জান্নাতুন নুর দিশা
ভাদ্র মাসের মধ্য দুপুর। বছরের এই সময়টায় আবহাওয়ার মতিগতি ঠাওর করা যায় না। ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, কী গনগনে রোদটা উঠেছিলো! ছাতা নেবার কথা মনেই আসেনি। অথচ দুই ঘন্টার ব্যবধানে একটু আগেই ধুমধাম বৃষ্টি হয়ে গেলো এক পশলা। এখন আবার কাঠফাটা রোদ উঠছে! তাকানো যাচ্ছে না রীতিমতো। গায়ের ভেজা কাপড়গুলো গায়েই শুকাচ্ছে। এই দুপুরবেলা চকবাজারে গাড়ি ধরতে পারা মানে রীতিমতো যুদ্ধজয়। প্রতি দশ মিনিট পরপর এক একটা লেগুনা আসছে, মানুষ পঙ্গপালের মতো হুড়মুড় করে ঘিরে ফেলছে। বারো-পনেরো জন যুদ্ধ জয় করে চড়ে বসছে, বাকিরা ব্যর্থ হয়ে অপেক্ষা করছে পরের গাড়ির। আমিও সেই পঙ্গপালেরই একজন সদস্য আপাতত। যে করেই হোক, একটা লেগুনায় উঠে বসতে হবে।
ইচ্ছে করছে একটা সিএনজি নিয়ে আরাম করে বাসায় চলে যাই। ব্যাগের দিকে তাকালাম। চেইনটা ভেঙে আছে, এই পুরনো ব্যাগটা বদলানো দরকার। রাস্তার অপরপাশে ভ্যানই ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। কলেজপড়ুয়া মেয়েরা এসব ভ্যানের পাশে ভীড় করে আছে। ছাত্রজীবন শেষ করার পর আমার এ তল্লাটে কমই আসা হয়। সে যা-ই হোক, ভাবছিলাম এখন যাবো কিনা একটা ব্যাগ কিনতে। কিন্তু গিয়ে তো লাভ নেই। ব্যাগে আছে গুনেগুনে সাঁইত্রিশ টাকা। সাঁইত্রিশ টাকায় নতুন ব্যাগ পাওয়া যাবে না। এ টাকায় সিএনজিও নেয়া যাবে না। সব দরকার সবসময় মেটানো যায় না, সব ইচ্ছেও সবসময় পূরণ হয় না।। আজ একটা রোদচশমা পছন্দ হয়েছিলো, সোনালি গ্লাসে রোদ এসে পড়লে ভালোই দেখাতো, চোখে এভাবে সরাসরি রোদ লাগতো না। সাঁইত্রিশের ডান পাশে একটা শূন্য বসানো গেলেই অনায়াসে কিনে ফেলা যেত রোদচশমাটা।
গত পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাবত চকবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ইতোমধ্যে গোটা পঁচিশেক লেগুনা এসে যাত্রী ভরে চলে গেছে। আরো শ দুইশো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়। কটা নাগাদ একটা লেগুনায় উঠে বসা যাবে কে জানে!
এই দৌড়ঝাঁপের নামই বোধহয় জীবন কিন্তু সবাইকে তো দৌড়াতে হয় না। নাকি সবাই দৌড়ায় নিজ নিজ ভিন্ন ভিন্ন দৌড়? সামনে যাকে হেঁটে আসতে দেখা যাচ্ছে তাকে কি আমি চিনি! চিনিই তো মনে হচ্ছ। সে নাকি! না অন্য কেউ হয়তো। খোদা এতটা নির্দয় হবেন না নিশ্চয়ই। আমি এই ভাদ্র মাসের মধ্য দুপুরে ব্যাগে সাঁইত্রিশ টাকা নিয়ে ঠাঁয় আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার এই জীবন অনায়াসে মেনে নিতে পারি, আমার কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু তাই বলে সামনে সে এসে পড়বে এ আমি কী করে মেনে নিই!
সেই তো। সাদা শার্ট তাকে ঠিক আগের মতোই মানায়। সাথে কাউকে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাওয়াই স্বাভাবিক। তার সাথে কাউকে দেখা যাবে এটাই তো নিয়ম। তাই বলে আমার সামনে এসে পড়া লাগে! আমি এখন কী করবো বুঝতে পারছি না পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকি, যদি একটা লেগুনা আসে, উঠে পড়বো। সে পূবদিক থেকে আসছে, আমার মুখ দেখবে না হয়তো। কিন্তু যদি দেখে ফেলে কী হবে কে জানে চোখে চোখ পড়ে গেলে মোটেও ভালো হবে না চোখ নিচের দিকে থাক আমার। চারপাশে শ-দুইশো মানুষ, এর মধ্যে আমার চোখেই কি চোখ পড়বে তার? পড়বে না সম্ভবত। তাছাড়া সে কথায় মগ্ন। এখনো কি কথা দিয়ে মুগ্ধ করে অন্যকে? করুক। তাতে আমার কী!
একটা লেগুনা আসুক, আমি দ্রুত উঠে পড়তে চাই। আমি পালাতে চাচ্ছি এখান থেকে। সে চলে আসছে অতি নিকটে। আমি চাচ্ছি আমার চোখ ঢেকে রাখতে। কারণ আমার চোখে জল! রোদচশমাটা থাকলে বেশ ভালো হতো। চোখ আড়াল হতো, আড়াল হতো জল, আড়াল হতো আমার অনাহূত কৌতূহল। রোদ রশ্মি ঢেকে ফেলতো আপোসহীন আমার ভেতরকার কোমল অনুভব এই নিদারুণ পৃথিবীকেও দেখা যেত রঙিন কাচে। একটা রোদচশমার বড় অভাব!
জান্নাতুন নুর দিশা, গল্পকার