মনে রেখো ঘাসফুল
রজব বকশী
মনে রেখো ঘাসফুল ফড়িঙের গান
মনে রেখো একসাথে পথে বহুদূর
ভোরের শিশির ধোঁয়া ঝলমল দিন
মৃদুমন্দ বাতাসের আদর চুম্বন
চাঁদনী চত্বরে
মধুমাস
মনে রেখো কালবৈশাখীর ঝড় বৃষ্টি
নীড় ভাঙা দীর্ঘশ্বাস
তবু হালখাতা
নবান্ন উৎসব
শুভ সূচনায়
নব জীবনের ডাক
মনে রেখো ঘাসফুল জীবনের গান
শীতার্ত রাতের ওম
আগুনের দিনগুলো ডেকে যায়
শরৎ বিকেলে শান্ত নদীটির তীরে
ধুধু বালিচর
তবু আকাশের মনে উড়ে কাশবন
মনে রেখো ঘাসফুল হৃদয়ের গান
দিয়েছিলাম খোপায় গুঁজে একদিন
কত বিকেল বসেছি মুখোমুখি অপলক যাদুবাস্তবতা
জোড় কদম দুয়ার খুলে দেহ মন জেগে ওঠে
রিমঝিম বৃষ্টি কিংবা পাতাঝরা দিন
বসন্ত বাতাসে ভেসে আসা গুনগুন
মনে রেখো ঘাসফুল শিকড়ের গান
বাংলা বর্ণমালা রক্তবৃষ্টির কাহিনি
লাল সবুজ পতাকা
দীপ্ত ইতিহাস
নকশী কাঁথার মধ্যে জেগে ওঠে
একটি বাংলাদেশ।
মায়ের জন্য ভালোবাসা
নিতাই সেন
পেয়েছি মায়ের কাছে জীবনের ভারসাম্য
ধীরস্থির স্থিতিশীল জলের আবাস
মা দিয়েছে অনুভূতি আনন্দ-গানের
উৎসাহ কল্পনা আর উদার আকাশ।
মা দিয়েছে জগৎজ্যোতি হিরন্ময় বিশ্বাস
মা দিয়েছে সত্য ধর্ম আলোরেখা জোছনার বট
মা দিয়েছে আকাশ পাহাড় নদী সমতট
মা দিয়েছে সোহাগ-আদর বাঁচার আশ্বাস
আমিতো মায়ের এক অবাধ্য সন্তান
অক্ষম উত্তাপে চষি অবারিত মাঠ
স্বর্গের সিঁড়ি ফেলে নেমে আসি মর্তে
মাকে ভুলে ডুবে থাকি স্বনির্মিত গর্তে।
এক অরক্ষণীয়
জাহাঙ্গীর আজাদ
মরমে লেগেছে সূর্যাস্তের টান
পঞ্চশিলায় শ্যাওলা জমেছে ঢের
বাঘবন্দির চালটিতে শেষ দান
খেলাটির জানি হবে না রকমফের
তবু কার হাতছানির আশায় দিগন্তে রাখো চোখ
পেরিয়ে এসেছো, সমুখেও আঁধিয়ার
নৈঋত ঢাকা ঘোলাজল কালোমেঘ
মরচের ত্রাসে ক্ষয়ে যাওয়া হাতিয়ার
তবুও পড়শী ঘুমায় নিরুদ্বেগ
মাকড়সাদের জীর্ণ বুননে ঝুলে থাকে ইহলোক
স্তনের বৃন্ত হারায় নি বৈভব
শিশ্নের ফণা এখনও চন্দ্রচুড়
আজও ঝড় ওঠে প্রতি রোমকূপ মূলে
শীৎকারে কাঁপে কামাখ্যা কামরূপ
তবু নিষ্ফলা চরের কিষাণী হয়না রজস্বলা
এভাবে ফুরোয় পারানির কানাকড়ি
ফুরোয় ভাঁড়ারে সময়ের সঞ্চয়
ক্ষয়ে আসে ক্রমে নোঙরের দড়াদড়ি
ধূলো গিলে খায় সবুজের বরাভয়
উইয়ের ঢিবিতে চাপা পড়ে থাকে তাবৎ পুণ্যশ্লোক
মাতৃগর্ভের দিকে
মহীবুল আজিজ
সমস্ত প্রশ্নের শুরু সেই আদি অন্তর-নিবাস থেকে,
কেন এ-আঁধার কেন কোলাহলে বন্দি নিঃসঙ্গতা!
সত্তার শেকড় থেকে উঠে আসা ডাক কাকে যায় ডেকে
মায়ের গর্ভের আদি ভঙ্গি তাই প্রশ্নসূচকতা।
কালে-কালোত্তরে বিশ্বের তাবৎ মাতৃভক্তকূল
সত্তার গহিনে ডুব দিয়েছিল গর্ভ ভালোবেসে।
গর্ভই উৎস জেনে প্রশ্নের আঁকশিতে ফোটায় গর্ভের ফুল,
মানুষও থেকেছে শ্যন-পাহারায় প্রশ্নকে ধরেছে ঠেসে।
প্রশ্ন আর কত থাকতে পারে খাড়া গর্ভের আদিম কায়দায়,
অন্তিমে তাকেও সোজা হয়ে যেতে হয় যতিচিহ্ন প্রায়।
প্রশ্ন অবাধ্যও হয়, ভিন্ন পথে ধায় অভিযাত্রায়,
স্বতন্ত্র রীতিতে গায় তারা যদিও কোরাসেই কণ্ঠ মেলায়।
কিছু প্রশ্ন আছে চিরকাল প্রশ্ন-চিহ্নের মতন ঘাড়-ত্যাড়া,
যতই শিকারী কুকুর লেলাও হবে না ইচ্ছের ভেড়া।
স্মৃতিপুরাণ
হোসাইন কবির
উপকূলে যাবো বলে আজো অবোধ বালক
জলজোছনায় বৃষ্টিদিনে তরী ভাসাই
পাখিহীন শিশুহীন প্রেমহীন সীমান্তরেখায়
কে যেন দাঁড়ালো মুখোমুখি
আততায়ী অবয়বে পল্লবিত ইস্পাত ছায়ায়, আর
অতঃপর জেনেছিÑ
মুখোশের আড়ালে লোহার শেকলে বাধা
সোনার ঘুঙুর নিয়ে পাশা খেলে যারা
তাদের নির্মম নিষ্ঠুরতা
মনে পড়ে–
ছাইচাপা আগুনে ফেলেছি যে পাÑ বালকবেলায়
কে কোথায়? দেখে যা বলেÑ
যে নারী বৃক্ষ হয়ে দিয়েছিল উষ্ণতা পুষ্পের ঘ্রাণ মহুয়ামাতাল
সেও আজ ধাবমান বায়ুস্রোতে স্মৃতির পুরাণে বড্ড অচেনা
ভস্ম জীবনের গান
রিজোয়ান মাহমুদ
অপেক্ষা কর না খুব ভোরে
যদি কোনোদিন পাখি হও
লতাগুল্মের আড়ালে রাখ
তোমার মধুমাস আর ছাও।
ভাঙনটা এখন আত্মার নাড়ু
উড়ে বালুকণা মরু ঝড় ঝুপঝাপ
তুমি সদাশিব এতটা ভাঙছ কেন
এ-সব তো জান তুমি, কার পাপ!
কাছে এলে পাহাড় দেখি
দূরে গেলে বালু
উল্টো করে সূর্য ওঠে
জীবন আলুথালু।
বেদনাগুলো বেদানা ফল
বুকে ঝরে গল গল
বুকে যার দু’রাকাত নফল
সে জাগে নিমিষে অনর্গল
কারে বলি,
পরমব্রত দাঁড়াবে কোন গলি!!
দাগ যদি
মেঘবাবু
সরে সরে যায়
ক্ষত তবে
বুকঢিল
বুকের পাড়ায়।
যদি হয় আবার কখনো দেখা
তোমার নাকের ঘাম নিয়ে লেখা হবে
একখানা ছিন্নপত্র লেখা।
বৃষ্টির ফোঁটা গর্ভবতী হলে
নিচে নামে
নাদুস-নুদুস বাচ্চা হলে
সারা পুকুর ও গ্রাম ঘামে!
আবলুশ কাঠের সকালে লুকনো
এক ভয়ার্ত শূন্যতা
তোমার গভীরে চোখের লবন জমা
বানায় হাবেলি করুণ রুক্ষতা।
কবির আকাশে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষীর ঝরে
তোমার দিনেরা সব ক্রাচের ভাঙা পা ‘
দিগন্তের বধির রোদেরা সব নষ্টকূপ
প্রসবিতা দেশটা খামচে তারেক-হনুফা।
সেই নিস্তব্ধ বিষণœ সন্ধ্যায়
মুজিব রাহমান
পঞ্চান্ন বছর আগে যেখানে জন্মেছিলে তুমি
সেখানে তোমাকে পৌঁছে না দিয়ে
তাদের উপায় ছিলো না, পিতা!
ধানম-ি থেকে টুঙ্গিপাড়া
টুঙ্গিপাড়া থেকে ভুবনগাঁয়ের সর্বত্র তোমার সম্মান
পিতা, তুমি বিশ্ববন্ধু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সত্তরটি বুলেটে তোমাকে বিদীর্ণ করে
তারা ভেবেছিল পথ খুঁজে পাবে
না, তারা তা পায়নি।
এক সময় তাবৎ বাংলাদেশ তাদের জন্যে
কবরের মত সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল
তারপর এলো তাদের পালিয়ে বেড়ানোর কাল
গনগনে আগুন-সূর্যের নিচে
আজও তারা কেবলই পালিয়ে বেড়ায়
পালিয়ে বেড়ায়
পালিয়ে বেড়ায়…
সময়ের বাধা ফুঁড়ে তোমার সমাধি আজ
সবার জন্যে উন্মুক্ত তীর্থ, পিতা।
তোমার সাতই মার্চকে তারা ভয় পেতো
তোমার জনপ্রিয়তাকে তারা ভয় পেতো
তোমার মৃত দেহকে তারা ভয় পেতো
তারা ভেবেছিল রাজধানীতে সমাধিস্থ করা হলে
অতি সহজেই এ কবর মানুষের ভালোবাসায়
শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে জনাকীর্ণ মাজারে পরিণত হবে
তাই তারা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে নিয়ে
সমাধিস্থ করেছে তোমাকে, পিতা।
আহা! তারা যদি সেদিন জানতো
এ-সমাধি দেশের চেয়েও বিশাল,
দেশের আত্মা ভর করে আছে যে দেহে
সে-দেহ অবিনশ্বর, তাকে হত্যা করা যায় না,
তাহলে কি সশস্ত্র সৈনিকেরা সেদিন নিরস্ত হতো!
সেই কালান্তক ভোরে বুলেটের মুখে প্রকম্পিত
ত্রস্ত সন্ত্রস্ত সরকার কবির উদ্দিন
কী খবর পড়েছিলেন!
ষোলোই আগস্টের শেষ বিকেলে
কী ঘটেছিল টুঙ্গিপাড়ায়!
কেমন হয়েছিল সৈনিকদের দশা!
ভীতু সৈনিকেরা দ্রুত নিশ্চিত করতে চেয়েছিল
পিতার দাফন। না পারেনি। সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
ভূমিপুত্রের পূর্ণ মর্যাদা সেদিনও তাদের দিতে হয়েছিল Ñ
সাবানে গোসলে কাপড়ে জানাজার নামাজে…
সব সম্পন্ন হলে পর
মা-বাবার কবরের পাশে
চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন পিতা
বুকে যার শ্যামল বাংলা বাঙালি স্বাধীনতা
স্থির হয়ে আছে রক্তদীপময় সূর্যের প্রত্যয়ে।
সেই নিস্তব্ধ বিষণœ সন্ধ্যায়
নিসর্গের অঝোর কান্না
বৃষ্টি হয়ে ঝরেছিল
রাজনীতির কবির
কবরের গায়
অজস্র সহস্র ধারায়…
অপর আঙুল
রেদওয়ান খান
সকাল-বিকেল কত যে নেমেছি নিচে
নিরেট দালান সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আর
মনে হয়েছিল সেই পাখি কার্নিশে
ডেকে ওঠে, আমি সম্মুখে আছি তার ।
সিঁড়ি ভেঙে নামি সিঁড়ি ভেঙে নামি নিচে
হাতে বাজারের পুরোনো চটের ব্যাগ
হঠাৎ সড়কে নিয়েছো আমার পিছে
চেয়ে দেখিÑ তুমি ! বুকে বড়ো উদ্বেগÑ
তিনতলা-সিঁড়ি নিষেধ তোমার ভাঙা
ভালো লেগেছিল এই লুকোচুরি খেলা ;
নিজের ছায়ায় মুগ্ধ সে-মাছরাঙাÑ
এইভাবে হাঁটি তুমি-আমি সারাবেলা ।
চুপে চুপে এসে ধরেছো আমার হাতÑ
আঙুলের ডগা যেন কচুরির ফুল
তুমি ঘুমে আমি কতো নির্ঘুম রাত
কাটিয়ে দিয়েছি বিলি কেটে কালো চুল ।
ভোরের আজান শেষ হলে জাগি শোকে
নগর-দুয়ার খোলা, দেখিÑকেউ নাই
আমার আঙুল ছেড়ে গেছো কই , লোকে
কানাঘুষা করেÑ ফিরবে না নীলগাই !
প্রতিবেদন
সীমা কুন্ডু
শান্ত বাতাসেও থিরথির কাঁপে সুপারীর ফুল
তার ঘ্রাণে মুছে যদি বিষাদের দাগ
বিচিত্র তীক্ষèস্বরে সুর সাধে ‘ভয়’
বুকের উপর শিশুর মতো ঘুমায় ‘আশা’
ঈগলের মতো ডানা খুলে টহল দিচ্ছে ‘সর্বনাশ’
এটা কী পাখি! আধোবোলে ডেকেই চলেছে
‘ঈগল পাখি ছোঁ মারে’
সুদূর মৃত্যুলোক থেকে ভেসে আসে শেষ ঢেউ
করুণ দু’হাত আগলে আছে প্রাণের সমুদ্রতট!
রুদ্রপলাশের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে কে বাঁশি বাজায়!
এত তীব্র ফুঁ! নুইয়ে পড়ি
নিঃসীম অন্ধকার পেরিয়ে কবে চোখ খুলবে বনপায়রা?
উড়ে যাবার পতপত শব্দে কাজল মাখবে বেদনাগামী চোখ।
কষ্ট
নূরুল হক
কষ্ট কাকে বলে
কেন রুক্ষতা গলে গলে
নামে দুঃখ। দুঃখ কাকে কয়
কাকে বলে শোক আর হতাশা
কখন নেমে আসে দুঃসময়…
অন্দরে পথে প্রান্তরে বনে নির্জনে
কিম্বা মানুষের সামুদ্রিক কোলাহলে
পূতিগন্ধময় জলে
পড়ে থাকে যে পথশিশু
আমি কী তার প্রতিকৃতি
কষ্ট কাকে বলে?
কাকে বলে পুরনো দুঃসহ স্মৃতি…
স্মৃতি কি কাঠ ঠোকরা পাখি
অসময়ে রক্তাক্ত করে যায়
আমায়
চঞ্চু ঠোকে বারবার বারবার
নেমে আসে অযাচিত অন্ধকার
কিছুই থাকেনা আর বলা না বলার
কষ্টগুলো থাকুক শুধুই আমার…
পাতাসংসার
আকতার হোসাইন
প্রিয়জন হেরে গেলে নিজেকেই পরাজিত ভাবি
নিজেকে হারিয়ে দিয়ে তার সুখে সুখনিদ্রা যাই
আমাদের আজকাল মনোময় হারজিত খেলা
এইভাবে ভেসে যায় জেনে-বুঝে জীবনের নিরুদ্দেশ ভেলা।
বাসা বোনা শেষে
খাবারের খোঁজে যায় পরিশ্রান্ত পাখিদম্পতি
বৃক্ষেরও খুশিভাব, কতোদিন একা থাকা যায়,
পাতাসংসারে!
পাতানো খেলায় মেতে দিনকাল মোটামুটি কাটে
উনুনের আঁচে সে-ও দিনদিন রাঙা হয়ে ওঠে
বয়স বাড়ে না কমে, আয়নায় ঘুরেফিরে দেখে
মন্দ কী, ভালো বাসা,গামলায় নিশিপদ্ম
নিরাপদ ভালোবাসা খেলা।
ছেঁড়া চিঠি গিলে খায় আগুনের উলসিত শিখা
আই-ফোন হাতে এলে পুরনো সেটের সাথে ভেঙে পড়ে
চুম্বনের শিহরিত দিন , ঝরাপাতা, মরা ফুল
আলিঙ্গন, উদ্দাম মিলনের স্মৃতি,
ঈষৎ শ্বেতাভ চুল, ঢেকে যায় গার্নিয়ার-রঙে।
মুখে হাসি, সুখিভাব, জমা হয় সংসারখেলা
বিগত রঙের দিন আজকাল সঙ মনে হয়
কখন উড়াল দেবে, পাখি ভাবে, সজীব পাতায়
বুনবে নতুন বাসা, বুকে বহে বাউরিবাতাস।
পারা
রফিক আনম
যাদের বিবেক শূন্য হায়েনা স্বভাব
তাদের মন যা চায় করে যায় মর্ত্যে
সুরের কোকিল মারে কর্কশ অসুর
কাঁটামুক্ত রাখে পথ পুষ্পবন পিষে
স্বার্থের আঁচলে প্যাঁচে ফসলের কণ্ঠ
গাছ কাটে নদী রুখে প্রতিদ্বন্দ্বী রোধে
গিলে গিলে দেশ খায় ঠেলে রেখে ধর্ম
কতকিছু তারা পারে আমি ত পারি না
আমি পারি ফুল দিতে শহিদ মিনারে
স্মৃতিসৌধ ভালোবেসে বুকে নিতে পারি
আমার পারায় নেই স্বার্থের সংশ্লেষ
আমার আমিরে আমি বলি দিতে পারি
আমাকে উচ্ছেদ করে খেতে এলে লুটে
এ মাটি কামড়ে ধরে থেকে যেতে পারি
শক্তিহীন মাছের মত জীবন
মজুমদার শাহীন
ন্যুজ্ব হয়ে যাচ্ছে শরীর, ক্রমাগত হাড়ের মধ্যে
টের পাচ্ছি বার্ধক্যের কিট।
চোখের সীমার ভিতরে ঝাপসা আলো – আধারী,
কালো থেকে সাদা হয়ে গেছে লোমের আণন।
রক্তকনায় জমে আছে জীবানু রাত,
ঘুমের চারপাশে ঘুরে সময়ের ঘড়ি।
কখন জানি থেমে যাবে ঘড়ির কাটা?
কচুপাতা থেকে ঝড়ে পড়া জলের মত
ক্ষয়ে গেছে ছেলেবেলা, ক্ষয়ে গেছে
সোনালি দিন, মাল্টিকালার স্বপ্ন।
প্রেমিকার তিলের সুগন্ধ কোথায় হারিয়ে গেছে?
চন্দ্রালোকিত রাতে বুকের স্পন্দন থেকে জাগেনা কৃষ্ণচূড়া।
একটা অসীম শুন্যতায় জমে থাকে বয়সের ঘাম।
আর কতদিন যাবো?
কতদিন নেবো জলজ শ্যাওলার সুখ!
মাটির ঘুম থেকে চিনে নেবো জীবন!
নিমগ্ন হয়ে মিশে যাবো নিরাকার আত্মার কাছে।
পেকাথাও ছিলো না কেউ, থাকে না কখনো।
মায়ের বুকের সুখ থেকে – বাবার প্রশান্তি থেকে
বিদায়ের ঘন্টা ধ্বনি বেজে গেছে কবে,
এখন এক মৃত প্রায় নদী, বর্ষাহীন বৃষ্টিহীন একাকী।
শক্তিহীন মাছের মত জীবন; অসীম স্রোতে ভেসে থাকা।
উত্থান
সুফিয়া শীলা
জলপ্রপাতের স্রোত নিয়ে সূর্য ডোবে
দুচোখের আগুন কোণে,
বুনো রাজহাঁস বসে থাকে চুপচাপ অন্ধকার ভাঁজে;
স্তব্ধতায় জীবনের কোলাহল মিশে যায়
বিকলাঙ্গ সময়ের দেহে,
অবসন্ন মুমূর্ষু মায়িক প্রেম কাঁদে অনাদরে।
মধ্য রাতের হুইসেল খামচে ধরে নিশিত নিশ্বাস,
হৃদয় পোড়ার দগদগে চিত্রপট অপ্রকাশ্যেই
করে হাহাকার;
উদ্বেল শ্রাবণ খুঁজে ফেরে তার চেনা গতিপথ,
আপন দেহের তট
ফেলে আসে মেহগনি কাঠের বারান্দা;
ঘাসফুল জীবন।
অহর্ণিশ ঝুলে আছে
খড়কুটোর ভেলায় পক্ষাঘাত জঠরে,
কালের দাড়টানা ক্ষত
গড়েছে শিকড় যাযাবর আত্মা-মাঝে;
হারিয়েছে নদী গতিপথ তার,
বিবর্ণ সবুজ পাড়;
তবুও যে জাগে চর ¤্রয়িমান টানে,
বিষণœ সকালে ভাঙে ঘুম শিশিরের আলো ছেনে।
বিধ্বস্ত নীলিমা
শফিউল আজম মাহফুজ
আহারে স্বদেশ আমার-
কলমির বন নেই আর, আছে ঝাউবন
তাও বুকের মাঝখান দিয়ে পাথুরে সড়ক
ইলেকট্রিক ব্যাটে মশকির সশব্দ মড়ক।
লোহার উপর বউ-পেটানোর ভঙ্গিমায় হাতুড়ি চালাচ্ছে বেধড়ক।
উদ্ধত স্তন তবু, স্তনে স্তনে পর-পুরুষের দাঁত
দেশের শরীর ভুলে যায় সমস্ত আঘাত
রাতে চর্বি, দিনে-দুপুরেও তাই, এ শহর ভুলে গেছে হা-ভাত।
আকাশেও ফাটল ধরেছে, ডাকতো নীলিমা এককালের কবিরা
মাথার উপর নীলিমা নেই আর, রাতের সড়কেই শুধু
ঘুরে-ফিরে সহস্র নীলিমারা।
বিশ্বলয়ে বঙ্গবন্ধু
জহির সিদ্দিকী
স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে
বীরত্বে রেখেছে বাঙালির মান,
হৃদয়ে প্রাণে অমর তাই
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ছয়দফা থেকে স্বাধীনতার জয়গানে
নির্ভীক চিত্তে দিয়েছে শ্লোগান,
বজ্রকন্ঠে দিয়েছে ঐক্যের ডাক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বচ্ছতা থেকে ন্যায়ের আহবানে
থেকেছে অটুট রেখেছে মান,
বঞ্চিত, অসহায়ের হয়েছে সহায়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অধিকার থেকে প্রাধিকার পেতে
গৌরবে তুলেছে বিজয় নিশান,
তাইতো তিনি স্বাধীনতার স্থপতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দাসত্ব থেকে স্বাধীনতা পেয়ে
দূর করেছে যত অপমান ,
তাইতো বিশ্বলয়ে একটি নাম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কুঁড়িতেই ঝরে শেষ
জেসমিন সুলতানা চৌধুরী
আমি কী আর ফুটতে পারি শতদলের মতো
শত পাপড়ি মেলে ধরে আকাশমুখো রতো
আমি কী আর ছুটতে পারি শ্বেত বলাকার দলে
মলা, পুঁটি লুকায় কোথায় দেখতে পারার ছলে
আমি কী আর নাইতে পারি হাঁসের ছানা হয়ে
ডানা ঝাপটে ছুটোছুটি ক্ষুদিপানায় বয়ে
উড়তে পারি পাখা ওয়ালা গাংচিলেরেই খোঁজে
থাকতে পারি ঘোর নির্জনে একলা একা গোজে
মুক্ত বিহঙ্গ পাখির মতো নীল আকাশে উড়ে
হাওয়ার তালে নাটাই বিহীন ঘুড়ি হয়ে ঘুরে
চোখ ধাঁধানো বুনো ফুলের সুবাস মাখাই বাটে
মাঝি ছাড়াই ভাসাই তরী নোঙর ফেলি ঘাটে
তবে কেন নিংড়ে দিলো কলি ফোটার আগে ?
মারলো বিষে দললো পিষে হিংসা দ্বেষ আর রাগে
শোর তোলেনি, ঝড় ওঠেনি, ছিল না শোক পালন
বিশ্বজুড়ে নীরবতা দেখল সে আস্ফালন !
কেউ নামেনি প্রতিবাদে ব্যস্ত সড়ক ধরে
দিনগুলো সেই হয়তো কারো আজো মনে পড়ে
সকলেরই ঘুমের ঘোরে বছর ঘুরে একদিন
স্বপ্ন হয়ে দিই ধরা তাই শোধ করে দাও ঋণ
হাসু আপার কর্ম মেলায় প্রাণহীন এক ফুলে
যাও নেচে যাও বৈঠা বেয়ে ভরা নদীর কূলে !
ইরাবতী’র চুপকথা
ইসরাত জাহান ডেইজী
হৃদয়ের তোলপাড় থামেনি আজও!
বারেক চেয়ে চেয়ে,
কী গান গেয়ে গেলে,
শেষ বিদায়ের ক্ষণে……
খুব জানতে ইচ্ছে করে!
গভীর নিশীথে বৈরী বাতাসে ভেসে আসে…..
সোহাগলোভে বেহাগের কান্না।
সে কী আমারই বুকভাঙ্গা আর্তনাদ!
কেগো তুমি দূরের সাথী……
সেধে সেধে কেঁদে কেঁদে ভাঙ্গো আমার বুক?
সময় খেয়ে নেওয়া জীবন আমার,
অথৈ শূন্যতার মাঝে করি বসবাস।
নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে,
পৃথিবীর এক কোণে এসে দাঁড়িয়েছি।
বেঁচে আছি ,না মরে গেছি বুঝতে পারিনা আজকাল!
শূন্যতায় ভরা হোক আমার ভুবন,
হয়তো তুমি কখনও চাওনি এমন!
তবু বড্ড অবেলায় শূন্য চিরকুটে ছেড়ে গেলে আমায়!
সেই থেকে থমকে গেছে জীবন আমার…..
না বলা এক গল্পের পাতায়,
ইরাবতী’র চুপকথায়!!
জলের গহীন
আলী আকবর বাবুল
নীল পূর্ণিমা চাঁদের বুকে
মধ্য রজনীর আবরণ
যেন উদার বাহুর অমর আকুলতা নিয়ে
রুপালী স্রোতকে কাছে টানছে ভীষম আদরে।
তীরভাঙা ঢেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে
সবুজ সাগরের যৌবন পানে;
পৃথিবীর উজ্জ্বল তারুণ্যে গিয়ে মিশেছে
আটপৌরে লাবণ্যের মত রংধনু সাতরঙে।
সৈকতের তনুতে প্রেমের বিহ্বলতা হেসে
উঠে ঢেউয়ের কল্লোলে-
দীর্ঘ অশান্ত স্রোতে নির্মলতা উদ্ভাসিত হয়
আবেগ কম্পিত কলতানের চম্বুনে।
মৃদুতরঙ্গ সীমান্তে পৌঁছে যায় মদ্রিত উত্তাল
পার হয়ে যায় উদ্দাম আনন্দে
এবং আহরণ করে মুক্তোদানা,
সুখে প্রসারিত হয় সাগরের বুক।
অজস্র তিমিরময় রাতের হাহাকারে
আবিষ্কার হয় –
জলের গহীনে লুকিয়ে থাকা অমূল্য রতন।
শারদ ভাবনা
টিপলু বড়ুয়া
তখন…
আকাশে সাদা মেঘ দেখে
তুমি ভাবতে, শরৎ এসেছে-
আমি তো শরৎ দেখেছি তোমার হাসিতে
আমি তো শরৎ দেখেছি তোমার দাঁতের ফালিতে।
দূর মাঠের ঐ কাশবন দেখে
তুমি ভাবতে, শরৎ এসেছে-
আমি তো শরৎ দেখেছি তোমার এলোমেলো চুলে,
আমি তো শরৎ দেখেছি তোমার কুচকানো কপালে।
শিউলিতলায় সাদা ফুল দেখে
তুমি ভাবতে, শরৎ এসেছে-
আমি তো শরৎ দেখেছি তোমার দেহের ছন্দে
আমি তো শরৎ পেয়েছি তোমার ঘামের গন্ধে।
এখন…
তুমিহীনা শরৎ যায় আর আসে
তোমার হাসি, এলোমেলো চুল
এখনো আমার চোখে ভাসে।
যাপিত কারফিউ
রহমান মিজান
নৈঃশব্দ্যের রাতে রক্তাক্ত মগজের যাপিত কারফিউ শিথিল,
অনুরাগের শর্তে দায়েমি ক্ষণে পেয়েছিলে প্রবেশাধিকার।
অথচ তৃপ্তি লোভে কত সহস্র বার বিচরণ করেছো ভাবনা,
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া আয়নার বুকে।
বেমানান সুখের এ্যালকোহেল ছুঁয়েছি ,
ফিরতি পথে চেনা আগন্তুকের অবলোকনে
ঠোঁট জুড়ে মাতাল হাসি।
নিষিদ্ধের কাঠগড়ায় মুখোমুখি সহ¯্রবার স্বয়ং প্রেমাশ্বর,
ছুড়েঁ ফেলতে চেয়েছিলে কুঞ্জের কিতাব।
চুম্বনের চুমুকে ছুঁয়েছি ঠোঁট নিরদ্বিধায়,
অনিয়ন্ত্রিত চুম্বনে আঁকড়ে আছো তুমি নিয়ন্ত্রিত ঠোঁটে বলি
জন্ম জন্মান্তর ভালোবাসি তোমায়।
উঠোনে নেমেছে শরৎ
নুরুল ইসলাম বাবুল
শালুক-শালুক গন্ধ মাখানো দিনে
নোঙর তুলেছে ধবল মেঘের যাত্রী,
বুকের ভেতর পাখা ঝাপটায় কী যে
শরৎ এনেছে অপরূপ দিনরাত্রি।
এই শরতের পুরো কাশবন তুলে
শুভ্র বিছানা পেতেছি উঠোন জুড়ে,
রেখেছি আমার সকল দুয়ার খুলে
কেননা শরৎ এসেছে আবার ঘুরে।
শরৎ এলেই তুমুল স্বপ্ন রাখি-
দেখব তোমাকে আবার নতুন করে,
মনের ভেতর ডাক দিয়ে যায় পাখি
সেই পাখিটাই পাখা ঝাপটায় ভোরে।
দুয়ারে দুপুর দাঁড়ায় যখন এসে
পাড়ায় পাড়ায় গানের বালিকা নাচে,
আমরা তখন আকাশে বাতাসে ভেসে
প্রার্থনা করি শরৎ মেয়ের কাছে।
এই শরতেও বিগত দিনের মতো
সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা আসুক রোজ,
ঘরে ঘরে থাক ভালোবাসা অবিরত
যেখানে হৃদয় পায় শান্তির খোঁজ।
দিনে দিনে খাটো হয় মানুষ
দুখাই মুহাম্মাদ
ভালোবাসা কমে যায়
সংশয় ঢুকে পড়ে সহজে
প্রেম বেড়ে যায়
গিলে নেয় অস্তিত্ব; সহজের মতো সহজে,
বাহিরের মতো ঘরেও উঠে ঝড়
সংকোচে-সংকোচে ছোট হয় পৃথিবীর বহর।
ক্রমাগত ছোট হয় মানুষ; একেবারে ছোট!
বেড়ে যায় পুঁজিবাদী উত্তাপ
আগ্রাসী বলয়ের ঢেউ।
প্রেম সিঁড়ি
সাগর আহমেদ
আমি বলি সুন্দর
ফুটে ওঠো তুমি
নীল রঙে এঁকে যাও পুরোটা আকাশ,
উর্বর মৃত্তিকা জাগে
পাললিক সোমগন্ধে
লাঙলের ফলায় চিরে করি প্রেম চাষ।
রাত্রি ফুরিয়ে গেলে বীজপত্র ডানা মেলে,
নতুন সকালে আজ জন্মান্তর জাগে কৌতুহলে।
শোক পাহাড়
মোহামেদ সাইফুল হাসান রাকিব
শোকের সুউচ্চ পাহাড় তৈরি হবে একদিন
শাঙনের বানের জলে ভাসবে দুটি চোখ,
মাটি চাপায় মৃত্যু হবে সমস্ত সুখ,সমস্ত হাসি!
আশ্রয় খুঁজতে অনিচ্ছুক নিরুদ্দেশ বাউন্ডুলে মন,
বাঁধ ভাঙা পাকা ঘরও যে বিলীন হয় নদী গর্ভে,
কিংবা দীর্ঘ ছাদ ভেঙে পড়ে মুমূর্ষু মস্তিষ্কে.!
বিশ্বাস সে তো অকস্মাৎ নভেম্বর রেইনের খানিকটা সময়,
তারপর শৈত্যের চাদরে আবারও জবুথবু হয়ে যায়!