আলম খোরশেদ
বছর ছয়েক আগে জার্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আমন্ত্রণে বিশ্বখ্যাত নাট্যোৎসব থিয়েটার ট্রেফেন এর ছাপ্পান্নতম আসরে যোগ দিতে বার্লিন গিয়েছিলাম, পৃথিবীর আরও কুড়িটি দেশের একঝাঁক মেধাবী নাট্যকর্মী ও চিন্তকের সঙ্গে। সেই উৎসবশেষে প্রতিবেশী দেশ নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহরেও ঢুঁ মেরেছিলাম দিনকয়েকের জন্য, আমার এক পরমাত্মীয় ও তার বিদুষী ডাচ বধূর সহৃদয় আহ্বানে। সে-খবর সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে যথারীতি চাওর হয়ে গেলে, আমস্টারডামের লাগোয়া শহর লেইডেনে বসবাসরত তরুণ বাঙালি বিজ্ঞানী ও সাহিত্যামোদী, চাটগাঁরই ছেলে শরিফুল ইসলামও অন্তর্জালে ডাক পাঠালো, অন্তত একটি সন্ধ্যায় তার আতিথ্য গ্রহণের জন্য। সঙ্গে এক দীর্ঘ প্রলোভন-তালিকা: প্রায় হাজার বছর বয়সী লেইডেন বিশ্বখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্টের জন্মশহর; এই দেশের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, চারশত বছরেরও অধিক বয়সী, ইউনিভার্সিটি অভ লেইডেনের অবস্থানও এই শহরেই, যে-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন নোবেলজয়ী ডাচ পদার্থবিদ
হেন্ড্রিক লরেঞ্জ, এমনকি খোদ আইনস্টাইনও যেখানে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন শিক্ষকতা ও গবেষণার কাজে (উল্লেখ্য, শরিফপত্নী গ্রিক তরুণী মারিনাও সেখানকারই ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক); বিশ্বখ্যাত নারী গুপ্তচর মাতাহারি এখানেই শিশুদের জন্য তৈরি একটি বিশেষায়িত স্কুলে কাজ করতেন; ঐতিহাসিক মে ফ্লাওয়ার জাহাজে করে আমেরিকা অভিমুখে যাত্রা-করা অভিযাত্রীদলের, ইতিহাসে যারা পিলগ্রিমস নামে পরিচিত, আবাসস্থলও এই শহর; ষোড়শ শতাব্দীতে তুরস্ক থেকে আনা টিউলিপের কলি লাগিয়ে ইউরোপে প্রথম টিউলিপ ফোটানো বাগানটিও এখানেই অবস্থিত; এই লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নোবেলজয়ী পদার্থবিদ হাইকে কামেরলিং ওনেস হিলিয়াম গ্যাসকে তরলপদার্থে রূপান্তরিত করে, তাপমাত্রাকে প্রায় অ্যাবসল্যুট জিরো ডিগ্রির কাছাকাছি ২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নামিয়ে এনে এখানেই সৃষ্টি করেছিলেন একদা বিশ্বের শীতলতম স্থানবিন্দুটি; এবং সর্বোপরি এই শহরেরই অন্যতম গর্বের ধন ইন্ডে পোয়েট্রি বুকস নামে অসাধারণ একটি বইয়ের দোকান, যারা কেবল কবিতা এবং কবিতাবিষয়ক বই-ই বিক্রি করে; এর প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টিয়ান ফন মিনেনের ভাষ্য অনুযায়ী, গোটা ইউরোপেই নাকি এরকম কবিতার বইয়ের বিপণীর সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা, মাত্র দু’টি কি তিনটি।
এমন দুর্লভ সব প্রলোভনের আবেদন তাই উপেক্ষা করা গেল না কিছুতেই। আমার আমস্টারডামের আন্তরিক আপ্যায়ক রুশোর গাড়িতে করে এক বিকালে ঠিকই গিয়ে হাজির হই লেইডেন শহরে, একেবারে শরিফের বাড়ির দোরগোড়ায়, এবং সেখান থেকে প্রথমেই যাই সেই বিখ্যাত কাব্যবিপণী ইন্ডেক্স পোয়েট্রি বুকস সন্দর্শনে। যাবার পথে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দেওয়ালে আঁকা লেইডেনের গর্ব রেমব্রান্টের বিখ্যাত সব চিত্রকর্মের অনুকৃতি, এবং অপরাপর আকর্ষণীয় দালানসমূহের গায়ে উৎকীর্ণ বিশ্বের সেরা কবিদের কবিতার প্রদর্শনী ছিল বিশুদ্ধ চোখের আরাম। আর বইয়ের দোকানটিতে প্রবেশ করে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া! বিশাল একটি ঘর জুড়ে কেবল কবিতা আর কবিতা-বিষয়ক বইয়ের ছড়াছড়ি। বিশ্বকবিতার আস্ত একখানা স্বর্ণখনি যেন এই গ্রন্থবিপণীটি, যেখানে পৃথিবীর হেন কোনো দেশ, হেন কোনো ভাষা, হেন কোনো খ্যাতনামা কবি নেই যার কবিতার বই পাওয়া যায় না। এশীয় কবিতার শেলফে আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইও রয়েছে দেখলাম একাধিক, যার মধ্য থেকে তাঁর কবিতার ডাচ অনুবাদের একটি সংকলন কবিতানুরাগী শরিফ নিজেই কিনে নেয়। আমার নজর যায় সমকালীন বিশ্বকবিতার একটি মূল্যবান সংকলন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস আন্হেলেসভিত্তিক এৎববহ ওহঃবমবৎ ইড়ড়শং কর্তৃক প্রকাশিত অহঃযড়ষড়মু ড়ভ ডড়ৎষফ চড়বঃৎু ড়ভ ঃযব ২০ঃয ঈবহঃঁৎু এর দ্বিতীয় খণ্ডটির দিকে। ওতে স্পেনের হোর্হে গিয়্যেন, জার্মানির গটফ্রিড বেন, আর্হেন্তিনার আল্ফোন্সিনা স্তর্নি, ফিনল্যান্ডের এডিথ স্যোডেরগ্রান, গুয়াদেলুপের স্যাঁ-ঝন পের্স, ব্রাজিলের অসওয়াল্ড দে আন্দ্রাদে, চিলির পাবলো নেরুদা ও বিসেন্তে উইদোব্রো, রাশিয়ার কবিদম্পতি নিকোলাই গুমিলেভ ও আনা আখমাতোভা, ইরানের ফারোখ ফারোখজাদ, সুইজারল্যান্ডের ব্লেজ সন্দ্রার, রোমানিয়ার লুসিয়ান ব্লাগা, একুয়াদরের হোর্হে র্কারেরা আন্দ্রাদে, এবং খোদ নেদারল্যান্ডসের খ্যাতনামা সাহিত্যিক কেইস নুটবুম প্রমুখের কবিতা রয়েছে দেখে সেটিই কেনার সিদ্ধান্ত নিই আমি। অবশ্য বইয়ের দাম পরিশোধ করতে গেলে ইন্ডে পোয়েট্রি বুকস এর স্বত্বাধিকারী, দীর্ঘদেহী ক্রিস্টিয়ান মিনেন, যিনি নিজেও একজন কবি ও অনুবাদক, আমাকে সেটি উপহার হিসেবেই দিয়ে দিলেন এবং বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলেন, আমি যেন গ্রন্থ’ভুক্ত তাঁর স্বদেশী নুটবুমের কবিতাগুলো বাংলায় অনুবাদ করে তাঁকে পাঠাই। তিনি সেগুলো দিয়ে একটি দ্বিভাষিক পুস্তিকা প্রকাশ ও শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গটিতে অনুষ্ঠেয় তাঁদের বার্ষিক কবিতাউৎসবে পাঠের আয়োজন করতে চান। আমি তাতে সানন্দ সম্মতি প্রদান করে, আমার ঝোলা হাতড়ে রবিঠাকুরের একটা গানের সিডি খুঁজে বার করে তাঁকে সেটা পাল্টা উপহার হিসেবে দিয়ে, আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের পথ ধরি।
দেশে ফিরে একটু গুছিয়ে বসেই আমি ক্রিস্টিয়ানের অনুরোধ অনুযায়ী বিংশ শতাব্দীর ডাচ ভাষার অন্যতম প্রধান কবি কেইস নুটবুমের (জন্ম: ১৯৩৩, হেগ শহরে) গোটা পাঁচেক কবিতা অনুবাদ করে আমার সফরসঙ্গী শরিফের মাধ্যমে তাঁকে পাঠিয়ে দিই। এখানে উল্লেখ্য, ঔপন্যাসিক, ভ্রমণলেখক এবং কবি কেইস নুটবুম সারা জীবন ধরেই মানবজীবনের মৌল কিছু বিষয় যেমন সময়, সম্পর্ক, মৃত্যু, আত্মা ও আত্মচেতনা নিয়ে ঘোরগ্রস্ত থেকেছেন এবং এর প্রভাবে তাঁর কবিতা উত্তরোত্তর জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। এতটাই যে, অপরাপর ভাষায় তাঁর কবিতার খুব বেশি অনুবাদও হয়নি অদ্যাবধি। খোদ ইংরেজি ভাষাতেই তাঁর কবিতার প্রথম অনুবাদগ্রন্থ দ্য ক্যাপ্টেন অব বাটারফ্লাইজ প্রকাশিত হয় মাত্র কয়েকবছর আগে, ১৯৯৭ সালে। বাংলাভাষাতে তাঁর কোনো কবিতার অনুবাদ আমার অন্তত চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। মাসিক আন্দরকিল্লার পাঠকদের সঙ্গে সেখান থেকে তিনটি কবিতার তরজমা ও তার নেপথ্যকাহিনিটি ভাগ করে নিতে পেরে গভীর আনন্দ অনুভব করছি।
আবৃত আরোহীরা
অন্ধকারের ফুটো
চাঁদের আলোর নাম রেখেছে তারা
আর তারই আলোতে বিকলাঙ্গ হাতে
তারা তাকে পরিমাপ করতে চায়
ক্রমে সচল হয়
মানবমাংসের ঘোড়ায় চাপা
আলোয়ান ও মুকুটে লুকোনো
মুখ-ঢাকা বিশৃঙ্খল বাহিনী।
নিজেদের নাম ছাড়া তাদের
আর কোনো নাম ছিল না
কোনো কোনো বছর তারা সম্পূর্ণ অদৃশ্য
চোখ, মুখ কান সবই আবৃত
এই মিছিলের কোনো শেষ থাকবে না
আমি তাদের দেখি, দেখি
আর জ্বলতে থাকি।
স্বর্ণকলস
সেই সময়কে স্মরণ করো
যখন আমরা কিছু একটা খুঁজছিলাম,
যা খুব সুনির্দিষ্ট,
একটি ধারণা, ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা,
বিষয়, তত্ত্ব, অনুমান,
আমরা যা কিছু জানি না তার যোগফল,
যাকে আমরা অস্পষ্ট সমস্ত কিছুর মধ্য থেকে
আন্দাজ, পরিমাপ কিংবা যোগ করে নিতে চাই?
তুমি জানো, জানো না কি
কীভাবে আমরা ধারণা ও অনুসন্ধানকে
বণ্টন করে দিয়ে দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়েছিলাম,
অগাস্টিন বেশ্যালয়, আলবার্ট সংখ্যা,
জর্জ আয়না, ইমানুয়েল ঘরবাড়ি, পাবলো আকার,
ওল্ফগাং বর্ণসমুদয়,
তেরেসা, ব্লেইজ, ফ্রিডরিশ, লেওনার্দো, অগাস্টাস,
সারাক্ষণ শব্দ ও রচনার পরিমাপ ও যোগবিয়োগে ব্যস্ত
মঠবাসিনী, সৈন্যদল, কবিদের মাঝখানে ভাবনারত
ভাঙছে, ছিড়ছে, দেখছে যতক্ষণ না
হাড়গোড়, ছায়া, একটি ঝলক,
বোধ ও চিত্রের সারমর্ম পাওয়া যাচ্ছে,
যতক্ষণ না একটি আয়না কিংবা সংখ্যা,
তবে সর্বদাই খুব সংক্ষেপে,
একটি চিন্তার হেঁচকি, একটি অনন্ত অস্পষ্ট পথ
দৃশ্যমান হয়ে উঠছে?
চিঠি
তাহলে কি, আপনার ভাবনারা এতটাই স্বচ্ছ
ডাকপিয়ন শুধান। ঠিক সেই মুহূর্তে
আকাশ আঁধার হয়ে আসে,
তবে সেটা অন্য বিষয়,
এখানে ঘটনারা এভাবেই ঘটে,
এক মুহূর্ত থেকে পরের মুহূর্তে।
তার মানে বৃষ্টি, তিনি বলেন, আর তখনই বৃষ্টি নামে।
বড় বড় ফোঁটায়। তার পেছনে আমি উপকূল দেখতে পাই,
প্রান্তর, ধীরগতি মেঘে ছাওয়া,
বৃষ্টি নামে।
এই মুহূর্তেরা কোথায় যায়?
কতটা মর্মরধ্বনি হারাতে পারে?
স্বপ্নের তলদেশে, স্মৃতির বিভ্রমে,
কোন সংলাপগুলো কখনও
সময়-দেয়ালের আঘাতে বিচূর্ণ হতে পারে না?
কল্পনাকাহিনি, পাহাড়শিখরে বাড়ি,
বৃষ্টির সামগান, পৃষ্ঠা ছয়,
ডাকপিয়ন, অবতরণ, নিম্নমুখী
পথে বিস্মৃতিতে তলিয়ে যাওয়া।
তার, আমার,
সময়ের স্ফীতি,
কেউ একজন যেমন
না পড়েই পৃষ্ঠা ওলটায়,
লিখিত সবকিছু
অর্থহীন।
আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক