবির বক্তব্য ফুটে উঠেছে কবিতাগুলোতে।
একুশের প্রথম কবিতার মাধ্যমে যার কবিত্ব শক্তির প্রকাশ, জীবনব্যপী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর প্রতিবাদী চেতনা সর্বদাই কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। একাত্তর পূর্ব সময়গুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে তিনি জেগে ছিলেন প্রতিনিয়ত, সেই সাথে ছিলো তাঁর লেখনী, বলা যায় কবিতায় শক্তিমান ছিলেন তিনি। মূলত মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিত বাংলার মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশে তাঁর কবিতাই ছিল হাতিয়ার। একাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর কবিতায় নিয়ে আসেন রোমান্টিকতা, প্রেমের চেতনা এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ কবিতাই এভাবে এগিয়ে চলে। আজীবন দেশাত্মবোধে উদ্দিপ্ত, প্রগতিবাদী এই কবি তাঁর কাব্য সাধনা করেছেন মানুষ আর স্বদেশ নিয়ে, তাই কবিতার জগতে মাহবুব উল আলম চৌধুরী সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
সৌভিক চৌধুরী, বাচিক শিল্পী, প্রাবন্ধিক