জয়নুল টিটো:
বাঁশের লাঠিটার আগাগোড়াই গিরা। মাপে দুই হাত মতো হবে। টনটনে। যে কাউকে কাবু করতে এর একটা
ঘাঁ…ই যথেষ্ট। হয়েছে ও তাই।
বাংলোর খোলা বারান্দার আরাম কেদারার নিচে গোংগাচ্ছে পরিতোষ বাবু।
কেন গোংগাচ্ছে? ঘটনাটাই বা কী?
সেটাই বলছি…।
পরিতোষ বাবু এ বাগানে জয়েন করেছে বছর তিনেক হতে চললো। কেতাদুরস্ত ভদ্দরলোক।
ধবধবে সাদা কোর্তা সাথে সাদা প্যান্ট আর সাদা জুতো ।
এ বেশভূষাতে দেখলে যে কারোরই সমীহ জাগার কথা।
গায়ে গতরে দামি খুশবো লাগায়। সাহেবি কায়দায় সিগারেট ফুঁকে। কালো রোদচশমা লাগিয়ে বাগানের এবড়ো থেবড়ো পথ ধরে হেঁটে গেলে অনেকগুলো কালো চোখ একসাথে হামলে পড়ে ।
ভুরভুর করে খুশবু বেরোয়।
খুশবু একরাশ আরাম নিয়ে আসে ঘার্মাক্ত মুখগুলোর মাঝে।
তার চলে যাওয়ার পরেও বাগানের কচিপাতায় খুশবু ভেসে বেড়ায় ।
বাগানের মেয়ে ছেলেরা সেই পাতা খুঁটে পেছনের কাপড়ের পুটলায় ফেলার আগে এক আধটু নাকে ছুঁয়ে নেয়।
কাজটা অবশ্য বেশি করে মালতি ।
মালতি কাজের ফাঁকে ফাঁকে সাদা বাবুকে দেখে আরাম পায়।
পরিতোষ বাবু খুব একটা এদিক ওদিক তাকায় টাকায় না। বাগানের চৌহদ্দি দেখে আর পেছন পেছন হাঁটতে থাকা হারাধনের দিকে সন্দেহের নজর ফেলে বলে-
Ñ ছায়া গাছগুলো বোধ হয় হাঁটতে শিখেছেরে হারাধন!
চোখের অলক্ষেই বাগান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে !
হারাধন, সেয়ানা লোক। মাথা নাড়ায় কেবল।
গোটা বাগান চক্কর দিয়ে পরিতোষ বাবু যখন বাংলোয় ফিরে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দেয়, হারাধন মাথার পেছনে দাঁড়িয়ে বাতাস করে।
এ কাজে তার কোন ক্লান্তি নেই। অবশ্য তার বাপের ও ক্লান্তি ছিলনা।
সেই হারাধন ভ্যাবাচেকা খেয়ে কেদারার পেছনেই দাঁড়ানো। আর কেদারার নিচে মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরে গোংগাচ্ছে পরিতোষ বাবু।
হবিগঞ্জের ডানকান টি এস্টেটের ম্যানেজার।
Ñতো! ঘটনাটা কী?
সেটাই বলছি।
চা বাগানের চৌহদ্দি তারকাঁটায় ঘেরা। বড় অংশই সমতল।
মাঝ দিয়ে এবড়ো-থেবড়ো পথ চলে গেছে পাড়া পর্যন্ত।
ও পাড়ায় বাগানের কুলি কামিনদের বাস।
ছোট একটা বাজার আছে পাড়ার শেষ কোনায়। সন্ধ্যে হলে চা শ্রমিকরা আড্ডা জমায় বাজারে।
বেটা ছেলেরা রস পানি খায়। মেয়েরা সওদাপাতি করে। আবার কেউ কেউ টং দোকানে গাল গপ্পে মজে থাকে।
মালতি রোজ সন্ধ্যায় কেতকীর চা দোকানে বসে।
গাল গপ্প করে। কথায় কথায় কলকলিয়ে হাসে।
মালতির ঢেউ তোলা হাসি পাড়ার উঠতি ছাওয়াল থেকে শুরু করে আইবুড়া কানা কার্তিকের বুকের মধ্যিখানে ধাক্কা মারে। কানা কার্তিক তার হাজার সুতায় পেঁছানো আতসীকাঁচের ঘোলাটে চশমাটা নাকের ডগায় টেনে ধরে, মালতির ঢেউ তোলা হাসি আর গতর দেখে।
পাড়ার প্রায় সবার আগ্রহের জায়গা কেতকীর চা দোকান।
শুধু পিত্তি জ্বলে রাহু সন্যালের। মাঝে সাঝে দেখা যায় রাহু, রসের বোতলটা হাতে নিয়ে টলতে টলতে দোকানে ঢুকে মালতির চুলের ঝুঁটি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। পাড়ার দিকে। যেতে যেতে খিস্তি আওড়ায়।
মালতি পোষমানা জন্তুর মতো সোজা হাঁটে।
কোন প্রকার রা করেনা।
রাহু সন্যাল মালতির স্বামী।
চুলের ঝুঁটি ধরা ছাড়া তার আর কোন মুরোদ নেই।
সারাদিন রসের হাঁড়িতে টাল হয়ে থাকে। মালতি আর হাঁড়ি এছাড়া তার কোন জগত নাই।
চুলের ঝুঁটি ধরাতে মালতির কিছু যায় আসেনা।
দু’গোছা চুল ধরাতেই রাহু সন্যালের পৌরুষ সীমাবদ্ধ।
উবু হয়ে থাকা ঝুপড়ি ঘরটার দরোজা অব্দি পৌঁছানোরও মুরোদ নেই।
মালতি খুব করে জানে, চৌকাঠ পেরোনোর আগেই ধপাস করে পড়ে যাবে রাহু সন্যাল।
অত:পর, হাত পা ব্যাঙের মতো ছড়িয়ে দিয়ে নাক ডাকতে থাকবে।
বিহানে দেখা যাবে রাহু সন্যালের বাসিমুখে মাছি ভন্ভন্ করছে। মালতির ওসব চোখ সওয়া ।
মালতি বুঝে শুনেই কিছু বলেনা।
পাড়াতে শকুনের চোখ এড়াতে তার একটা মরদ দরকার ।
রাহু সন্যাল সেই মরদ।
বাংলোর আরাম কেদারার একপাশে গিরা বাঁশের লাঠি হাতে গোখরার মতো ফোঁস ফোঁস করছে রাহু সন্যাল।
কেদারার নিচে গোংগাচ্ছে ম্যানেজার পরিতোষ বাবু।
এর আগে অবশ্য দু’চার ঘাঁ হয়ে গেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় কাঠ হয়ে আছে হারাধন।
রাহু সন্যালের হঠাৎ কি এমন হলো যে, বাবুর গায়ে হাত!
এ তল্লাটে এমন ঘটনাতো আগে কখনো ঘটেনি!
বিষয়টা খোলসা করা দরকার ।
যে বার প্রথম পরিতোষ বাবু বাগানে এলেন, তখন ঝুম বৃষ্টি। বাংলোর বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার চোখ আটকে যায় দূরের এক শিরিষ গাছের তলায়। কাপড়ের পোটলা মাথায় এক যুবতী মেয়ে কাক ভেজা হয়ে দাড়িয়ে আছে ।
আনকোরা নতুন ম্যানেজার পরিতোষ বাবু ।
তার কাছে মায়া লাগে। ছাতা নিয়ে সোজা বেরিয়ে যায় শিরিষ গাছের দিকে।
কাছে যেতেই তার শরীরে কাঁপন ধরে।
আধ ভেজা কালো মেয়ে। শাড়ী লেপ্টে আছে গতরে।
শরীরের বাঁক স্পষ্ট। চোখ তার সরে না।
মনে মনে রবীন্দ্রনাথ কথা বলে-
Ñ দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ
কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি…
ছাতাটা এগিয়ে ধরে কালো মেয়ের মাথায়।
মেয়েটি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। হিসেব মেলেনা।
সাদা বাবু। বাগানে নতুন বোধ হয়!
সামনে এগোতেই পিচ্ছিল কাদায় ধপাস। অনভ্যস্ত ম্যানেজার।
খিলখিল করে হেসে ওঠে কালো মেয়ে। শরীর দোলে।
হাত ধরে টেনে তুলে।
হাসি আর থামেনা। বৃষ্টির আওয়াজ হারায় হাসির শব্দে।
পরিতোষ বাবুর ধবধবে সাদা পোষাক কাদায় মাখামাখি।
বাংলোর নিচে এলে কালো মেয়ের হরিণ চোখ নাচে,
Ñ যাই বাবু। তুই বড়ো বোকা আছিসরে বাবু!
বলেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে বৃষ্টি মাথায় চলে যায় মেয়েটি।
একমনে কালো মেয়ের চলে যাওয়া দেখে নতুন আনকোরা ম্যানেজার ।
অবশ্য ক’টা দিন পরেই সে জেনে গেছে মেয়েটির পরিচয়।
মালতি ।
বাগান শ্রমিক ।
মালতি ও ততোদিনে জেনে গেছে আনকোরা বোকা লোকটি বাগানের নতুন বাবু। ম্যানেজার বাবু।
মালতি তাকে “সাদা বাবু’’ নামেই ডাকে।
ডানকান টি এস্টেটের ম্যানেজারের বাংলোটি দেখার মতো।
বনেদী ভাব আছে। বৃটিশ কায়দায় তৈরী বাংলোয় ফায়ার প্লেস থেকে শুরু করে সকল সুবিধাদিতে ঠাসা ।
পাড়ার কিছু লোক পালা করে কাজ করে বাংলোয়।
ম্যানেজারের রান্নার কাজ করে ¯হানীয় এক বাবুর্চি।
মশালচির কাজ করে মালতির শাশুড়ী হরিবালা। মাঝে সাঝে মালতিও এসে হাত লাগায়।
ম্যানেজার পরিতোষ বাবুর কাছে মালতি! ভুল করে বাগানে নেমে পরা কালো পরী।
পরী কখনো কালো হয় কি না পরিতোষ জানেনা। তবুও মালতি তার কাছে কালো পরী।
মালতি তার সাদা বাবুর আগ্রহ টের পায়। সেও উপভোগ করে ব্যাপারটি।
তবে মালতি দেখেছে তার সাদা বাবুর দৃষ্টিতে কোন কাম নেই। সাদা বাবুর মনটা ও যেন ধবধবে সাদা।
রাহু সন্যালের কাছে ব্যাপারটা অস্বস্তির।
সন্ধ্যায় বাজারে রসের আসরে জনার্ধন, সুবল, তপনরা বাজে কথা বলে ।
ম্যানেজারের সাথে মালতির রঙ্গরসের কাহিনি সাঁধে।
সে এক জ্বালা। পাড়ায়, বাজারে, ছেলে বুড়োর নজর।
আর ওদিকে ম্যানেজার বাবু!
রাহু সন্যাল রসের হাঁড়িতে বুঁদ হয়ে থাকে।
মালতির জন্যে তার খুব মায়া।
দিন কিভাবে এত তাড়াতাড়ি বদলে যায়! রাহু বুঝতে পারেনা। এই তো সেদিনইতো!
বাগানের বয়সী কড়ই গাছের শিকড়ে বসে মালতির খোঁপায় সোনালু গুঁজে দিলে মালতি বলেছিল –
Ñ তুই ছেড়ে গেলে, গলায় ফাঁস দিবো।
মালতি কি এখন ফাঁসের কথা ভাবে?
না কি!
রাহু সন্যাল নিজেই একখান ফাঁসের দড়ি!
বাগানের ছোকরা ম্যানেজার বাবুই যত সব্বনাশের মূল।
ও আসার পর থেকেই মালতির কেমন যেন ডানা গজিয়েছে।
অকারণে খিলখিলিয়ে হাসে।
চোখে কাজল মাখে। চুলে তেল ফিতা।
ঠোঁট লাল করে। খিঁচিয়ে শাড়ী পরে।
ইচ্ছে করেই বাগানের মাঝপথের ধারে পাতা তোলে।
ও পথে রোজ ম্যানেজার বাবু হেঁটে যায়।
রাহু, মাতালের ভান করে সব খেয়াল করে।
রুপার চাদরে থইথই করা এক ভর পূর্ণিমার রাতে ম্যানেজারের বাংলোয় শহুরে বাবুদের আসর বসে।
রাহুর ডাক পড়ে বাংলোয় ।
বাবুদের খাঁটি দেশি রসের যোগান দেয় রাহু।
শহুরে বাবুদের অনেকেই নিতে পারেনি।
অল্পতেই বেসামাল।
বাংলোর খোলা বারান্দা লাগোয়া কামিনি গাছটার গোড়ায় পরেছিল একজন।
আরেকজন তো সিঁড়িতে।
ম্যানেজার বাবু অবশ্য ঠিকঠাক ছিল। ওসব খায়টায় না ।
হারাধন, রাহু, মালতি আরো দু’চারজন মিলে ওদের যতœ-আতিœ করে।
সেই রাতে রাহুর চোখে প্রথম ধরা পরে ব্যাপারখানা।
মালতি যেন একটু বেশি বেশি ম্যানেজার বাবুর কাছে ঘেষছিল।
তাদের দু’জনের চোখের ভাষা ঠিকঠাক পড়তে পারছিল রাহু।
মালতি কি, জল দিতে গিয়ে ইচ্ছে করেই গায়ে ফেলে নি!
রাহু সব বুঝে ।
মাতালের ভান করে সব দেখেছে।
তমাল সর্দার একদিন বাগানের কড়ইতলায় ডেকে নিয়ে রাহুকে বলেছে –
Ñ মালতির ভাবভঙ্গি জুত লাগছেনারে… রাহু!
রাহু কিছুই বলেনি। মাতালের ভাব ধরে ছিল।
সন্ধ্যায় সোজা চলে যায় ফুলির ডেরায়।
রসে মাতাল রাহু উজাড় করে কাঁদে। ফুলি তাকে বুকে ঠাঁই দেয়-
Ñ হামাক লিবি, রাহু?
রাহু কথা বলেনা। হু হু করে কাঁদে।
তার ভেতরটা জুড়ে মালতি। মালতিকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেনা সে।
অথচ ফুলির কাছে রাহু মানিক ধন।
তার কাছে রোজ সাঁঝের বেলায় কত বেটা ছেলে আসে! কারোরেই মনে লয় না।
রাহুর জন্যে তার প্রতীক্ষা বুঝে কার সাধ্য!
হ্যাঁ। ঘটনাটা রাহু ই ঘটিয়েছে ।
গুনে গুনে ছ‘খান ঘাঁ দিয়েছে ম্যানেজারের ঘাড়ে… মাথায়।
গিট্টু বাঁশের লাঠি দিয়ে। টনটনে বাঁশের লাঠি ।
বাঁশঝাড় থেকে বেছে বেছে গিরাযুক্ত চিকন বাঁশের লাঠিটা বানিয়েছে সে।
প্রায় মাস খানেক ধরে ছেঁচে শক্ত সামর্থ্য একটা কাঠামোতে নিয়ে গেছে। বেশ তেলতেলে ভাব আছে লাঠিতে।
ছ’টা ঘা দিতে পেরে রাহুর মনটা শান্তিতে ভরে যায়।
বহুদিন ধরে বুকের মাঝ বরাবর পুষে থাকা দানবটা ফুস করে বেরিয়ে যায়।
তার খুব আরাম লাগে।
চোখ বন্ধ করে বুক ভরে লম্বা শ্বাস নেয়।
তার লম্বা করে শ্বাস নেয়ার আওয়াজ, কেদারার পেছনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হারাধন ঠিকই শুনতে পায়।
কেন ধপ্ করে ঘটনাটা ঘটাল রাহু!
বিষয়টা খোলাসা হওয়া দরকার ।
গতকাল সাঁঝ পেরিয়ে রাত নামলেও মালতি ঘরে ফেরেনি।
রাহু বাজারে খোঁজ করে।
কেতকীর দোকানেও আসেনি। ফুলির ডেরা থেকে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে তমাল সর্দারই মাথায় আগুনটা জ্বালিয়ে দেয়।
Ñ ইধাক খুঁজি লাভ নাই রে রাহু!
দেখি আইলাম, মালতি লীলা করে বাবুর লগে।
বাগানের শিরিষতলায়।
রাহু কিছুই বলেনা।
কে যেন তাকে টানতে টানতে বাগানের পথ ধরে সোজা শিরিষ গাছটার কাছে নিয়ে যায়।
রাহু চুপ করে লুকিয়ে থাকে চা গাছের সারিতে।
চাঁদের আলোয় খলবলিয়ে হাসছে গোটা বাগান।
শিরশিরে হাওয়া লাগে গায়ে। একটা বুনো বিড়াল দৌড়ে গেল কোনার দিকে।
শিরিষের পাতা কাঁপে হাওয়ায়। রাহু শুনতে পায়-
Ñ হামাক লিয়ে যা সাদাবাবু । এ বাগান হামাক টানেনা।
রাহু চা গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পায়,
মালতি লুটিয়ে পরেছে ম্যানেজারের বুকে।
তার এলোচুলে ঢেউ খেলছে ম্যানেজারের দশ আংগুল।
Ñ না, মালতি! আমি এ বাগানেই থাকবো, তোমাকে নিয়ে।
ম্যানেজার বাবুর কথাগুলো সপাং… সপাং করে চাবুক মারে রাহুর বুকে।
না!
আর পারছেনা রাহু।
এ দৃশ্য তার সইছেনা ।
আস্তে আস্তে সরে আসে সে। সোজা চলে যায় ফুলির ডেরায়।
পরদিন সকালেই ঘটে ঘটনাটি ।
চা বাগানের ম্যানেজার পরিতোষ বাবু বাংলোর খোলা বারান্দায় বসে, চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে সবে চোখ রেখেছেন।
হারাধন আরাম কেদারার পেছনে দাঁড়িয়ে বাতাস করছে।
ঠিক তখনি আচমকা বাজ পরার মতো ঘটে ঘটনাটি।
সপাং… সপাং বারি পরতে থাকে ম্যানেজারের ঘাড়ে…মাথায়।
ম্যানেজার কেদারার নিচে হামাগুড়ি দিয়ে কাতরাতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হারাধন।
লাঠি হাতে একটু দূরে ফুঁসতে থাকে রাহু সন্যাল-
– তোর এত বড় হিম্মত আছে! হামাক মালতিকে লুটিস!
ম্যানেজারের কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে।
হারাধন ধাতস্থ হয়ে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে।
রাহু পালিয়ে যায়নি।
ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। লাঠি হাতে।
খবর পেয়ে টি এষ্টেটের ডাক্তার ছুটে এসে মাথাটা ব্যান্ডেজ করে দেয়। ম্যানেজার কাতর দৃষ্টি নিয়ে রাহুর দিকে তাকায়।
রাহুর চোখে মুখে ক্রোধ। ঘৃণা টিকরে বেরোচ্ছে।
ততোক্ষনে ব্যাপারটা গোটা বাগানে ছড়িয়েছে।
চা বাগানের কুলি, কামিন, মজুররা সব জড়ো হয়ে গেছে।
তমাল সর্দারের গলা সব’চে উঁচা –
Ñ ছি… ছি…, তাই বলে কামিন মজুরের দিকে!
হামাক বললেই তো দু ‘চারখান…।
ম্যানেজার পরিতোষ বাবু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
একটু দূরে কড়ই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছে মালতি। কেমন যেন ভয়ে সেঁটিয়ে আছে ।
খবর পেয়েই মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে চলে আসে চুনারুঘাট থানার দারোগা বাতেন সাহেব।
সাথে দু’জন কনস্টেবল। এসেই হাঁকডাক শুরু করেন-
Ñ কার এমন কলিজা!
ম্যানেজারের গায়ে হাত তোলে?
সোজা চালান করে দিবো…,
কম করে হলেও সাত বছরের জেল।
হারাধন রাহুর দিকে আংগুল উঁচিয়ে দেখায় ।
অমনি খপ্ করে ধরে ফেলে দারোগা।
দুই কনস্টেবল হ্যান্ডকাপ পরাতে গেলে,
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ম্যানেজার পরিতোষ বাবু বলে ওঠে,
Ñ ও কে ছেড়ে দেন দারোগাবাবু। ও কিছু করেনি।
আমিই পড়ে গেছি পা পিছলে। মাথায় লেগেছেতো,
তাই সামান্য কেটেছে ।
ম্যানেজারের কথা শুনে উপ¯িহত সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। মৃদু গুঞ্জন শুনা যায় চারপাশে।
নাহ!
কোন পুলিশ কেস হয়নি।
বলা যায় কেস হতে দেয়নি ম্যানেজার।
বাগানের এই খেটে খাওয়া সহজ-সরল মানুষগুলোর জন্য বুকের ভাঁজে ভাঁজে তার মায়া।
এই বাগানে, মালতির কালো হরিণ চোখ তাকে ভালোবাসা বুঝতে শিখিয়েছে।
রাহু সন্যালের জন্যেও তার মায়া লাগে।
সে যখন দারোগাবাবুকে অনুরোধ করে রাহুকে ছেড়ে দিতে, মালতি তখন কড়ই গাছের আড়াল থেকে মাথা বার করে ছিল। রাহুকে ছেড়ে দিতে বলায়,
মালতির চোখে মুখে কৃতজ্ঞতার আভা দেখেছে সে।
দারোগাবাবু চলে গেলে লোকজন ও চলে যায়।
হারাধন বাতাস করে।
বাতাসে ম্যানেজারের ক্ষত মাথায় আরাম লাগে। চোখ বুজে।
বার বার ভেসে ওঠে মালতির ভয়ার্ত উঁকি দেয়া মুখ।
রাহুর হাতের শক্ত লাঠি।
কোনটি তবে সঠিক?
রাহুর কিড়মিড় করা চোয়াল! নাকি মালতির কৃতজ্ঞতামাখা ভয়ার্ত কালো হরিণ চোখ!
পরদিন খুব সকালে ডানকান টি এস্টেটের ম্যানেজার বাংলোটি খালি পরে থাকে।
আরাম কেদারার পেছনে হারাধনের তোড়জোড় চোখে পরেনা। বাংলোর খুব কাছের হরিতকি গাছটার ডালে ডেকে যায় নাম না জানা পাখি।
বাতাসে তিরতির করে কাঁপে সবুজ পাতা।
চায়ের টেবিলে এসট্রেতে অবহেলায় পুঁড়তে থাকে আধ ফোঁকা সিগারেট।
কুন্ডলি পাকিয়ে ধুঁয়া মিলিয়ে যায় ভোরের নরোম হাওয়ায় ।
অন্যদিকে দূর হতে ভেসে আসে ট্রেনের হইসেলের শব্দ।
ঠিক দুপুরে, দারোগার মোটরসাইকেল এসে থামে বাগানের মাঝ পথে ।
আশপাশে চাওর হয় একটি কথা
কে জানি ফাঁস দিয়েছে…। শিরিষ তলায়…।
জয়নুল টিটো, কথাসাহিত্যিক