এখন সময়:বিকাল ৫:২৪- আজ: শুক্রবার-২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৫:২৪- আজ: শুক্রবার
২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি: ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপট ও বুদ্ধদেব বসুর প্রতিক্রিয়া

মোহীত উল আলম

 

ইংরেজ রবীন্দ্র—গবেষক ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে কালধারা সাহিত্য—পত্রিকার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা ঠিক আছে, কিন্তু তিনি সেটি ভুল কারণে পেয়েছিলেন। ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অধিকতর উৎকর্ষজনক রচনাগুলোর জন্য পুরস্কারটি পাননি, পেয়েছিলেন তাঁর কিছু বাছাই করা কবিতা  ও গানের স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদের জন্য। রাদিচের নালিশটা হলো যে রবীন্দ্র—প্রতিভার যে অনুপম আকর তাঁর মৌলিক রচনায় আত্মলগ্ন হয়ে আছে তার খবর নোবেল প্রাইজ কমিটি জানলেনও না। রাদিচের উক্তিতে এ কথারও স্বীকৃতি মেলে——যা বহু আগে কবি টি এস এলিয়টও নিম্নস্বরে বলেগেছিলেন——যে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি একজন ভারতীয়ের ইংরেজি হিসেবে যতোই উৎকর্ষ হোক, এবং ভারতীয়দের কাছে তা যতোই গ্রহণযোগ্য হোক, ইংরেজি কবিতার উচ্চ ঘরানার কাছে তা মানোত্তীর্ণ নয়।

কেন মানোত্তীর্ণ নয় তার বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন বুদ্ধদেব বসু তাঁর অত্যন্ত শক্তিশালী প্রবন্ধ “ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ”—এ।

কিন্তু আমাদের বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের ইংরেজির মান—এর ওপর মন্তব্য করা নয়, বরঞ্চ কেন রবীন্দ্রনাথ

Song Offerings নামক ইরেজি—অনুবাদ গ্রন্থটি রচনা করতে গেলেন সে সম্পর্কে একটু আলোকপাত  করা।

এ আলোকপাত করতে যেয়ে বুদ্ধদেব বসুর কয়েকটি পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত করার বিনীত ভরসা রাখি।

প্রথমে বলে রাখি, বুদ্ধদেব বসুর ক্ষুরধার অন্তদৃর্ষ্টিসম্পন্ন সাহিত্য সমালোচনার সমালোচনা করা তেমনই একটা ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ, যা টি এস এলিয়ট ইংরেজ প্রবাদপ্রতীম ইংরেজ সাহিত্য—সমালোচক স্যামুয়েল জনসনের সঙ্গে কাব্যনীতির ব্যাপারে দ্বিমত করার সময় বলেছিলেন যে

he is a dangerous man to disagree with.

দ্বিতীয়ত, বুদ্ধদেব বসু তাঁর প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর অনুবাদকর্মের বাছাইয়ের মান নিয়ে প্রচন্ড আঘাত করলেও  তা করেছেন রবীন্দ্র—সাহিত্যের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও কবির প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে। অনেকটা তাঁর অনুভূতি এরকম: ওহ্, তিনি যদি এ—কাজটা না করতেন!

কিন্তু, বুদ্ধদেব বসুর রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ কর্মের তিরস্কারপূর্ণ লেখায় যে জিনিসটি ভয়ংকরভাবে অনুপস্থিত সেটি হলো রবীন্দ্রনাথের যে অনুবাদ—অভীপ্সার পেছনে একটি রাজনৈতিক—মনস্তত্ত্ব কাজ করতে পারে সে সম্পর্কে ধারণার।

রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি অনুবাদে হাত দেন ১৯১২ সালের বসন্তকালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথের বাংলা কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি আর তাঁর কিছু কবিতা ও গানের গদ্য—অনুবাদের সংকলন গীতাঞ্জলি বা Song Offerings ——যেটির জন্য মূলত তিনি নোবেল পুরস্কার পান——এক বই নয়।

বুদ্ধদেব বসু অনুমান করছেন যে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির অনুবাদ শুরু করেছিলেন “এক ছুটির প্রহরে . . . খেলাচ্ছলে,” কিন্তু এই খেলা ক্রমে এমন জমে উঠলো যে লন্ডনগামী জাহাজে যেতে  যেতে “এক খাতা ছাপিয়ে আর এক খাতায়” পেঁৗছালো।

তারপরের গল্প সবার জানা। কীভাবে শিল্পী—বন্ধু রোদেনস্টাইনের বাসগৃহে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গদ্য অনুবাদগুলো কয়েকজন ইংরেজকে পড়ে শোনান, এবং কীভাবে এর “wonder and glory”—তে অভিভূত থাকেন তাঁর অন্য বন্ধু ডব্লিউ বি ইয়েটস, যিনি শুধু স্বীকারই করলেন না যে “টেগোর আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো,” বরঞ্চ স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে গীতাঞ্জলির জন্য ষোলপৃষ্ঠাব্যাপী তাঁর বিখ্যাত ভূমিকা লিখে দেন (যেটির একটি স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করেন আবদার রশীদ ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গীতাঞ্জলির একটি নতুন সংস্করণে।)

ইয়েটস রবীন্দ্রকাব্যের সহজতা, স্বত:স্ফূর্ততা, ঐতিহ্য—সংলগ্নতা আর আধ্যাত্মিক নিবেদনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন, আর মুগ্ধ হলেন জীবনের বহু বিচ্ছিন্ন ে¯্রাতকে একীভূত করার রবীন্দ্র—ক্ষমতায়। যে ইয়েটস বিশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপের নগর সভ্যতায় নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতি দেখে এলিয়টের মতোই শংকিত হয়ে ওঠেন, যিনি ১৯১৯ সালে “দ্য সেকেন্ড কামিং” কবিতায় সে বিখ্যাত অনুযোগটি করবেন, “Things fall apart, the centre cannot hold”,  তিনি স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের “আমার সকল রসের ধারা তোমাতে হোক না সারা” বা “ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমা পানে” শীর্ষক গানে মুগ্ধ হলেন।

“একটি নমস্কারে, প্রভু / একটি নমস্কার” শীর্ষক গানটির তৃতীয় স্তবকটি রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করলেন এ ভাবে যা ইয়েটসকে অতিশয় মুগ্ধ করে: “Let all my songs gather together their diverse strains into a single current and flow to a sea of silence in one salutation to thee.”

রবীন্দ্রনাথের শিশুসুলভ প্রকৃতি—নিমগ্নতা ইয়েটসকে অভিভূত করলো। তাঁর ভূমিকার শেষ প্রান্তে এসে তিনি লিখছেন: “An innocence, a simplicity that one does not find elsewhere in literature makes the birds and the leaves seem so near to him as they are near to children.”

তারপরও এ প্রশ্নটা রয়ে যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কেন ইংরেজি গাদ্যিক পদ্যে তাঁর কিছু গান ও কবিতা অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেটি কি শুধু তাঁর বিদেশি বন্ধুর মনোরঞ্জনের জন্য? তা অবশ্যই নয়, কেন না তা হলে শুধুমাত্র কয়েকটি কবিতা/গান অনুবাদ করেই তিনি ক্ষান্ত হতেন। কিন্তু গীতাঞ্জলিতে মোটমুদ্রিত গান/কবিতার সংখ্যা ১০৩, যেখান থেকে তিনি ৫৩টি গান অনুবাদ করেন, এবং বাকিগুলি নেন গীতিমাল্য, নৈবদ্য ও খেয়া থেকে।

তা হলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় অনুভব করেছিলেন যে তাঁর কাব্যপ্রতিভা বিশ্বমানের, এবং তা বিশ্বদরবারে পেঁৗছানো চায়।

তখনকার প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজিতে নিজের লেখা অনুবাদে প্রবৃত্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, এতই স্বাভাবিক যে এর মধ্যেও যে একটি ঔপনিবেশিক—কাঠামো নিয়ন্ত্রণচালিকা হিসেবে কাজ করতে পারে, সেটি প্রায় অলক্ষ্যে থেকে গেছে।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ইংরেজরা পলাশী যুদ্ধ জেতার ১০৪ বছর পর। রবীন্দ্রনাথের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও যৌবনত্তোর মৃত্যু অবধি কাল কেটেছে ইংরেজ শাসনের সময়। ইংরেজদের শাসন ও তাদের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে এক নব যৌবনের শুরু করে যার একজন কনিষ্ঠ সদস্য রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।

অর্থাৎ, বাংলার রেনেসাঁ বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো শিক্ষিত কোলকাতা—কেন্দ্রিক অভিজাত বাঙালীদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে আধুনিক ধ্যান—ধারণায় প্রবেশের সময়।

ঔপনিবেশিকতার মূল চাবিকাঠি হলো উপনিবেশিতদের মনে একটি অনুকরণপ্রবণতা তৈরি করা, যা বহু পরে ভি এস নাইপল তাঁর উপন্যাস দ্য মিমিক মেন (১৯৬৭) এ প্রতিভাত করেন। এই উপন্যাসটির নায়ক র্যালফ সিং ঔপনিবেশিকতার ছন্দে জীবনযাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগতে থাকেন।

রবীন্দ্রনাথ র্যালফ সিংএর মতো ঔপনিবেশিকতার অনুকরণের অর্থে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদে হাত দেন নি, তিনি ঔপনিবেশিকতার শীর্ষ সূচকগুলো আত্মস্থ করে নিজেকে বাংলাভাষার অন্যতম সৃজনশীল লেখক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের বিরাট প্রতিভার তুলনায় তাঁর অনুবাদ—শিল্প নিয়ে নাড়াচাড়া করাকে বুদ্ধদেব বসু “খেলাচ্ছলে” বলে ঠিকই করেছেন, কিন্তু বুদ্ধদেব বসু যদি একবার ভারতীয় রাজনৈতিক—সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলটির দিকে দৃষ্টিপাত করতেন, যদি রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ—কর্মের পেছনে মনস্তাত্ত্বিক অভিসন্ধির স্বরূপটা খুঁজতেন তা হলে “খেলাচ্ছলে” বা “খেলা ক্রমে এমন জমে উঠলো” জাতীয় শব্দনিচয় তিনি নিশ্চিত পরিহার করতেন।

বুদ্ধদেব বসু যা দেখেন নি, রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যত দ্রষ্টা হিসেবে তা দেখেছিলেন বলেই তিনি ইংরেজি অনুবাদকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ কী দেখেছিলেন? তিনি দেখেছিলেন যে ভারতবর্ষ একটি পরাধীন দেশ, বৃটিশ সা¤্রাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল উপনিবেশ। রবীন্দ্রনাথ আরও দেখেছিলেন বিশ্বের ভাষাগুলোতে ইংরেজি সর্বপেক্ষা প্রচারিত ভাষা। তিনি আরও জানতেন, ইংরেজরা ভারতে (অন্তত বঙ্গভূমিতে) বাস করতে শুরু করেছে তাঁর জন্মেরও প্রায় একশত বছর আগে থেকে। শুধু তাই নয়, বিশ্ব সংস্কৃতির মানদন্ডও তখন নির্ধারিত হচ্ছে ইউরোপের প্যারী ও লন্ডন নগরী থেকে।

অর্থাৎ, ভারতকে যদি উপনিবেশ ধরি, তা হলে ইংল্যান্ড ছিলো কেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ তখন আন্তর্জাতিক বিচারে অবশ্যই একজন উপনিবেশিত লেখক বা কবি। আরও কয়েক দশক পরে নাইজেরিয়া বা ঘানা বা কেনিয়ার লেখকদের যেমন ইংরেজিতেই, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক, ভাষায় লিখতে হয়েছে বিশ্ব—সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করার জন্য, তেমনি রবীন্দ্রনাথকেও অশেষ মর্মবেদনা সহ্য করেও এ উপলব্ধিকে মেনে নিতে হয়েছিলো যে ইংরেজিতে তাঁর কিছু রচনা অনুবাদ না করলে বিশ্ব—সাহিত্যাঙ্গনে তিনি অচেনা থেকে যাবেন।

এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণ খানিকটা গ্রহণযোগ্য, খানিকটা আবার বিতর্কিত। তিনি বলছেন যে, এটি খুবই দু:খজনক ব্যাপার যে বিশ্বমানের একজন প্রধান কবিকে তাঁর নিজেরই রচনা একটা বিজাতীয় ভাষায় অনুবাদ করতে হলো। কথাটা সঠিক, ব্যাপারটি খুবই মর্মন্তুদ, কেননা বুদ্ধদেব বসুর এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গেও আমরা একমত যে, রবীন্দ্রনাথ যে প্রতীচ্যে দু’দশকের বেশি তাঁর সুনাম রাখতে পারেন নি, তার একটি কারণ তিনি নিজেই অনুবাদক হওয়াতে অনেক বিদেশিই মনে করতো রবীন্দ্রনাথ বুঝি ইংরেজিতেই লিখতেন। এ জন্য বুদ্ধদেব বসু ঠিকই দায়ী করেছেন দি কালেক্টেড পোয়েমস অ্যান্ড প্লেইজ অব বরীন্দ্রনাথ টেগোর শীর্ষক সম্পাদিত গ্রন্থটিকে। রবীন্দ্রনাথের স্বসম্পাদিত গ্রন্থটি ম্যাকমিলান এ্যান্ড কোম্পানি প্রকাশ করেন ১৯৩৬ সালে লন্ডন থেকে, কিন্তু এর কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে গ্রন্থভুক্ত রচনাগুলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নিজের বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা। ফলে বিশ্ব—পাঠক বুঝতে পারেনি যে এটি রবীন্দ্রনাথের মৌলিক রচনা নয়, কেবলমাত্র অনুবাদ। বুদ্ধদেব বসু স্টিফেন স্পেন্ডারের কথাও বললেন যাঁর ১৯৬০ সালে কলকাতায় প্রদত্ত একটি ভাষণে বোঝা যায় নি যে তিনি যে অবগত আছেন রবীন্দ্রনাথ বাংলায় লিখতেন।

কিন্তু, তারপরেই বুদ্ধদেব বললেন যে চিন্তা করা যায় তলস্তয়, প্রম্নস্ত, রিলকে বা এঁরা কেউ নিজেদের রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন। এই তুলনাটা যে তৎকালীন ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে একেবারেই অসংগত সেটি বুদ্ধদেব বসু বিবেচনায়ই আনলেন না। সেটি হলো, ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে সা¤্রাজ্যবাদীর সম্প্রসারণ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উপনিবেশবাদের গোড়াপত্তনের ফলে ইউরোপ ক্রমশ বিশ্ব—সভ্যতার নিয়ন্তা হয়ে ওঠে, যা এডওয়ার্ড সাইদেরও বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক ইতিহাস পর্যালোচনার মূলতত্ত্ব, এবং, সাহিত্য—সংস্কৃতি হয়ে পড়ে ইউরোপকেন্দ্রিক বা ইউরোসেন্ট্রিক। সে বিচারে তলস্তয়, রিলকে বা প্রুস্ত প্রমুখ পশ্চিমা সাহিত্যিকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের মূল পার্থক্য হলো এখানে যে, এঁদের প্রত্যেকের ভাষাই ইউরোপিয় ভাষা বা ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষা, অন্যপক্ষে রবীন্দ্রনাথের ভাষা উপনিবেশিত বা শাসিতের ভাষা, তাই প্রশ্রয়তর ও পৃষ্ঠপোষণযোগ্য। এই অনুধাবণটি বাংলাভাষাভাষী আমাদের জন্য যতোই মন:পীড়ার কারণ হোক না কেন, রবীন্দ্র—উত্থান ও—খ্যাতির পর্বে এটাই ছিলো রাজনৈতিক পরিকাঠামো, এবং বুদ্ধদেব বসুর চিন্তায় এই ধারণাটি স্থান পায় নি বলে, তাঁর প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের স্ব^কৃত অনুবাদকর্মের শানিত তিরস্কারের ভূমিটি শেষ পর্যন্ত দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়।

বুদ্ধদেব বসু যে রাজনৈতিক প্রশ্নের খুব কাছাকাছি যান নি তা নয়। তিনি যখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ চিত্তে বলছেন যে এজরা পাউন্ড থেকে শুরু করে পার্ল এস বাক্ ও রবার্ট ফ্রস্টসহ বিভিন্ন বিদেশিরা যে যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথকে প্রশংসা করে গেছেন (Frost: It’s fine to hear he’s [Tagore] still a living force in India.’) (Poetry, November, 1961), তা নিছক গাল—ভরা বুলি ছাড়া কিছু নয়।

কিন্তু, এ বিশেষ তোষণনীতিও ঔপনিবেশিক পরিকাঠামোয় স্বীকৃত আচরণ। মার্কিনী তাত্ত্বিক নব্যইতিহাসবাদের প্রবক্তা অধ্যাপক স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাটের ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদের পাঠ সাইদ থেকে ভিন্নতর। যেখানে সাইদ বলছেন যে ইউরোপের মনস্তত্ত্ব থেকে নির্গত কল্পনাপ্রসূত জগতের অনুরূপ তারা ঔপনিবেশিক শাসিত প্রাচ্যকে রূপ দিতেন বা মনে করতেন, সেখানে গ্রিনব্ল্যাট বলছেন যে ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকেরা বরঞ্চ যেখানে যে ফর্মুলা প্রয়োগ করে ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখা যায় সেখানে সে ফর্মূলা প্রয়োগ করে তারা একটি সৃজনশীল পদ্ধতিতে তাদের সা¤্রাজ্যবাদ বজায় রেখেছিলো। যেমন, আমরা বলতে পারি, ভারতবর্ষে তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি বলবৎ রেখেছিলো।

ইমপ্রোভাইজেশনের একটি মূল কর্ম হচ্ছে পড়হঃধরহসবহঃ. অর্থাৎ, বিপ্লবী বা প্রতিবাদীশক্তিকে একটি বৃহত্তর উদারনৈতিক ধারণার বলয়বৃত্তের মধ্যে নিয়ে আসা। এ দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সাহিত্যগুণকে স্বীকার করে নিয়েও  ইংরেজরা তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অবকাশ নিয়েছে। আমার মনে হয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যখন কাজী নজরুল ইসলাম অন্তরীণ হলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অনশন ভাঙতে বলার পেছনে রবীন্দ্রনাথের অজান্তেই সে ঔপনিবেশিক চাবিকাঠিই ব্যবহৃত হয়েছে যে বড়ো কবিকে দিয়ে ছোট কবিকে বশ করার কৌশল।

এ হিসেবে দেখলে, বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চেহারাটা মোটেও খেয়াল না করে তাঁকে প্রায় একাধারে আক্রমণ করে গেছেন।

এখানেও রবীন্দ্রনাথের আরেকটি প্রবণতা বুদ্ধদেব লক্ষ করলেন না, সেটি হলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ ভারতের ভাষাভাষী লোকদের কাছেও পরিচিত হয়ে উঠলেন। অবশ্য, আবু সয়ীদ আয়ুবের একটি তথ্যে খটকা লাগে——রবীন্দ্রনাথের রচনা ইংরেজিতে অনূদিত হবার আগে ভারতের অন্য ভাষায়ও হয়েছিলো কিনা। কারণ, আয়ুব বলছেন তাঁর বাংলা ভাষা শেখার আগ্রহ বাড়ে প্রথমে গীতাঞ্জলি উদুর্তে পড়ে এবং তারপর ইংরেজিতে পড়ে মুগ্ধ হয়ে মূল বাংলায় তিনি গীতাঞ্জলি পাঠ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অবশ্য এটাও হতে পারে যে আয়ুবের হাতে আগে উদুর্ অনুবাদটি পেঁৗছায়——যা কিনা পূর্বেই প্রকাশিত ইংরেজিতে অনূদিত গীতাঞ্জলি—র উর্দু অনুবাদ।

বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে শেষ তর্কটা এবার আনি। আমরা জানি যে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেলেই যে একজন ধ্রুপদি সাহিত্যিক হয়ে গেলেন তা নয়। কারণ, পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় এমন অনেক আছেন, যাঁদের পুরস্কার পাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি কাজ করেছে  (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখক সিনক্লেয়ার লুইস।) এবং, যুক্তির খাতিরেই বলছি, যদিও এটা আমার মনের উচ্চারণ নয়, রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়াটা রাদিচে—কথিত যে ভুল কারণে পাওয়া হয়েছে বলে প্রচলিত একটি ধারণা হয়েছে, সেটিকে  মানতে গেলে রাজনৈতিক কন্টেইনমেন্টের প্রশ্নটাই এসে যায়।

বুদ্ধদেব বসু যদিও বারবার বলছেন যে গীতাঞ্জলির কয়েকটি অনুবাদ ছাড়া বাকিগুলো রবীন্দ্রনাথের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে, যেমন যেগুলি বাংলায় কবিতা ও গান হিসেবে মোটমুটি গৌন বা অলক্ষে থেকে গেছে সেগুলোই রবীন্দ্রনাথের সাধারণ কিন্তু প্রাঞ্জল ইংরেজি অনুবাদে স্বচ্ছন্দে পরিস্ফুট হয়েছে, সেগুলো, বুদ্ধদেবের ভাষায় ‘ইংরেজি চিকিৎসায়’ বলীয়ান হয়ে বহি:পাঠককে আকৃষ্ট করেছে। অথচ, তুলনামূলকভাবে গভীরতর কবিতাগুলি  (যেমন, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’) মোটেও উতরোতে পারেনি।

কিন্তু বুদ্ধদেব এটা একবারও বলছেন না যে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়াটা ঠিক হয়নি। অর্থাৎ, বুদ্ধদেব মেনেই নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ন্যায্যতা, কিন্তু তাঁর সে পুরস্কারটি পাওয়ার পদ্ধতি তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তা হলে কি রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি অনুবাদ না করলেই ভালো করতেন, এবং বুদ্ধদেব কি তা’তে সন্তুষ্ট থাকতেন। বুদ্ধদেবের কথা হলো, গীতাঞ্জলির কিয়দংশ ও তৎপরবর্তী কিছু রচনার অক্ষম ইংরেজি অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের জন্য আত্মঘাতী—স্বরূপ কান্ড হয়েছিলো। তা হলে যদি অনুমান করি যে সিদ্ধ অনুবাদকের হাতে পড়ে (যেমন, একালের রাদিচের মতো অনুবাদকের হাতে) রবীন্দ্রনাথ অদ্যাবধি জনপ্রিয় হয়ে রইলেন, কিন্তু দিন—ক্ষণ কালের বৈষম্য ও রাজনৈতিক পট—পরিবর্তনের কারণে তিনি নোবেল প্রাইজ পেলেন না, সেটি কি বাঙালী হিসেবে আমাদের কাছে অধিকতর সুখের ব্যাপার হতো? নিশ্চয় না। বরঞ্চ রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন বলেই ‘খেলাচ্ছলে’ নয়, সম্পূর্ণ আন্তরিকভাবেই ইংরেজি গদ্যে তাঁর কিছু গান ও কবিতা বিশ্বাঙ্গনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।

 

মোহীত উল আলম, সাবেক উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

ভাষার যতো মান অপমান

অজয় দাশগুপ্ত : বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমাদের মাতৃভাষার নাম বাংলা ভাষা। আপনি আশ্চর্য হবেন জেনে প্রবাসের বাঙালিরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের সন্তানদের বাংলা শেখায়। এ

চাঁদপুর চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির কবিতা উৎসবে ১০ গুণী ব্যক্তির পুরস্কার লাভ

আন্দরকিল্লা ডেক্স : নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির কবিতা উৎসব-২০২৫। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় চাঁদপুর শহরের ইউরেশিয়া চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সবুজ

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্কুলের শতবর্ষ উদযাপন

আন্দরকিল্লা ডেক্স : শতবর্ষ পূর্ণ হওয়া চট্টগ্রামের হাতেগোনা কয়েকটি স্কুলের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পাহাড়তলী অন্যতম একটি। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল ২০২৪

কেনো ইহুদিরা জাতি হিসেবে এত বুদ্ধিমান?

মূল লেখক: ডঃ স্টিফেন কার লিওন অনুবাদক— আসিফ ইকবাল তারেক   ইসরাইলের কয়েকটি হাসপাতালে তিন বছর মধ্যবর্তীকালীন কাজ করার কারণেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার চিন্তা

আগমনী এবং দুর্দান্ত দুপুর

দীপক বড়ুয়া ঋষিতার মুখে খই ফুটে। কালো মেঘে ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ার সময়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পরে। আনন্দে বৃষ্টি ফোটা ছুঁয়ে হাসে। মাঝেমধ্যে