এখন সময়:বিকাল ৫:৩৯- আজ: বৃহস্পতিবার-৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৫:৩৯- আজ: বৃহস্পতিবার
৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

বাংলা কবিতায় বর্ষার রূপ, তাৎপর্য ও বিবর্তন

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

বাংলা সাহিত্যে ঋতুর গানে বর্ষা একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। ষড়ঋতুর এই দেশে বর্ষা শুধু জলবায়বীয় পরিক্রমার অংশ নয়, বরং তা এক আবেগঘন, অনুভব সমৃদ্ধ ও চিত্রকল্পবহুল অভিজ্ঞতা। বাংলার মাটি, নদী, বৃক্ষ, কৃষক, প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা পথিক সবাই বর্ষায় যেন নতুন করে জেগে ওঠে। কবির হৃদয়ে বর্ষা একদিকে যেমন প্রেম ও প্রতীক্ষার রোমান্টিক রূপ নিয়ে ধরা দেয়, তেমনি অন্যদিকে বিরহ, নিঃসঙ্গতা ও আধ্যাত্মিক উন্মোচনের প্রতীকও হয়ে ওঠে। বাংলা কবিতায় বর্ষার এই বহুমাত্রিকতা আমাদের সাহিত্যকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব বাংলা কবিতায় বর্ষার বন্দনার রূপ, তাৎপর্য ও বিবর্তন।

 

প্রথমেই আসা যাক প্রাক-মধ্যযুগীয় কাব্যে বর্ষার প্রতিফলন। বাংলা সাহিত্যের আদি পর্যায়ে বর্ষা বন্দনা মূলত লৌকিক আবহে, কৃষিভিত্তিক সমাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। চর্যাপদের কবিগণ বর্ষাকে আধ্যাত্মিক গূঢ়তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। “বৃষ্টি পড়ে টিপ টিপ”ত্মএই ধরনের ধ্বনিমূলক চিত্রকল্প মধ্যযুগীয় কবিতায় প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ চিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বারামাসি পদাবলিতে বর্ষা মাস

 

একধরনের বিচ্ছেদ ও অপেক্ষার মাস। কৃষক-কন্যা কিংবা পতিব্রতা নারীর কণ্ঠে বর্ষা হয়ে ওঠে দীর্ঘশ্বাসের প্রতীকত্ম“আষাঢ় মাসে বাজে বাদল / নাহি আসেন প্রিয়তম।” এখানে বর্ষা শুধু প্রকৃতি নয়, অন্তর্জগতের একাকিত্বের রূপকও বটে।

 

এবার আসা যাক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বর্ষার রোমান্টিক রূপ প্রসঙ্গ। বলা বাহুল্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে বর্ষার বন্দনাকে এক পরিশীলিত, দার্শনিক ও রোমান্টিক রূপ প্রদান করেছেন। তাঁর ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতাগুচ্ছ, ‘সোনার তরী’, ‘স্মরণ’, ‘ছিন্নপত্র’ কিংবা ‘গীতবিতান’-এর অসংখ্য গানে বর্ষা এক বহুবর্ণ আবেগে মূর্ত হয়েছে। তিনি লিখেছেন: “বাদল-দিনে এলে আমার মনের মাঝে/ গোপন বসন্ত-মরুরাজে।”

 

রবীন্দ্রনাথের বর্ষা প্রকৃতির প্রতি এক নিসর্গ-আস্থার রূপ, আবার তা মনের মেঘলা আবহাওয়ার উপমাও। প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষার, আশাবাদের প্রতিচ্ছবি এই বর্ষা। তাঁর ভাষায়, “আজি ঝরঝর মুখর বাদলদিনে/প্রাণের মাঝে আসো তুমি গোপনে।”

এখানে বর্ষা মানে শুধু বৃষ্টি নয়, প্রেমিক হৃদয়ের অন্তরালে আসা সেই গোপন আবেগও। রবীন্দ্র কবিতা ও ছড়ায় বর্ষার যতটা বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়; বাংলা সাহিত্যে ততটা আর দেখা যায় না।

 

এবার আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছড়া ও কবিতায় বর্ষা বন্দনা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। বিদ্রোহ ও প্রেমের বর্ষা নজরুলের কবিতায় বর্ষা একদিকে যেমন প্রেমের গান, তেমনি বিদ্রোহের অগ্নিবাণ। তিনি বর্ষার মেঘ, বজ্রপাত ও জলধারাকে বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যা সাধারণত বাংলা সাহিত্য এমনকি অন্য কোনো ভাষার কবিতায় সচরাচর দেখা যায় না। নজরুল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বর্ষা-সন্ধ্যা’তে লিখেছেন:

“ঘন ঘোর বরিষায়/ধরা দেয় কাঁপিয়া কাঁপিয়া/বিষণ্ন অলিন্দে তুমি,/ কার তরে হায়!”

 

এখানে বর্ষা প্রেম ও নিঃসঙ্গতার দ্বৈত আবেশে মিশে গেছে। আবার অন্যত্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঝড়-বৃষ্টি এক মহান দ্রোহের উপমা হয়ে ওঠে। তাঁর বর্ষা ভয় ডরহীন, বীরত্বময়। ঝড় ও ঝঞ্জার মতোন সংক্ষুব্ধ, অন্যায়, জুলুম, নিপীড়ন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা। রবীন্দ্রনাথের বর্ষা যেখানে প্রেমময়, রোমাঞ্চকর; সেখানে কাজী নজরুল ইসলামের বর্ষা যেন দ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

 

এবার কবি জীবনানন্দ দাশ ও বর্ষার বিষণ্নতা প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। বাংলা আধুনিক কবিতার শ্রেষ্ঠ কণ্ঠস্বর জীবনানন্দ দাশ বর্ষাকে চিত্রকল্প ও নিঃসঙ্গতার ছায়া দিয়ে মোড়ানো এক আবহমান বেদনারূপে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় বর্ষা যেন মাটি, জল, আলো ও মৃত্যুর মধ্যে সংলগ্ন এক নিস্তব্ধ ধ্যান। তিনি লিখেছেন: “আষাঢ়-শ্রাবণ, গাঢ় অরণ্যের ধ্বনি,/ তুমি এসেছো, কাদামাটি আর সাপের চলাচলের ঘ্রাণ নিয়ে।”

 

জীবনানন্দের বর্ষা কখনো পুরনো দিনের স্মৃতিপ্রবণতা, কখনো বা অস্তিত্বগত বিষণ্নতা বহন করে। বর্ষা এখানে বাস্তবতার সীমান্তে দাঁড়িয়ে সময়ের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া। উপরোক্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলা সাহিত্যে কবি বিশেষে বর্ষাও বিচিত্র রুপে দৃশ্যমান। প্রায় সকল শক্তিমান কবির কবিতায় বর্ষা যেন জীবনের বিবিধ অনুষঙ্গ।

 

এবার আধুনিক কবিতায় বর্ষার রূপান্তর নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। পূর্ব ও মধ্য-আধুনিক বাংলা কবিতায় বর্ষা যেখানে প্রকৃতি ও প্রেমের প্রতীক, সেখানে আধুনিক কবিতায় তা হয়ে ওঠে বিভ্রান্তি, অস্তিত্ব সংকট বা নাগরিক নিঃসঙ্গতার ভাষা। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী প্রমুখ কবিরা বর্ষাকে নাগরিক সংকট, সম্পর্কের জটিলতা ও আত্মপরিচয়ের আভাসে রূপান্তরিত করেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় বর্ষা যেন স্মৃতির জানালায় বৃষ্টির শব্দ হয়ে ফিরে আসে। তিনি লিখেছেন, “বৃষ্টির শব্দে জেগে উঠি, পুরনো মুখ ভেসে ওঠে ঘুমঘোরে।”

 

আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’-এ বর্ষা কখনো কৃষিজীবী সমাজের রসদ, আবার কখনো প্রেমিকার চুলে জমে থাকা বৃষ্টির বিন্দু। আধুনিক নারী কবিতায় বর্ষার নতুন ভাষা তসলিমা নাসরিন, জাহানারা নূর, নাসরীন জাহান প্রমুখ আধুনিক নারী কবিতায় বর্ষা এক আত্মবীক্ষণের প্রতীক। এখানে বর্ষা নারী-জীবনের জটিলতা, প্রতিবন্ধকতা ও প্রতীক্ষার অনুষঙ্গ হয়ে উঠে আসে। কখনো তা মেয়ে শিশুর চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখা, কখনো বা গৃহবন্দিত্বের প্রতীক।

 

নব্য আধুনিক ও পরাবাস্তববাদী কাব্যে বর্ষা নব্বইয়ের পরবর্তী সময়ে যেসব কবি পরাবাস্তববাদ, অস্তিত্ববাদ এবং বিমূর্ততা নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের কবিতায় বর্ষা এক অদ্ভুত স্বপ্ন-ভঙ্গের উপকরণ। এখানে বর্ষা মানে আর শুধু মেঘ নয় এ এক ‘ভিজে-জেগে-থাকা আত্মা’। বৃষ্টির শব্দ হয়ে ওঠে নিঃশব্দ আত্মঘাতী আত্মার আকুতি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, “বর্ষা নামে হৃদয় ছুঁয়ে / নিঃশব্দে কেউ হাঁটে / গোধূলির আকাশে আত্মার ছাতা খুলে।”

এই ধরনের কাব্যে বর্ষা এক অতীন্দ্রিয় অস্তিত্ব, যেখানে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

 

সবশেষে বলতে চাই, বাংলা কবিতায় বর্ষা বন্দনা কেবল প্রকৃতির প্রশস্তি নয়, তা মনুষ্যজগতের আবেগ, স্মৃতি, প্রেম, বেদনা ও প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবিও। যুগে যুগে কবিরা বর্ষাকে দেখেছেন ভিন্ন ভিন্ন চোখে। প্রেমিকের, বিপ্লবীর, নিঃসঙ্গ পথিকের কিংবা আত্মঘাতী আত্মার চোখে। বর্ষার এই বহুবর্ণ রূপ বাংলা কবিতাকে করেছে প্রাণবন্ত, আবেগময় ও চিরন্তন। বাংলা কবিতা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন বৃষ্টির শব্দে জেগে উঠবে প্রেম, প্রতীক্ষা ও প্রজ্ঞার এক অপরিমেয় জগৎ।

 

 

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ, প্রাবন্ধিক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।