হানিফ ওয়াহিদ:
আমি নিচতলায় বউয়ের জন্য আন্ডারগার্মেন্টস দেখছি। তিনজন মহিলা পুলিশ সেখানে ঢুকলো। একজন মনে হলো অফিসার পর্যায়ের। তারা ঢুকেই লেডিস ব্যাগ দেখতে লাগলো।একজন সেলসম্যান তাদের দিকে দৌড়ে গেল।
আমি লক্ষ করলাম, অফিসার বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকালেই চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে!
ব্যাপারটা কী, মহিলা অফিসার বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে কেন? বউয়ের জন্য আন্ডারগার্মেনস কেনা কী অপরাধ? প্রেমিকার জন্য কিনলে না হয়,,, আচ্ছা, আমাকে দেখতে কি চোর চোর লাগছে? পুলিশ আমাকে চোর ভেবে সন্দেহ করছে না তো!
আমি একমনে আন্ডারগার্মেনস দেখছি, মহিলা আমাকে ফলো করছে!
আমার মধ্যে অস্বস্তি শুরু হলো। আমার মধ্যে যখন অস্বস্তি বা ভয় কাজ করে, প্রচ- প্র¯্রাবের বেগ হয়। এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। এখনো তাই হলো। আমি হেঁটে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
ইচ্ছা করেই ওয়াশরুমে একটু দেরী করলাম।অনাহুত পায়চারী করলাম, যাতে আবার দেখা হয়ে না যায়।
লে হালুয়া! ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই দেখি, সামনেই সেই তিন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে! অফিসার আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে! ব্যাপার বুঝলাম না, এরা আমাকে ফলো করছে কেন? গ্রেফতার করবে নাকি?
বুঝার চেষ্টা করলাম, অদূর ভবিষ্যতে কারও সাথে কোনো অন্যায় করেছি কি-না! বউকে কী জোরে ধমক মেরেছি? বউ কি নালিশ করেছে? শেষমেশ মহিলা পুলিশের কাছে গ্রেফতার হবো! হায় আল্লাহ!!
কিছুই বুঝতে পারছি না।
পুলিশ দেখলে এমনিতেই আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। এবার বোধহয় হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে! আমি জানি, বউ ছুঁইলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁইলে ছত্রিশ ঘা!!
অফিসার আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি মোটামোটি একটা দৌড় দেওয়ার প্ল্যান করে ফেলেছি। আরেকটু সামনে এগুলেই
এই দাঁড়াও, তুমি কী হানিফ?
মহিলার বাজখাঁই আওয়াজ শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। মনে মনে বললাম, এই সেরেছে রে! আমার নামও জানে দেখছি!
আমি আমতা আমতা করে বললাম, কোন হানিফের কথা বলছেন, ম্যাডাম! নাম ঠিকানা কী? আমি তো এই নামে কাউকে চিনিও না! আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।
তুমি নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে পড়তে না? মিথ্যা কথা বলছো কেন? আমাকে চিনতে পারো নি?
ম্যাডাম, আপনাকে কি আমার চিনতে পারার কথা?
অবশ্যই চিনতে পারার কথা। আমার মতো পুলিশ অফিসারকে না চিনলে তো, রীতিমতো আমার অপমান!
আমাকে মাফ করে দিন, প্লিজ! আমি যাই,,,
একদম যাবে না। পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না। আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। তুমি আগের মতোই ভীতু আছো। আমি ছন্দা!
আমি ছন্দা মন্দা নামের কাউকেই চিনি না,ম্যাডাম। আমি আপনার সাথে কোনো অপরাধ করি নি। অন্য কেউ হয়তো করছে।
ছন্দা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, আমাকে চিনতে পারছো না কেন? আমি টমবয় ছন্দা! এ কী অবস্থা তোমার? চুলটুল পেকে একশেষ! ভুঁড়িও তো মাশাল্লাহ ভালোই বানিয়েছো! বউ বুঝি আদর করে বেশি খাওয়ায়?
এবার আমি চিনে ফেললাম।
আমি ইয়াহু! বলে একটা চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। মুখ ফুটে শুধু একটা শব্দ বেরিয়ে এলো,ছন্দা, তুই?
চিনতে পারছিস তাহলে? বাপ রে! যে ভয় পাইছিলি!
আমি তোকে চিনতে পারি নি, এই অপরাধে আমাকে একটা উষ্ঠা দে!
ছন্দা ফিক করে হেসে ফেললো। আমার মনে হলো,ছন্দার হাসিটা আগের মতোই সুন্দর!
এসএসসি পাশ করার পর আমি কেরানীগন্জ থেকে চলে গেলাম নারায়নগন্জ। সেখানে আমার নানাবাড়ি। ভর্তি হলাম সরকারি তোলারাম কলেজে।
আমার এক মামা আলাদা বাড়ি করেছেন। তিনি দেশে থাকেন না। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। মেয়ে দুইজনের একজন ক্লাস নাইন, আরেকজন ক্লাস এইটের ছাত্রী। দুজনেই বেশ সুন্দরী। মামি আমাকে নিয়ে গেলেন তার বাসায়, গৃহশিক্ষক প্লাস মামাতো বোনদের বডিগার্ড হিসেবে।
মামি আমাকে বেশ পছন্দ করেন, তার মনের ইচ্ছা, তিনি আমাকে তার মেয়ের জামাই বানাবেন। এই নিয়ে টুকটাক দুই পরিবারে কথাও হয়েছে, মামাও আমাকে বেশ পছন্দ করেন। আমার মা এতে নিমরাজি।
আমি কলেজের পাশাপাশি স্বরলিপি সংগীত একাডেমিতে ভর্তি হলাম।সপ্তাহে তিনদিন গানের ক্লাস। আমাদের ব্যাচে ছাত্রছাত্রী সব মিলিয়ে বিশ পঁচিশজন হবে।
ছন্দাও আমার সাথে গান শিখতো। ওর সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। নানাবাড়ি গেলেই ওর সাথে দেখা হতো।আমার অন্য এক মামাতো বোনের বান্ধবী। মেয়েদের মধ্যে ছন্দা এবং ছেলেদের মধ্যে আমি ভালো করছিলাম। গানের শিক্ষকের বেশ প্রশংসা পাচ্ছিলাম। কোন অনুষ্ঠান হলে আমরা ডুয়েট গান করতাম।
ছন্দা এবং আমি একই এলাকায় থাকি, ও নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আমি সেকেন্ড ইয়ার।যেহেতু মহিলা কলেজ এবং তোলারাম কলেজ কাছাকাছি, প্রায়শই আমরা একসাথে কলেজে যেতাম। গানের ক্লাস থেকেও আমরা প্রায়শ একই সাথে ফিরতাম।
ছন্দা ছিলো শ্যামলা গড়নের। হাইট প্রায় আমার কাছাকাছি। শরীরের গঠন বেশ সুন্দর। যা পরতো, মানিয়ে যেতো। সব সময় মাথায় একটা ক্যাপ পরে থাকতো। সাহস ছিলো দুর্দান্ত। আমি ওকে টমবয় বলতাম।
অনেক ছেলে ছন্দার পিছনে লাগতো, কাউকে পাত্তা দিতো না। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলে ঘুষি বাগিয়ে দৌড়ে যেতো। ফলে, আমরা সবাই ওকে ভয় করতাম। কোন এক বিচিত্র কারনে ছন্দা আমাকে বেশ পছন্দ করতো। এটা ভালবাসা নয়। হয়তো ভালো ছাত্র ছিলাম, এটা কারন হতে পারে।
আমি ছিলাম একেবারেই ভীতু টাইপ একজন মানুষ। কেউ জোরে ধমক দিলে মুতে দেই,এই টাইপ অবস্থা! সেই আমি কিনা সুন্দরী মামাতো বোনদের বডিগার্ড!!
তখন বিটিভিতে দলীয় সংগীত হতো। আমাদের দল দলীয় সংগীতে বিটিভিতে চান্স পেলো। বলা হলো,প্রতি ছাত্রছাত্রীকে পাঁচশো টাকা করে চাঁদা দিতে হবে, বিটিভিতে যাওয়া আসার খরচ প্লাস একবেলা খাওয়া বাবদ। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো টাকা উঠানোর।
আমি একটা কাগজে ছাত্রছাত্রীদের তালিকা তৈরী করলাম। যারা টাকা দিচ্ছে, তাদের নাম তালিকায় তুলছি। একদিন আমি আর ছন্দা গানের ক্লাস থেকে ফিরছি, ওদের বাড়ির কাছাকাছি আসার পর,কারা কারা টাকা জমা দিয়েছে তার তালিকা জানতে চাইলো। আমি পকেট থেকে কাগজটা বের করে পড়তে দিলাম। ছন্দা ওটা পড়ে আমাকে ফেরত দিয়ে চলে গেলো।
ছন্দা চলে যাওয়ার পর একা একা হেঁটে বাসায় ফিরছি, হঠাৎ কে যেন পিছনে থেকে আমার শার্টের কলার চেপে ধরে বাজখাঁই গলায় বললো, শালার পো,তোর সাহস তো কম না! তুই আমার বোন রে চিঠি দিছস!!
আমি অতি কষ্টে পিছনে ঘুরে দেখি, প্রায় আমারই বয়সী একজন আমার শার্টের কলার চেপে ধরে আছে। আমি যদি পাতলু হই,সে তবে মটু!
তাকে দেখে আমার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো। তাকে আমি প্রায়ই আমাদের বাসার সামনের ক্লাবে দেখি,চেয়ারে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। কখনো বা ক্যারাম বোর্ড খেলছে,চা খাচ্ছে। ওর মাথায় সব সময় ক্যাপ পরা দেখি। এই শালারা কী টমবয় ফ্যামিলি!
এই ষন্ডাটা তাহলে ছন্দার ভাই!
আমার হঠাৎ করে কেন যেন প্রচন্ড মুতা ধরে গেলো!
সে আমাকে প্রচ- ধমক দিয়ে বললো, নাম কী?
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, সালামালাইকুম ভাই, ছন্দা।
মারবো এক চড়। হারামজাদা, আমার বোনের নাম আমি জানি না?তোর নাম ছন্দা?
জি না ভাই, আমার নাম হানিফ।
বাড়ি কই?
কেরানীগন্জ।
থাকিস কই?
দোতালায়। (আমি মামার বাসায় দোতালায় একটা রুমে থাকি।)
শালা,মজা লস আমার লগে! মারবো এক রামচড়। কার বাসায় থাকিস?
আমি আমার মামার নাম বললাম। সে আমার কলার ছেড়ে দিয়ে বললো, আর যেন ছন্দার আশেপাশে না দেখি। মনে থাকবো?
জি, ভাইজান। অবশ্যই, অবশ্যই!
আবার যদি ছন্দার আশেপাশে তোরে পাই, তোর ঠ্যাং হাত পা সব কাটবো, তারপর তোর হাতের জায়গায় ঠ্যাং , ঠ্যাংয়ের জায়গায় হাত লাগিয়ে দিবো। ঠিকাছে?
আমি বিনীত গলায় বললাম, অবশ্যই ঠিকাছে,ভাইজান!!
সে আমাকে ভয়ানক একটা ধমক দিয়ে বললো,যা ফোট! আমার নাম ফরিদ, কথাটা মনে রাখবি। আমার নাম কী বললাম?
শেখ ফরিদ।
শালা,আবার শেখ পাইলি কই? শুধু ফরিদ। দে,দৌড় দে।
আমি আবার সালাম দিয়ে চোখমুখ বুঝে সামনের দিকে দৌড় শুরু করলাম!
সে রাতেই আমার শরীরে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর এসে গেলো। এরপর থেকে ছন্দাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি।
বিটিভিতে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। একদিন শুনি, আমাদের ক্লাসের একটা মেয়েকে নিয়ে আমাদের গানের শিক্ষক হাওয়া!
পরে আর আমাদের বিটিভিতে যাওয়া হলো না। প্রোগ্রাম ক্যান্সেল হয়ে গেলো!
রাস্তাঘাটে ছন্দার সাথে দেখা হয়,কলেজের কাছে দেখা হয়, আমি এড়িয়ে যাই। ছন্দাকে দেখলেই আমি পালিয়ে থাকি। কী দরকার হাত পা কাটার!
একদিন হঠাৎ চাষাড়া মোড়ে ছন্দার সাথে দেখা। সে রিকশা খুঁজছিল। প্রচ- রোদ। আমি তাকে দেখে পালাচ্ছিলাম, সে আমাকে দেখে ফেললো।
সে আমার কাছে এসে বললো,এই শালা পালাচ্ছিস কেন? মারবো একটা লাথি? তুই জানিস, তোকে আমি কতো খুঁজি?
আমি চুপ করে রইলাম। এরা টমবয় ফ্যামিলির মানুষ। লাথি মেরে ফেলতেও পারে!
সে আমাকে রেল লাইনের পাশের একটা খাবার হোটেলে নিয়ে গেলো। ওরা চমৎকার সিঙ্গারা বানায়। আমরা আগেও কয়েকবার এখানে এসে খেয়েছি। সিঙ্গারা আমাদের দুজনের প্রিয় খাবার। সে চারটা সিঙ্গারা অর্ডার করলো। আমি মনে মনে বললাম, ছন্দা রে! তুই আমাকে সিঙ্গারা খাওয়াচ্ছিস,তোর ভাই এটা জানলে আমাকে ফালুদা বানিয়ে খেয়ে ফেলবে!
হোটেল থেকে বেড়িয়ে ছন্দা একটা রিকশা ঠিক করে বললো,উঠ।
আমি বললাম, তুই যা। আমি হেঁটে যাবো।
সে রেগে গিয়ে বললো, শালা হাফ লেডিস। রিক্সায় উঠ। এতো ভয় পাস কেন রে, শালা! কেউ তোকে কিছু বলেছে? কার এতো সাহস,আমাকে বল। এমন লাথি মারবো না,,,,
আমি সাথে সাথে বললাম, না না, কেউ কিছু বলে নাই তো!
কাজের দোহাই দিয়ে ওদের বাড়ির কিছুটা দূরে আমি নেমে গেলাম। আশেপাশে উঁকি দিয়ে দেখলাম ওর ভাই ফরিদকে দেখা যায় কি-না!
আমাদের বাসায় যেতে হলে ক্লাবের সামনে দিয়ে যেতে হয়। আমি আজকাল ক্লাব এড়িয়ে চলি। যাতে ওর ভাইয়ের সাথে দেখা না হয় সেজন্যই দূরের অন্য পথে হেঁটে বাসায় যাই। বলা তো যায় না, কোনদিন ক্লাবে ধরে নিয়ে গিয়ে রামধোলাই দেয়! যদি কখনো দেখা হয়ে যায়,সালাম দিয়ে সরে যাই।
আগে দুই একদিন ক্লাবে গিয়ে ক্যারাম বোর্ড খেলেছি, ফরিদের ভয়ে এখন ওটাও ছেড়ে দিয়েছি!
এর দুইমাস পর একদিন বাজার করে ফিরছি, প্রচ- জোরে বৃষ্টি শুরু হলো, রিকশা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি একটা চায়ের দোকানের পাশে আশ্রয় নিলাম। হঠাৎ দোকানের ভেতর থেকে ফরিদ বেরিয়ে এসে বললো, আরে,হানিফ ভাই না! সালামালাইকুম, ভালো আছেন?
আমি আশেপাশে তাকালাম, কাকে বলছে বুঝতে চেষ্টা করলাম।ফরিদ আমার দিকেই তাকিয়ে আছে! ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। এই শালা না আবার এখানেই প্যাঁদানি শুরু করে,ওর কোনো বিশ্বাস নেই। ওর বোনের সাথে রিকশার চড়েছি,শালা নিশ্চয় জেনে গেছে!
সে আমার কাছে বললো, হানিফ ভাই, কী করছেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, রিকশা খুঁজে পাচ্ছি না,
চা খান, রিকশা আনিয়ে দিচ্ছি। সে তার পাশে দাঁড়ানো একজনকে ধমক দিয়ে বললো, দৌড় দে, ভাইয়ের জন্য একটা রিকশা নিয়ে আয়!
লোকটা বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে রিকশা খুঁজতে দৌড় লাগালো।
সে চায়ের দোকানিকে বললো, কাপটা গরম পানিতে ভালা কইরা ধুইয়া সুন্দর কইরা চা বানা। লেবু, আদা ভালো কইরা দে।
একটা চেয়ার জোগাড় হয়ে গেল। আমি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বসে বসে চা খেতে শুরু করলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না, দুইদিন আগেই আমাকে দাবড়ানি দিলো, আজকে আদর করে চা খাওয়াচ্ছে! কাহিনি কী? আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার জন্য কেউ কী তাকে হুমকি দিয়েছে? কে হতে পারে সে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছাড়া সে আর কাকে ভয় পাবে?
রিকশা চলে এসেছে। সে আমার বাজারের ব্যাগ রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে বললো, যান, ভাইজান। কোনো সমস্যা হলে আমারে জানায়েন!
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,আচ্ছা!
সেদিন বাসায় এসে ভয়ে আমি আবার জ্বরে পড়ে গেলাম!
এর কয়েকদিন পর আবার একদিন ফরিদের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। আমি মনের খেয়ালে বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে ক্লাবের কাছাকাছি চলে গেলাম। ফরিদ ওখানে আড্ডা দিচ্ছিল। আমাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,সালামালাইকুম ভাই, ভালো আছেন?
আমি তোতলাতে তোতলাতে কোনো রকমে বলতে পারলাম, জি ভাই,ভালো।
বসেন, চা খান।
না, চা খাবো না। একটু হাঁটতে বের হইছি। এটা বলেই সামনের দিকে জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম। ফরিদ আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো!
আমি কিছুতেই ফরিদের এই পরিবর্বতন ধরতে পারি না। ওকে দেখলেই আমার কলিজা শুকিয়ে যায়!
একদিন ছাদে উঠেছি, দেখি আমার মামাতো বোন ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে। ক্লাস নাইনে পড়লেও ওকে বেশ বড়োসড়ো দেখায়। আমাকে দেখে ও নেমে গেলো। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, ফরিদ আমাদের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে সরে গেলো।
আগে ফরিদকে দেখলে আমি ভয় পেতাম,এখন ফরিদ আমাকে ভয় পাচ্ছে কেন বুঝলাম না!
আগে দেখা হলে, আমি সালাম দিতাম, এখন ও দেয়!
কারণটা জানা গেলো এর কিছুূদিন পর।
একদিন বিকেলে আমি ছাদে উঠেছি, দেখি আমার মামাতো বোন রাস্তায় কাকে যেন কী ইশারা করছে। আমার সন্দেহ হলো, চুপি চুপি গিয়ে ওর পিছনে দাঁড়ালাম। একটা দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদ। আমাকে দেখেই চট করে সরে গেলো!
আমাকে দেখে দৌড়ে মামাতো বোনও নিচে নেমে গেলো। কাহিনি তাহলে এই!
ফরিদ আমার ছোটবোনের সাথে প্রেম করছে। একে তো আমি বড়োভাই, আবার গৃহশিক্ষক। ফরিদ আমাকে সম্মান না করে পারে!
আমরা একটা কফি হাউসে বসলাম, সাথের পুলিশ দুটো চলে গেছে। কফি খেতে খেতে ছন্দা বললো, রাজশাহী পোস্টিং ছিল। কয়েক মাস আগে ঢাকায় ফিরেছি। তোর কী অবস্থা? তোর বউকে কিন্ত আমি চিনতাম। ভালো মেয়ে।
মামাতো বোনের সাথে ফরিদের সম্পর্কটা টিকে নি। আমিও ওখান থেকে চলে আসি। নারায়ণঞ্জ তোলারাম কলেজ ছেড়ে দিয়ে উত্তরা আনোয়ারা মডেল কলেজে ভর্তি হই। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিই আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। আমি নানাবাড়ির পাশেই বিয়ে করেছি। ছন্দা চিনবে এটাই স্বাভাবিক। আমি চুপ করে রইলাম।
ছন্দা বললো, কী ভাবছিস?
আমি বললাম, অতীত!
অতীতটাই ভালো ছিল রে! কেন যে বড়ো হলাম!
আমি তখনও চুপ করে রইলাম। ছন্দা বললো,তুই পালিয়েছিলি কেন, বল তো?
আমি ফরিদের কথা বললাম। মামাতো বোনের সাথে সম্পর্কের কথা বললাম।সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,ফরিদ ভাই তো কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
আমি বললাম, জানি। নানাবাড়ি গিয়ে তোকেও আমি খুঁজেছি। তোর বিয়ে হয়ে গেছে বলে যোগাযোগ করতে পারি নি।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, আমার বিয়েটা সুখের হয় নি রে। আমি বিএ পাস করার পরই বিয়েটা হয়ে যায়। দুটা বাচ্চা হওয়ার পর বুঝতে পারি, জামাই পরকিয়া করছে। আমি বাধা দিতে পারি নি। সে দ্বিতীয়া বিয়ে করার পর তাকে তালাক দিই।
বলিস কী রে!
একজনকে ধরে অতিকষ্টে পুলিশের চাকরিটা নিই। একজন হেল্পিং হ্যান্ডের ওপর বাচ্চাদের চাপিয়ে দিয়ে নিজে চাকরি করি। ট্রেনিংয়ের সময় কী পরিমাণ কষ্ট যে করতে হয়েছে, তা তুই বুঝবি না। আমার মা সহায়তা করেছিল বলে রক্ষে! বলতে গেলে আমার সাথে সাথে আমার মাও কষ্ট করেছে। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করি নি! আমার জীবনটাই কষ্টে কাটলো রে!
বলতে বলতে সে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। এই টমবয় মেয়েটার একি অবস্থা!
জানিস হানিফ, বাচ্চাদের বড়ো করতে গিয়ে কোন স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করতে পারি নি। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ভেবেছিলাম, ওরা বড়ো হলে সব দুঃখ কেটে যাবে! আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখেন নি রে!
কেন? কী হয়েছে?
আমার মেয়েটা আমার অমতে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে চলে গেছে।মায়ের স্নেহ মমতাকে সে পাত্তাই দেই নি। সে তার চোখের সামনে মায়ের কষ্ট দেখেছে,তারপরও মূল্যায়ন করে নাই। বাবা ছাড়া সন্তান মানুষ করা বহু কঠিন।
যোগাযোগ নাই?
আছে। ও রাজশাহী। আমি ঢাকায়। প্রতিদিনই ভিডিও কলে কথা হয়। আমি একা বাসায় পড়ে থাকি।
একা কেন? ছেলে কই?
আমার ছেলেটা ইংল্যান্ড পড়তে গেছে আজ ছয় বছর। সেখানেই একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। মনে হয় হয় ফিরবে না! এতো কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করে কী লাভ হলো, বল তো! ডিউটি শেষ করে একা একা বাসায় গিয়ে পড়ে থাকি, মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানিস? দ্বিতীয় বিয়ে না করে বোধহয় ভুল করেছি! চার দেয়ালের ভেতর একা বন্দী জীবন আর ভালো লাগে না রে!
বলতে বলতেই টমবয় ছন্দা কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে জীবন থেকে পালিয়ে যাই, কিন্ত কোথায় যাবো, বল তো!
আমার কফি আগেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমি ঠান্ডা কফির মগ হাতে ঝিম মেরে বসে রইলাম। মেয়েটা কাঁদুক। কেঁদে বুকটা হালকা করুক।
কিছুক্ষণ আগেই একজন ক্ষমতাবান নারীর ভয়ে পালাতে চাইছিলাম, এখন আমার সামনে বসে কাঁদছে একজন অসহায় নারী! পুলিশের পোশাক পরা একজন নারী আমার চোখের সামনে কেঁদে চলেছে, আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।
আমার মনে হলো, চাকরিক্ষেত্রে একজন নারী যতোই ক্ষমতাশালী হউক না কেন, সংসার ধর্মে একজন নারী সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল!
হানিফ ওয়াহিদ, গল্পকার, রম্যলেখক