আনোয়ারুল হক
বসুন্ধরা ফুড কোর্টে হাবিজাবি খেয়ে দীপা তন্ময়কে নিয়ে রওয়ানা হলো ডায়মণ্ড প্যালেসে।
যাবো না যাবো না করতে করতে দীপাকে ফেরাতে না পেরে প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে তন্ময়কে যেতে হলো ওর সাথে। করিডোর ধরে পাশাপাশি যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো তন্ময়, কী কিনবি?
—হীরের আংটি। যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবে, তার জন্যে।
—যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হবে তার জন্যে ? গাছে কাঁঠাল গেঁাফে তেল ! পাগল একটা !
দীপা সাথে সাথে বললো, তা হবে কেন ? অচিরেই বিয়ে হবে, খেঁাজাখুঁজি চলছে বাসায়, দেখিস। আর দেরি নেই।
তন্ময়ও পাল্টা জবাব দিলো, বুঝলাম, হবে। হয়নি তো এখনো। দেখে তো মনে হচ্ছে তোর তর সইছে না!
তন্ময় দীপার অগ্রিম আগ্রহে বিরক্ত। আবার সে দীপাকে ফেরানোর জন্যেই বললো,
—ছেলের জন্য আংটি তো মেয়ের মায়েরা, খালারা দল বেঁধে পাতিহাঁসের গোষ্ঠীর মতো প্যাক প্যাক করতে করতে আশেপাশের সবাইকে জানান দিতে দিতে এসে কিনে নিয়ে যায়। তুই হামলে পড়েছিস কেন ? বেহায়া!
নিন্দা শুনে দীপার সম্মুখগতি একটু শ্লথ হলো। মুখ লুকিয়ে হাসে। কিছু বলে না।
বসুন্ধরার মোজাইক ফ্লোরে মাঝারি হিলের পাদানিতে দীপার ফর্সা দুই পা থেমে গেছে। সরু কোমর বাঁকিয়ে সে তার তন্বী শরীর তন্ময়ের দিকে তেরছা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেনো ফাল্গুনের প্রথম দিনটি থমকে গেছে তেমাথার কোন এক মোড়ে শিমুল তলায়। চোখের ক্যানভাসে সবুজ পাতার ফাঁকে একটু লাল রঙ ঠেঁাটে, গালে। চারিদিকে মানুষের ভীড়ে দীপাকে আজ লাগছে পুরোনো দিনের নায়িকা বৈজয়ন্তী মালার মতো। স্নিগ্ধ, সুকোমল।
তন্ময় দেখছে, একটু গোলাপি আভার ললাটের ওপর দুই পাশ জুড়ে একগুচ্ছ অগোছালো কেঁাকড়ানো চুল আলসেমিতে গড়াচ্ছে, মাথার পিছনে ঘন কালো চুলের এলো খেঁাপা, পড়নে ঢলঢল সেলোয়ার কামিজ। চাপা ঠেঁাটে লুকোনো হাসি আর কুচুটে চাহনীতে তন্ময়ের চোখ থেমে আছে। সেই চোখে চোখ রেখে দীপা জিজ্ঞেস করলো,
— মেয়ের মা আর তার বোনেরা কনের বরের জন্য আনন্দ করে আংটি কিনতে আসবে আর তুই তাকে কী বললি ? হাঁসের মতো প্যাক প্যাক করতে করতে..!
তন্ময় এবার বিব্রত বোধ করলো। বললো,
—তুই কি রাগ করেছিস ? সরি, আমি কিন্তু কিছু ভেবে বলিনি।
বিব্রতকে নি:শঙ্ক করে দিতে দীপা হেসে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে পড়ে। আশেপাশে পাশ কাটানো মানুষজন তারাও হাসিমুখে
দীপাকে দেখছে। অপ্রস্তুত তন্ময়কে দীপা বললো,
—হি হি হি, তুই তো আমার মাকে দেখিস নি। গলার আওয়াজটা মায়ের অমনই। লেডি পাতিহাঁসের মতো। তোর উপমাটা আমার পছন্দ হয়েছে। হি হি হি, এবার চল্।
বলে সরে এসে দীপা তন্ময়ের হাত ধরে।
কারণে অকারণে দীপার এই হাত ধরার অনুভূতি তন্ময় একটু সংকোচের সঙ্গে হজম করে, উপভোগও করে। কেননা ওদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক তাতে একে অপরের হাত ধরাটা একটু বেশিই বটে। কিন্তু দীপা প্রায়ই অনায়াসে তন্ময়ের হাত ধরে দ্বিধাহীন। বরাবর দক্ষিণের জানালার মতো মনের ভিতরে তার আলো হাওয়া খেলা করে অহরহ— এমন একটি মেয়ে দীপা। তন্ময় জিজ্ঞেস করলো,
—হীরের আংটি কিনবি। এত টাকা তুই পেলি কোথায় ?
—কোথায় পাবো আবার, মায়ের আলমারিতে শাড়ির নিচ থেকে নিয়েছি।
দীপার জবাব শুনে যুবকের দম আটকে আসতে চাইলো কণ্ঠার কাছে। দ্রুত খাতার পাতা ছেঁড়ার মতো কণ্ঠে সে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, কী? কী বললি ? টাকা চুরি করেছিস তুই ?
দুষ্টুমির হাসি দীপার মুখে। মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
—আরে, কী মুসকিল, চুরি করবো কেন রে বোকা ? মা বলে রেখেছে, যখন যা লাগে ওখান থেকে নিতে। তাই নিয়েছি। টাকাওয়ালার ছেলেমেয়েরা এভাবেই যখন খুশি টাকা নেয়, বুঝলি।
বলতে বলতে দীপা ডায়মণ্ড প্যালেসে ঢুকে।
তন্ময় তার সামনে ডানে বায়ে শোকেসে ঝকঝকে বাহারি ডিজাইনের গয়নার ঝলমলে আলোয় কেন জানি আনমনা হয়ে যায়। দীপা মনোযোগ দিয়ে তার পাশে হীরের আংটি দেখে।
তন্ময় জানে, দীপা বিরাট বড়লোকের মেয়ে। কত বড়, টাকাওয়ালা লোকের মেয়ে সেই ধারণা কথায় কথায় দীপা তাকে দিয়েছে। ওর তুলনায় আর্থিক স্বচ্ছলতার দিক থেকে তন্ময়রা কিছুই না। স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত। অভাব নেই এবং স্বাচ্ছন্দ আছে জীবনে, এমন পরিবার তাদের। গ্রিণরোডে একটা ফ্লাটবাড়িতে মা—বাবা আর স্কুলে পড়ুয়া ছোট বোন নিয়ে সরল দিনযাপন। পড়াশুনা শেষে হন্যে হয়ে চাকুরি খুঁজতে হবে তেমন নয়। বাপের তহবিলে জায়গা সম্পত্তি আছে বেশ, যাতে চলে যাবে বছর কে বছর।
দীপার সঙ্গে তার পরিচয় ফেসবুকে। কথায় কথায় একদিন দুজনেই মিলে গেলো। ফুরফুরে সময় গড়ালো, হাসি আনন্দে ছবি বিনিময় সব হলো দিনের পর দিন, কতো কথা ! কিন্তু কেউ কারো পারিবারিক পরিচয় জানতে চাইলো না, চাইলো না দুজনের দেখাদেখি হোক। বিগত দুই বছর ধরে চ্যাট করতে করতে একদিন দুজনে রাজি হয় মুখোমুখি হতে, তবে একটা শর্তে। আর শর্তটা দুজনেই মেনে নেয়।
অবশ্য ততদিনে জানা হয়ে গেছে ওরা উভয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। দীপা কলাভবনে অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষে আর তন্ময় কার্জন হলে ক্যামেস্ট্রিতে শেষ বর্ষ। সব ঠিকঠাক থাকলে এ বছর বের হয়ে যাওয়ার কথা তন্ময়ের। দেখা হওয়ার
প্রথম দিনেই দীপা হাসতে হাসতে তাকে বলে দিয়েছিলো,
—সে একজন ঋণখেলাপির মেয়ে। যাকে বলে নামকরা শিল্পপতি। দেশে বিদেশে বাড়ি আছে একাধিক, গাড়ি আছে কয়েকটা। দুই হাতে সে টাকা খরচ করে। ওকে কখনো কোন উপহার তন্ময়ের কিনে দেওয়া চলবে না। নিতে ভাল লাগে না। দিতে ভাল লাগে। সে কোন কিছু দিলে তন্ময়কে হাসিমুখে নিতে হবে। মধুর ক্যান্টিনে, রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়া চলবে তবে সেখানেও দীপা বিল দেবে, সে নয়। আর..
তন্ময়ের হাসিমুখ প্রশ্ন, আর ?
—আমরা বন্ধু হবো বন্ধুর মতো। আর.. অলঙ্ঘনীয় শর্ত হলো—
—শর্ত ?
—কেউ কারো প্রতি দুর্বল হওয়া চলবে না। দীপা মাথা ঝাঁকিয়ে জানতে চায়, রাজি ?
—রাজি। তন্ময় হেসে জবাব দেয়।
এই শর্ত মেনে ওরা দুজন বন্ধু। মুখ দেখাদেখির পর বন্ধুত্বের ছ‘মাস গত হয়েছে।
বামদিক থেকে দীপার কনুইয়ের ধাক্কায় তন্ময়ের আনমনা মন ফিরে আসে ওর দিকে। দীপা বেশ কয়েকটা হীরে বসানো আংটি নাড়তে নাড়তে বলে,
—এই তন্ময়, দেখতো, কোনটা পছন্দ হয় তোর—
চাপা কণ্ঠে পাশ থেকে তন্ময় দীপাকে ধমক্ দেয়, এই কী বলছিস্ তুই ? আমার পছন্দ মানে ? বর তোর, তুই পছন্দ কর, গিল্লিগিল্লি কোথাকার..
—রাগ করিস্ ক্যান, আমার বর তো কী হইছে ? তোর পছন্দ করতে দোষ কী ? দে, তোর হাতটা দে তো দেখি..
বলে দীপা তন্ময়ের ডান হাতটা ধরে টেনে এনে রিং ফিঙ্গারে হিরের আঙটিটা পরিয়ে দিয়ে দেখে।
এরমধ্যে দোকানি তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে,
—লজ্জ্বা পাচ্ছেন কেন স্যার। দেখুন দেখুন, আপনাকে কিন্তু বেশ মানিয়েছে।
দোকানীর এই কথায় দীপাও সায় দেয়। মুচকি হেসে বলে,
—তাইতো, লজ্জ্বা পাচ্ছিস্ কেন ? দেখতো, তোকে বেশ মানিয়েছে কিন্তু !
তন্ময়ের হাত কাঁপে। ঠাণ্ডা হয়ে আসে শরীর, বুক কাঁপে। দাঁতে দাঁত চেপে দীপার প্রগলভতা হজম করে। হাসি ফিরিয়ে দেয়। আঙটি পছন্দ করে বিল দিয়ে রিংয়ের বাক্সটা ভ্যানেটি ব্যাগে রেখে দীপা তন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তরল কণ্ঠে বলে,
—ভ্যালেন্টাইনস্ ডে’তে আমাকে দেখতে আসবে সে। সেদিন তাকে পরাবো।
—তাই না কি ? আগে বলিস নি তো ! খুব ভাল।
—আগে বলার কী আছে ! সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে বিয়েতে যাবি, আমাকে আশীর্বাদ করে আসবি। যাবি না ? সেদিনটা আবার ভুলে যাসনি যেনো !
বলতে বলতে দীপা বসুন্ধরা থেকে বের হতে হতে তন্ময়ের হাত ধরে।
এরপর থেকে দুজনেই কেন জানি চুপচাপ, সেদিন ওরা বসুন্ধরার সামনে থেকে যার যার ঘরে ফিরে যায়। সেই রাতে বিছানায় দীপার ঘুম আসে না। ওদিকে তন্ময়েরও।
ফেব্রুয়ারির এক তারিখ থেকে বইমেলা শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ওরা দুজনে মেলায় আসে। দীপা তার প্রিয় কবির কবিতার বই কিনে। জুননুরাইনের এয়া। উপহার দেয় তন্ময়কে। টিএসসির ঘাসের বিছানায় বসে বিকেলে দুজনে একে অপরকে কবিতা পড়ে শোনায়।
তারপর এক সময় সবকিছু বাদ দিয়ে কখনো একে অপরের মুখের দিকে, কখনো ঘাসের ডগায় চোখ রেখে চুপচাপ বসে থাকে, যা নাকি ‘একে অপরের প্রতি কখনো দুর্বল হওয়া যাবে না’ এই শর্তের সঙ্গে মিলে না। সাহস করে কেউ কাউকে না বলা কথাটা বলেও না।
এর ভিতরে একদিন। পৃথিবীতে বহু অবাক করা ব্যাপার ঘটে, যার কোন ব্যাখ্যা থাকে না। এটিও তেমনি। ভালবাসা দিবসের আগের রাতে দীপা এবং তন্ময় ঘুমের মধ্যে প্রায় একই রকম স্বপ্ন দেখলো। অপরাজেয় বাংলার নিচে দাঁড়িয়ে একজন আরেক জনকে বলছে,
—কী বলবি বল, বলে ফেল। দীপা বললো,
—আমার বুক কাঁপে, গলা শুকায় তোকে দেখলে—
—ডাক্তারের কাছে যা। দীপার প্রেসক্রিপশান।
—ডাক্তারের কাছেই তো এসেছি।
—আমি কি ডাক্তার না কি ? তাহলে তো আমার রোগ আমিই সারাতে পারতাম। আমারও তো তোকে দেখলে বুক কাঁপে, গলা শুকায়।
—তাই নাকি ? তাহলে !
এরপর দুজনেরই ঘুম ভেঙ্গে যায়।
সেদিন সকালের কমলা রোদে দীপা পড়েছে বাসন্তি রঙের শাড়ি, মিলিয়ে ব্লাউজ, কপালে লাল টিপ। তাকে দেখেই তন্ময়ের গলা শুকায়, বুক ঢিপঢিপ করে। তন্ময়ের জিন্সের প্যান্টের ওপর সাদা কাজের ঝুল পাঞ্জাবি গলায় উত্তরীয়। মুখে মানানো দাড়ি। ওটা এই সময়ের ফ্যাশান।
তন্ময়কে দেখে উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসা দীপার হাত চলে যায় ভ্যানেটি ব্যাগে। দেখলো, জিনিষটা আছে তো ঠিকঠাক ! আঙুলে স্পর্শে বুঝে, আছে।
এদিকে দিনের শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, চারুকলা, বাইমেলা সারা এলাকা জুড়ে আজ রঙে রঙিন হয়ে আছে ভালবাসা দিবস। তারুণ্য উচ্ছ্বাসে আনন্দে চারিদিক মাতোয়ারা। দীপা আর তন্ময়ও আছে এর ভিতরে। এখন চারুকলার বকুলতলায় বসে আছে দুজনে। তাদের দেখে ফুলের মুকুট নিয়ে এগিয়ে এলো একটি পথ বলিকা। তন্ময় হাত বাড়িয়ে একটি মুকুট নিল। দাম মিটিয়ে দিয়ে কোন কথা না বলে পড়িয়ে দিল দীপার মাথায়। দীপা হাসিমুখে চোখ বন্ধ করে উপহার গ্রহণ করলো। বললো,
—এটা পরিয়ে দিতে তোর ভাল লাগছে ? তন্ময় মুখে কিছু বলে না। হাসে। দীপার মনে হলো হাসিটা মলিন। বললো,
—মনে হলো তোর যেনো হাত কাঁপলো। আচ্ছা, সত্যি করে বলতো তন্ময়, আমার কাছে এলে তোর গলা শুকায়, বুক কাঁপে?
তন্ময় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে দীপার চোখের তারায়। তারপর মাথা নাড়ে, হ্যঁা।
দীপা আর দেরি করে না। বলে,
—তাহলে চল্ শর্তটা ভেঙ্গে ফেলি। দীপা প্রায় বাতাসের স্বরে তন্ময়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
—জানিস্, আমারও তোর কাছে এলে কেমন কেমন জানি লাগে!
এ সময় চারুকলার বকুলের ডালে একটা মাতাল কোকিল ডেকে যায়, কুউউ ! কুউউ..
সেই পাগল করা ডাক শুনতে শুনতে মিলিয়ে দীপা তন্ময়কে ডাকে,
—দেখি, তোর হাতটা দে। আঙটিটা সেদিন আমি কিনেছি তোর জন্য। বুদ্ধু কোথাকার !
বিকেলের আলোতে ঝিলিক্ দিয়ে ওঠে দীপার হাতে ধরা হীরের চমক।
তন্ময়ের বুকের ভিৎ ঝরে পড়া বেড়ার ঘরের বাঁশের পালার মতো নড়ে। দীপার হাতের দিকে বাড়াতে গিয়ে তার ডান হাতের আঙুল কাঁপে, বুক কাঁপে, গলা শুকায়।
আনোয়ারুল হক, গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত