অনুবাদ : খান মোহাম্মদ ফারাবী
(মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে যশোর রোডের শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে দেখেছিলেন বিট প্রজন্মের খ্যাতিমান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে তিনি লিখলেন অনন্য এক কবিতা- সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়া মাত্রই বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন গড়ে ওঠে। আন্দরকিল্লা’র নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য এই সেপ্টেম্বর মাসেই কবিতাটি পুন:প্রকাশ করা হলো। -সম্পাদক)
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদর স্ফীত, বিস্ফারিত চোখের ধার
যশোর রোডেÑবিষ সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।
লক্ষ পিতা ভিজছে হিমেল বৃষ্টিতে
লক্ষ মাতা দুঃখ দেখে দৃষ্টিতে
লক্ষ ভাইয়ের হৃদয় শুধু যন্ত্রণা
লক্ষ বোনের নেইকো ঘরের সান্ত¡না।
লক্ষ মাসি ভাতের জন্য যায় মরে
লক্ষ মাতুল মাতাল হয়ে শোক করে
লক্ষ পিতামহের গৃহ চূর্ণপ্রায়
পিতামহী হচ্ছে পাগল নিঃসহায়।
হাঁটছে পাকে লক্ষ পিতার কন্যারা
অবোধ শিশু ভাসিয়ে নিল বন্যারা
লক্ষ মেয়ে করছে বমন আর্তনাদ
লক্ষ পরিবারের আশা চূর্ণ সাধ।
লক্ষ প্রাণের উনিশ শত একাত্তর
উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর
সূর্য জ্বলে ধূসর রঙে মৃতপ্রায়
হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়।
সিক্ত মিছিল হাঁটছে মানুষ নিঃসহায়
ত্রস্ত ভীত ক্ষুব্ধ বালক থমকে চায়
স্তব্ধ আঁখি শীর্ণদেহ অস্থিসার
মানববেশ এ ক্ষুধার্ত সব ফেরেশতার।
কাঁদছে মাতা উঁচিয়ে আঙুল ঐ দেখায়
দাঁড়িয়ে আছে সন্ন্যাসিনীর মতোই প্রায়
সন্তানেরা শীর্ণপদে প্রার্থনায়
পাঁচটি মাসের অন্নবিহীন যন্ত্রণায়।
দুইটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষছায়
নীরব চোখে আমায় শুধু দেখেই যায়
অন্ন জোটে সপ্তাহেতে একটিবার
দুধের গুঁড়ো ক্লান্ত শিশু চায় না আর!
সবজিবিহীন অন্ন খেয়েই কাটছে দিন
সপ্তাহেতে তিনটি দিনই অন্নহীন
দুধের ছেলে করছে উপোস মৃতপ্রায়
যা কিছু খায় করছে বমি যন্ত্রণায়।
সামনে আমার কাঁদছিল মা অন্ন চাই,
বাংলা ভাষায় ডাক দিল কে ‘শুনুন ভাই’
পরিচয়ের পত্র ছেঁড়া মাটির গায়
ক্যাম্প অফিসের দ্বারে স্বামী দাঁড়িয়ে ঠায়।
খেলছে শিশু বানের পানি চারটি ধার
শেষ হয়েছে দেবে না আজ খাদ্য আর
আমার ব্যাগে পয়সাÑএ কি আমার পাপ
শিশুর চোখে দেখছি মোদের মৃত্যুশাপ।
হাজার বালক লাইন দিয়েছে একটি ধার
খাদ্য দেবে প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে তার
হল্লা কিছু করছে ছেলে নিরন্তর
উঁচিয়ে লাঠি ছুটছে পুলিশ ক্রুব্ধস্বর।
এমনি করে দাঁড়িয়ে এ কোন শিশুর দল
হল্লা করে দিচ্ছে কিউ ঝড়বাদল
মাথায় নিয়ে কান্নাহাসির মাঝখানে
খাদ্য কেন হচ্ছে দেওয়া এইখানে।
অফিস থেকে বেরিয়ে এল একটি লোক
হাজার বালক দেখল চেয়ে কী উৎসুক
প্রার্থনা এ? ‘আজ আর কোন খাদ্য নাই’
হল্লা করে হাজার ছেলে লক্ষ ভাই।
ছুটল সবাই তাঁবুর ঘরে প্রতীক্ষায়
বসেই আছেন মাতা-পিতা একটি ঠায়
কঠিন খবর ছুড়ল ছেলেÑখাদ্য শেষ
রুগ্ন শিশু চমকে উঠে জীর্ণ বেশ।
মাতার কোলে নবজাতক শিশুর শব
অদ্ভুত সব রোগে এখন ভুগছে সব
দুঃখ-শোকের মদ গিলে আজ সব মাতাল
শরণার্থী শিবিরটাই তো হাসপাতাল।
সীমান্তে আজ বানের পানি তা থৈ থৈ
সব ডুবেছে, খাদ্য দেবে পথটা কৈ?
মার্কিন সব দেবতারা কোথায় আজ?
বিমান থেকে শিশুর গায়ে ছুড়ছে বাজ?
রাষ্ট্রপতি, কোথায় তোমার সৈন্যদল?
বিমানবহর নৌবাহিনী অর্থবল?
তারা কি আজ খাদ্য ওষুধ আনতে চায়?
ফেলছে বোমা ভিয়েতনামে নিঃসহায়?